Tumgik
manayeem · 3 years
Text
সায়েন্স ফিকশন
ভাইরাস তৃতীয় অধ্যায়
২১| হঠাৎই পাশের ঘরে হুলস্থূল কান্ড শুরু হয়ে গেছে। ঘরের ভেতরের জিনিসপত্র কেউ উল্টে ফেলছে। দরজা জানালায় কিছু দিয়ে সজোরে আঘাত করছে। তারপরই এক ধরনের আর্তনাদের মতো শব্দ করে ঘর ফাটাচ্ছে। এরপর কিছু সময় চুপচাপ থেকে আবার এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
এক হাতে ছোট্টু অন্য হাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে খাটের উপর বসে আছে শামসু। সামনে হারিকেনের বাতিটি নিভিয়ে রাখা হয়েছে। সবাই মনে মনে দোয়া দরুদ পড়ে চলছে। যেন অনস্তকাল ধরে কোন এক নরকের ভেতর বসে আছে তারা।
সামসুর স্ত্রীর চোখ গড়িয়ে অনবরত পানি ঝরে পড়ছে। একটু পর পর সে ফুপিয়ে উঠছে। এক হাতে তার মুখ চেপে ধরে রেখেছে সামসু।
হাসেম চাচা মরেনি অথবা মরে গেলেও পুনরায় কোন ভাবে জেগে উঠেছে। ঠিক কোন জিন্দা লাশের মতো! যেভাবে তার বাজান জিন্দা লাশে পরিণত হয়েছিল। আর কিছুই ভাবতে পারছে না ছোট্টু। তার চোখের জলও এখন যেন শুকিয়ে এসেছে। অনেকটা পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে চোখ দুটি।
সারাদিন মা ভাইদের কোন খোঁজখবর নেই। বেঁচে আছে কিনা তাও জানা নেই। মিলিটারি চাচাও আর ফিরে আসলো না। সবকিছুই যেন হঠাৎ করেই উলটপালট হয়ে গেছে। পুরো পৃথিবী ওলট-পালট হয়ে গেছে।
এত সুন্দর সাজানো গোছানো পৃথিবী, যেখানে তার বাবা প্রতিদিন তার জন্য গঞ্জ থেকে হাতে করে একটা খেলনা বা এক ঠোঙা মজা নিয়ে আসত। তারা সেগুলি নিয়ে কাড়াকাড়ি জুড়ে দিতো। কালু সবার ভাগেরটা খেয়ে ফেলতো।
কালুর কথাটি ভাবতেই বুকটা যেন আরো ভারী হয়ে আসলো ছট্টুর। তারা মাঠে ফুটবল খেলতে যেত। নারকেলের পাতা দিয়ে বানানো ফুটবল। কালু সেটা দিয়ে খেলতে চাইতো না। বাজানের কাছে কতবার তারা প্লাস্টিকের ফুটবলের জন্য আবদার করতে গেছে। পারেনি। সেই আবদার আর করা হয়ে ওঠেনি। আর কোনদিন সেটা হবেও না। যার কাছে করার কথা ছিল সেই মানুষটিই আর নেই। নেই তার সেই রগচটা ভাইটিও।
এ কেমন এক পৃথিবী! ছন্দছাড়া, স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, বীভৎস। আলোহীন, অন্ধকারময় এক দুনিয়া। এখানে যেন সূর্য থেকেও নেই। অন্ধকার কাটাতে চাঁদের আলো যেন আরো ভয়াবহ এক বিভীষিকা। এই চাদের আলোয় সৌন্দর্য নেই। শুধু আছে ভয়, আতঙ্ক, দুঃস্বপ্ন। এই আলো কারো মনে প্রশান্তি এনে দেয় না, অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে। এই আলোয় স্নান করতে বেরিয়ে পড়ে পিশাচ নরখাদকেরা। এ যেন এক অভিশাপ্ত জগৎ।  
দৈত্যদানো ভূত-প্রেতের গল্প কাহিনি ছোটবেলা থেকেই অনেক শুনেছে ছট্টু, তার মায়ের কাছে এসব কাহিনির ভান্ডার ছিল। কিন্তু বাস্তব এই পৃথিবী যে কোন একদিন তার থেকেও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে নেবে সেটি বোধহয় তার মায়েরও জানা ছিল না। তার ঝুলিতে যে এরকম কোন গল্প ছিল না!
বিভীষিকাময় এই বাস্তবতা হার মানিয়ে গেছে সব কল্পনাকে। এখানে জ্বীন-ভূতের ভয় নেই, ভয় নিজের আপন মানুষগুলিকে। ভয় তাদের কখন জিন্দালাশ হিসেবে দেখতে হয় সেটি নিয়ে। ভয় তাদের সাথে প্রান বাচাতে কখন যুদ্ধ করতে হয়! তার চেয়েও ভয়ের বিষয়, নিজেকেও না কখন এই একই রকম কিছু একটায় রূপান্তরিত হতে হয়। এ যে কোন সাধারণ মৃত্যু নয়, মৃত্যুর চেয়েও হাজার গুণ ভয়ংকর একটা কিছু।
অনেক কিছু মনে মনে ভেবে চলছিল ছট্টু। হঠাৎ করেই হাসেমের ঘর থেকে দরজা ভাঙার বিকট শব্দ  তাদের কানে ভেসে এলো। ঘরের ভেতর থেকে কারো  অনবরত আঘাতে হুরমুর করে কাঠের দুর্বল দরজাটি ভেঙে পরেছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে উঠোনের আশেপাশে কেউ একজন পায়চারি করতে শুরু করেছে।
সামসু দ্রুত পায়ে বিছানা থেকে উঠে ঘরের জানালাগুলি আরো একবার পরীক্ষা করতে শুরু করল।
মা! ও মা! কই গো তুমি! বাইরে কেউ একজন বিকৃত কন্ঠে টেনে টেনে কথাগুলি পুনরাবৃত্তি করে চলছিল। যেন অনর্গল এক ধরনের প্রলাপ বকছে। তারপরই অস্থিরতা করতে করতে বাড়ীর এপাশটায় ওপাশটায় ছুটে বেড়াতে লাগলো সেই কন্ঠের মালিক। যেন কেউ একজনকে হন্যে হয়ে খুজে বেড়াচ্ছে।
চারিপাশের নীরবতা ছাপিয়ে উঠোনের উপর তার খালি পায়ের ধুপ ধাপ শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
এবার যেন জড়ানো ভারী কণ্ঠস্বরটি ধীরে ধীরে এক ধরনের গোঙ্গানিতে রূপান্তরিত হতে লাগলো।
ছোট্টু বিছানা থেকে উঠে গিয়ে শক্ত করে দরজার খিলটি আঁকড়ে ধরল। সামসুর ঘরের দরজার খিলটি একটু দুর্বল। দরজাটি আটকানোর মতো আর কোন ধরনের ব্যবস্থা সেটির উপরে নিচে নেই।
এবার সামসু তার ঘরের কাঠের আলমারিটি কাধ দিয়ে সজোরে ঠেলতে শুরু করলো। তাকে দেখে তার স্ত্রী সাহায্য করার জন্য উঠে গেল। ধীরে ধীরে দুজনে মিলে নিঃশব্দে আলমারিটি ঠেলে দরজার সামনে নিয়ে আসলো। দরজার উপর সেটি হেলান দিয়ে রাখার সময় খট করে একটি শব্দ হল।
হঠাৎ করেই যেন বাইরে ছোটাছুটি থেমে গেল। কেউ একজন ব্যাপারটি খেয়াল করেছে।
পরক্ষনেই সেটি দরজার উপর সজোরে একটি আঘাত করে বসল।
পর পর আরও কয়েকটি আঘাতে দরজাটি প্রায় কেঁপে কেঁপে উঠলো। ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। সামসু, ছোট্টু সবাই মিলে আলমারিটি ঠেলে ধরে রেখেছে। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দরজাটি বাঁচানোর চেষ্টা করে চলছে।
উপর্যুপরি কয়েকটি আঘাতের পর হটাৎই যেন জিনিসটি একটু বিরাম দিল। উঠোনের এক কোনে গিয়ে আবার বোবাকান্না জুড়ে দিল।
ধীরে ধীরে কান্নার শব্দ মিলিয়ে সেখানে এক ধরনের গোঙ্গানির মত গরগর শব্দ তৈরি হতে শুরু করল।
.
রফিক চাচার উঠোনে ভুতুড়ে কিছু একটা চলাফেরা করে বেড়াচ্ছে। উপরে চাদের আধো আলোয় বেড়ার ফাঁক গলিয়ে সেটি সে দেখতে পাচ্ছে। একটি ছায়া তড়িৎ গতিতে উঠোনের এপাশে চলে যাচ্ছে, আবার দৌড়ে ওপাশটায় চলে যাচ্ছে।
রফিক চাচা মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়ছে। তার স্ত্রী খাটের এক পাশে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।
অনবরত অস্থিরভাবে পায়চারি করা ছায়াটি হঠাৎ করেই উঠোনের ঠিক মাঝখানটায় এসে দাড়িয়ে পড়ছে, মুখ দিয়ে এক ধরনের গরগর শব্দ করে চলছে। প্রায় বেশ কিছুক্ষণ এক জায়গায় স্থির মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে তারপর আবার সেটি অস্থির পায়চারি করতে শুরু করেছে।
ভুতপ্রেত জীবনে দেখার অভিজ্ঞতা তার নেই তা নয় কিন্তু আজকে যা দেখতে পেল তা পেছনের সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। রাফিক চাচা টের পাচ্ছে তার বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটি লাফাচ্ছে। তার শরীর কেপে কেপে উঠছে। দৃশ্যটি যেন আর সহ্য করতে পারছে না সে। এবার দ্রুত বিছানার উপর এসে বসে পড়ল সে। তার স্ত্রী ছুটে তার কাছে গিয়ে তাকে পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগলো। তারপর কলসি থেকে তাকে এক গ্লাস পানি এনে দিল। রফিক চাচার কপাল থেকে দরদর করে ঘাম বেয়ে পরছিল।
খাটের উপর রাখা হারিকেনের ফিতাটি টিমটিমে এক ধরনের হলদে আলো তৈরি করেছে। রফিক চাচা আলোটি নিভাতে দেয়নি। তার বিশ্বাস আগুন আশেপাশে থাকলে ভুত-প্রেত জাতীয় কিছু সামনে আসতে পারে না।
কিছুক্ষণ পরে তার স্ত্রী ছোট ছোট পায়ে বেড়ার ফুটোটির দিকে এগিয়ে গেল। সাহস করে চোখ রাখতেই বেড়ার ফাঁক গলিয়ে যা দেখতে পেল তাতে যারপরনাই অবাক হল সে। অদ্ভুত একটি ছায়া মাটিতে বসে হামাগুড়ি দিচ্ছে। তারপর গড়িয়ে গড়িয়ে উঠোনের এক কোনায় চলে গেছে। এবার একনাগাড়ে হাত দুটি দিয়ে সামনের মাটি খুঁড়তে শুরু করেছে।
.
অনেকক্ষণ কোন সাড়াশব্দ ছিলনা উঠোনে। তারপর হঠাৎ করেই ঘরের পেছনটায় এক ধরনের শব্দ শুনে সেদিকে ছুটে গেল সামসু। তার পেছন পেছন গেল ছোট্টু ও তার স্ত্রী।
কেউ একজন বেড়ার ওপাশ থেকে মাটি খোঁড়ার চেষ্টা করে চলছে। সামসু দ্রুত মাটিতে বসে পড়ে বেড়ায় কান পেতে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলো। কোন কুকুর বিড়াল নয় সেটি। মানুষ জাতীয় কিছু একটা বসে রয়েছে বাইরে। অনবরত মাটি খুঁড়ে চলছে। ইতিমধ্যেই ছোটখাটো একটা গর্ত তৈরি হয়ে গেছে সেখানে। আবছা চাদের আলোয় কাদামাখা দুটি হাত দেখা যাচ্ছে!
এভাবে খুড়তে থাকলে তো সেটি খুব শীঘ্রই এই গর্ত দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়বে! (চলবে)
২২| হাশেমের বিকৃত মুখখানা গর্ত দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। রক্তমাখা, দাঁত কিড়মিড় করা সেই মুখটি দেখে সামসু যেন সাক্ষাৎ মূর্তি বনে গেছে। এতদিনের একসাথে ওঠাবসা করে আসা মানুষটিকে এইরূপে দেখতে হবে সেটা কোনদিন কল্পনাও করেনি সে। এইতো কয়েক সপ্তাহ আগেও তারা টং দোকানে বসে সন্ধার আলাপ জমিয়েছে। নতুন সিনেমা নতুন নায়িকা নিয়ে আড্ডা দিয়েছে। আর আজকে তার এই রূপ! সময় কত দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যায়, বিকৃত হয়ে যায়! গর্ত দিয়ে হাসেমের শরীরের অর্ধেকটা প্রায় ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। হাত দুটি সামনে বাড়িয়ে সবকিছু ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। সামসু বুঝতে পারছে ধীরে ধীরে হাসেম ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। তাকে আটকাতে হলে যা কিছু করার খুব দ্রুতই করতে হবে। কিন্তু সামসুর হাত দুটি যেন বাধা! পা দুটি এক চুলও নড়ছে না। তার প্রিয় বন্ধুটিকে কিভাবে থামাবে সে? হাসু! জোরে চিৎকার করে উঠল সামসু। যেন হাশেমের কাছ থেকে কোন উত্তর আশা করছে। হাসেম কোন উত্তর দিল না। শুধু মুখ দিয়ে পশুর মত এক ধরনের ঘরঘর শব্দ করতে লাগল। কিছুটা বিভ্রান্ত ছোট্টু নিজেও সামসু চাচার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কোনো পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করছে। নিজে থেকে কিছু করার সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু ঘরের সবাই জানে যা কিছুই করার খুব শীঘ্রই করতে হবে। হাশেম ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লে তাকে থামানো আরও কঠিন হয়ে পড়বে। কিন্তু শামসু যে মিলিটারি নয়! হাশেমের কোমর বেড়ার নিচে আটকে গেছে। তাই সে কিছুটা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। তা না হলে এতক্ষণে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়তো সে। হাসেম আবার খুড়তে শুরু করল। আরো জোরে খুড়তে শুরু করল। তার হাত দুটি যেন এক ধরনের যন্ত্রের মতো কাজ করছে এবার। এই ভয়াবহতার মধ্যে সামসু ও ছোট্টুর অলক্ষ্যেই, হঠাৎ শামসুর স্ত্রী মোনা কোথা থেকে একটা মোটা লাঠি যোগাড় করে হাসেমের মুখের উপর সজোরে একটি আঘাত করে বসেছে। তার পরপরই উপুর্যপুরি আরো কয়েকটা আঘাতে হাসেমের নাকটি বসিয়ে দিয়েছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় সামসু শুধু ফ্যালফ্যাল করে দেখছে। তারই নাজুক, বোকাসোকা, স্বামীভক্ত বউটি আরেকটি আঘাত করে হাসেমের মুখের এক পাশের দাঁতগুলো ভেঙে দিয়েছে। হাশেম নামক জন্তুটি এবার পাগল কুকুরের মত অস্থির হয়ে উঠেছে। কুমিরের মতো ডিগবাজি দিতে শুরু করেছে। মোনা তখনো থামেনি, তার আরেকটি সজোরে আঘাতে এবার হাসেমের একটি চোখ দেবে গিয়েছে। ছোট্টু ততক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়েছে। পাকের ঘর থেকে একটি রুটি বেলার বেলুন, অন্য হাতে একটি খুন্তি নিয়ে এসেছে। তবে শামসুর বউয়ের শেষ আঘাতটি যেন কাজে লেগেছে। নরপিশাচটি এবার পিছপা হতে শুরু করেছে। সামসু এর মধ্যে ভকভক করে বমি করে মেঝে ভাসিয়ে দিয়েছে। হাসেম ইতিমধ্যে সাপের মতো এঁকেবেঁকে নিজের শরীরটা বের করে নিয়ে গেছে। কিন্তু হাসেমের সেই কদর্য মুখখানা এখনো শামসুর চোখের সামনে ভাসছে। ছোট্টু দৌড়ে গিয়ে ঘরের কোণ থেকে একটি স্টিলের ট্রাংক টেনে গর্তের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সামসুর স্ত্রী তাকে সাহায্য করার জন্য সেদিকে এগিয়ে গেছে। বমি মুছতে মুছতে কোনরকমে সামসু নিজেকে সামাল দিয়ে তাদের সাহায্য করতে পা বাড়াল।   ইতিমধ্যে তারা ট্রাংকটি গর্তের মুখে বসিয়ে দিয়েছে। বাইরে হাশেম উন্মাদের মত চিৎকার করে বেড়াচ্ছে। তার চিৎকারে এক ধরনের অশুভ, অপার্থীব সংকেত পাওয়া যাচ্ছে। কোন নরপিশাচ রেগে গেলে যেমনটা হয়। সামনে তবে আরো ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে! এইটা হাসেম না! একটা রাক্ষস! পরনের কাপড় কোমরে গুজে, পেছনের লম্বা চুলগুলি খোপা করে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে কথাটি বলল শামসুর স্ত্রী। সামনের এই মেয়েটিকে বড় অচেনা লাগছে আজ সামসুর কাছে। কিছুটা লজ্জিতও সে। মেয়েটির দিকে ঠিক চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। আসলে মানুষের চরিত্র বোঝা বড় দায়। যাকে আজীবন শান্তশিষ্ট, দুর্বল মনের মানুষ মনে হয়েছে, এ যাত্রা সবার জীবন সেই মেয়েটিই বা���চিয়ে দিয়েছে। . রফিক চাচা হারিকেনের আলো আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এবার অনেকটা শব্দ করেই দোয়া দুরুদ পড়তে শুরু করেছে। হঠাৎ করেই অবয়বটি মাটিতে খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করে দিয়েছে। কয়েক সেকেন্ড মূর্তির মত স্থির থেকে তড়িত্গতিতে এদিকেই মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়েছে। অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় সেটির ছোপ ছোপ রক্তমাখা কুঁচকানো চামড়ার চেহারাটি দেখে বুকটা যেন ধক করে উঠলো রফিক চাচার স্ত্রীর। তার মনে হলো এখনই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। ঝট করে বেড়ার ফাঁক থেকে চোখ সরিয়ে নিল সে। এক পা দুপা করে কোন রকমে পাটি বিছানো বিছানার উপর এসে বসলো। আলোটা নিভান! রফিক চাচার উদ্দেশ্যে ফিসফিস করে বলল সে। রফিক চাচা তার কথা শুনতে পেল বলে মনে হলো না। সে অনেকটা উচ্চস্বরে বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়ে চলছিল। তার স্ত্রীর চোখেমুখে আতঙ্ক। সে নিচু স্বরে আবারো বলে উঠল, আওয়াজ কইরেন না! এবার হঠাৎ করেই তার মনে হলো ছায়াটি বোধ হয় আবার উঠোনে ছুটাছুটি শুরু করে দিয়েছে। সেটির পায়ের শব্দ আরো বেড়ে গেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে সেটি ঘরটার কাছাকাছি এগিয়ে আসছে। সামনের চুলগুলি সাদা হয়ে আসা পেটের পীড়ায় ভোগা বয়স্কা মানুষটির হৃদযন্ত্র যেন এবার বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। সে কোনরকমে রফিক চাচার দিকে এগিয়ে যায় তার কাধ ধরে একটা ঝাঁকি দেয়। কিন্তু রফিক চাচার কোন সৎবিৎ ফেরে না। যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে সে। তার গলার স্বর আরও বেড়ে গেছে। ঠিক তার পরমুহূর্তেই পশ্চিমের বেড়ার উপর সজোরে কিছু একটা আছড়ে পরল। রফিক চাচার স্ত্রীর পুরো শরীর যেন এবার একটা ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। তার পরপরই শরীর এলিয়ে বিছানার উপর পড়ে গেল সে। সম্ভবত মূর্ছা গেল। রফিক চাচা আরও উচ্চস্বরে দোয়া দুরুদ পড়তে শুরু করল। হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দিল। নিজে নিজে বলল আগুনের সামনে ভুত-প্রেত আসতে পারবে না। তারপর উঠে খাটের অপর পাশে তার স্ত্রীর কাছে এগিয়ে গেল। কয়েকবার তার নাম ধরে ডাকলো। কাধে ধরে নাড়া দিল কিন্তু কোন সারা শব্দ মিলল না। অজানা আশঙ্কায় তার বুকটা ভারী হয়ে আসলো। এরপরই বেড়ার উপর আরেকটা আঘাত। অবয়বটি তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল এখন। সেটি জানে ঘরের ভিতরে কিছু রয়েছে। তাই ভেতরে ঢোকার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছে। ঘরের এপাশের বেড়ায় কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করে, এবার সেটি দরজার কাছে চলে গেছে। সজোরে দরজার উপর ধাক্কা দিতে শুরু করল। দরজার খিলটি নড়ে নড়ে উঠল। রফিক চাচা স্থির দাঁড়িয়ে একমনে দোয়া দুরুদ পড়েই চলছিল। হারিকেনটা তার এক হাতে বুকের কাছে ধরে রাখা। পাগুলি রীতিমত ঠকঠক করে কাঁপছে। নাছোড়বান্দার মতো এলোপাতাড়িভাবে দরজার উপর আঘাতের এক পর্যায়ে দরজাসহ অবয়বটি ঘরের ভেতর আছড়ে পড়ে। রফিক চাচা পাটি বিছানো খাটের উপর উপুড় হয়ে পড়ে যায়। তার হাতে থাকা হারিকেনটি খাটের উপর পড়ে গেলে সেটির কাচ ভেঙে চুইয়ে চুইয়ে তেল পড়তে থাকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পাটির উপর আগুন ধরে যায়। রফিক চাচা সৎবিৎ ফিরে পেতেই কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘরের এক কোণে বেড়ার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে। জন্তুটি ইতিমধ্যে লাফিয়ে তার স্ত্রীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তার ছিন্নভিন্ন দেহটা গোগ্রাসে গিলে চলছে। খাট চুইয়ে চুইয়ে মেঝেতে রক্ত ছড়িয়ে পড়ছে। সেটি দেখে মুখ থেকে এক ধরনের বোবা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে তার। মুখে হাত দিয়ে চাপা কান্নায় কুঁকড়ে ওঠে সে। এদিকে আগুন আরো ছড়িয়ে পড়েছে। খাটের পাশে থাকা আসবাবগুলির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রফিক চাচা ঘর থেকে বেরোনোর জন্য হামাগুড়ি দিতে শুরু করল। ধীরে ধীরে নিজেকে টেনে হিচড়ে দরজার দিকে নিয়ে যেতে থাকল। জন্তুটি একবার রফিক চাচাকে খেয়াল করল কিন্তু পরমুহুর্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তার স্ত্রীকে খেতে ব্যাস্ত হয়ে পরলো। কোনরকমে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠে দাড়াল সে। ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে উঠোনের এক কোনে গিয়ে থামল। তারপর হাঁটুতে ভর করে কুঁজো হয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। এরমধ্যে ঘরের চারপাশ থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। হঠাৎ করেই তাল গাছের পাতায় তৈরি বিশাল ভারী চালাটি হুড়মুড় করে মেঝের উপর ভেঙে পড়ে। ব্যাপারটি এত দ্রুত ঘটে যায় যে রফিক চাচা নিজেও ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারে না। পরমুহূর্তেই ঘরের ভেতর থেকে জন্তুটির এক ধরনের  আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসতে থাকে। আর এক মুহূর্ত দেরি করলে রফিক চাচা নিজেও সেটির নিচে চাপা পড়তো। জন্তুটি বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। সেটির মুখ থেকে গরগর শব্দ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। রফিক চাচার কাছে মনে হল অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে। জন্তুটি ঘরের চালার নিচে আটকে পড়েছে। আগুন ইতিমধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেটির বাইরে বেরিয়ে আসার কোনো পথ সে দেখছে না। স্ত্রীর জন্য আপন মনে তার চোখ বেয়ে পানি ঝরছে। অপরাধীর মতো মাথা নাড়তে নাড়তে নিজেকে এক রকম টেনে রাস্তার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল সে। . সবুর দেওয়ানের বাড়িতে এই শেষ রাতেও বৈঠক চলছে। শফিক লাঠিয়াল হঠাৎ করেই গলা হাঁকিয়ে বলে উঠলো, কাইল সক্কালে আমরা কালামের বাড়ি যামু। কালামের পরিবার এই সবকিছুর সাথে জড়িত থাকবার পারে। এইটা আমাদের খুঁইজে বার করতে হইবে। সবুর দেওয়ান শফিকের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। বলল, শফিক ঠিকই বলছে। তোমরা যারা যারা এই পাগল লোকগুলোরে দেখছো, তারা সকলে দিনের বেলায় তাদের খুঁজে বার করার চেষ্টা করো। তাদের বাড়ি যাও, কেউ কাউরে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলে আমারে জানাও। দরকার হইলে আমরা আরো কঠোর হইব। সার্বিক স্বার্থে! গেরামের স্বার্থে! হয়! হয়! বলে পেছন থেকে এক ধরনের রব উঠলো। সবাই সবুর দেওয়ানের নতুন সিদ্ধান্তে একাগ্রতা প্রকাশ করল।
২৩। হাশেম আরো কয়েকবার বেড়ার উপর ধাক্কাধাক্কি করে একটা পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। উঠোনের এক কোনে গিয়ে কুকুরের মতো কেউ কেউ শব্দ তুলে কাঁদতে শুরু করেছে। অশুভ সেই কান্নার শব্দ চারপাশ ভারী করে তুলেছে। এ যেন হাসেম নয়, ভয়াবহ অসুস্থ এক পৃথিবীর মায়া কান্না। বিষাক্ত ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত সেই পৃথিবী। একটা সময় ধীরে ধীরে কান্নার শব্দ উঠোন থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে। তারপর একসময় মিলিয়ে যায়। ছোট্ট ভয়ে ভয়ে বেড়ার দিকে এগিয়ে যায়। চোখ বাড়িয়ে বেড়ার ফাঁকে একবার বাইরে তাকায়। তার শরীর তখনও সামান্য কাঁপছিল। বাইরে অল্প অল্প সূর্যের আলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে, যদিও বিভীষিকাময় ভয়াল রাতের আঁধার তখনও কাটেনি। অন্ধকারে চারপাশ ছেয়ে আছে। সামসু ঘরের এক কোনে বসে বাশের সাথে একটি ধারালো দা বেধে চলছে। তার স্ত্রী খুন্তি বটি জোগাড় করে নিয়ে এসেছে। . ভোরের আলো ফুটে উঠতেই সবুর দেওয়ান শফিক বাহিনীকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। সর্বপ্রথম কালামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করেছে। ঝলমলে সকালের আলোয় চারপাশটা দেখে মনে হয় না রাতে কি ভয়ঙ্কর বিভীষিকা চলে এই গ্রামটায়। শরতের হালকা বাতাসে রাস্তার দু পাশের ধানিজমিগুলির উপর ঢেউ খেলে যাচ্ছে। দুই একটা বক পাখি মাছ শিকারে ক্ষেতের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে। এক মুহূর্তের জন্য সবুর দেওয়ানের কাছে মনে হয় পৃথিবীটা এখনও সুন্দরই আছে। ভেতর থেকে ধুঁকে চলা এই পৃথিবীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। কালাম! বাড়ি আছোনি? শফিক তার বাজখাঁই গলায় হাক ছাড়ে। সবুর উঠানের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে শফিকের লাঠিয়াল বাহিনী। ভেতর থেকে কোন রকম সাড়া শব্দ আসে না। শফিক হাতের লাঠিটি শক্ত করে ধরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ঘরের ভেতর থেকে খট করে খিল খোলার শব্দ ভেসে আসে। সবাই তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখ দরজার দিকে, হাতে শক্ত করে ধরা লাঠি। ধীরে ধীরে ক্যাঁচক্যাচ শব্দ তুলে কাঠের দরজার কপাট দুটি খুলে যায়। ভেতর থেকে মাথায় গামছা মোড়ানো একটি অবয়ব ধীরে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সবুর মাথা নিচু করে দরজার দিকে তাকায়। ছায়ার আড়ালে চেহারাটি বুঝতে চেষ্টা করে। লোকটি আর কেউ নয়, কালামের বড় ভাই মিলিটারি। আমরা কালামরে খুঁজতে আসছি। কালাম কই? সবুর জিজ্ঞেস করে। কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকে অবয়বটি। কোন জবাব দেয় না। জবাব না পেয়ে শফিক তার লাঠিটি শক্ত করে ধরে সামনে কয়েক পা সামনে এগিয়ে যায়। পেছন ফিরে একবার সবুর দেওয়ানের দিকে তাকায়। সবুর দেওয়ান তখনও স্থির মিলিটারির দিকে তাকিয়ে আছে। কোনরকম জবাব না পেয়ে মনে মনে কিছু একটার জন্য প্রস্তুতি নেয় শফিক। . সারা রাত হন্তদন্ত হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে রফিক চাচা। কোথাও আশ্রয় পায়নি। গ্রামের বেশিরভাগ ঘরগুলি বাইরে থেকে তালা দেওয়া। দু-একটা বাড়িতে মানুষ থাকলেও কেউ দরজা খোলেনি। ক্লান্তি ভরা শরীর নিয়ে কখন যে একটি গাছের ���াথে পিঠ এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই তার। চোখ মেলে দেখে ভোরের আলো ঝলমল করছে। গাছের উপর পাখপাখালি কিচিরমিচির করে চলছে। সে ঝট করে মাটিতে বসে পড়ে। আশে পাশে, গাছের পেছনে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করে। চারপাশটা শুন্য, নিরব। আশে পাশে কেউ নেই। কিছুটা দূরে তার বাড়িটা পুড়ে ছারখার। সে দিকে তাকাতেই মনে পড়ে তার স্ত্রী আর বেঁচে নেই। বুকের ভেতর থেকে চাপা কান্না বেরিয়ে আসে তার। হাতে মুখ চেপে বৃদ্ধ শরীরটাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। মনে মনে কিছু একটা ভাবে। তারপর আকবর মেম্বারের বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। . সকাল হয়ে পড়েছে। সামসু ভয়ে ভয়ে ঘরের দরজা সামান্য খুলে ফেলে। মাথা বাড়িয়ে সামনে বাড়ির উঠোনে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করে। তারপর ছোট্টু ও তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ঠোটের উপর তর্জনী রেখে তাদের চুপ থাকার নির্দেশ দেয়। দরজার ফাঁক গলিয়ে নিশব্দে শরীরটাকে বাইরে বের করে নেয়। তারপর ছোট ছোট পায়ে ঘরের পেছনের দিকে হাঁটা দেয়। আশেপাশে কোন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাইরে মৃদু বাতাস বয়ে চলছে। গাছের উপর পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। পেছনের ধানী জমিগুলি দিয়ে দূর-দূরান্তে তাকালেও কোন কিছু চোখে পড়লো না তার। উঠোনে আসতেই এক কোনায় একটি গর্ত দেখতে পায় সামসু। গর্তটা রাতে আঁধারে হাসেম খুড়েছে। অগভীর গর্তটির ভেতরে কিছু নেই। ফাঁকা! . চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মিলিটারি। সবুর দেওয়ান আবার জিজ্ঞেস করে, কি হইছে তোমার, মিয়া? কালাম তার বউরে নিয়া শশুর বাড়ি চইলা গেছে। এবার মুখ খোলে মিলিটারি। কবে গেছে? এই গতকাইল ... মিলিটারি কন্ঠে আরষ্টতা। তুমি ঠিক আছো তো? গামছা দিয়ে চেহারাটা একটু ঢাকার চেষ্টা করে জবাব দেয় মিলিটারি, হয়, ভাইজান। শফিক লাঠিয়াল সবুরের দিকে একবার তাকায়। সবুরের চেহারায় এক ধরনের অবিশ্বাসের ছাপ। ঐ কোনায় গিয়া খারাইছো কেন? বাইরে আইসা দাড়াও। ধমকের সুরে বলে শফিক। মিলিটারি কোন জবাব দেয় না। দরজার সামনে থেকে একচুল নড়েও না। তাকে দেখে কিছুটা দুর্বল, ভারসাম্যহীন মনে হচ্ছিল। সবুর আকাশের দিকে একবার তাকায়। সূর্য ঝলমল করছে চারপাশে। সূর্যের আলোয় গা পুড়ে যাচ্ছে। কেন যেন সবুরের কাছে মনে হয়, মিলিটারি এই আলো থেকে বাঁচার জন্য মুখ ঢাকার চেষ্টা করছে। কালাম কই? সত্যি কইরা বল? এবার শফিক হাক ছাড়ে। শফিকের বাজখাই গলার স্বরেও একচুল নড়ে না মিলিটারি। কিছু একটা গন্ডগোল আছে। সবার তা বোঝা হয়ে গেছে। এবার শফিক তাঁর হাতের মোটা বাশটি সামনে বাড়িয়ে মিলিটারির শরীরের উপর একরকম গুতো দেয়ার জন্য চালিয়ে দেয়। গুতো খেয়ে মিলিটারি কয়েক পা পেছনে সরে যায়। কিন্তু তার মুখ থেকে কোন ধরনের শব্দ বের হয় না। পেছন থেকে শফিকের কয়েকটি সাঙ্গোপাঙ্গ সামনে এগিয়ে আসে। একরকম আঘাত করার ভঙ্গি নিয়ে মিলিটারির দিকে তাদের হাতে ধরা বাশগুলি তাক করে। তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। একটা সাঙ্গ মিলিটারি উপর আঘাত করতে গেলে সবুর দেওয়ান চেঁচিয়ে ওঠে, বলে, থাম তোরা! শফিক কিছুটা বিস্ময় নিয়ে সবুর দেওয়ানের দিকে তাকায়। মানুষটা তো কথা কইল এইমাত্র। শফিকের উদ্দেশ্যে বলল সবুর। অন্য কিছুও তো হইবার পারে! কিন্তু... শফিক কিছু একটা বলতে গেলে সবুর তাকে আবার থামিয়ে দিল। বললো, আমরা দেশ, দশের উপকার করতে বাইর হইছি। মানুষ খুন করতে নয়! ওরে ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢোকা। তারপর? দরজার পেছন দিয়ে তালা দিয়ে দে! কি কন মিয়া ভাই? শফিক ভীষণ অবাক। আপনে বুঝতাছেন না? এইটারে ছাইড়া দিলে তো আমরার রাইতের ঘুম তো হারাম হইয়ে যাইবে! ছেড়ে দিলাম কে বলল? প্রত্যেক বেলায় তোরা আইসে দেখে যাবি। কোন সমস্যা মনে হইলে ব্যবস্থা নিবি। সবুর উত্তর দিল। সাথে সাথে মাথা ঘুরিয়ে নিল শফিক। কিছু একটা মনে মনে ভাবল। তারপর ছোট্ট একটা মুচকি হাসির রেখা তার চেহারায় খেলে গেল।
২৪| কড়া দুপুর বাইরে। কটকটে রোদে দো-চালা ঘরের টিনের চাল ঝলসে যাওয়ার উপক্রম। এদিকে বেলা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে মিলিটারির অস্থিরতাও ক্রমেই বেড়ে চলছে। মুখ দিয়ে হিংস্র গরগর শব্দ বের হচ্ছে। অস্থিরভাবে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে তার কোটরাগত লাল হিংস্র চাহনি কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। মিলিটারির তামাটে চেহারাটা দাড়ি-গোঁফে ভরে গেছে। উস্কোখুস্কো চুলগুলি ঘাড় অবধি নেমে এসেছে। শরীরে জড়ানো জরাজীর্ণ শার্টটি তার এক পাশ থেকে ছিঁড়ে ঝুলে পড়েছে। পেটা তামাটে শরীরে বুকের পেশী গুলি দৃশ্যমান হয়ে পড়েছে। শিরাগুলো ফুলে ফুলে উঠছে। চোখ দুটি বন্ধ করে অনবরত সামনে-পেছনে মাথা ঝাকাতে থাকে মিলিটারি। যেন তীব্র ব্যথায় তার মাথার ভেতরটা ছিড়ে ভুরে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যেই তার শরীর প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে। যেন এক প্রকার খিঁচুনি হচ্ছে। একটা পর্যায়ে মিলিটারি খাটের একপাশে নিজের শরীর টেনে নিয়ে বাকানোর চেষ্টা করতে থাকে। ঠিক যেমন করে কুমিরের মতো পাক খেতে শুরু করেছিল রহিম বক্স এর শরীর। হাত পা ছুড়তে ছুড়তে এক সময় হাতের বাধন কিছুটা আগলা করে ফেলে সে। আরো কিছুক্ষন ধস্তা-ধস্তির পরে মুখ দিয়ে ধরি কামড়ানোর চেষ্টা শুরু করে মিলিটারি। এদিকে কেউ বা কারা উঠনে এসে ভীড় করেছে। মাটিতে বাশের ঠুক ঠাক শব্দ উঠানে শোনা যাচ্ছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার তোড়জোড় এবার যেন আরো বাড়িয়ে দিল মিলিটারি। শিগগিরই দরজার ওপাশে মনুষ্য উপস্থিতি টের পাওয়া গেল। বিড়বিড় করে চলা কথাবার্তার মধ্যে হঠাৎ করেই বাইরে শফিকের বাজখাই গলা শোনা গেল, শালাকে এক বারিতে খতম করবি। খবরদার বারিটা যেন মাথার উপরই হয়। শফিক কারো উপর চিত্কার করে আদেশ করল। মিলিটারি ততক্ষনে তার এক হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে। অন্য হাতটাও ছাড়িয়ে ফেলেছে প্রায়। শফিকের সাথে থাকা লম্বা করে সাঙ্গটা দরজার তালা খুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তার সাথে বেঁটেখাটো স্বাস্থবান পাংগোটি বাশ নিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুখে পান চিবোতে চিবোতে এক পর্যায়ে সাঙ্গকে এক দিকে ঠেলা দিয়ে চাবিটি হাতে নেয় সে। চাবিটা তালার ভেতরে ঢুকিয়ে ডানে আলতো করে চাপ দেয়। কট শব্দ করে তালাটা খুলে যায়। লম্বু মানুষের বুদ্ধি থাকে হাঁটুতে। এখন খুলল কেমনে? সগর্বে কথাটি বলতে বলতে দরজার কপাট খুলল পাঙ্গ। ভেতরে ঢুকতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তেই, 'হই' শব্দ করে তার উপড় ঝাপিয়ে পড়ে মিলিটারি? হাতের বাশটি একপাশে ছিটকে পড়ে যায় লোকটির। মিলিটারির হাতে একটা শক্ত কাঠের পীড়ে ছিল। সেটি দিয়ে চোখ মুখ বন্ধ করে ধুমধাম বেদম পিটুনি দিতে থাকে সে। পাঙ্গ ইতিমধ্যে মাটিতে ধরাশায়ী। এর মধ্যে একটা বাড়ি মাথায় গিয়ে লাগতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। সাঙ্গ ততক্ষণে দৌড়ে বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। মিলিটারি এক লাফে উঠে দরজার পেছনে ঘরের বেড়ার সাথে সিঁটকে যায়। সাঙ্গ কাঁপতে কাঁপতে শফিকের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। শফিক বিরক্তির চেহারা নিয়ে তাকে মারতে উদ্যত হলে, দুই হাত জুরে কাচুমাচু করে মাটিতে বসে পরে সে। শফিক এবার দরজার দিকে মুখ করে গলা বাড়িয়ে চিৎকার করে বলে, বাইরে আয়, মিলিটারি! সাহস থাকলে বাইরে আয়! দোতলা ঘরের দরজার সামনে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে পাংগোর স্থুল দেহটি। মিলিটারি ঘরের ভেতরে গা ঢাকা দিয়ে আছে। দরজাটা হা করে খোলা। ভেতরটা কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। শফিক আবার বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, বাইরে আয় গোলামের পো! তারপর সাঙ্গর দিকে একবার কটমট চোখে তাকায় সে। শফিকের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায় তার। এবার লাঠিটা ফেলে এক পা দু পা করে পিছিয়ে যায় সে। তারপর শফিকের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে পেছনে ফিরে দেয় এক দৌড়। আর কোন তাকা তাকি নেই। সে আর এই মুখ হবে না। তার ওস্তাদ যাই বলুক না কেন, নিজের জীবন বিপন্ন করে এই রাক্ষসের মুখোমুখি হবে না সে। সাঙ্গর তড়িঘড়ি দৌড়ানো দেখে চরম সীমানায় পৌঁছায় শফিকের রাগ। দাঁত চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার। কিড়মিড় করতে থাকে যেন এখনই ক্ষয়ে যাবে। তারপর দরজার দিকে ফিরে রাগে ক্ষোভে বাশটি একবার মাটিতে ঠুকে দেয়। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর এক পা সামনে বাড়াতে গিয়েও কি একটা ভেবে পা-টা ফিরিয়ে নেয়। তারপর কটমট করতে করতে নিরাপদ দূরে দাঁড়িয়ে গলা হাকিয়ে চিৎকার করে বলে, তুই বাইর হবিনা? ঠিক আছে! আইতাছি আমি আগুন লইয়া। সব জায়গায় আগুন দিমু আজকে। তোরে আগুনে পুড়ায় মারমু। মাথার ছোট ছোট চুল গুলির উপর একবার হাত বুলিয়ে পেছনে ফেললো শফিক। তারপর লুঙ্গিটা আধা কাঁচা দিয়ে দ্রুতপায়ে উঠান ছেড়ে আইলে নেমে পড়ল। শফিক জানে মিলিটারি এই প্রখর রোদে ঘর থেকে বাইরে বের হতে পারবে না।
২৫| সারা সকাল দুপুর বাইরে কোনো কিছুর সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। সামসু এরমধ্যে উঠোন থেকে কয়েকবার চক্কর দিয়ে এসেছে। সন্তর্পনে বাড়ির এপাশ ওপাশ ঘুরে দেখেছে। কিন্তু আশেপাশে কোন কিছুর দেখা মেলেনি। না, কোন জন্তু জানোয়ার না পাখপাখালি। কিছুই নেই। যেন দূরদূরান্ত জনমানব শূন্য খা খা মরুভূমি। প্রকৃতি যেন এখানে কিছু একটার আভাস দিচ্ছে। এই নিস্তব্ধ নীরবতা যেন স্বাভাবিক নয়। কিছু একটা ঘটে গেছে এখানে। বড়ই অস্বাভাবিক কিছু একটা। আর সেটারই পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে। প্রকৃতির এই ভাষা এক অশনী সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। সামসু কিছুতেই কিছু ভেবে পাচ্ছেনা। তার মাথা আর কাজ করছে না। হাসেমকে নিয়ে চিন্তিত সে। কি হলো তার? ভোরের আলোর সাথে সাথে হাশেমের হিংস্রতাও গায়েব হয়ে গেল। সকাল থেকে আর তার দেখা মেলেনি। একদমই লাপাত্তা। এর মধ্যে কয়েকবারই ঘরের বাইরে এসেছে সামসু। উঠোনের এক কোনায় একটি গর্ত ছাড়া হাশিমের আর কোন চিহ্ন নেই। সামসু আবার একবার উঠে যায়। ঘরের জানালাগুলির ফাঁকফোকর দিয়ে অস্থির মনে আবার বাইরে তাকায়। এইদিক ঐদিক সবদিকে তার গোয়েন্দা চক্ষু বসায়। "আশেপাশে কেউ নেই, মোনা।" দ্বিধান্বিত গলায় একটু নিরভার গলায় কথাটি বলল সামসু। মোনা তার কথার কোন উত্তর দেয় না। কাঠের চোকির এক কোনে চুপ মেরে বসে থাকে। সেই সকাল থেকেই এভাবে বসে আছে সে। যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন। এক মনে কিছু একটা ভেবে চলছে। ছোট্টু মোনার চোখের দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করছে। যেন তার মুখ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা শুনতে যাচ্ছে। একপর্যায়ে মুখ খুলল মোনা। বলল, আমাদেরকে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। যদি বাইরে ওইগুলো আরো থাইকা থাকে। প্রায় সাথে সাথেই কাঁপা কাঁপা গলায় কথাটি বলল ছোট্টু। হুম তা তো থাকবার পারে। চিন্তিত ভঙ্গিতে উত্তর দিল সামসু। কিন্তু সকাল থেকে তো কেউ কিছু দেখবার পারলাম না। মোনার দৃঢ় কণ্ঠ। সেটাই ভাবতেছি। হাশিমও লাপাত্তা। আপন-মনে বিড়বিড় করল সামসু। ছোট্টু কিছু একটা ভেবে চোখ দুটি বন্ধ করে ফেলে। তারপর তাদের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করে, শামসু চাচা, এই লাশগুলা বেশিরভাগ সময় রাইতের বেলাই বাইর হয়। চোখ খুলে ছোট্ট। তার চোখগুলি যেন ভয়ানক কিছু একটা আচ করতে পারছে। বাজানেরে রাইতের বেলাতেই ধরছিল। বলতে থাকে সে, যেদিন মিলিটারি চাচার সাথে কালাম চাচার মারামারি হয়, সেদিনও রাইতের বেলায়ই ঘটে ঘটনাটা। আমার মনে হয় রাইতের সাথে এগুলোর কিছু একটা সম্পর্ক আছে। সামসু ছোটুর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। বয়সে ছোট হলেও তার কথাগুলো একদম ফেলনা নয়। তাছাড়া অনেক ঘটনার সাক্ষী সে। সূর্য ডোবার আগে এই গ্রামছাড়া হওয়া উচিত আমাগোর। মোনা বলল। তার এবারের কথাটিতে আগের চেয়ে একটু বেশি জোর ছিল। হুম, আমিও সেটা ভাবতেছি। শান্ত গলায় বলল সামসু। কিন্তু যামু তো কই যামু? পাশের গ্রামেও যদি একই অবস্থা হয়। তাছাড়া রাইত নামার আগে যদি নিরাপদ কোথাও আশ্রয় নিতে না পারি। সামসু ভীত-সন্ত্রস্ত। সে আসলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তার কাছে একবার মনে হয় এখানে থাকাটাই নিরাপদ, পরক্ষণেই আবার ভাবে যদি হাশেম রাতের বেলায় আবার ফিরে আসে! হাসেম তো তাদের অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সত্যি সত্যি যদি সে দিনের বেলায় কোথায় গা ঢাকা দিয়ে থাকে। ওৎ পেতে থাকে রাতের অপেক্ষায়। কিন্তু সামসুকে তো একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার দিকেই তাকিয়ে বাকি দুজন। সামসু ছোট্টুর দিকে তাকায়। কিছু একটা ভাবে। তারপর মোনার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে, আমরা আইজি এই গ্রাম ছাইড়া চাইলা যামু। কথাটি শুনে মাথা নাড়ে মোনা। ছোট্ট শামসুর দিকে তাক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকে।
২৬| এখন ভর দুপুর। সারাটা সকাল কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি বাইরে। চারিপাশটা নিরব নিস্তব্ধ। নেই কোন মানুষের আনাগোনা, পাখপাখালির কিচিরমিচির বা গরু ছাগলের হাক ডাক। দুপুরের খা খা রোদে সামনে উঠোনের মাটি ফেটে চৌচির। সকাল থেকেই ঘরের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে ছিল সামসু। বেড়ার ওপাশ এপাশ থেকে ফাক ফোকর গলিয়ে বাইরের নজর রাখছে ছোট্টু। মোনা এরমধ্যে হাতে বটি নিয়ে কয়েকবার বাড়ির আশেপাশে ঢু মেরে এসেছে। দূর-দূরান্তে কাকপক্ষীও চোখে পড়েনি তার। ভোর থেকে একরকম লাপাত্তা হাশেম। কেউ ভেবে পাচ্ছেনা কোথায় গেল সে? শুধু উঠোনে জন্তু-জানোয়ারের খোড়া দেখতে কয়েকটা গর্ত ছাড়া হাশেমের আর কোন চিহ্ন নেই। বাইরে কেউ নাই, চাচা। দরজার দুই কপাটের ফাঁক দিয়ে চোখ বুলিয়ে বলল ছোট্টু। কি করবা? শামসুর উদ্দেশ্যে বলল সে। শামসু গভীর মনোযোগে কিছু একটা ভেবে চলছে। অন্যদিকে মোনা একদম চুপ, মুখে কোনও রা নেই। ছোট্টু তাদের দুজনের উপর থেকে চোখ সরিয়ে আরেকবার তাকালো বাইরে। তারপর নির্বিকার ভঙ্গিতে চৌকির উপর এসে বসল সে। আমাদের কিছু একটা করা উচিত। কথাটি বলে এক রাশ বুকে আশা নিয়ে মোনার দিকে তাকাল ছোট্টু। যেন এই মুহূর্তে মোনাই কোন একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমাদের এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত? ছোটুর মনোযোগ কেড়ে গম্ভীর গলায় কথাটি বলল সামসু। যদি বাইরে ওইগুলা আরো থাইকা থাকে। এবার নীরবতা ভাঙলো মোনা। হুম তা থাকবার পারে। একটু ভেবে মাথা ঝাকাল সামসু। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল সে আবার। আমি ভেবে পাচ্ছিনা হাশেম গেল টা কই? গলায় উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল মোনা। পরের কয়েক মুহূর্ত কেউ কিছু বলল না। হঠাৎ চট করে কিছু একটা ভেবে ছোট্টু বলে বসল, শামসু চাচা, এইগুলারে কখনো দিনের বেলায় দেখি নাই। তুমি কি ব্যাপারটা খেয়াল করছো? সামসু চুপ করে রয়েছে। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। ছোট্টু বলে চলল, বাজানেরে রাইতে ধরছিল। মাঝ রাইতে কামড় খেয়ে বাড়ি আসছিল। একটু থেমে একবার দম নিয়ে বলল, আর সেই দিন আমরার বাড়িতে কালাম চাচাও রাইতের বেলাতেই দারজার আঘাত করেছিল। রাইতের সাথে এগুলোর কোনো একটা সম্পর্ক আছে। চট করে কথাটি বলল মোনা। সামসুও মাথা ঝাকালো। ছোটুর কথাটা একদম ফেলনা নয়। তাছাড়া অনেক ঘটনার সাক্ষীও বটে সে। তার কথাতে গুরুত্ব না দিয়ে পারছে না। আমাদের কি গ্রাম ছাইড়া চইলা যাওয়া উচিত। শামসুর দিকে তাকিয়ে বললো মোনা। তার গলায় এক ধরনের কাঠিন্য। হুম, আমি ভাবতেছি। শান্ত গলায় বলল সামসু, কিন্তু যামু তো যামু, কই বা যামু? পাশের গ্রামেও যদি একই অবস্থা হয়! আর তাছাড়া আমরা যদি মাঝপথে আটকায় পরি। পথে রাইত নাইমা যায়! বলতে বলতে চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল শামসুর। আমারার যা করার দিনের বেলাতেই করতে হইবো। দৃঢ় গলায় বলল ছোট্ট। মানুষটা ছোট হলেও কন্ঠে যেন এক ধরনের পরিপক্কতা চলে এসেছে তার, রাইতে এইগুলার আনাগোনা নিশ্চয়ই বাইড়া যায়। শামসুর চোখেমুখে তখনো আতঙ্ক। আসলে সবাই যে তার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে আছে। নির্ণয় যে তাকেই নিতে হবে! রাতের সাথে এগুলোর একটা সম্পর্ক আছে। এই ব্যাপার�� এখন নিশ্চিত সে। কোনভাবেই রাতে বাইরে বের হওয়া যাবে না। এটাও বোঝা যাচ্ছে রাতের চেয়ে দিনের বেলা কিছুটা হলেও নিরাপদ। তাই যা করার দিনের বেলাতেই করতে হবে। তাছাড়া হাশেম তাদেরকে ছেড়ে চলে গেলেও যদি প্রতিশোধের নেশায় রাতে আবার ফিরে আসে! এমন তো হতে পারে এখন কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছে সে। বাইরে বের হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু তারপরেও রাতের চেয়ে দিনের বেলায় তার মোকাবেলা করা তুলনামূলক সহজই হবে। তবুও শামসুর মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। একবার মনে হয় এখানে লুকিয়ে থাকাটাই নিরাপদ। পরক্ষণেই আবার ভাবে যদি সত্যি সত্যিই রাতে হাসেম চলে আসে। বা আরো কয়েকটা লাশ সাথে করে নিয়ে আসে, ঠিক যেমনটা কালাম করেছিল। হাসেম তো তাদের অবস্থান সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। আর তাছাড়া এই জন্তুগুলি হিংস্র জানোয়ারের মতো হলেও একদম বুদ্ধিহীন নয়। হয়তোবা স্মরণশক্তিও ভালো। ছোট্টুর কথার বিবরণে তার কাছে তাই মনে হয়েছে। রহিম বক্স এর বাড়িতে কালাম একা আক্রমণ করেনি। সাথে করে আরো একটিকে নিয়ে এসেছিল। সামসু ঝট করে ডানে বামে একবার মাথা ঝাকায়। তারপর বলে উঠে, আমরা এই গ্রাম ছাইড়া চইলা যামু! কাপুরুষের মত এইভাবে বইসে থাকলে বাচবার পারুম না। আমাদের শক্ত পদক্ষেপ নিতেই হইবে। ছোট্টু ও মনা কয়েক মুহূর্ত নিরব হয়ে রইল। শামসু ওদের চোখের দিকে একবার করে তাকালো। তাদের এই নিরবতা যে সম্মতির লক্ষণ।
২৭| মিলিটারির গা-হাত-পা ক্ষনে ক্ষনে কেপে কেপে উঠছিল। বলা যায় এক ধরনের ঝাকুনি দিচ্ছিল। নিজেকে সে কোনভাবেই সামাল দিতে পারছিল না। মিলিটারি জানে যত শীঘ্রই সম্ভব তাকে এখান থেকে পালাতে হবে। শফিক চলে এলো বলে! শফিকের হাতে কোনওভাবে ধরা পড়তে চায় না মিলিটারি। তার বিশ্বাস সে সুস্থ হয়ে উঠবে। ওই রকম কোন কিছুতে পরিনত হবে না। এই ব্যাপারটি সে শুরু থেকেই মনে প্রানে বিশ্বাস করে এসেছে। তাই কোনভাবেই শফিকের কাছে ধরা পড়া যাবে না। রান্নাঘর থেকে একটা ধারালো ছোড়া এনে রেখেছে সে। আজ রাতেই একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। যদি তিল পরিমাণ অন্য ধরনের কোন পরিনতি শুরু হয়, তবে সাথে সাথেই ধারালো ছুরির এক পোচ বসিয়ে দিবে গলায়। এই ব্যাপারে প্রচন্ড দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সে। কিন্তু তাই বলে এখনি ধরা পড়তে রাজি নয়। নিজেকে তো অন্তত একটা সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু শফিক প্রচন্ড ঘাড়তেড়া ধরনের লোক। একগুঁয়ে। সে একবার যাকে তার অপছন্দের তালিকায় ফেলে দেয়, তার ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লেগে পড়ে। তখন যেন এটাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। সারা জীবন সে এই কাজটিই করে এসেছে। মানুষের পিছনে লেগেছে, ক্ষতি করেছে। তাই শেষ পর্যন্ত এই গুন্ডামি ছাড়া জীবনে আর অর্জন নেই তার। গ্রামের লোকে তাকে মাথামোটা বলে ডাকে। কারণ নিজের মাথার বুদ্ধি নিজের উন্নতি সাধনের বদলে পরের ক্ষতি করার জন্যই সারাজীবন ব্যবহার করে এসেছে সে। একেই বলে মহামূল্যবান মানব মস্তিষ্কের চরম অপচয়। যা স্রষ্ঠা নিজেও সহ্য করে না। তাই কর্মফল হিসেবে প্রতিদান কোন না কোন দিন ফিরে আসে। তবে শফিকদের মত লোকদেরও সমাজে প্রয়োজন আছে। নয়তো আকবর মেম্বর, হারিস দেওয়ানের মতো লোকেরা মানুষের উপর ক্ষমতা খাটাতে পারবে না যে। নখর বিহীন দুর্বল বাঘ হয়ে পড়বে। শত কাঁপুনি নিয়েই খাট থেকে নেমে পড়ল মিলিটারি। রান্নাঘরের দরজার পাশেই তার মায়ের রাখা ট্রাংকটি রয়েছে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে সেই দিকে এগিয়ে গেল। পুরনো জরাজীর্ণ কাথা আর চাদরে ভর্তি ট্রাঙ্কটি এক ঝাটকায় খুলে ফেলল। সামসু তার স্ত্রী মোনার হাত টেনে ধরে ছোট ছোট পায়ে ক্ষেতের আইল ধরে সামনে এগিয়ে চলছিল। পেছনে রয়েছে ছোট্টু, তাদেরকে অনুসরণ করছে। মাথার উপর প্রচন্ড রোদ খাঁ খাঁ করছে। তালু ফেটে যাচ্ছে। কিছুটা সামনে এগিয়ে যেতেই সবুর দেওয়ানের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। দোতলা বাড়ির ছাদ দূর থেকে উকি দিচ্ছে। এই বাড়িটি পেড়িয়েই পাশের গ্রামের পথ। আরও কিছুটা সামনে যেতেই মোনার হাতে এক ঝাটকা টান দিয়ে মাটিতে বসে পরলো সামসু। ছোট্টু প্রথমে ব্যাপারটি খেয়াল করেনি। সামসু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে ইশারা করলে সে ধান ক্ষেতের আড়ালে হাটু গেড়ে বসে পরে। যতদূর সম্ভব ধান ক্ষেতের আড়ালে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করছে সবাই। বাড়ির ভেতর থেকে এক ধরনের হট্টগোল শোনা যাচ্ছিল। ভেতরে লোকজনের জমায়েত চলছে। ক্ষেতের একপাশে উচু টিলার উপর সবুর দেওয়ানের বাড়ি। শক্তপোক্ত ইটের দোতলা দালানের সামনে বিশাল উঠান। চারপাশে টিনের লম্বা বেড়া। বেড়ার ওপাশ থেকে ক্ষণে ক্ষণে মানুষের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে কারো কারো ধমকের সুর শোনা যাচ্ছে। সম্ভবত সবুর দেওয়ান তার দলবলের উদ্দেশ্যে কিছু বলে চলছে। টিনের দেয়ালের ফাঁকফোকর দিয়ে মানুষের অস্পষ্ট চলাফেরা বোঝা যাচ্ছে। সামসু আর দুই কদম সামনে এগুতেই কে যেন বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, এই কে ওখানে? ক্ষেতের মধ্যে কে রে? সাথে সাথে আরো কয়েকটি গলা খেঁকিয়ে উঠলো। ভিড় থেকে কেউ যেন একজন বলে উঠল, ওই লাশগুলো নয়তো! কাথাটি শুনে সামসুর বুকটা ধক করে উঠল। এবার উঠোনের ওপাশ থেকে অনেকগুলি লাঠির ঠক্ঠক্ শব্দ পাওয়া গেল। ওই ধর! ধর! বলে একদল লোক বাড়ির এপাশ ওপাশ দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো।
২৮| ওই বান্দির পো! বাইরে আয়! দাঁত মুখ খিঁচিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল শফিক। মুখ থেকে কয়েক ফোঁটা থুতুর বুদবুদি ছিটিয়ে পড়ল মাটিতে। এক হাতে একটা কেরোসিনের গ্যালন অন্য হাতে একটা ম্যাচ নিয়ে উঠোনের উপর এসে দাঁড়িয়েছে সে। এবার তার হাতে কোন বাশ নেই। না আছে কোন সাগরেদ। রাগে ক্ষোভে বিচার-বুদ্ধি কিছুটা লোপ পেয়েছে তার। উঠোনের ঠিক ওপারেই ঘরের দরজাটা হা করে খোলা। দরজার ঠিক মুখেই মাটিতে চিত হয়ে পড়ে আছে তার পাঙ্গ। হয়তোবা মৃত অথবা জীবিত। তবে তাতে কোনো যায় আসে না শফিকের। সে মিলিটারির সংস্পর্শে গিয়েছে, তাকেও মরতে হবে। গ্যালনটি ধপাস করে মাটিতে রাখল শফিক। তারপর ঘরের দরজার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে দুই হাতে লুঙ্গিটা গুটিয়ে নিল। গ্যালনটির মুখটি ছুড়ে ফেলল দূরে। ছোট ছোট পায়ে ঘর বরাবর দৌড় দিল। তোর বাইচা থাকবার কোন অধিকার নাই! চিৎকার করে বলতে বলতে ঘরের এক পাশে চলে গেল শফিক। দুই-হাতে গ্যালনটি উঁচিয়ে ঘরের বেড়ার উপর ছিটিয়ে দিতে লাগলো কাচা তেল। তোগোর সবগুলারে পুড়ামু আমি! একটা একটা কইরা মারমু! গোলামের পো! সাহস থাকলে বাইরে আয়! চিৎকার করতে থাকা শফিক ঘরের ভেতর থেকে কোন ধরনের সাড়াশব্দ পেল না। একবার দরজার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে উঁকি দিল সে। তারপর আবার কেরোসিন ঢালায় মগ্ন হল। চারিদিকটা কাঁচা কেরোসিনের গন্ধে ভরে উঠেছে। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া গিয়ে শফিকের নাকে ঠেকেছে। এই মুহুর্তে যদিও হিতাহিত জ্ঞান নেই তার। পাগলের মতো ঘরের চারপাশে ছুটতে ছুটতে কখন যে গ্যালনটা খালি করে ফেলেছে খেয়ালই করেনি। সেটি উঠিয়ে মাটিতে এক আছাড়ই দিল। যেন যতো রাগ ক্ষোভ সব গ্যালনের উপর। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে ম্যাচটি বের করল। একটা একটা করে কাঠি জ্বালিয়ে ছুড়ে মারল বেড়ার ওপর। কাঁচা কেরোসিনে ভেজা মুলির বেড়ায় মুহূর্তেই দাউ দাউ করে আগুন লেগে গেল। দখিনের দমকা হাওয়ায় কয়েক মুহূর্তেই আগুনের শিখা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তপ্ত রোদে বেড়াগুলো যেন জ্বলে ওঠার জন্য তৈরিই হয়ে ছিল। আগুনের তাপে শফিক এক ঝটকায় নিজেকে পেছনে সরিয়ে নিল। উঠোনের ঢালু ধরে দৌড়ে নীচে নেমে এলো। ক্ষেতের পানিতে হাটুগেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। যেন সামনে সার্কাস শুরু হবে। সেটি দেখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কাদায় চপাক চপাক শব্দ করে এবার হাঁটতে শুরু করল। হঠাৎই ঘরের ভেতর থেকে মানুষের চিৎকারের শব্দ পাওয়া গেল। শফিকের বুকটা যেন আত্মতৃপ্তিতে ভরে উঠলো। চেহারায় খুশির ছাপ ফুটে উঠলো। মুচকি একটা হাসি দিল সে। তারপর মুখ থেকে একরাশ থুতু ফেলে বলে উঠলো, মর গোলামের পুত, মর! . হারিস দেওয়ানের বাড়ির উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সামসু, মোনা আর ছোট্টু। তাদের ঘিরে সবুরের লাঠিয়াল বাহিনী, যেন কোন তামাশা দেখার অপেক্ষায়! সবুর রক্তচক্ষু করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার একটা চ্যালা হটাৎ লাঠি উঁচিয়ে ধরল। সবুর ধমকের সুরে বলে উঠল, ওই দাঁড়া! চ্যালাটা সাথে সাথেই থেমে গেল, যেন থেমে যাওয়ার জন্যেই লাঠিটা উঁচিয়ে ছিল। আসলে সবুরকে খুশি করাই তার উদ্দেশ্য ছিল। সবুর খুশি হল কিনা বোঝা গেল না। তোরে তো আমি বুঝদার ভাবছিলাম। সামসুর দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল সবুর। কিন্তু তুই শালা একটা নাদানই ঠেকলি। ভাইরাসটা সারা গ্রামে ছড়ায় পড়তেছে। কে কেমনে কখন আক্রান্ত হইতেছে কেউ জানে না? এতবার বললাম ঘরে থাক, ঘরে থাক কিন্তু শুনলি না! ভাইজান! আমরা শুধু গ্রাম ছেইড়ে চইলে যাইবার চাইছিলাম। আমরারে চইলে যাইতে দেন! সামসুর গলায় কাকুতি। তারপর তুই আরেক গ্রামে গিয়া ছড়ায় দে, তাই তো! রাগে ক্ষোভে ফুসছিল সবুর। নিজের অনিচ্ছায় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল তার মুখ থেকে। তুই আসলে নিজের ইচ্ছায় ঘরে থাকবার লোক না। কথার সুরে মনে হচ্ছিল কিছু একটা করতে যাচ্ছে সবুর। মোনা গলা উচিয়ে কিছু একটা বলতে গেলে এক ধমকে তাকে থামিয়ে দিল সে, এই মহিলা! আমরা দুই ব্যাটা ছেলে কথা বলতেছি না! এতো সাহস তোমার! শোনেন! ভাইসাব শোনেন! পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে ভেবে সামসু তৎক্ষণাৎ সবুরের উদ্দেশ্যে বলল। আমরা কেউ আক্রান্ত না, ভাইজান। আমরা সবাই ঠিক আছি। হ, তাই বুঝি! বিদ্রুপের সুরে বলল সবুর। তোমরা কেউই আক্রান্ত না! ঠিক আছে বুঝলাম, তা মিয়ারা আমারে একটু বুঝায়ে বলো, তোমরা তা বুঝলা কি কইরা? সামসু চুপ করে রইল। কিছু বলতে পারল না। এর সদুত্তর তার কাছে নেই। তাবৎ গ্রামের মানুষ যে জিনিসটা বুঝবার পারে নাই, তোমরা সেইটা বুইঝা ফালাইছো। সবুর দাত কিড়মিড়িয়ে বলল। . দূরে মিলিটারির বাড়ি দাউদাউ করে জ্বলে পুড়ে চলছে। সাথে যেন মিলিটারির বুকের ভেতরটাও। কতো বছরের পুরনো পিতৃস্থান, কতো স্মৃতি। সবকিছু এক নিমেষেই শেষ। এটা তো শুধু একটা বাড়ি নয়, একটা সংসার, পরিবার। বাড়ি নিয়ে আফসোস হচ্ছে না মিলিটারির। তার আসল বাড়িতো অনেক আগেই জলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে গেছে। দুর্বল, আহত বাঘের ন্যায় ক্ষিপ্ত মিলিটারি একটা দোচালা বাড়ির পেছনের ছায়ায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। বাড়িটা খালি। বাড়ির বাসিন্দারা বহু আগেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। ভেতর থেকে পঁচা বাসি গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মিলিটারি সাড়া শরীর মোটা কাঁথায় মোড়ানো। মাথা থেকে পা পর্যন্ত আরেক পরদ চাদরে ঢাকা। মুখটা মোটা গামছায় শক্ত করে বাধা। মাথায় পুরু করে ঘোমটা দেয়া, শুধুমাত্র চোখ দুটো খোলা। শফিক শুধু মিলিটারির বাড়ি নয় আশেপাশের অনেকগুলি বাড়িতেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ক্ষেতের আইল ধরে পালানোর সময় পুড়ে ছাই হওয়া কিছু বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখে এসেছে মিলিটারি। তার মধ্যে পরিচিত জনের ঘর দোরও ছিল। তারা পালাতে পেরেছে কিনা যানা নেই তার। শফিক বাহিনী আসলে ভাইরাস নিধণের নামে তাণ্ডব চালাচ্ছে। নিরীহ মানুষ হত্যা করে চলছে। শফিক অবশ্য তা নিয়ে খুবই খুশি। তার মনের ভিতরের সুপ্ত হিংস্রতা যে নিংড়ে বেরিয়ে আসার এটাই সুযোগ। রৌদ্রের তাপ ইতিমধ্যেই কমে এসেছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতে চলেছে। কিছুক্ষণ পরেই আঁধারের চাদরে ঢেকে যাবে পুরো গ্রাম। মিলিটারি কোমরে গুঁজে থাকা ছোড়াটি বের করল। একবার গলার কাছে নিয়ে একটা পোচ বসিয়ে দেয়ার ভঙ্গি করলো। শেষবারের মত বুঝে নিল নিজেকে কিভাবে শেষ করতে হবে। হয়তোবা আজ রাতই তার জীবনের শেষ রাত! চলবে।
0 notes
manayeem · 3 years
Text
সায়েন্স ফিকশন
ভাইরাস দ্বিতীয় অধ্যায়
১১। পড়ন্ত বিকেল। আকবর মেম্বারের বাড়িতে বৈঠক বসেছে। বৈঠকে হারিস দেওয়ানও রয়েছে।
সগীর মুন্সি তার কাছে একটি আকুতি নিয়ে এসেছে। বেশ কিছুদিন যাবত সে তার বাবাকে খুঁজে পাচ্ছে না। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়ি খুঁজে তার কোন হদিস মেলেনি। যেদিন সে হারিয়ে যায়, তার আগের দিন রাতে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তার বাবা। সগীর মুন্সি তড়িঘড়ি করে ডাক্তার ডাকতে গেলে ফিরে এসে আর তার বাবাকে খুঁজে পায় নাই। এখন অবধি তার বাবার কোন হদিস পাওয়া যায়নি।
আকবর মেম্বার সগির মুন্সির কথাগুলি মনোযোগ দিয়ে শোনে। তারপর হুক্কাতে একটি টান দেয়। মুখ থেকে ধোঁয়া বের করতে বের করতে বলে, সগীর, তোমার বাপ তো মিন্টুর মায়ের দাফনে অংশগ্রহণ করছিল। তাই না?
ছগির হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। আকবর মেম্বার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তার চেহারায় এক ধরনের চিন্তার ছাপ ফুটে ওঠে। বলে, তারপরে তোমার বাপ অসুস্থ হইয়া গেল আর এখন তারে খুঁজে পাইতেছ না।
আকবর মেম্বারের পাশেই দাড়িয়ে থাকা শফিক মস্তান সগির মুন্সির উদ্দেশ্যে হাক ছেড়ে বলে, খুইজা পাইতেছনা নাকি একমাস ঘরে বন্দী থাকতে হইবো তাই কোথাও পাঠায়ে দিসো, মিয়া।
সগির মুন্সি প্রায় সাথে সাথেই উত্তর দেয়, খোদার কসম মিয়া ভাই। কোথাও পাঠাই নাই। নিজের বাপেরে নিয়া এত বড় মিথ্যা কথা বলার সাহস আমার নাই।
আকবর মেম্বার গম্ভীরভাবে একবার মাথা নাড়লো। কথা ঠিক তার, চেহারায় অসহায়ত্ব, পিতৃবিরহের বেদনা। মিথ্যে বলছে না সে। ভাবল সে।
একবার হারিস দেওয়ানের মুখের দিকে তাকায় মেম্বার সাব। হারিস দেওয়ান নিজেও এই বিষয়টি নিয়ে ভীষণ চিন্তিত।
এবার মেম্বর সাব ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আর কারো কোন সমস্যা আছে? থাকলে বল।
মাটিতে এক কোনায় মাখনলাল হাঁটু ভাঁজ করে কাচুমাচু ভঙ্গিতে বসে ছিল। চেহারায় তার গভীর আনুগত্য। ভয়ে আকুতি মিনতি করে আকবর মেম্বারের উদ্দেশ্যে বলল, হুজুর আমার ছেলে দিলিপরে তো আর খুঁইজা পাইলাম না!
আকবর মেম্বর এবার তার দিকে ঘুরে তাকায়। একটু বিরক্তি নিয়ে বলে, আরে মিয়া, লাশও তো পাও নাই। এখনো তো আশা আছে, তাই না। আর আমি তো পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেই রাখছি। তারা জানতে পারলে আমারে জানাইবে। একটু ধৈর্য রাখো। মেম্বরের এরূপ বিরূপ আচরণে, মাখনলালের চোখদুটি ভিজে যায়। ডুকরে কেদে উঠে। প্রায় এক মাস হতে গেল যে!
হারিস দেওয়ান তার মনের অবস্থা বুঝতে পারে। বলে, তোমার কষ্ট আমি বুঝবার পারি। কিন্তু একটু ধৈর্য ধরো। এই গ্রামে অনেকেরই আপন লোক হারায় গেছে। আমরা কেউই কিছুর কোন সুরাহা করবার পারতেছি না। পুলিশও আসছে কয়েকবার। কোন কিছুর মীমাংসা হয় নাই।
ওইদিকে মিন্টুর বাড়িতে লাশ পড়ে আছে। কেউ সেটা ধরবারও সাহস পায় নাই। এখন সেটা থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। পুলিশকে বলা হইছে। পুলিশেরও দেখা নাই। সবাই আমরা একটা বিপদের মধ্যে আছি। বোঝার চেষ্টা করো।
মাখনলাল মাথা নাড়তে নাড়তে ভীর থেকে এক পাশে নিজেকে সরিয়ে নিল।
শোন, আমরা সবাই খুব চিন্তার মধ্যে আছি। সন্ধ্যার পর কেউ বাড়ি থাইকা বাইর হইবা না। গেরামে কোন পাগলা কুত্তা বা নেকড়ে থাইকা থাকতে পারে। বুড়ো মানুষ, বাচ্চা-কাচ্চা সাবধানে রাখবা। একটু থামল আকবর মেম্বার। একবার মাথা নিচু করে কিছু একটা ভাবলো। তারপর বলল, রহমানরে আমি মন থাইকা ভালবাসতাম। তার এই রকম মৃত্যুতে আমার দিলেও খুব দুঃখ লাগছে!
.
রহমান চাচার দোকানে এখন তার ভাস্তে বসেছে। রহমান চাচার বউ বাচ্চা নেই। অনেক আগেই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে কেউ  তাদের হদিস জানে না।
ভাস্তে এক হাতে চা বানাচ্ছিল, অন্য হাতে একটা একটা করে সবাইকে বিতরন করছিল। দোকানে আজ বেশ লোকজনের জমায়েত হয়েছে। সবাই ভাস্তের কাছে রহমান চাচার বিষয়ে জানতে চাচ্ছে। যদিও ভাস্তে তার কোনো সদুত্তর দিতে পারছে না। সে রহমান চাচার খুব একটা খোঁজখবর রাখে না। আর এখন তো সে একটা লাশ। লাশের এতো খোঁজ নিয়ে কি হবে!
বউ বাচ্চা না থাকায় রহমান চাচার দোকানটি তার কপালে জুটেছে। এটা যে তার জন্য এক ধরনের পরম সৌভাগ্য। তাই সে ফুরফুরে মেজাজে চা বানিয়ে চলছে। এই উছিলায় তার বেকারত্ব যে ঘুচল। বিনা পরিশ্রম, অর্থ ব্যয়ে এরকম একটি দোকানের মালিক হয়ে গেল। তার যে কপালটাই খুলে গেল!
সূর্য প্রায় ডুবি ডুবি করেছে, এরকম সময় শফিক তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ভাস্তের দোকানের সামনে এসে দাড়ালো। তাকে দেখে কয়েকটা অল্প বয়সী ছেলে দ্রুত আসন ছেড়ে উঠে পড়ল।
শফিক মস্তান ওদের দিকে একবার তাকাল, বলল, দিনকাল ভালো যাইতেসে না। তোমরা এখনো বাইরে ঘোরাঘুরি করতাছো কেন?
জে, আমার বাসা একটু সামনেই। আমি চইলা যাইতেই ছিলাম। তার মধ্যে আপনি আসলেন। তাদের একজন বলল। অনেকটা কাচুমাচু করতে করতে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল ছোকরাগুলি।
শফিকের সাথে থাকা সাঙ্গ ভাস্তেকে উদ্দেশ্যে করে বলল, মিয়া ভাইরে মাস্ত এক কাপ চা বানায় দাও।
ভাস্তে মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বিদ্যুৎ গতিতে চায়ের কাপে চিনি ঢালতে শুরু করল। চা পানি ঢেলে নাড়তে শুরু করল। এটা যে ভাইকে খুশি করার মোক্ষম সুযোগ!
রহমান তোমার কেমন ধরনের চাচা ছিল? ভাস্তের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল শফিক।
সে আমার বাবার চাচাতো ভাই। একটু ভেবে উত্তর দেয় ভাস্তে।
হুম সেইটাই ভাবতেছিলাম। শফিক মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ি হাতাতে হাতাতে বলে। রহমান মারা গেল দুইদিন হয় নাই, তুমি আইসা পড়ছো তার দোকান সামলাইতে।
ভাস্তে শফিকের কথার কিছু বুঝলো কিনা বোঝা গেল না। সে তাকে মুগ্ধ করণীয় চা বানাতে ব্যস্ত।
কিছুক্ষণ পরে চামচ দিয়ে কাপে ভালো একটা ঘুটা দিয়ে কাপটা ডান হাতে ধরে বাম হাত ডান হাতের নিচে রেখে আদবী কায়দায় শফিকের দিকে বাড়িয়ে দিল।
কাপটি হাতে নিয়ে শফিক মনে মনে একটু খুশি হলো। ভাবল আদব লেহাজ ভালোই জানা আছে রহমানের ভাস্তের।
তা তোমার চাচা কিভাবে মারা গেল তা তো জানা আছে? কাপটা হাতে নিতে নিতে শফিক লাঠিয়াল বলল। ছেলেটাকে একটু পরীক্ষা করছিল সে।
জে। জানা আছে। কোন এক জন্তু জানোয়ার দোকানে ঢুইকা তারে খাইয়া গেছে। অবলিলায় কথাটি বলে দিল সে। তার বলা তাও শেষ হয় নাই। বলতে লাগলো, বুড়া মানুষ বাড়িতে লোকজন নাই। তাই বইলা রাইত বিরাইতে দোকানে থাকতে হইবো। আর দোকানেরই বা কি হাল। এইখানে ভাঙ্গা, ওইখানে ভাঙ্গা। সামনের কপাটগুলোও ঠিকমতো লাগানোর ব্যবস্থা নাই। শফিক মস্তান শুনছিল আর চায়ের কাপে ফু দিচ্ছিলো। বলে চলল সে, বুড়া হইয়া গেছিল চাচায়। খেয়ালখুশি কইমা গেছিল তাই। আমি আইসা সবকিছু ঠিকঠাক করছি। একনাগাড়ে রহমান চাচার খুঁটিনাটি দোষ-ত্রুটির ব্যাপারে বলছিল সে।
ওয়াক থু ... শফিক চা-টা মুখে দিতেই শব্দ করে ফেলে দিল। কাপটা বেঞ্চের উপর রেখে উঠে দাঁড়ালো। মুখে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করতে করতে বলল, ধুর মিয়া, দিলা তো মেজাজটা খারাপ কইরা। কি বানাইছ এইডা, চা না আর কিছু। কথাটি বলে রাস্তার দিকে পা বাড়ালো শফিক।
তার এক সাঙ্গ ভাস্তের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার দ্বারা দোকানদারি হইব না। বাড়িতে গিয়া বেকার বইসে থাকো। বলেই মুখ ভেংচি দিয়ে শফিকের পিছু হাঁটা দিল।
তারা দোকান ছেড়ে কিছু এগিয়ে যাওয়ার পরপরই মুখ বাঁকিয়ে ওদের কথা নকল করে আপন মনে ভাস্তে বলল, তোমারে দ্বারা দোকানদারি হইবো না! এহ .. নিজেরা এক একটা ভবঘুরে। কাজ পারে না। মস্তানি কইরে বেড়ায়। আবার মানুষরে উপদেশ দেয়!
.
সবুর দেওয়ান একটু রাত করেই বাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল। তার পানাহারের বদঅভ্যাস রয়েছে। এই দুর্যোগের সময়ও সেগুলি থেকে দূরে থাকতে পারছে না। আজ রাতে সে অবশ্য একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছে। বাইক চালানোর সময় সেটা মাঝেমধ্যেই টের পাওয়া যাচ্ছে। একটু পর পর মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। পিচ্ছিল পথে  ক্ষনে ক্ষনে বাইকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। একবার তো বাইকসহ খাদেই পড়ে যাচ্ছিল প্রায়!
কি একটা ভেবে রাস্তার এক পাশে বাইকটা থামাল সবুর দেওয়ান। মাথাটা একবার ঝাকি দিল। হাত দিয়ে চোখ দুটি কচলালো। শরীর বেশি কড়া হয়ে গেছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ির উপরেই কিছুক্ষণ বসে রইলো সে। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার বাইক থেকে অদূরে কেউ একজনকে দেখতে পেল। বাইকের হেড লাইটের আলোয় লোকটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। পাশের নালা থেকে ধীরে ধীরে রাস্তায় উঠে এসেছে। সারা শরীর কাদাপানিতে সিক্ত।
সবুর লোকটাকে উদ্দেশ্য করে হাক দিল, কে ওই খানে?
লোকটা তার কথার কোন জবাব দিল না। রাস্তার ঠিক মাঝখানে এসে স্থির দাঁড়িয়ে পড়ল। এক মুহূর্তের জন্য সবুরের কাছে মনে হল যেন সামনে একটা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক কয়েক মুহূর্ত পরেই সেটির শরীর এক ধরনের ঝাকি দিতে শুরু করলো। মনে হল অবয়বটি কেঁপে কেঁপে উঠছে। সবুরের চোখ দুটি ছোট হয়ে আসে। তার মাথা ঠিক কাজ করে না। এবার ছায়াটি একটু দুলতে শুরু করেছে। সেটির কাঁপুনি আরো বেড়ে গেছে।
আজকে বেশি খেয়ে ফেলেছে সে। মনে মনে ভাবল সবুর দেওয়ান। তাই উল্টাপাল্টা কি সব দেখছে।
একটা ঢোক গিলে আবার হাক ছেড়ে বলল, কে রে ওইখানে? এই রাত দুপুরে আমার সাথে মশকরা করস?
কাদায় সিক্ত অদ্ভুত সেই অবয়বটি তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে। এবার মুখ থেকে এক ধরনের গোঙ্গানির শব্দ বেরিয়ে আসে সেটির। এক ঝটকায় মুখ তুলে তাকায় তার দিকে। যেন সবুরের কথায় চটে গেছে।
সেটির অশুভ চাহনির দিকে তাকিয়ে ব���কটা ছ্যাৎ করে ওঠে সবুর দেওয়ানের। একটু ভয় ভয় লাগতে শুরু করে। ভুত-প্রেত জাতীয় কিছু নয় তো!
পরক্ষনেই নিজেকে আবার সামলে নিল সবুর। ভাবল সব অতিরিক্ত পানাহারের ফল।
হয়তোবা লোকটি কোন চোর ডাকাত। তার হাতে বা আশেপাশে কোন দা চাপাতি নেই তো! ভাবল সে।
আর বেশি কিছু ভাবার সুযোগ পেল না সবুর দেওয়ান। ঠিক পরমুহূর্তেই হাত-পা বাঁকিয়ে কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে তারই দিকে ছুটে আসতে শুরু করল অবয়বটি।
সবুর দেওয়ান কিছুটা বিভ্রান্তির দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে রইল। কাদায় সিক্ত বুড়ো মত কেউ অপার্থিব শারীরিক ভঙ্গিতে এক ধরনের আর্তচিৎকার করতে করতে তার দিকে ধেয়ে আসছে।  
সেটিকে ঠিক চিৎকার বলবে নাকি কোন ধরনের হিংস্র গর্জন সবুর দেওয়ান ঠিক ভেবে পায় না। তার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সৎবিৎ ফিরে পেতেই আর কিছু না ভেবে গাড়িটা স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করে। চাবিটি বারবার ঘুরাতে থাকে। জোরে জোরে ঘোরাতে থাকে। এখন এক মুহূর্ত যে তার কাছে অনন্তকালের সমান। একসময় গাড়িটা স্টার্ট নেয়। মাটিতে পা ভর করে বাইকটিকে উল্টো দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করে সবুর। সপাত সপাত কাদা পানি ছিটিয়ে এক ঝটকায় ঘুরে যায় বাইকটি।
ইতিমধ্যে বুড়ো ছায়াটি অনেকটাই তার কাছাকাছি চলে এসেছে। এখন প্রায় ছুঁই ছুঁই। নিজের অজান্তেই সবুর দেওয়ান এর মুখ থেকে এক ধরনের আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। চোখ বন্ধ করে বাইকের গতি বাড়িয়ে দেয় সে। বুড়োটি এখনো তার পেছন পেছন। মনে মনে পণ করে সবুর দেওয়ান, জীবনে আর কোনদিন এত বেশি মাল খাবে না।
পর্ব ১২ রহিম বক্স মিলিটারির প্রতিবেশীই শুধু নয় বরং তাদের বিপদ আপদের বন্ধু। রহিম বক্সের বিপদে যেমন মিলিটারি এগিয়ে আসে, মিলিটারির ক্ষেত্রেও তাই। ভোর রাতের দিকে কালাম রহিম বক্সের বাড়িতে গেল। রহিম বক্সের শরীর খারাপ কালাম সেটা জানে। রহিম বক্সকে দেখতে বা বিরক্ত করতে সে যায়নি, গিয়েছে একটি সাহায্য চাইতে। অনেকক্ষন দরজায় কড়া নেড়ে, ডাকাডাকি করার পর, ভেতর থেকে ছট্টু জিজ্ঞেস করে, কেডা বাইরে? আমি তোর কালাম চাচা। উঠোনে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় উত্তর দেয় কালাম। জবাব শুনে কিছুক্ষণ পর নিঃশব্দে ঘরের খিল খুলে উঠোনে বেরিয়ে আসে ছট্টু। চাচা! এতো রাইতে! সব ঠিক আছেনি? নারে কোন কিছুই ঠিক নাই। তর বাজানের শরীরটা কেমন আছে? ভালা নাই, চাচা। জর আরো বাড়ছে। কিছু খাইবার পারতাসে না। কথাও উলটপালট বলতাছে। ছট্টু কালামের হাতের দিকে তাকায়। বলে, তোমার হাতে কি হইছে চাচা? কালামের হাত সাদা কাপরে মূড়ানো। সেখানে ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে। একটা দুঃঘটনা ঘটছিল। কি দুঃঘটনা? কালাম কোন উত্তর দেয় না। কিছুক্ষন চুপ করে থাকে তারপর বলে, আমার একটা সাহায্য লাগবো। ছোট্ট একটু অবাক হয়, বলে, কি সাহায্য চাচা? তর ভ্যান গাড়িটা লাগব। ভ্যান গাড়ি। লইয়া যাও। এইডা আবার কবার কি আছে? না। তোরও একটু সাথে আসা লাগবো। কি হইছে চাচা খুইলা বল তো। এবার ছট্টু একটু অবাক হয়। তুই আইতে পারবি কিনা বল। একটু জোর গলায় কালাম বলে। বাজানের যেই অবস্থা। তারে রাইখা আসি কেমনে। ছোট্টু একটু চিন্তিত হয়ে বলে। কালাম একটু নিরাশ হয়। বলে, আচ্ছা ঠিক আছে। বাড়ির দিকে পা বাড়ায় সে। ছোট্টু পেছন থেকে ডাক দেয়, বলে, আইচ্ছা আমি মায়েরে বইলা দেখতাসি। তুমি একটু খাড়াও।   কিছুক্ষণ পরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ছট্টু। বলে, চলো, চাচা। উঠনের এক কোনে পরে থাকা ভ্যানগাড়িটির তালা খুলে সামনে চালিয়ে নিয়ে আসে ছট্টু। উঠ চাচা। কালামের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে। কালাম এক লাফ দিয়ে ভ্যানের পেছনে চড়ে বসে। পা দুটি বাইরে দুলিয়ে দেয়। ছট্টু ভ্যানের প্যাডেলে এক পা দিয়ে একটু দৌড়ে ভ্যানের গতি আসতেই, অন্য পা-টি ঘুরিয়ে চালকের আসনের উপর চড়ে বসে। বাইরে এখনো পুরোপুরি ফর্সা হয়নি। কালাম ও ছোট্টু ভ্যান থেকে সাদা কাফনের কাপড়ে মোড়ানো দুটি লাশ এক এক করে ধরে নিচে নামায়। এই মুহূর্তে ওরা টুটপাড়া কবরস্থানে রয়েছে। কালাম চায় গোপনে বেশি কিছু জানাজানি না করে লাশদুটি দাফন করতে। হাতে কোদাল নিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করে দুজনে। প্রায় ঘন্টা খানেক পর দুজনে মিলে দুটো কবর খুঁড়ে ফেলে। প্রথমে সাদা কাপড়ে মোড়ানো বুড়োর লাশটি দুজনে ধরে কবরের গর্তে রাখে। তারপর গর্তের উপর একটি বাশের চালা বসিয়ে দেয় কালাম। চোখ মুছতে মুছতে  মাটি ছিটিয়ে দিতে শুরু করে। ছোট্টু কুঁজো বুড়ির লাশটি টানতে টানতে পরের গর্তটির কাছে নিয়ে যায়। দুজনে মিলে লাশটি ধরে কবরের মাঝখানটা নামায়। হঠাৎ করেই ছোট্টুর মনে হয় লাশটি যেন কাপড়ের ভেতরে একটু নড়ে উঠেছে। প্রথমে বিষয়টি ধরতে পারেনি সে। তার কাছে মনে হয়েছে, তার মনের ভুল কিংবা লাশটি নিয়ে নাড়াচাড়া করার সময় দেখতে এরকমটা লেগেছে। কিন্তু তার প্রায় কয়েক মুহূর্ত পর লাশটি আবার নড়ে ওঠে। এবার ছোট্টু কিছুটা আঁতকে ওঠে। সে ভাবে সে যা দেখেছে ঠিক দেখেছে। ছোট্টু কালামের দিকে তাকায়, বলে, চাচা তুমি কি কিছু দেখছো? কালাম ওর কথায় একটু অবাক হয়, বলে, কি দেখমু? ছোট্ট কিছু না বলে মাথা নাড়ে। কবরের উপর বাশের চালাটি বসাতে গিয়ে এবার তৃতীয়বারের মতো একই জিনিস লক্ষ্য করে ছোট্টু। লাশটির মাথার দিকটা খানিকটা নড়ে উঠেছে। ছোট্টু সাথে সাথে এক চিৎকার করে ওঠে। কালামকে উদ্দেশ্য করে বলে, চাচা তোমার মায় তো বাইচা আছে! কালাম ছোট্টুর কথাটি শোনার জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিল না। হতভম্ব হয়ে জবাব দেয়, কি? কি বলছ তুই? ছোট্টু আবার বলে, হয় দাদি বাইচা আছে! এদিকে আহো, দেইখা যাও। এই মাত্রই নইড়া উঠছে! কালাম বাশের চালাটি পাশে রেখে ছুটে ছোট্টুর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর স্থির কয়েক মুহূর্ত লাশটির দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পরে ছোট্টুর উদ্দেশ্যে বলে, তোর চোখের ভুল! ছোট্টু কালামের কথাটি বিশ্বাস করে না। আরে আমি একবার না, কয়েকবার দেখছি। দাঁড়াও এইখানে। কথাটি বলে এক লাফে গর্তে নেমে পড়ে সে। তারপর মাথার দিকের মোড়ানো কাপড়টি খোলার চেষ্টা করে। ঠিক ওই মুহূর্তেই লাশটি পাক খাওয়ার মত করে মোচড় দিতে শুরু করে। ছোট্টু সভয়ে কিছুটা পেছনে সরে যায়। কালামের ততক্ষণে মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছে। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই কুজোবুড়ির লাশটি এবার গলা কাটা মুরগীর মত লাফাতে শুরু করে দেয়। তাই দেখে পড়িমড়ি করে গর্তটি থেকে উপরে উঠে আসে ছোট্টু। কি করবে সে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কালাম নিজেও দিশেহারা হয়ে পড়ে। তবে কি তার মায় বাইচে আছে? বাইচে থাকলেই বা কি? সেতো পাগল হয়ে গেছে। বিকালে সে তার যে রূপ দেখছে, তারপর থাইকা তারে আর স্বাভাবিক লাগে না কালামের কাছে। স্ট্রোক নামে নাকি কি এক রোগ আছে, সেইটা হলে মানুষ এরকম পাগলের মত আচরণ করে। তার মায়ের কি সেইরকম কিছু হইল? কালাম চতুর্দিকে একবার তাকায়, বলে, মায়ের শরীরের দাফনের কাপড় খোলা যাইবো না। ছোট্টু জিজ্ঞেস করে, কেন চাচা? তোমার মা তো বাইচে আছে। না খুলে দিলে তো শ্বাস আটকে যাইবে। কালাম কোন কথা না বলে। দ্রুত গর্তের মধ্যে নেমে পড়ে। মাথার দিকের মোড়ানো কাপড়টুকু খুলে দেয়ার চেষ্টা করে। তারপর দড়ি চায় ছোট্টুর কাছে। ছোট্টু এক দৌড়ে তার ভ্যান গাড়ি থেকে এক গোছা দড়ি নিয়ে আসে, বলে, দড়ি দিয়া কি করবা? কালাম বলে, বাধবো। ছোট্টু অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে  কালাম চাচার দিকে তাকিয়ে থাকে। কালাম দাফনের কাপড়ের উপর থেকেই কুঁজো বুড়ি পা-দুটি বেঁধে ফেলে। তারপর দুই হাতের চারপাশ দিয়ে কোমর বরাবর আরেকটা বাঁধা দেয়। এবার সে বুড়ির মাথা মোড়ানো কাপড়ের পুরোটুকু খুলে দেয়। কুজোবুড়ির ভয়ঙ্কর মুখখানা এক ঝটকায় ��েরিয়ে আসে। তার চেহারার হিংস্���তা দেখে ছোট্টুর বুক ধক করে ওঠে। এবড়ো থেবড়ো মুখের চামড়ার উপর জমে যাওয়া ছোপ ছোপ রক্ত। বুড়ির মুখ থেকে অনবরত লালা ঝড়ছে। দাঁতে দাঁত কামড় দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে কিড়মিড় করছে। প্রচন্ড ক্ষুধায় কোন হিংস্র পশু যে রকম আচরণ করে কুজোবুড়িকে দেখে সেরকম কিছু একটা মনে পড়ে গেল ছোট্টর। সে বুঝে উঠতে পারছে না কালাম চাচার মায়ের আদতে কি রোগ হয়েছে। চাচা তোমার মায় কি পাগল হইয়া গেছে? আমি ঠিক জানিনা রে। কালাম সরাসরি উত্তর দেয়। মায়েরে বাড়ি নিয়া যাইতে হইবো। আমারে একটু সাহায্য কর। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কালাম আবার বলে, আমি তার মুখ দড়ি দিয়ে বাধমু। ছোট্টু ভয়ে ভয়ে নিচে গর্তে নেমে আসে। কুঁজো বুড়ি তার মাথা এমনভাবে নেড়ে চলছিল সেটি ধরতে গেলে কামড় খাওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। কালাম তার মাথাটি কোনভাবেই স্থির করে ধরে রাখতে পারছিল না। মাথায় হাত দিতেই সাপের মত ছো মেরে উঠছিল কুঁজো বুড়ি। দুজনে মিলে এদিক ওদিক করে বুড়ির মুখটি বাঁধার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। . হারিস দেওয়ান সগীর মুনসিকে ডেকে পাঠিয়েছে। হারিস দেওয়ানের ছেলে সবুর দেওয়ান তার ঠিক পাশেই মুখ ভার করে একটি কাঠের চেয়ারে বসে আছে। সগির মুন্সি বাড়ির মূল ফটক পেরিয়ে আসতেই, সবুর দেওয়ান ইশারায় তাকে সামনের একটি টুলের উপর বসতে বলে। সগীর মুনসির কাছে সবুর দেওয়ানের হাবভাব ঠিক ভালো ঠেকে না। তার কাছে মনে হয়, কোন একটা গন্ডগোল আছে। সগির মুন্সি ভয়ে ভয়ে সামনের কাঠের টুলটির উপর গিয়ে বসে। সবুর দেওয়ান সগির মুনসির দিকে এক ধরনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায়, তারপর একটু কড়া ভাষায় জিজ্ঞেস করে, তোমার বাপ কয়দিন আগে হারায় গেছিল? সগির মুন্সি কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, তিন চারদিন হইবো। তারপর জিজ্ঞেস করে, কেন সাব? বাজানরে কি পাওয়া গেছে? সবুর দেওয়ান সাথে সাথে তাকে একটি ঝাড়ি দেয়, বলে যেটা জিজ্ঞেস করি শুধু সেইটার উত্তর দিবা। সগির মুন্সি দ্রুত মাথা নাড়ে। তোমার বাপ তো মাঝেমধ্যে রহমানের দোকানে আসতো। সবুর দেওয়ান বলতে থাকে। চা সিগারেট খাইতো। পথে ঘাটে দেখা হইলে সেলাম দিতো। তারে কখনো তো পাগল মনে হয় নাই। একটু কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে সবুর দেওয়ান। তারপর বলে, কাইল রাইতে আমি তারে দেখছি। উত্তর পাড়ার বড় রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরতাছিল। সবুর দেওয়ানের কথাটি যেন নিজ কানে বিশ্বাস করতে পারছিল না সগির মুন্সি। কি বলেন, সাব? আমার বাজান তো পাগল ছিল না? এবার সগিরের উপর বেশ চটে যায় সবুর দেওয়ান। অনেকটা খেঁকিয়ে ওঠে, তবে কি আমি মিথ্যা কথা কইতাছি? সগির মুন্সি সাথে সাথে ডানে বামে মাথা নাড়ে। সবুর দেওয়ান আবার বলে, তোমার বাপেরে আমি কাইল রাইতে দেখছি, ন্যাংটা পাগলের মতো ঘুরতাছিল। মানুষরে ধাওয়া কইরা বেড়াইতাছিল। তারে কি আপনে ধরতে পারছেন? আবার মুখ ফসকে প্রশ্নটি করে ফেলে সগির মুন্সি। প্রশ্নটি করেই নিজের ভুল বুঝতে পারে সে। মাথা নাড়ে। ওই মিয়া! সবুর আবার চেঁচিয়ে ওঠে। বলে, তারে ধরা কি আমার কাজ? তোমার বাপ তুমি গিয়া ধরো। সে বেশ রেগে গিয়ে এবার যেন ফুঁসতে থাকে, আমি যদি আবার শুনি তোমার বাপ গ্রামের আর কাউরে বিরক্ত করছে, তবে আমি তোমারে দেইখা নিমু। কথাটা মনে রাইখো মিয়া। সগীর মুন্সী হারিস দেওয়ানের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। হারিস দেওয়ান এক ধরনের বিরক্তি নিয়ে মুখ থেকে এক গোল্লা থুতু ফেলে। তারপর বলে, সবুর ঠিকই কইছে, তুমি তোমার বাপেরে ধরার ব্যবস্থা করো। এলাকার মানুষেরে সে যেন আর বিরক্ত না করে। সগির নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
পর্ব ১৩ বাড়িতে ঢুকতেই ঘরের ভেতর চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ পেয়ে ভ্যান গাড়িটি উঠোনে রেখে দৌড়াতে শুরু করে ছোট্টু। ভেতরে ঢুকেই দেখতে পায় মিলিটারি আর তার মেজো ভাই তার বাজানের হাতদুটি খাটের দুই পাশ থেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। নিজের স্বামীর পা দুটি বাঁধার চেষ্টা করছে তার মা। তার ডান পায়ে যে আঘাতটি ছিল সেটির ব্যান্ডেজ খুলে ফেলা হয়েছে। আঘাতটি আরো বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। সেটি এখন প্রায় পুরো পা জুড়ে। পূজে ভরে গেছে পুরো ক্ষত স্থানটি। বিভৎস সেই ক্ষত দেখে ছোট্টুর গা রি রি করে উঠলো। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, কি হইছে বাজানের? পাগলের মত হাত-পা ছুড়তে থাকা রহিম বক্স যেন এক মুহূর্তের জন্য ছোট্টুর দিকে তাকালো। ছেলের সাথে যেন তার শেষবারের মতো একবার চোখাচোখি হলো। তার পরক্ষনেই আবার ভয়ঙ্করভাবে আর্তচিৎকার জুড়ে দিলো। পুরো শরীর বাঁকিয়ে মোচড় কাটতে শুরু করলো, যেন সারা শরীরে তার অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। ক্ষুদার্থ মুখে অঝোরে লালা ঝরছে।   রহিম বক্স এর চোখের মনি দুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। তার উপরে এক ধরনের ঝাপসা আবরণ তৈরি হয়েছে। মুখের ভেতর দাঁতের সাথে দাঁত কিড়মিড় করছে সে। যেন প্রচণ্ড ক্ষুধায় ছটফট করছে, ঠিক যেন মিলিটারির মায়ের মতো, একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। একটু আগে ছোট্টু কালামের সাথে তাকে বাড়ি ছেড়ে এসেছে। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছট্টুর দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ে মিলিটারি, আমারে একটু সাহায্য কর! এবার যেন সৎবিৎ ফিরে পায় সে। দ্রুত পায়ে মিলিটারির কাছে এগিয়ে যায়। খাটের কলামের সাথে তার বাপের হাত বাঁধতে সাহায্য করে। অন্য পাশের হাতটি ইতিমধ্যে তারা বেঁধে ফেলেছে। নিচে তার মা পা দুটি খাটিয়ার সাথে বাধার চেষ্টা করছে। খাঁচায় আটকানো জন্তুর মতো ছটফট করতে শুরু করে রহিম বক্স। ধীরে ধীরে তার আর্তনাদটি এক ধরনের গর্জনে রূপান্তরিত হয়। ছোট্টু ব্যাপারটা খেয়াল করে। ঠিক যেন মিলিটারির মায়ের মত, গলার স্বরে পরিবর্তন আসছে তার বাজানেরও। মিলিটারি ছোট্টুর দিকে তাকিয়ে বলে, তোর বাপের মুখটা বাঁধতে হবে। ছোট্টু মাথা নাড়ে, সে জানে এই মুখ বাধাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। . কালাম তার বউ এর উদ্দেশ্য ঠান্ডা গলায় বলে, মায়েরে একটু খাওয়ানো দরকার। তার বউ মুখ বাঁকা করে উত্তর দেয়, তোমার পাগল মায়েরে তুমি খাওয়াও। আমারে বলতাছো কেন? শাশুড়ির এরুপ প্রত্যাবর্তন ভালোভাবে নিতে পারেনি তার বউ। কালাম কোন জবাব দেয় না। অগত্যা নিজের দুর্বল শরীরটাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে। খাবারের হাড়িগুলির দিকে এগিয়ে যায়। শরীরটা প্রচন্ড ক্লান্ত  লাগছিল তার। একটি থালায় করে একটু ভাত, এক টুকরো মুরগির মাংস, ঝোল নিয়ে মাখাতে মাখাতে তার মায়ের খাটের উপর গিয়ে বসে সে। কুঁজোবুড়ি খাটের সাথে শক্ত করে বাঁধা রয়েছে। কালাম কুজোবুড়ির মুখের বাঁধনটি খুলে দেয়। এখন যেন কিছুটা শান্ত রয়েছে কুঁজো বুড়ি। কালামকে কামড়ানোর কোন চেষ্টা করল না সে। কালাম তার মুখে এক গাল ভাত তুলে দেয়ার চেষ্টা করে। কুজোবুরি একটু মুখটা তারদিকে বাড়ায়, সম্ভবত নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকে। তারপর অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কালাম অনেকক্ষণ তাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কুজোবুড়ি কোনভাবেই খাবার মুখে নেয় না। অগত্যা কালাম মুরগির মাংসের টুকরাটি হাতে নিয়ে মায়ের দিকে বাড়িয়ে দেয় কালাম, বলে, ভাত না খাও, মাংসটা নষ্ট কইরো না। কুজোবুড়ি কিছুক্ষণ অন্যদিকে ফিরে থাকে। তারপর কালামের হাতের দিকে তাকিয়ে কি একটা মনে করে, সাথে সাথেই গপ করে মাংসের টুকরোটি মুখে পুরে নেয়। কুজোবুড়ি আগে কখনো মাংস খেতে চাইত না। শাকসবজি ছিল তার পছন্দের খাবার। তবে তার মুখের রুচিতে সম্ভবত পরিবর্তন এসেছে। কালাম ছুটে গিয়ে হাড়ি থেকে আরো কয়েক টুকরা মাংস তুলে আনে। প্রায় সাথে সাথেই তার বউ খেঁকিয়ে ওঠে, বলে, সব মাংস কি তোমার মায়ের পেটে দিবা? আমারার জন্য রাখা লাগবো না। কালাম আবার ফিরে যায় হাড়ির দিকে। এক টুকরো মাংস হাঁড়ির মধ্যে রেখে দেয়। বাকি কয়েক টুকরো কুজোবুড়ি গোগ্রাসে গিলে নেয়। ইতিমধ্যেই কালামের বউ পাশের ঘরের বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়েছে। কালাম ঘরে আসতেই তার বউ তাকে এক ধরনের ইঙ্গিত করে, ইশারায় খাটে ডাকে। কালাম বউয়ের এই ইশারা ভালো করেই জানে। ইশারার ডাকে সাড়া দিতে ভাতের থালাটি মাটিতে রেখে দ্রুত কলসি থেকে পানি নিয়ে হাত ধুয়ে নেয়। তারপর এক লাফে বিছানায় চলে যায়। কালামের বউয়ের গায়ের রং একটু চাপা হলেও, আদতে খুবই সুন্দরী সে, আবেদনময়ীও বটে। যেন খর কুটের ঘরে একটি ঝকঝকে ঝাড়বাতি। মূলত এই কারণে কালাম অনেকটাই তার বউয়ের বসে থাকে। তার কথা মতো উঠাবসা করে। কালামের বউ তার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু একটা হাসি দেয়, বলে, সব ইশারা কি আমারেই করতে হইব? কালাম কোন কথা না বলে বউয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। তার গলায় ঘাড়ে আলতো কামড় দেয়, যেটি তার বউয়ের খুবই পছন্দের। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসতে থাকে মেয়েটির। চোখ দুটি বুজে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলে, আরো দাও! কালাম নিজেও খানিকটা উত্তেজিত হয়ে পড়ে, বউয়ের গলায় আরেকটা কামড় বসায়। তৎক্ষণাৎ তার বউ চিৎকার করে লাফিয়ে ওঠে। এক ঝটকায় কালামকে সরিয়ে দেয়। বিছানা থেকে দ্রুত নেমে দৌড়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কালাম তার ঘাড়ে জোরে একটি কামড় বসিয়ে দিয়েছে। কিছুটা মাংস খুবলে তুলে ফেলেছে! তোমার কি মাথা খারাপ হইয়া গেছে? মায়ের মত পাগল হইয়া গেছো? চিৎকার করে কালামের উদ্দেশ্যে বলে সে, আইসা দেইখা যাও, আমার ঘাড়ে কি করছো! ক্ষতটি দেখাতে দেখাতে বিস্মিত দৃষ্টিতে কালামের দিকে তাকায় সে। কালাম হতভম্ব হয়ে লক্ষ করে কামড়ে বেশ খানিকটা কেটে ফেলেছে সে। কিভাবে ব্যাপারটা ঘটলো সে নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সে তো কখনও এত জোরে কামড়ায় না। নিজের অজান্তেই সে এভাবে দাত বসিয়ে দিতে পারল! কালাম অপরাধী ভঙ্গিতে তার বউয়ের একটু কাছে এগিয়ে যেতে চায়। ঠিক তখনই তার বউ চেঁচিয়ে ওঠে, বলে, খবরদার! আমার সামনে আসবা না। দূরে থাকো। আইজ থাইকা তুমি তোমার মায়ের সাথে পাশের ঘরে থাকবা। কথাটি বলে এক ধরনের আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা নিয়ে কালামের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। (চলবে)
পর্ব ১৪ হাসপাতালের মর্গে পড়ে রয়েছে রহমান চাচার লাশ। কর্তৃপক্ষ কারো কাছে তার লাশটি হস্তান্তর করার সুযোগ পায়নি। রহমান চাচার স্ত্রী-সন্তান নেই। অনেক আগেই তাকে পরিত্যাগ করেছে। কেন করেছে, তারা এখন কোথায় সেটিও কারো জানা নেই। তার একমাত্র যে আপন ভাই, সেও তার লাশের খোঁজ খবর নেয়নি। সেটি সৎকারের জন্য কোন ধরনের ব্যবস্থাও গ্রহণ করেনি। যদিও তার ছেলে রহমান চাচার ভাস্তে তার দোকান দেখভালের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। গ্রামে গ্রামে ভাইরাসের বিষয়টি রটিয়ে পড়েছে। মূলত সেই কারণেই মানুষ অনেকটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। অজানা কারণে গ্রামের মানুষ মারা যাচ্ছে। কেউ ভাবছে অজ্ঞাত কোন জন্তু জানোয়ার মানুষ মেরে ফেলছে, কেউবা ভাবছে অতিপ্রকৃত কোন ঘটনা। মানুষ অজানাকে বড্ড বেশি ভয় পায়। তাই এই বিষয়গুলি যতক্ষণ সুরাহা না হচ্ছে, সেগুলির ব্যাপারে বিশদ জানতে না পারছে, তাদের মধ্যে ভয়-ভীতি কমে আসার সম্ভাবনা নেই। অন্ধকার রাত। প্রহরী একটু আগে মর্গের ভেতর রহমান চাচার লাশটি অন্য একটি কেবিনেটে স্থানান্তর করেছে। লাশকাটা ঘরে কেবিনেট সংকট রয়েছে। হঠাৎ করেই অনেক বেশী বেওয়ারিশ লাশ আসতে শুরু করেছে। লাশগুলি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কারো কাছে হস্তান্তর করা সুযোগ পাচ্ছে না। তাই লাশকাটা ঘরে এক ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। বুড়ো প্রহরীটি মর্গের মূল ফটকের পাশে, একটি চেয়ারে বসে বিড়ি টানছে। ফটকের সামনে উঠোনের মত একটি জায়গা আছে। সেটির আশেপাশটা ঘিরে রয়েছে ঝোপঝাড়। বহু বছর ধরে কেউ সেগুলি পরিষ্কার করেনি। সরকারি সদর হাসপাতালগুলি যেমন হয় আর কি। হটাত মাঝে মাঝেই দুই একটা রাত জাগা পাখি গাছগুলির মগডাল থেকে ক্ষণে ক্ষণে ডেকে উঠছে। চারিপাশ থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ কানে আসছে। এগুলি অবশ্য প্রতিদিনকার ঘটনা। বুড়ো প্রহরী এসবে অভ্যস্ত। তবে আজকের রাতটা কেন জানি তার কাছে অন্যরকম মনে হল। মনে হল অলুক্ষনে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। অনেক বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা তার। খারাপ কিছু আগে থেকেই আঁচ করতে পারে সে। হঠাৎ করেই লাশকাটা ঘর থেকে এক ধরনের শব্দ ভেসে আসে। বুড়ো প্রহরীর অভিজ্ঞ কান সাথে সাথে খাড়া হয়ে যায়। রাত বিরাতে ইঁদুর-বিড়াল ঘুরে বেড়ায় চারিদিক। বিভিন্ন ধরনের শব্দ করে। কিন্তু এই শব্দটি সেরকম কিছুর সাথে মেলাতে পারছে না সে। বুড়ো প্রহরী সিঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়ায়। হাতের জ্বলন্ত বিড়িটি সামনের উঠোনে ছুঁড়ে ফেলে। তারপর লুঙ্গিটি ভাজ করে তুলে সিঁড়ি বেয়ে সামনে এগিয়ে যায়। শব্দটি সম্ভবত লাশ কাটা ঘরের কোন কেবিনেট থেকে আসছে। কেবিনেট এর ভেতরে কোন ইদুর বিড়াল ঢুকে পড়ল কিনা। কিন্তু এত বছরের অভিজ্ঞতায় সেটি কখনো ঘটতে দেখেনি সে। তাছাড়া সম্ভবও না সেটা। কেবিনেটগুলি তালাবদ্ধ থাকে। লাশকাটা ঘরের সামনে পৌঁছাতেই হাতের চাবি দিয়ে খট করে তালাটি খুলে ফেলে বুড়ো। ভেতরে ঢুকতেই টের পেল সামনের কেবিনেটগুলির কোন একটা থেকে আসছে শব্দটি। বুড়ো সেটি বোঝার জন্য কান পেতে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করে। উপরে কোনার একটি কেবিনেট থেকে শব্দটা আসছে। বুড়ো খুব সাবধানে সেই দিকটায় এগিয়ে যায়। লাশ ঘরটির পরিবেশ স্বাভাবিকভাবেই খুব শীতল। ইঁদুর-বিড়াল এই দিকটায় কমই আসে। তাছাড়া প্রতিটি কেবিনেট তালাবদ্ধ। কোন প্রাণীর পক্ষে সেটির ভেতরে ঢোকা সম্ভব নয়। এত বছরের চাকুরি জীবনে সে এরকম ঘটনার সম্মুখীন হয়নি। শব্দটি এক ধরনের ভেতরকার দিক থেকেই আসছে বলে মনে হয় তার কাছে। হতে পারে সেটি দেয়ালের পেছন থেকে আসছে। বুড়ো অতিপ্রাকৃত বিষয়ে বিশ্বাস যে করে না ঠিক তা নয়। আবার এত বছরের  অভিজ্ঞতায় এরকম ঘটনা ঘটেনি সেটিও নয়। হঠাৎ করেই কেউ যেন কেবিনেটের দেয়ালে জোরে একটি শব্দ করল। বুড়ো সভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে সেই দিকে তাকিয়ে রইল। তার হৃদস্পন্দন বহুগুন বেড়ে গেছে। অন্য কেউ হলে হয়তো কেবিনেটটি ধারার সাহস পেত না। কিন্তু আধি-ভৌতিক বহু ঘটনার অভিজ্ঞতা যে রয়েছে তার। বুড়ো সন্তর্পনে কোমরে গোজা চাবির ছড়া থেকে কেবিনেটের চাবিটি বের করল। কাঁপাকাঁপা হাতে চাবি ঘুরিয়ে কেবিনেট খুলে ফেলল। আস্তে আস্তে ট্রেটি টেনে লাশটির অর্ধেকটা বের করল। বের করে যা দেখল তা এই জীবনে কখনো দেখেনি সে। রহমানের লাশটি ক্ষণে ক্ষণে সাপের মত পাক খেয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তারই প্রেক্ষিতে ভাঙ্গা হাড় বেরিয়ে থাকা তার অর্ধ খাওয়া হাতটি কেবিনেটের দেয়ালে বারি খাচ্ছে। এরকম ভয়ানক একটি দৃশ্য দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা বুড়ো। আচমকা এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে কেবিনেটটি খোলা রেখেই দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। তারপর উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে মুহূর্তেই কোথাও হারিয়ে গেল। . কালামের বউ স্টিলের ট্রাংকটিতে তার কাপড়-চোপড় গোছাতে শুরু করেছে। সে আর কালামের সাথে থাকবে না বলে মন স্থির করেছে। আজি বাপের বাড়ি চলে যাবে। কালাম তার মায়ের মতো পাগল হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন তাকে মাংস খাওয়ায়। প্রথমে রাধা মাংস খাওয়ালেও, এখন সে কাঁচা মাংসই কোথা থেকে জোগাড় করে নিয়ে আসে। মাকে খেতে দেয়, এমনকি নিজেও খায়। তার আচরণ এতোটাই অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে যে, তার সাথে থাকাটা এখন এক ধরনের ভীতিকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কালাম তার মায়ের ঘরে বসে, তাকে মাংস খাওয়াচ্ছে। তার বউ স্টিলের ট্রাংকটি টানতে টানতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। তারপর রওনা করেছে তার বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে। কালাম ভেতরে বসে কিছু শুনতে বা বুঝতে পারল কি না তা নিয়ে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
১৫. হাসেম অস্থিরভাবে ছুটে ঘর থেকে বের��য়ে আসে। সামসুর ঘরে কয়েকবার কড়া নেড়ে একটু দুরে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। শামসুর বউ দরজা খুলতেই সামসুকে সে ডেকে দিতে বলে। সামসু ঘরে বসে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছিল। বউয়ের কথা শুনে সে তড়িঘড়ি করে পাখাটি বিছানায় রেখে বাইরে বেরিয়ে আসে। হাশেমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিরে কি হইছে, হাসু? বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে হাসেম বলে, আমার খুব শ্বাসকষ্ট হইতেসে। পায়খানা দিয়ে রক্ত যাচ্ছে। আমি মনে হয় ভাইরাসে আক্রান্ত, মিয়া ভাই! কথাটি শুনে শামসু তার দিকে পা বাড়াতে যায়। উঠোনে নেমে আসতে গেলেই, হাসেম বাধা দেয়, বলে, আমার সামনে আইসো না। ওইখানেই থাকো। হাসেমের চেহারায় গভীর চিন্তার ছাপ। মৃত্যুভয় তাকে পুরোপুরি কাবু করে ফেলেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে হতভম্ব সামসু হাসেমের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, কি উত্তর দিবে, কি করবে, কিছুই সে বুঝে উঠতে পারছে না! . বিকেল পেরিয়ে রাত গড়িয়েছে। রহিম বক্সকে কোনভাবেই শান্ত করতে পারছে না মিলিটারি। তার মুখে শক্ত করে এটে কাপড় বেঁধে দেয়া হয়েছে। তাতে করে তার আর্তচিৎকার কিছুটা কমে আসলেও অস্থিরতা একটুও কমেনি। সারাদিন খাটের উপর কুমিরের মতো উল্টানোর চেষ্টা করেছে সে। যেন তার শরীরের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণায় সে গলা কাটা মুরগীর মত কাতরাচ্ছে। তার উপর এরকম ধস্তাধস্তিতে কয়েকবার তার হাতের বাধন ঢিলা হয়ে যায়। মিলিটারি ও ছোট্টু মিলে বাঁধনগুলি আবার শক্ত করে এটে দেয়। সবাই তারা ঘরের ভেতর একপ্রকার বন্দী। তার ওপর সারাদিন সারাক্ষণ রহিম বক্স এর উপর নজর রাখাটাও বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে দাড়িয়েছে। কেউ তাকে না পারছে ছেড়ে দিতে, না পারছে ছেড়ে যেতে। শুধু রহিম বক্সের পরিবারই নয়, মিলিটারির নিজেরও যে তার উপর মায়া পড়ে গেছে। রহিম বক্স ছিল তার বড় ভাইয়ের মতো। এমনকি কালামের চেয়ে রহিম বক্স এর সাথে তার বেশি ওঠাবসা ছিল। ইতিমধ্যে রহিম বক্স এর চোখ দুটি আরো ঘোলাটে হয়ে এসেছে। মুখ দিয়ে এক ধরনের আর্তনাদ বের হচ্ছে। যেন ক্ষুদায় অস্থির হয়ে উঠেছে সে। হঠাৎ করেই বাইরে এক ধরনের জান্তব আর্তচিৎকারের শব্দ শুনতে পায় মিলিটারি। ছোট্টুর দিকে তাকিয়ে চোখ দুটি বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে যায় তার। চিৎকারটি কোন সাধারণ মানুষের নয়। যেন অতিপ্রাকৃত কোন জন্তুর। ছোট্ট একদম চুপ মেরে যায়। কান খাড়া করে শব্দটি শোনার চেষ্টা করে সে। চিৎকার থামে না, একনাগাড়ে হতেই থাকে। রহিম বক্স এর বউ ব্যাপারটির ভয়াবহতা বুঝতে পেরে তার ছোট ছোট বাচ্চাদুটিকে নিয়ে ঘরের এক কোণে বসে পড়ে। চিৎকারটি অনেকটা তাদের উঠোন অবধি এসে পড়েছে। মিলিটারি বিদ্যুৎবেগে ছুটে গিয়ে ভাল করে দরজার খিলটি আটকে দেয়। ছোটুকে জানালাগুলি পরীক্ষা করে দেখতে বলে। ছোট্টু একে একে প্রত্যেকটি জানালার খিলগুলি শক্ত করে আটকে দেয়। মেজো ঘরের কোন থেকে একটি বাশ যোগাড় করে মিলিটারি হাতে এনে দেয়। মিলিটারি বাশটি শক্ত করে হাতে ধরে চুপচাপ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আর্তচিৎকারটি এবার যেন এক ধরনের গোঙ্গানির মত গরগর শব্দে রূপ নেয়। তারপর হঠাৎ করেই দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে কেউ একজন বলে ওঠে, মিয়া ভাই। ও মিয়া ভাই। কণ্ঠটি কালামের। মিলিটারি চিনতে পারে। কিন্তু খানিকটা বিকৃত। তার গলার স্বরে এক ধরনের  পরিবর্তন এসেছে। ছোট্টু তড়িৎ গতিতে দরজার খিলটি খুলতে গেলে, মিলিটারি তার হাতটি চেপে ধরে। ইশারায় তাকে থামতে বলে। রহিম বক্স এর পায়ের দিকে একবার তাকায় মিলিটারি। রহিম বক্সের পায়ের ক্ষতটি ধীরে ধীরে আরো বিস্তৃতি লাভ করেছে। দকদক করছে চারিপাশ। পুজ দিয়ে ভরে উঠেছে। কালামের হাতেও রহিম বক্সের মতই একটি আঘাত আছে। কুঁজো বুড়ি তার হাতটি কামড়ে দিয়েছিল। এবার যেন ঠিক দরজার ওপাশে এসে বসে কালাম। ডুকরে কেঁদে ওঠে, এক ধরনের ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠে, সবাইইই আমারারেরেরে ছাইড়াড়াড়া চইলালালা গেছেছেছে! তার স্থূল গলার স্বরটি ভিশন অস্বাভাবিক লাগে ছোটুর কাছে। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তার। কালাম তার বিকট গলায় প্রলাপ বকতে থাকে। আর বলতে থাকে, দরজাটাটাটা খোলো... তারপর হঠাৎ করেই যেন রেগে ফুঁসে ওঠে। আবার সেই হিংস্র আর্তনাদ করতে শুরু করে। তার চিৎকারে  আশেপাশের নীরবতা ভেঙে খানখান হয়ে যায়।   মিলিটারি বুঝতে পারে কালাম ��ীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে যাচ্ছে। কালামকে কোনোভাবেই ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেয়া যাবে না। . এদিকে সদর হাসপাতালে সকাল থেকে সারাদিন রহমানের লাশটি খুঁজে চলছে পুলিশ। অবশেষে সেটি না পেয়ে তারা হাসপাতালে খোঁজ বন্ধ করে চলে গেছে। পুলিশ প্রহরী বুড়োর কাছে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেও, তেমন কোন তথ্য বের করতে পারেনি। বুড়ো রাত্রিতে ভয়ে আতঙ্কে কেবিনট খুলেই পালিয়ে গিয়েছিল। তারপরে কি হয়েছে তার আর কিছুই জানা নেই। এদিকে হাসপাতাল থেকে রোগীরা একে একে চলে যেতে শুরু করেছে। এই ঘটনার পরে পুরো হাসপাতাল জুড়ে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। সারাদিনে হাসপাতালের প্রায় অর্ধেক রোগী ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। শুধুমাত্র পুরুষ ওয়ার্ডসহ অন্যান্য কিছু কেবিনে কয়েকজন মুমূর্ষু রোগী রয়ে গেছে। পুরুষ ওয়ার্ডের একজন মুমূর্ষু রোগী অবিরত কাতরাচ্ছিল। তার সাথে শুধু তার ২০-২২ বছরের ছেলেটি হাত ধরে বসে ছিল। অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকলে, ছেলেটি দ্রুত পায়ে ডাক্তার ডাকতে বেরিয়ে যায়। বাইরে চারপাশটা গাড় অন্ধকারে ঢেকে গেছে। এদিকে মুমূর্ষু রোগীটির প্রাণ বায়ু বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। পুরুষ ওয়ার্ডে দশটি বেড থাকলেও আজকের ঘটনার পরে বাকি যে কয়েকটি রোগী ছিল ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। হঠাৎ কিছু একটা যেন বাইরের সিঁড়ি ঘর দিয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসতে শুরু করেছে। একটা অবয়ব, একটি হাত নেই। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অবয়বটি পুরুষ ওয়ার্ডের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। চারিপাশে একবার তাকিয়ে সেটির চোখ কাতরাতে থাকা মুমূর্ষ রোগীটির উপরে গিয়ে পড়ে। মুখ থেকে এক ধরনের বিকৃত শব্দ করে অবয়বটি। রোগীটি বিছানায় পড়ে শেষবারের মতো কাতরাচ্ছিল, এই যেন প্রাণ বায়ু বের হতে চলেছে। . কালাম সজোরে দরজায় আঘাত করে চলছিল। এবার যেন সে প্রায় পুরোপুরি তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। এদিকে হঠাৎ করেই মিলিটারির মনে হয় উঠোনে আরও কেউ একজন কালামের সাথে যোগ দিয়েছে। অস্ফূট একটা গলার স্বর শুনতে পাচ্ছিল সে, যেন বিড়বিড় করছে। দাঁত কিড়মিড় করছে। কালাম রয়ে রয়ে হিংস্রভাবে চেঁচিয়ে উঠছিল। এদিকে রহিম বক্সের অস্থিরতাও যেন আরও বেড়ে গেছে। সে এক ধরনের ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে। কুমিরের মতো উল্টে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ অস্থিরতা করতেই তার একটি হাত খাটের কলামটি থেকে কিছুটা ঢিলা হয়ে আসে। দেখে মনে হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই সে হাতটি ছাড়িয়ে নেবে। ঘরে বাইরে দুই জায়গায়তেই যেন অবস্থা আরো সংকটপূর্ণ হয়ে পড়ছে। মিলিটারি দৌড়ে রহিম বক্সের স্ত্রীর কাছে ছুটে যায়। বলে, ভাবী, তুমি ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে ওদেরকে নিয়ে বেরিয়ে যাও। রহিম বক্সের স্ত্রী তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, তোমার কি হবে মিলিটারি? মিলিটারি কোন উত্তর করে না। বলে, আমরা এই ঘরের ভেতরে আর এক মুহুর্ত নিরাপদ না। মিলিটারি পেছনে তাকিয়ে দেখে রহিম বক্স তার হাতটি খাটের কলাম থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেই চলছে। রহিম বক্স এর স্ত্রী তার ছোট ছোট বাচ্চাদুটির একটিকে কোলে তুলে নেয়, অন্যটির হাত ধরে পেছনের দরজার দিকে এগিয়ে যায়। তার পেছন পেছন মেজটা দরজার দিকে পা বাড়ায়। মায়ের মমতা নিয়ে ছোট্টুর দিকে একবার তাকায় সে। দ্রুত চোখের পলক ফেলে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করে ছোট্ট। নিচের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি মিলিটারি চাচার সাথে থাকমু। ছেলের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটি ছ��� ছল করে ওঠে তার। কিন্তু ছোট্টর দৃঢ় মানসিকতা, তাকে ফিরে যেতে বাধ্য করে। আঁচলে চোখ দুটি মুছতে মুছতে পেছনে দরজা খুলে বাইরে পা দেয় রহিম বক্সের স্ত্রী। মেজ তার অন্য ভাইটিকে কোলে তুলে নেয়। তারপর খুব দ্রুতই পেছনের ঝোপঝাড় গুলির ভেতর তারা হারিয়ে যায়। রওনা করে কোন এক অজানার উদ্দেশ্যে। মিলিটারী দরজার দিকে ফিরে শক্ত হাতে বাশটি ধরে থাকে। ছোট্টু রহিম বক্সের হাতটি পুনরায় বেঁধে ফেলার চেষ্টা করে যেতে থাকে। (চলবে)
১৬. পশুর মত হিংস্র কালাম এক সময় সজোরে এক ধাক্কা দিয়ে পুরো দরজাসহ ঘরের ভেতর উপুড় হয়ে পড়ে। মিলিটারি টাল সামাল দিতে না পেরে দরজার একপাশে উলটে পড়ে। হাতে ধরে থাকা বাশটি একটু দূরে ছিটকে পড়ে যায়। এদিকে রহিম বক্স প্রচণ্ড রকমে ধস্তাধস্তি জুড়ে দিয়েছে। একটি হাত খাট থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে, অন্যটি প্রায় খুলে যাচ্ছে। তার হাতের এক ধাক্কায় ছোট্টু উল্টে ঘরের কাঠের আলমিরার সাথে সজোরে এক বাড়ি খেয়ে নিচে বসে পরে। তারপর আস্তে একপাশে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এদিকে মিলিটারি কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করে। তার কাছে মনে হয় কয়েক মুহূর্তের জন্য তার চারপাশটা অন্ধকার হয়ে আসছে। তার পা দুটি অসাড় হয়ে আসছে। কোনরকমে কনুইতে ভর করে বাশটির দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে মিলিটারি। হঠাৎ তার পিছনে একটি ঘরঘর শব্দ হলে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পায়, কালাম মাটির উপর হাঁটু ভাঁজ করে উঠে বসেছে। মিলিটারির দিকে তাকিয়ে তার মাথাটি একদিকে একটু কাত করে বাঁকিয়ে ফেলেছে, যেন স্থির দৃষ্টিতে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করেছে। কয়েক মুহূর্ত পরেই বাদরের মত এক লাফ দিয়ে মিলিটারির উপর আছড়ে পড়ে কালাম। মিলিটারি কোনরকমে তার দিকে ফিরে দুই হাতে সজোরে তাকে ঠেকানোর চেষ্টা করে যায়। কালাম মিলিটারির মুখের সামনে মাথাটি নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে, কিছু একটা বলার চেষ্টা করে কিন্তু তার গলা দিয়ে অস্ফূট গরগর শব্দ ছাড়া আর কিছুই বের হয় না। যেন এক ধরনের গোংগানীর মত শব্দ সেটি। তার সেই ভাষা বোধগম্য হয় না মিলিটারির কাছে। মিলিটারির মুখের উপর কামর বসানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে কালাম। মিলিটারি কোন রকমে তার বুকে, গলায় হাত দিয়ে তাকে প্রানপণে ঠেকানোর চেষ্টা করে। এই দিকে ঘরের দরজায় অন্য আরেকটি অবয়ব আবছা দেখতে পায় মিলিটারি। একটি বীভৎস চেহারার ছায়া দাড়িয়ে আছে দরজায়। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। চোখ দুটি ঘোলা, ছানির মত এক ধরনের সাদা পর্দা পড়েছে। চেহারাটি বিকৃত, বুড়ো। চামড়া এবড়ো থেবড়ো। অন্যদিকে রহিম বক্স তার অন্য হাতটিও ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে ফেলেছে। পর মুহুর্তেই খাট থেকে লাফিয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়েছে। গড়িয়ে গড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্ত তার পা দুটি খাটের অন্য দুটি কলামের সাথে আটকে থাকায় অনবরত হাতের নখ দিয়ে মাটিতে আচড়ে যাচ্ছে। এদিকে তাকিয়ে দাত কিড়মিড় করছে। মুখ দিয়ে কুকুরের ঘেউ ঘেউ এর মত এক ধরনের আর্তনাদ করে চলছে। মিলিটারি ঘরের চারপাশটায় একবার তাকায়। ছোট্টু মাটিতে লুটিয়ে আছে। সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছে। একবার মুখ হা করে ছোট্টুকে ডাকার চেষ্টা করেও আবার চুপ হয়ে পড়ে সে।   কারন হিংস্র বিভৎস লাশগুলির দৃষ্টি এখন মিলিটারি দিকে। ছোট্টুর নিথর দেহের দিকে কারো খেয়াল নেই। কোনভাবে সেগুলির নজর তার দিকে চলে গেলে তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে বাচ্চা ছেলেটিকে। কালাম তখনো কামড় বসিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। মিলিটারি প্রানপনে তার কামড় থেকে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রান চেষ্টা করছিল। কারণ সে জানে এই জন্তুটি কামড় দিয়ে বসলে আর তার রক্ষে নেই। এখনো বাশটি মিলিটারির হাত থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বাশটি পেলেই মিলিটারি কালামকে কোনভাবে আঘাত করে সরিয়ে দিতে পারত। যদিও কালাম প্রচন্ড ক্ষিপ্রগতির, হিংস্র পশুর ন্যায়। তবে শক্তিতে কোন রাক্ষসের মত নয়, যে তাকে হারানো সম্ভব না! তবে এটাও ঠিক তার সাথে খালি হাতে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। অনেকক্ষণ চেষ্টার পরেও মিলিটারি কালামের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারল না। অনেকটা অসহায়ভাবেই আত্মসমর্পণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। তার শরীরের সব শক্তি যে ফুরিয়ে আসছে। জীবনে লড়াই করেছে সে। অন্য দেশের সৈনিকের সাথে। মানুষের সাথে। কিন্তু এরকম অতিপ্রাকৃত কিছুর সাথে লড়াইয়ের অভ্যাস যে তার নেই। তবে জীবনে অনেক কিছুই প্রথমবারের মতো করতে হয়। অনাকাঙ্খিত ভাবেই সেটির মোকাবেলা করতে হয়। তাই আজ বাঁচতে হলে তাকে এটির সাথে লড়াই করেই বাঁচতে হবে। শেষ নিঃশ্বাস অবধি এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সে যে কাপুরুষ নয়! যেটি এই গ্রামের অনেকেই মনে করে। সে যুদ্ধ ছেড়ে চলে এসেছে ঠিকই কিন্তু এই ভয়ংকর যুদ্ধে হারবার জন্য নয়। চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসে মিলিটারির। সৃষ্টিকর্তাকে একবার স্মরণ করে। কারন এই যুদ্ধে বাচতে যে ভাগ্যের সহায়তাও একটু প্রয়োজন! হঠাৎ করেই রহিম বক্স পেছন থেকে কালামের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রহিম বক্স কোনভাবে খাটের কলামগুলি থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে নিয়েছে। খাটের কলামের একটি ভাঙ্গা কাঠের অংশ তার পায়ের সাথে দড়ি দিয়ে ঝুলছে। রহিম বক্সের অতর্কিত হামলায় কালাম ভারসাম্য হারিয়ে এক পাশে পরে যায়। কালাম উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই দুজনে জড়াজড়ি করে মাটিতে ছিটকে পড়ে। শুরু হয় তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি। সে এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। দেখে মনে হচ্ছিল বাঘে-সিংহের লড়াই লেগেছে। চিৎকার হুংকারে চারিদিকটা গমগম করে উঠছে। কথায় আছে ভাগ্য সাহসীদের সঙ্গ দেয়। মিলিটারি এই সুযোগে কোন রকমে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে বাশটির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এদিকে অন্য অবয়বটি তার নড়াচড়া দেখতে পেয়ে হিংস্র বেগে চিৎকার করতে করতে তার দিকে ছুটে আসতে থাকে। মিলিটারি বাশটি কোনরকমে হাতের নাগালে পেতেই সেটি ধরে বুড়ো লাশটির মুখে সজোরে একটি আঘাত করে বসে। এক আঘাতে সেটি ছিটকে ঘরের বেড়ার সাথে গিয়ে আছড়ে পড়ে। মুহূর্তেই মিলিটারির রক্তের ভেতর দিয়ে এক ধরনের উষ্ণ স্রোত বয়ে যায়। সে নিজের ভেতরে এক ধরনের সাহস ও শক্তি অনুভব করে। মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায়। দৌড়ে ছোট্টু কাছে এগিয়ে যায় মিলিটারি। তার গালে কষে কয়েকটা থাপ্পর দেয়। এতে কিছুটা যেন কাজ হয়। ছোট্টু অল্প করে তার চোখের পাতাগুলি মেলে তাকায়। মিলিটারি তার হাত ধরে টেনে ঘরের পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ছোট্ট কিছু একটা বুঝতে পেরে দুর্বল ভঙ্গিতে ভাঙ্গা ভাঙ্গা পায়ে মিলিটারির সাথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। মিলিটারি পিছনে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। অন্য অবয়বটিও ইতিমধ্যে রহিম বক্স এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যেন তিন ভয়ঙ্কর হিংস্র দানবের লড়াই চলছে। তাদের গর্জনে চারিদিকটা গমগম করে উঠছে। মিলিটারি এই অন্ধকার ঝোপের মধ্য দিয়ে কোনরকমে ছোট্টুকে টেনে হেচড়ে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। পেছনে তাকানোর সময় যে নেই তার।
১৭| ছুটে চলছে মিলিটারি। দিগিত্তিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটে চলছে যতদূর চোখ যায়। ছোট্টু মাঝেমধ্যেই থেমে যাচ্ছে। বসে পড়ে হাপাচ্ছে। মিলিটারি আবার তার হাত টেনে ধরে তুলছে। জোর করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। জঙ্গল ঝোপঝাড় পেরিয়ে একটি ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে ছুটে চলছে তারা। ছুটে চলছে কোন এক অজানা গন্তব্যে। মিলিটারি জানে না এই যাত্রায় রহিম বক্সের রক্ষা হবে কিনা। হয়তো বাকিরা তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে। অথবা হতে পারে তার ভাই কালাম তাদের হাতে মারা পড়বে। মিলিটারির চোখদুটি জলে ভিজে যায়। একে একে সবাইকে হারানোর বেদনা যেন তাকে গ্রাস করে ফেলছে। এ যে যুদ্ধের চেয়েও ভয়ংকর, অবর্ণনীয় নিষ্ঠুর এক লড়াই। এখানে লড়তে হয় নিজের আপন মানুষের সাথে। তকালই যে ভাইটির সাথে কথা হয়েছে, রাগারাগি খুনসুটি হয়েছে। আজই তার সাথে লড়তে হচ্ছে। তাও সেটি কি কারনে! ভাবতেই গা শিউরে উঠে যেন! ভাই ভাইকে ভক্ষণ করতে চাচ্ছে। পিতা-পুত্রের মাংস খেতে চাইছে। এটি কি মানুষ কোনদিন কল্পনাও করতে পেরেছে! দুই দিন আগেই যে ছোট্টু বাবা বাবা করেছে, বাবার হাতের খেলনার জন্য অপেক্ষা করেছে, আজ সেই ছোট্টু বাবার হাতে ভক্ষনের ভয়ে গ্রাম ছাড়া হচ্ছে। এ যেন নরকের ভয়াবহতাকেও হার মানায়। রক্ষক যে ভক্ষকে পরিণত হয়েছে। এই নিষ্ঠুরতার শেষ কোথায়? জানে না সে। নাকি এটি সবে শুরু? তাও জানে না। মানবজাতি কি পারবে এই ভয়াবহতাকে পরাস্ত করতে? অতীতে অনেক যুদ্ধ হয়েছে পৃথিবীতে কিন্তু এরকম কোন যুদ্ধ তো ঘটেনি। মানুষ কি পারবে এই নতুন যুদ্ধে জয়ী হতে? নাকি হেরে যাবে! চলে যাবে বিলুপ্তির পথে। মিলিটারির চোখদুটি ছল ছল করে ওঠে। বুকের ভেতর থেকে বোবা কান্না বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু তাকে যে শক্ত হতে হবে। এখন যে হেরে গেলে চলবে না। যতক্ষণ প্রাণ আছে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ছুটতে ছুটতে ছোট্টুর দিকে একবার তাকায় সে। এই দৌড়ঝাপে যতটা না সে ক্লান্ত তার চেয়ে বেশি ক্লান্ত মানসিকভাবে। ষোল কি সতের বয়স তার। এই বয়সে এরকম ভয়াবহতার সাক্ষী হতে হয়েছে তাকে। দুই দিনের ব্যবধানে পরিবার-পরিজনের সবাইকে হারাতে হয়েছে। তাও তো সে বুকে একটি আশা বাধতে পারে, তার মা ভাইদের ফিরে পাওয়ার। কিন্তু মিলিটার? সে তো সবাইকে হারিয়েছে। মাকে হারানোর ক্ষত না শুকাতেই ভাইকে হারাতে হয়েছে তাকে। মিলিটারি জানে না কালামের উপর রহিম বক্স কেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? হতে পারে মিলিটারি কালামের নিচে ছিল, তাই রহিম বক্স এর কাছে কালামের গতিবিধি নজরে পড়েছে। এই লাশগুলি কোন ধরনের গতিবিধি লক্ষ্য করলেই সেটির উপরে ঝাপিয়ে পড়ে। ছোট্টু নিথর হয়ে পড়েছিল, ছোট্টুর উপর কেউ আক্রমণ করেনি। মিলিটারি ছুটাছুটি করেছে তার ওপরই হামলা হয়েছে। ভোরের আলো কিছুটা ফুটে উঠছে। মিলিটারির চোখের পাতা দুটি ভারী হয়ে আসছে। পা দুটি অসাড় হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে কতদিন ঘুমায় না সে! কত বছর ধরে না জানি দৌড়ে চলছে! . সকাল হতেই সামসু ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। ছুটতে থাকে গঞ্জের পথে। হাশেমের জন্য ওষুধ আনতে হবে যে। হাসেমের শ্বাসকষ্ট এর রোগ আছে। তাছাড়া জ্বর পায়খানার ওষুধও তো লাগবে। হাসেমকে সাহায্য করার কেউ নেই। স্ত্রী আর মাকে সপ্তাহখানেক আগেই সে চাচার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। নিজের অসুস্থতার জন্য তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু এখন সে যে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সামসু ছাড়া তাকে সাহায্য করার আর কেউ যে নেই। বেশ কয়েকদিন পর ঘর থেকে বেরিয়েছে সামসু। ইতিমধ্যে যেন গ্রামে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। অনেকেই গ্রাম ছাড়া হয়ে পড়েছে। ঘরগুলি শুন্য। গোয়াল ঘর শুন্য। পশুর বিচরণ নেই। মাঠে কৃষক নেই। রাস্তায় মানুষজন নেই। রহমান চাচার দোকানটিও বন্ধ। যেন কোথাও যুদ্ধ লেগে গেছে। মানুষ গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে গেছে। কিছু কিছু ঘর বাড়িতে মানুষ থাকলেও ঘরের জানালা দরজা সব বন্ধ করে রেখেছে। যেন বাইরে বাঘ ভল্লুক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বের হওয়া বারণ। একটা সময় গঞ্জে এসে পৌঁছায় সামসু। কিন্তু এখানে এসে সে যেন আরো হতবাক হয়ে যায়। দোকানপাট কিছুই খোলা নেই। সব বন্ধ। দেখে মনে হয় দীর্ঘদিন যাবত এই দোকানগুলির কপাটটিও কেউ খোলেনি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটি ওষুধের দোকান খোলা পেল সামসু। এক দৌড়ে দোকানটির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই, দোকানদার হকচকিয়ে তার দিকে মাথা তুলে তাকালো। তাকে দেখেই আতঙ্কে এক ধরনের  চিৎকার বেড়িয়ে এল তার গলা থেকে। শামসু না তুই! সামসুর দিকে তাকিয়ে বলল লোকটি। সামসু লোকটিকে চিনতে পাড়ল৷ তার বাবা মা বেঁচে থাকতে অনেকবার বাড়িতে এসেছে। মায়ের হাতে রান্না খেয়েছে৷ ইসহাক চাচা! সামসু কিছুটা খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো। তুই বাইরে কি করছ? তোর তো ঘরের ভিতর বন্দি থাকার কথা! তার ইসাক চাচা যেন তাকে দেখে খুব একটা খুশি হতে পারেনি। সামসু হাত নেড়ে তাকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু যেন অবুঝের মতো তার কোন কথাই শুনতে পায় না সে। দোকানের কপাটগুলি লাগিয়ে দিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। সামসুকে দেখে দূর দূর করে। সামসু দোকান থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাড়ায়। ইসহাক চাচার উদ্দেশ্যে বলে, আমরারে দুইপাতা ওষুধ দাও চাচা! আমি এখনই চইলে যাইতেছি! ইসাক সামসুর মুখের উপর সজোরে দোকানের কপাটগুলি আটকে দেয়। ভেতর থেকে চেচিয়ে বলে ওঠে, দেখ সামসু! আমি ওষুধ বেচার জইন্য দোকান খুলি নাই! আমার মাইয়াটা খুব অসুস্থ, তাই ঔষধ নিতে দোকানে আইসি। শামসু তার কাছে আর্তনাদ করে, বলে, আমারারে দুইটা ওষুধ দিয়া দাও, চাচা। একটু দয়া করো। ইসহাক চাচা আর কোন উত্তর দেয় না। নিষ্ঠুরের মতো দোকানের ভেতর মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। এবার শামসু দোকানের একটু কাছে এগিয়ে যায়। কপাটে নক করতেই খ্যাপা ষাঁড়ের মত চিৎকার করে ওঠে ইসাক চাচা। তারপর তাকে উদ্দেশ্য করে গালাগাল করতে করতে বদদোয়া দিতে থাকে। অগত্যা সামসু সেখান থেকে সরে পড়ে। একটু রাগ হয় তার। ভাবে, বিপদে পড়লে মানুষ কত পরিবর্তন হয়ে যায়!এই ইসহাক চাচা তার বাবা মা বেচে থাকতে কতো তাদের বাড়িতে এসেছে। তার মা তাকে নিজ হাতে রান্না করে খাইয়েছে। আজ তার কাছ থেকে দুই পাতা ওষুধ পেল না সে! তাকে কুকুরের মত দুর দুর করে তাড়িয়ে দিল! 
১৮| মাথায় ঘোমটার মতো করে গামছা পেচিয়ে গঞ্জ থেকে বাড়ি ফিরছিল, সামসু। গামছা এক হাতে টেনে মুখ ঢাকা তার। এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলছে সে। পথিমধ্যে হারিস দেওয়ানের বাড়ি এক ধরনের ভিড়ভাট্টা হট্টগোল দেখে থেমে পড়ে সামসু। বাড়ির বেড়ার সাথে গা ঘেঁষে নিঃশব্দে দাঁড়ায়। বাড়ির ভেতর থেকে এক ধরনের আহাজারীর শব্দ তার কানে ভেসে আসে। হারিস দেওয়ানের ইটের দালানের সামনের উঠোনে তার স্ত্রী মাটিতে বসে বুক চাপড়াচ্ছে। সামনে একটি লাশ কাফনের কাপরে মুড়ানো। পাশেই সবুর দেওয়ান তার মায়ের কাঁধে হাত রেখে তাকে থামানোর চেষ্টা করে চলছে। হারিস দেওয়ানের স্ত্রী ছেলের হাত দুটি বার বার সরিয়ে দিচ্ছে। চিৎকার করে বলছে, কই ছিলি সারারাইত! আমানুষের বাচ্চা! সবুর দেওয়ান সারারাত গঞ্জে ছিল। গোপন মদের আসরে তার প্রতিদিনকার আড্ডা। গ্রামে এত কিছুর ঘটে যাবার পরেও তাদের এই আড্ডা থামেনি। সে বাড়িতে থাকলে হয়তোবা আজ তার বাপের এই করুন মৃত্যু দেখতে হতো না। মদের নেশার বুদ হয়ে শেষ পর্যন্ত চরম মূল্য দিতে হলো তাকে। রাতে হারিস দেওয়ান বাইরে পায়খানায় গেলে, পাগলাটে কিছু মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। মুহূর্তেই তার দেহটি ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলে। গ্রামের অনেকেই বলে বেড়াচ্ছে, জিন ভূতের আছর পড়েছে গ্রামে। কিন্তু সবুর সেটা বিশ্বাস করতে নারাজ। তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা শফিকের দিকে তাকিয়ে, চোখে মুখে একরাশ হতাশা নিয়ে বলে, সগির মুন্সিকে খুজে বের কর। ওর উম্মাদ বাপ এইসবের সাথে জড়িত। শফিক তাঁর হাতে ধরা মোটা বাশটি দিয়ে সজোরে মাটিতে আঘাত করে। ঠক করে একটি শব্দ হয়। সামসুর বুকটি যেন কেঁপে ওঠে তাতে। মাথার ঘোমটাটা আরেকটু বাড়িয়ে বড় বড় পদক্ষেপে বাড়ির দিকে ছুটে চলে। বাড়িতে পৌঁছেই দরজায় ঠকঠক আঘাত করলে, তড়িঘড়ি করে শামসুর বউ দরজা খুলে তাকে ভেতরে আসতে বলে। ঘরে ঢুকেই সামসু দেখতে পায়, খাটের উপর মিলিটারি বসে আছে। পাশেই রহিম বক্সের বড় ছেলে এক কাত হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। মিলিটারির সামনে এক বোল গুড়-মুড়ি রাখা, পাশেই একটি পানি ভর্তি জগ। পানির গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে মুখ ভর্তি মুড়ি নিয়ে চিবোতে চিবোতে সামসুর দিকে মুখ তুলে তাকায় সে। সামসুকে দেখে তার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, চোখদুটি ছল ছল করে ওঠে। খারাপ কিছু একটা আঁচ করতে পেরে সামসু ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, কি হইছে মিয়া ভাই! . শফিক তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ভরদুপুরে সগীর মুন্সির বাড়িতে আসে। সগির মুন্সি আতঙ্কে দরজা জানালা সব বন্ধ করে ঘরের ভেতর বসে আছে। শফিক দুই তিনবার হাক ছেড়ে তাকে ঘর থেকে বের হতে বলে। সগির ভেতর থেকে উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর তার স্ত্রী জবাব দেয়, ভাইসাব, আপনেরা পরে আসেন। কথাটি যেন শফিক সহ্য করতে পারে না।  আতে ঘা লাগে তার। তেড়ে ফুঁড়ে বলে উঠে, ওই বান্দি! অরে ঘর থাইকা বাইর হইতে বল। নয়তো তোগোর সবাইরে পিটায়ে লাশ বানায় ফেলমু! শফিকের হুংকার শুনে ভেতর থেকে কিছুক্ষন কেউ কোন সাড়া শব্দ করে না। একটু পরে সগীর মুন্সী তার স্ত্রী কন্যাকে ঘরে রেখে ধীরে দরজার কপাট খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। কিছু হইসে, মিয়া ভাই? আমতা আমতা স্বরে জিজ্ঞেস করে। সগির মুন্সির শরীরটা ভালো নেই। কিন্তু সে সেটি কোনভাবেই প্রকাশ করে না। শফিক তার দিকে তাকিয়ে হাক ছেড়ে বলে, আমাদের সাথে চল! কই যামু, ভাইজান? শফিক কোন জবাব দেয় না। এক রকম কঠিন দৃষ্টি নিয়ে সগির মুন্সির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোয়াল দুটি একটু যেন নড়ে ওঠে। ভেতরে দাঁত কিড়মিড় করে। এক রকম জোর করেই সগির মুন্সির হাত টেনে তাকে সামনে এ��িয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সে। সগির মুন্সি প্রথমে একবার বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাকি দুজনও তাকে চেপে ধরলে একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেয় সে। প্রায় এক রকম জোর করেই তিনজনে মিলে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে তাকে। . রফিক চাচা ও তার স্ত্রী বাড়ি থেকে বের হয় না অনেকদিন। গ্রামও ছাড়ার উপায় নেই তাদের। এই গ্রামের বাইরে তাদের জানাশোনা কেউ নেই। কিন্তু ওপাশে মিন্টুর লাশ পচে গলে এলাকায় গন্ধ ছড়িয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত কেউ লাশটি সৎকারের ব্যাবস্থা করেনি। তাদের পাশে আরেক যে প্রতিবেশী ছিল, তারাও অন্য গ্রামে চলে গেছে। রফিক চাচার জন্য এখানে থাকাটা এখন প্রায় মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। না পাড়ছে বাড়ি থেকে বের হতে, না কিছু করতে। এদিকে গ্রামের অনেকেই ঘর ছাড়া হয়ে গেছে। গ্রামে নাকি জিন ভুত ভর করেছে। অনেকেই নাকি রাত বিরাতে দেখেছে। তার ওপর রয়েছে ভাইরাসের উৎপাত। মানুষ এই রোগে মারা যাচ্ছে। এদিকে আজ সকালে জানতে পারে হারিস দেওয়ান মারা গেছে। কে বা কারা তাকে মেরে ফেলে রেখে চলে গেছে। তবে কী গ্রামে চোর ডাকাতও পড়তে শুরু করেছে। অন্যদিকে তার বাড়িতে খাদ্যভাব শুরু হয়ে গেছে। চাল ডাল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। এভাবে আর কতদিন চলবে জানা নেই। আবার বাড়ির বাইরে বের হতেও ভয় লাগে। একবার ভাবে আকবরের মেম্বারের কাছে যাবে অথবা থানা পুলিশ করবে কিন্তু পরক্ষনেই ভয়ে পিছিয়ে পড়ে। বাইরে গেলে না আবার ভাইরাস সাথে করে নিয়ে আসে। তাছাড়া চোর ডাকাত, জিন ভুতের বিষয়টির কথাও তো এখন আর অবহেলা করা যাচ্ছে না! . মিলিটারি ছোটুর মা আর ভাইদের খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে সেই সাত সকালে। সামসুকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে, হাসেমের দিকে লক্ষ্য রাখতে। সে কোন উদ্ভট আচরণ করে কিনা খেয়াল রাখতে। এদিকে মিলিটারির শরীরটাও ভালো নেই। বুকটা কেমন যেন ভারী হয়ে আসছে তার। শরীর অসার হয়ে আসছে। অনেকটা এই কারনেই সামসুর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েছে সে। মিলিটারি নিজে একবার তার শরীর হাত পা ভালোভাবে পরীক্ষা করে। নাহ, তার শরীরে কোন ক্ষত নেই! কিন্তু এই দুর্বলতা কেনো তাকে এতো পেয়ে বসেছে? মাথার উপর খাড়া রৌদ্রে ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হটাতই তার খুব পানির তেষ্টা পায়। তারপরেই যেন মিলিটারি আর কিছুই ভাবতে পারে না। তার চারপাশটা যেন ঘুরে যেতে শুরু করে। হঠাৎই করেই যেন শরীরের সব বল হারিয়ে ফেলে। . সগির মুন্সিকে টেনেহিঁচড়ে একটি মাঠে নিয়ে এসেছে শফিক ও তার দল। একটু পরেই রাস্তার পাশে একটি বাইক এসে থামল। সবুর দেওয়ান বাইকটি থেকে নেমে মাঠের দিকে হেটে আসতে লাগল। সবুর দেওয়ান কিছু বলে ওঠার আগেই শফিক তার মোটা বাশটি দিয়ে সগির মুন্সির পায়ের উপর সজোরে একটি আঘাত করে বসে। সগির মুন্সি এক চিৎকার করে মাটিতে আছড়ে পড়ে যায়। ব্যথায় কষ্টে বুকে ফেটে আর্তনাদ করতে থাকে। সবুর দেওয়ান চোখ মুখ বাঁকিয়ে হিংস্র ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, বল, তোর বুড়া বাপকে কোথায় লুকায়ে রাখছোস! বল, হারামজাদা! সগির মুন্সি মুখ দিয়ে এক ধরনের অস্ফুট শব্দ করতে থাকে আর দুই পায়ে হাত দিয়ে ব্যথায় কুকড়ে ওঠে। এবার যেন সবুর দেওয়ানের ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়। শহর থেকে কিনে আনা গায়ে জড়ানো দামী প্যান্টটিসহ হাটুগেড়ে মাটিতে বসে পড়ে। তারপর সগির মুন্সির কলার টেনে তার মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলে, তর বাপ কালকে একটা মানুষ মাইরা ফেলসে! বুঝছোস? তুই কি মনে করস আমি কিছুই জানি না! এখনো সময় আছে বল! নয়তো আজ তোর বউ বাচ্চার কাছে তরে না তর লাশ পাঠামু! সগির মুন্সি এবার একটু কাকুতি মিনতি করতে থাকে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে, বলতাসি, সব বলতাসি ভাই সাব! সবুর দেওয়ান স্থির দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
১৯| বাজানে মিন্টু ভাইয়ের বাড়ি গেছিল, তার মায়ের লাশ দাফন করবার জন্য। সগির মুন্সি গরগর করে বলতে থাকে। বাড়িতে আসার দুই দিন পর থাইকা বাজানের শরীরটা খারাপ হইতে শুরু করে। অস্থির হইয়া পড়ে সে। আমি কিছু ওষুধপত্র বহু কষ্টে গঞ্জ থাইকা আইনা দিলাম কিন্তু সেগুলি খাইয়াও কোন কাজ হইল না। বরং শরীর আরো খারাপ হইয়া পড়ল তার। জ্বর কাশির সাথে রক্ত আমাশা শুরু হইল। একটু থামলো সগির। পায়ে হাত দিতেই ব্যথায় একবার কুকড়ে উঠল। তারপর একটা বড় শ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করল। দিন দিন বাজানের শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হইয়া যাইতে লাগলো। একটা সময় খাওন দাওন বন্ধ হইয়া গেল। মুখে তুইলা দিলেও কিছুই খাইবার চাইতো না। হঠাৎ কইরাই তার পাগলামি আরো বাড়তে লাগলো। একদিন রান্না করার জন্য হাড়িতে রাখা কাঁচা মাংসের উপর লাফ দিয়া পড়ল। আমার বউ আইসা দেখল সে সমানে কাচা মাংস গিলতাসে। কি বললা মিয়া! সগির মুন্সিকে থামিয়ে দিল সবুর দেওয়ান। এই কথাটি হজম করতে পারছিল না সে। বিস্ময় নিয়ে শফিকের দিকে একবার তাকালো। ওই! কথাবার্তা ঠিক কইরা ক! একটা ধমক দিল শফিক। হাতের বাশটা তুলতেই দুই হাত উঁচু করে নিজেকে বাচানোর চেষ্টা করে সগির মুন্সি। কেদো কেদো গলায় বলে, মিয়া ভাই, একটা কথাও বানাই বলি নাই। খোদার কসম! শফিক তার পেটে বাশ দিয়ে একটা গুতো দিতে গেলে সবুর তাকে থামিয়ে দিল, বলল, দাড়া, বলতে দে ওরে। শফিক থেমে গেলে সগির মুন্সি আবার বলতে শুরু করল। বাজানে দিনের বেলা বাইরে বাইর হইবার চাইতো না। নিস্তেজ হইয়া পড়তো। কিন্তু রাইত হইলে অস্থিরতা করতো। মুখ দিয়া লালা পড়তো আর দাত মুখ খিচাইতো। খাওন দাওন ছাইড়া দিলে আমরা এক সময় বাধ্য হইয়া তারে মুরগির কাচা মাংস খাওয়ানো শুরু করি। ওই, শালার পো শালা! মশকরা করছ! এবার যেন মেজাজ আর ধরে রাখতে পারল না শফিক। বারি আরেক ঘা দিয়েই বসল। সঙ্গে সঙ্গে 'ও মাগো' বলে এক লাফ দিয়ে কাতরাতে শুরু করল সগির। শফিককে এবার হাত দিয়ে বাধা দিল সবুর দেওয়ান। আরে রাখ! এক রকম কটমট করে তার দিকে তাকালো। সগির এবার চুপ হয়ে গেল। কথা বলা বন্ধ করে দিল। সবুর ওর দিকে তাকিয়ে তাকে আশ্বস্ত করল। ঠান্ডা গলায় বলল, শফিক আর কিছু কইবো না তরে। বাকিটা বল। সগির মুন্সি ডানে বামে মাথা নাড়তে থাকল। এবার হাটু গেড়ে বসল সবুর, সগিরের ভয়ার্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোর বাপেরে কি কোন পাগলা কুত্তা বিলাই কামড়াইছিলো? সগির দ্রুত মাথা নাড়ে। বলে, আমি তার পুরা শরীর পরিক্ষা কইরা দেখছি, মিয়া ভাই। তাছাড়া জলে তার কোন ভয়ও ছিল না। জল সে চাইতো। কিন্তু কোন খাবার মুখে নিতো না। দিনের বেলা কি হইতো? বাইরে বাইর হইতে চাইতো না কেন? কি জানি? তয় আমার কাছে মনে হইসে আলো সইতে পারতো না। চোখ বন��ধ কইরা ফালাইতো। তারপর ... থেমে গেল সগির। তারপর কি? তারপর একদিন রাইতের বেলা এতো অস্থিরতা শুরু করল, আমরা তারে আর ধইরা রাখবার পারলাম না। একটু ইতস্তত করে বলল, আমরার সাথে প্রায় হাতাহাতি কইরা দরজার খিল ভাইঙ্গে বাইর হইয়া গেল। তোগো কাউরে কামরায় টামরায় নাই তো? শফিক গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল। সাথে সাথে ডানে বামে মাথা নেড়ে উঠল সগির।   সবুর দেওয়ান তীক্ষ দৃষ্টি নিয়ে সগির মুন্সির দিকে তাকিয়ে বলল, কথা ঠিক তো রে, সগির? হ, মিয়া ভাই। নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল সগির। . সন্ধ্য নেমে আসার সাথে সাথে হাসেমের অস্থিরতা যেন আরও বেড়ে গেল। ঘরের জিনিস পত্র ছুড়তে শুরু করল। নিজে নিজে চিৎকার-চেচামেচি করতে লাগলো। হইচই শুনে পাশের বাড়ি থেকে দৌড়ে সামসু আর ছোট্টু তার ঘরের সামনে এসে কড়া নাড়ল। হাসেম কিছুক্ষন কোন কথা বলল না। তারপর ভেতর থেকে একটু অস্থির গলায় উত্তর দিল, সামসু ভাই! তোমরা কেউ ভিতরে আইসো না! বাইরে দিয়া দরজা লাগায় দেও। সামসু বিস্ময়ে ছোট্টর দিকে তকালো। ছোট্ট দ্রুত তার মাথা উপর নীচ করল। সামসুর বোঝা হয়ে গেল অনেক বেশি দেরী হয়ে গেছে। হাসেম আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। দরজার কড়া বাধার জন্য দড়ি খুজে আনতে উঠনে গেল সামসু। ছোট্টু দরজার কড়া দুটি শক্ত করে ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এইদিকে ভেতরে হাশেমের চিৎকার-চেঁচামেচি আরো বেড়ে গেছে। ছোট্টুর কাছে মনে হল এবার কিছু একটার সাথে নিজের মাথা ঠুকছে সে। ঠিক যেন তার বাজানের মতো, সেই একই রকমের অস্থিরতা, আর্তচিৎকার! যেন কোন অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে। ছোট্ট উঠানের দিকে ফিরে ফিরে তাকাতে থাকলো। সামসু ভাই এখনো দড়ি নিয়ে আসেনি! . সগির মুন্সি বাড়িতে ফিরতেই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। তার স্ত্রী কন্যা বাড়িতে নেই! মুহুর্তেই সে ঘরের ভেতর ঢুকে চিৎকার করতে থাকে। স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে থাকে। এই ঘর, ওই ঘর হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। তারপর দৌড়ে উঠোনে চলে আসে সে। বাড়ির কাচা পায়খানাটির দিকে এগিয়ে যায়। কোথাও কিছু না পেয়ে বাড়ির পেছনে লাউ গাছের মাচার কাছে গিয়ে হাক ছাড়তে থাকে। মেয়ের নাম ধরে ডাকতে থাকে। কিন্তু পুরো বাড়ি জুড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কারো হদিস পায় না। তার বউয়ের এক হাতে বাজান একটা কামড় দিছিলো! কিছুদিন যাবৎ দিনের বেলা বেশি একটা বের হতে চাইতো না তার বউ। সূর্যের আলো মোটেই সহ্য করতে পারত না। চোখে গিয়ে লাগতো খুব। খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিল একদম। এবার এক ভয়ঙ্কর চিন্তায় পড়ে গেল সগির মুন্সি। তার মেয়েটা গেল কই? . সামসু কোথা থেকে এক গোছা দড়ি যোগাড় করে নিয়ে এল। একবার ছট্টুর দিকে তাকাল। ছট্টু ভয়ার্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দেরী না করে দ্রুত দরজার কড়া বাধতে শুরু করল সামসু। কড়া বাধার সময় তার হাত দুটি কেপে কেপে উঠছিল। ঘরের ভেতর হাসেমের পাশবিক আর্তনাদ যে বেড়েই চলছে। ভেতর থেকে ভাংচুরের শব্দ ভেসে আসছে। যেন তার উপর জিন ভূতে আছড় করেছে। কড়াটি শক্ত করে বেধে দুজনেই পড়িমড়ি করে কোন রকমে ঘরের দিকে ছুটতে শুরু করে। 
২০| একটু আগে মিলিটারির জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে একটি ধান ক্ষেতের আইলের উপর পড়ে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করে সে। চারপাশটা অন্ধকার তার। আকাশে থালার ন্যায় চাঁদ উঠেছে। চারিদিকটা আলোকিত করে রেখেছে। কতক্ষন এভাবে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল জানা নেই। তেমন একটা বলও পাচ্ছে না শরীরে। কোনরকমে নিজেকে উঠিয়ে টেনেটুনে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল  মিলিটারি। . হাসেম পাশের বাড়িতে বসে এই রাত দুপুরে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। সামসু একবার ওপাশে তার সাথে দেখা করতে যেতে চাইলে ছোট্টু তার দুই হাত জোর করে তাকে যেতে বাধা দেয়। কালাম চাচাও এই একই রকম আচরণ করছিল। তারপর হঠাৎ কইরেই সবকিছু পরিবর্তন হইয়ে গেছিল সেদিন। কিছু একটা ভেবে ছোটুর চোখদুটি ছল ছল করে উঠলো। কেঁদো কেঁদো কন্ঠে আবার বলে, আমরার সবারই একই অবস্থা হইবার যাইতেছে, তাই না চাচা! শামসু কোন উত্তর দিল না। আসলে সামসুর কাছে এর কোন উত্তর নেই। ছোট্টর দিকে হাত বাড়িয়ে তাকে আগলে  বুকের সাথে জড়িয়ে নিল। . সবুর দেওয়ান শফিক ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের সাথে নিয়ে তার পাকা দালানের ভেতরে একটি কক্ষের দরজা-জানালা সব বন্ধ করে বসে বৈঠক করছে। শফিকের সাথে থাকা একটা চ্যালা সবুর দেওয়ানের উদ্দেশ্যে বলল, মিয়া ভাই, আমি মিলিটারির ভাই কালামরেও দেখসি পাগলা কুত্তার মতো সেই দিন রাইতে দৌড়াইতাছে। আমি বাইকে ছিলাম। জোরে টান দিয়া বাড়ি চইলা আইসি। পেছন থেকে আরেকজন বলে উঠল, আমিও পুব পাড়ার এক জনরে রাইত বিরাইতে ছন্নছাড়ার মতো ঘুইরা বেড়াইবার দেখছি। আমার কাছে হের আচরণও সন্দেহজনক মনে হইছিল। সবুর দেওয়ানের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে দাত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে বলল, এই পাগলগুলি রাইতের বেলা বাইর হয়। সগির মুন্সির কথাই ঠিক। কিন্তু আমি বুঝবার পারতাসি না এগুলি মানুষের উপর ঝাপায় পড়ে কেন! আরে বুঝলেন না, মিয়াভাই! কাঁচা মাংস খায় এগুলা! আপনার বাপেরে ছিন্নভিন্ন কইরা খাইছে না! হঠাৎই শফিক তাঁর বাজখাঁই গলায় খেঁকিয়ে উঠলো। মুহুর্তেই হুট করে মাথা তুলে তার দিকে তাকাল সাবুর। তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে শফিক বুঝতে পারল মুখ ফসকে ভুল কথা বেরিয়ে গেছে তার। শফিক কোন কথা বলতে পারল না। কাচুমাচু করে এপাশ ওপাশ তাকাতে থাকল। কিছুক্ষনের জন্য একদম চুপ মেরে গেলো সবুর।  তার মনটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারছে একইভাবে রহমান চাচার লাশও কেউ আধ খাওয়া করে খেয়ে ফেলে রেখে গেছে। সেগুলো কোন জংলি জানোয়ার, পাগলা কুত্তা নয়। বরং এই পাগল মানুষগুলি! . এদিকে হাশেমের চিৎকার-চেঁচামেচি হঠাৎ করেই থেমে গেছে। সর্বশেষ তার একটি আর্তচিৎকার শুনতে পেয়েছে ছোট্টু ও শামসু। আর্ত চিৎকার করেই যেন হঠাৎ সবকিছু নিশ্চুপ হয়ে গেছে। তারপর বেশ কিছুটা সময় পাশের ঘর থেকে কোন সাড়াশব্দ আসে না। সামসুর স্ত্রী ভয়ার্ত চোখে ছোট্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, হাসু কি মইরা গেল! . মিলিটারি দৌড়াতে দৌড়াতে আইল পাড় হয়ে তার বাড়ির উঠোনের উপর এসে দাঁড়ালো। প্রচন্ড হাপিয়ে পড়েছে সে। দাড়িয়ে থাকতে না পেরে মাটিতে হাটু গেড়ে বসে পড়ল। তারপর বুক ভরে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল। পুরো বাড়িতে কোনো আলো নেই। ঘরের দরজাটি হা করে খোলা। চারপাশটা নিশ্চুপ নিরব। কোন জনমানবের সাড়াশব্দ নেই। কোন রকমে উঠে নিজেরই ঘরের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল আতঙ্কিত স্তব্ধ মিলিটারি। . সবুর দেওয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। শফিক নিরবতা ভেঙে তার দিকে তাকিয়ে বলল, মিয়া ভাই, কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি। সবুর ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। শফিক বলে চলল, মিয়া ভাই, মিন্টু শহর থাইকে যে ভাইরাস নিয়ে আইসে, এইডে সেই ভাইরাস না। সবুর দেওয়ান তার দিকে মাথা তুলে তাকাল, এক ধরনের অনিশ্চয়তার ভঙ্গিতে বলল, তুই এতো নিশ্চিত হইলি কেমনে? শফিক কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। তারপর বললো, মিন্টু বা তার মায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হইয়ে মারা গেছে। কিন্তু তাদের কেউ এই রকম পাগলা কুত্তা হইয়া যায় নাই। আমরা মিন্টুর মায়েরে দাফন করসি। মিন্টুর লাশ মইরে পইচা গইলা গেসে। পেছন থেকে শফিকের একটা সাঙ্গো একটু কেশে উঠলো। শফিক একটু থেমে গেল। গলা ঝাড়ে আবার বলল, আপনে নিশ্চিত থাকেন এইগুলারে কোন পাগলা কুত্তা বা কোন জংলি জানোয়ারে কামরাইসে। কি একটা রোগ আছে না ... রা রা ... র‍্যাবিস বা জলাতঙ্ক। শফিকের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল গ্রামের এক মাত্র শিক্ষিত লোক সবুর দেওয়ান। হ, হ ওইটাই। রাবিশ না কি বলে জলাতঙ্ক। শফিক তার মোটা মাথা ঝাকাতে লাগলো। কিন্তু সগীর মুন্সির বাপেরে তো কিছুতে কামড়ায় নাই। সবুর এখনো অনিশ্চিত। আরে মিয়া ভাই, সগির মুন্সির সব কথা বিশ্ব��স কইরেন না। শফিক মোটা গলায় বলে উঠলো। তাও ঠিক। আপন মনে বিড়বিড় করল সবুর দেওয়ান। তারপর সামনে তাকিয়ে বলল, তবে আমরা এখন কি করতে পারি? আমরা এই গুলারে একটা একটা করে ধইরে মাইরে ফেলামু। কথাটা এমনভাবে বললো শফিক, যেন কাজটি খুবই সহজ। সবুর দেওয়ান একটু বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকাল। শফিক বলে চলল, হ, মিয়া ভাই। রাইতের বেলায় কাজটা কঠিন হইলেও, দিনের বেলায় নিশ্চয়ই এর চেয়ে সোজা হইবো। শফিককে যতটা মাথা মোটা ভাবতো সবুর, ততোটা মোটা মাথার লোক সে নয়। তার কথায় আজ সেটি প্রমান হল। হুম। একটু আপন মনে বিড়বিড় করল সবুর। সগীরের কথায়ও সেই আচ পেয়েছে। দিনের বেলায় এগুলা একটু দুর্বল হয়ে পড়ে কিন্তু রাতের বেলায় অস্থিরতা বেড়ে যায়। কিন্তু কথা হল এইগুলা দিনের বেলাতে থাকেটা কই? প্রশ্নটি যেন সবার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিল সবুর। . ছোট্টু সামসুর দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, চাচা আমার বাপেরে রাইতের বেলায় কিছু একটায় কামড়ায়ছিল। তারপর থাইকা সে অসুস্থ হইয়া পড়ে, তার রক্ত আমাশা শুরু হয়। একটু থেমে একটা দীর্ঘ একটা শ্বাস নেয় ছোট্ট। তারপর আবার বলে, মিলিটারির চাচার মায়েরেও কিছু একটা কামড় দিছিল। হুম। বুঝবার পারসি। সামসু মাথা নাড়ে। গেরামে কোন পাগলা কুত্তা, শিয়াল টিয়াল আছে। সেটার কাছ থাইকেই এই রোগটা সবার মধ্যে ছড়ায়ে পড়ছে। সেইটা হইলে তো এইটা মিন্টুর রোগ না। সামসুর স্ত্রী এবার বললো কথাটা। হইতে পারে। শামসু উত্তর দিল। তবে হাশেমের গায়ে তো কোন কামড়ও নাই। হুম, হেই কেন বাজানের মতো এমন পাগলামি করতে করতে মারা গেল, বুঝবার পারতেসি না। ছোট্ট আপন মনে বিড়বিড় করল। হঠাৎ করেই হাসেমের ঘর থেকে আবার এক ধরনের শব্দ শুরু হয়। কেউ যেনো আবিরাম দরজা ভাঙার চেষ্টা করে চলছে। ব্যাপারটি বুঝতে পেরে পিলে চমকে ওঠে সবার। অবিশ্বাসের চোখ নিয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে থাকে। এতক্ষণ পরে ভেতরে এটি আবার কিসের শব্দ! (চলবে)
0 notes
manayeem · 3 years
Text
সায়েন্স ফিকশন
ভাইরাস প্রথম অধ্যায়
১। "কাল রাইতে নাকি মিন্টু ঢাকা থাইকা ফেরত আইছে?" সামসু জিজ্ঞাসা করল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সামসু হাশেমের সাথে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়। সামসুর প্রশ্ন শুনে হাসেম একটু ভ্রু কুচকালো। বলল "হ, আমিও শুনছি মিন্টু বাড়িতে আইছে হঠাৎ করে। কি একটা না কি হইছে ঢাকা শহরে।"
"ও রহমান চাচা কি হইছে ঢাকা শহরে? তুমি জানো কিছু?" সামসু দোকানের ভেতরে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল। রহমান চাচার ২০ বছরের দোকান এই তল্লাটে। এলাকার সব খবরা-খবর তার কাছে থাকে। সে গ্রামের বিবিসি।
"কি একটা অসুখ আইছে নাকি ঢাকা শহরে।" রহমান বলল। "সেই অসুখ থাইকা বাঁচতে মিন্টু বাড়ি চইলা আইছে।"
"বল কি চাচা! কি এমন অসুখ? আমরায় তো কিছু শুনলাম না"
"আমিও কিছু জানি না। তবে শুনছি মরন অসুখ। হইলে আর রক্ষা নাই।" ভয়ার্ত চোখে বলল রহমান চাচা। 
সামসু আর হাশেম দুজনই বিচলিত তার কথায়। ওদের ভাবনায় আসছে না কী রকম অসুখ যার কথা কারো জানা নাই আর হলেও নাকি কারো রক্ষা নাই। 
"চল কাল সকালে আমরা মিন্টু ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে সাথে দেখা করে আসি।" হাসেম বলল।
"হাঁ ঠিক কইসস। তার সাথে একটু দেখা করে আসা দরকার। কি খবরা-খবর। কেন সে আসছে ঢাকা ছাইড়া।" পান চিবোতে চিবোতে দুজনে বাড়ির পথে রওনা দিল।
করিম বক্স সারাদিন ক্ষেতে ছিল। সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফিরেছে। আসার পথে গঞ্জ থেকে হাতে করে এক প্যাকেট সন্দেশ নিয়ে এসেছে। তার পাচ পাঁচটা ছেলে। সব থেকে বড়টাকে ছোট্টু ডাকে সে। তার সাথে গঞ্জে যায় ছোট্টু। আজ অবশ্য যায়নি। আর সবার ছোটটা হাটি হাটি পা পা করে এখন দৌড়ে বেড়ায় সারা বাড়ি। এদের জন্য প্রতিদিনই হাতে করে কিছু না কিছু নিয়ে আসতে হয়। আজকে সন্দেশ নিয়ে এসেছে করিম বক্স। সন্দেশ হাতে দিয়ে সারতে পারে নাই, সাথে সাথেই তা ছিড়ে লণ্ডভণ্ড করে ফেলেছে তার পাঁচ গুণধর পুত্র। সবার হাতে সন্দেশ শুধু ছোটটা ছাড়া। ওর সন্দেশটাতে ভাগ বসেছে সেঝোটা। করিম বক্স এর সেঝো ছেলেটা সবচেয়ে দুষ্ট। সবাই ওকে কালু বলে ডাকে। বাপের মত কালো হয়েছে তো গায়ের রং, তাই। 
এদিকে ছোটটা কান্না জুরে দিয়েছে। ছোট্টু কালুর হাত থেকে সন্দেশটা কেড়ে নিয়ে ছোটটার হাতে দিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওর কান্না থামানো কি চাট্টিখানি কথা। 
নীরব নিস্তব্ধতার এই গ্রামদেশে সূর্য ডোবার পরে শ্মশানের মতো ভূতুরে হয়ে পড়ে চারিপাশ। তারমধ্যে রহিম বক্সের এই ছোট ছেলের কান্নার শব্দ দূরদূরান্ত পাড়ি জমায়। সেটা প্রতিদিনকারই ঘটনা। ওদের বাড়ির আশেপাশে কোন বাড়িঘর নেই। প্রতিবেশী বলতে বেশ কয়েকটা ধানী জমির পরে মিলিটারিদের বাড়ি। 
ছোট ছেলের কান্নাকাটিতে রহিম বক্সের বউ ছাড়া আর কেউ তাই খুব একটা বিরক্ত হয় না। রহিম বক্সেরও তা গা সওয়া। কিন্তু আজ কি যেন একটা হল রহিম বক্সের। মেজাজটা বিগড়ে গেল খুব। কোন এক কারণে মুখ ভার করে গঞ্জ থেকে ফিরেছে রহিম বক্স। কারণটা তার স্ত্রী বা পুত্রদের কারো জানা নেই। রহিম বক্স ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে খেঁকিয়ে উঠলো। সাথে সাথে তার স্ত্রী বিছানা থেকে উঠে বসলো আর ছোটটাকে ধরে কষে একটা থাপ্পর দিল। "গোলামের পো গোলাম!" বলে এক রাশি গালি ঝারল সে। "বাপের লাইন হইছে তার মেজাজ!" রহিম বক্স এর বউ খেকিয়ে উঠলো। 
রহিম বক্স মেজাজ ধরে রাখতে পারলো না। এক লাফে কালুর সামনে গিয়ে দাড়াল, চিতকার করে বলল, "হারামজাদা! তোর কোন কাজ নাই! তোর জন্য কি আমি সন্দেস আনি নাই? তারপরেও তুই কেন ওরটা ধরতে গেছোস?" বজ্রকন্���ে ছেলের উপর চড়াও হল সে। "আমার সন্দেশ আনাটাই মহা ভুল হইছে। এইসব না আনতাম কিছুই ঘটত না। তোদের জন্য আর কোনদিন কিছু আনবো না আমি। তোরা কোন কিছু পাওয়ার লায়েক না।" মুহুর্তের মধ্যে পুরো বাড়ি জুড়ে একটা অস্থির গমগমে পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল। রহিম বক্স ও তার স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল।
ছোট্টু এই পরিবেশের মধ্যে ভাইদের তার সাথে বাইরে বেরিয়ে উঠোনে আসতে বলল।
"কালু, উঠোনে চল।" কালু নড়তে নারাজ। ছোট্টু ওর হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গেল। ওদের সাথে মেজোটাও বাইরে বেরিয়ে এলো। "তুই সব সময় ওর সাথে এরকম করিস কেন? ও তো সবার ছোট ওর সাথে তোর এরকম না করলে হয় না!" কালু কোন উত্তর দিল না। ওর মুখ ভর্তি সন্দেশ। 
"দিলি তো খামোখা বাজানের মেজাজটা গরম কইরা। আইজ সারারাত তার মেজাজ চিলেকোঠায় থাকবো।" মেজটা বলল। এমনি বাজান যে খিটমিট করে সারাক্ষন৷ ভাবছিলাম কালকে একটা বল আনতে কমু বাজানরে।" মেজোটা বলে চলল। "আর বল আমাদের হইছে। নারকেল গাছের পাতা দিয়ে বল বানায় খেলে খেলে জীবন শেষ হইব।"
হঠাত উঠোনের ওপাশ থেকে এক ধরনের শব্দ আসতে লাগলো। ওখানে লাউ গাছের ঝার রয়েছে। মনে হচ্ছে শব্দটি লাউ গাছের ঝারের ভেতর থেকে আসছে। মেজটা হকচকিয়ে উঠলো। "ভাই কিরে ওইখানে?" বলল সে।
"চল ঘরে চল শেয়ালের উৎপাত এমনি অনেক বাড়ছে, ভেতরে চল।" বলে ছোট্টু বাকি দুই ভাইকে টানতে টানতে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। কম বয়স বলেই কিনা! ভয় পেল মনে হয় একটু।
"মিলিটারি তুই কই গেলি? আমারে একটু পায়খানা নিয়ে চল। আমারে কেউ পায়খানায় নিয়ে চল।" খুনখুনে  গলায় চেচাল বুড়ি। কুজো বুড়ি বলে ডাকে ওকে গ্রামের সবাই। ওর একটা ছেলে আছে, যে এক সময় সেনাবাহিনীর সৈন্য হিসেবে চাকরি করতো। পরে কোন এক কারণে সে সেখান থেকে চলে আসে। তবে কি কারনে চলে আসে সে সেটা কারো জানা নেই। সেই তারপর থেকে বুড়ির ছেলেকে সবাই মিলিটারি নামে ডাকে। গ্রামের অনেক লোক আছে যারা তার আসল নামটাই জানেনা। অবশ্য কুজো বুড়ি ওকে ব্যঙ্গ করে মিলিটারি ডাকে।
মিলিটারি উঠোনে বসে বিড়ি খাচ্ছিল। মায়ের চিৎকার শুনে সে পড়িমড়ি করে দৌড়ে গেল ঘরের ভেতরে। 
"আরে গোলাম! কতক্ষণ ধরে আমি চিল্লাইতেছি।" কুঁজো বুড়ি খেঁকিয়ে উঠলো। "আমারে পায়খানা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর।" এটা অবশ্য নতুন কিছু না মিলিটারির জন্য। মাকে নিয়ে উঠাবসা, চলাফেরা, খাওয়ানো দাওয়ানো সবই মিলিটারির কাজ। তারপরেও তার উপরই সবচেয়ে বেশি চিৎকার চেচামেচি করে বুড়ি। তার আরেকটা ছেলে আছে যদিও  কিন্তু সেই ছেলে নিয়ে মাথাব্যাথা নেই বুড়ির। বউ নিয়ে ছেলে আছে দিব্যি আরামে। বুড়ির যত রাগ সব মিলিটারির উপরই নিংড়ে দেয়। মিলিটারি মায়ের বাহুতে হাত দিয়ে পায়খানা অবধি নিয়ে গেল। 
হঠাৎ একটা খট মট শব্দ শুনতে পেল সে পায়খানার পাশের একটা ঝোপে। মিলিটারি একবার সেই দিকে তাকালো, ভাবল কোন শিয়াল-কুকুর হবে। এই গ্রামে শেয়ালের উৎপাত অনেক বেশি। সন্ধ্যা নেমে আসলে এগুলা সব বাড়ির আশেপাশে চলে আসে। 
"ওই গোলাম, খারায় থাকবি। আমার জন্য জল নিয়ে আয়।" মায়ের চিৎকারে ঘোর ভাঙলো মিলিটারির। এক দৌড়ে জল নিয়ে আসতে গেল। 
জল এনে অনেক্ষন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মিলিটারি। ঝোপের ভেতর থেকে আসা শব্দটা এখন আর নেই। 
"মা, ও মা হইল তোমার?" কিন্তু মায়ের কোন সাড়া শব্দ নেই। 
মিলিটারি আবার ডাকল, "মা হইছে তোমার?" কিন্তু এবারও কোন সাড়া মিলল না। অগত্যা মেলেটারি ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল। দরজা খুলতেই হতভম্ব হয়ে গেল মিলিটারি। ঘরের ভেতরে কেউ নেই। ঘরটা খালি।
(চলবে)
সায়েন্স ফিকশন 
ভাইরাস 
পর্বঃ ২
পরদিন সকাল
সামসু আর হাসেম মিন্টুর বাড়িতে।
"মিন্টু ভাই বাড়ি আছো নাকি?" মিন্টুর বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে হাসেম হাক ছাড়লো। 
মিন্টুর বাড়ির উঠোন ঝাড়পোঁছ করা, সবকিছু পরিপাটি, গোয়াল ঘরে গরুর শব্দ ছাড়া পুরো বাড়ি জুড়ে আর কোন সাড়া শব্দ নেই। শামসু আর হাসেমের কাছে একবারের জন্য মনে হলো বাড়িতে কেউ নেই। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর ওরা যখন ফিরে যাবে ঠিক করেছে, তখনই বাড়ির ভেতর থেকে দরজার খিল খোলার শব্দ ভেসে এলো। সামসু আর হাসেম শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়ালো। কেউ একজন খুব ধীর লয়ে দরজার খিল খুলছে। ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে দরজাটা ভেতর থেকে খুলে গেল। মিন্টু দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপাশে। দেখে খুবই ক্লান্ত অসুস্থ লাগছিল ওকে।
"মিন্টু ভাই কেমন আছো?" নীরবতা ভঙ্গ করলো সামসু। মিন্টু কোন জবাব দিল না। সে আস্তে আস্তে দরজার বাইরে বেরিয়ে এলো। হাসেম দৌড়ে গেল ওর হাত ধরে সাহায্য করার ভঙ্গিতে কিন্তু মিন্টু মাথা নাড়লো বলল, "আমি ঠিক আছি হাসু।" একটু অবাক হয়ে মিন্টুর কাছ থেকে একটু সরে দাঁড়ালো হাসেম। ধীরে ধীরে সিঁড়ির উপর গিয়ে বসলো মিন্টু। 
"কি ব্যাপার মিন্টু ভাই, তোমার শরীরটা কি খারাপ?" সামসু জিজ্ঞাসা করল। মিন্টু কোন উত্তর করল না। সামসু একটু সামনে এগিয়ে এলো। মিন্টু কে দেখে তার কাছে অনেক অসুস্থ লাগছিল। 
"তোমার কি ঢাকায় অনেক পরিশ্রম করতে হয়? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি আগের চেয়ে অনেক বেশি শুকিয়ে গেছো। গায়ের রঙ চেপে গেছে।" মিন্টু কোন জবাব দিল না।
"ভাই চাচি কোথায়?" হাসেম জিজ্ঞেস করল। মিন্টু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তারপর বলল "মায়ের শরীরটা ভালো নাই। ঘরে বিশ্রাম করে।"
"ভাই তোমরা তো অসুস্থ হয়ে পড়ছে তোমাদের দেখাশোনা করার কেউতো নাই।" 
"আমাদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে না হাসেম। তোমরা আমাদের জন্য দোয়া কইরো। 
"ঢাকা শহরে কি হয়েছে?" শামসু জিজ্ঞেস করল।
"আমি পুরাপুরি জানিনা বিষয়টা।" মিন্টু বলল। "তবে কোন একটা বিদেশি অসুখ ঢাকা শহরে ছড়িয়ে  পড়তেছে। আমিতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডেলিভারি করি, আমি দেখছি অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আমি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ছি। সরকার সবকিছু বন্ধ কইরা দিছে। সব ধরনের প্রতিষ্ঠান কলকারখানা সব বন্ধ কইরা দিছে। সবাইকে নিজ বাড়ি চইলা যেতে বলছে। যারা ঢাকা শহরের বাসিন্দা, তাদের বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করছে।"
ভীষণ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো হাসেম "কি বলো? এমন কি হইসে যে সবাইকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করছে, কল-কারখানা অফিস-আদালত বন্ধ কইরা দিছে?"
"আমি জানিনা রে হাসু। কেউই কিছু জানে না। কেউ কিছু জানার আগেই সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে।
আমরারে লইয়া চিন্তা করিস না তোরা। সাবধানে থাকিস। ঢাকা শহর থেকে কেউ আসলে তার উপর খেয়াল রাখিস। তার খোঁজ খবর রাখিস।"
হাসেম বলল "ভাই তোমারে দেইখা তো আমার ভালো লাগতেসে না। হাসপাতালে নেওয়া লাগবো নাকি। 
মিন্টু জোর গলায় বলল "নারে আমি এখন ভালো আছি। মায়েরে নিয়া চিন্তায় আছি। আজকে সকাল থেকে মায়ের শরীরটা খুব খারাপ। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারতাছেনা।"
"আমরা কি গিয়ে একটু দেখে আসব।" সামসু জিজ্ঞেস করে। 
"অহন থাক। মায়েরে বিশ্রাম করতে দে। তোরা এখন যা। যাওয়ার সময় আমার গরুটারে সাথে করে নিয়ে যা। গরুটা দেখশুনা করার মত সামর্থ্য এখন আমারার নাই।"
"ঠিক আছে ভাই আমরা এখন যাচ্ছি কিন্তু সন্ধ্যায় তোমারে আবার দেখতে আসবো।" মিন্টু কোন জবাব দিল না।
সামসু ও হাসেম মিন্টুর বাড়ি থেকে বের হয়ে পরলো। ওরা দুজনেই যার পর নাই অবাক হল ভেবে পাচ্ছিল না কি এমন ঘটে গেছে ঢাকা শহরে যে সবাই শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। 
মিলিটারির বাড়িতে শোকের ছায়া। হাউমাউ করে মিলিটারি কান্নার ধ্বন��� পুরো গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মানুষ মিলিটারির বাড়িতে ভিড় করছে। 
"মা তুই কই! মা কই গেলি তুই!" মিলিটারি আহাজারি করে। পাশে উঠোনের সিঁড়িতে মিলিটারির ছোট ভাই ও তার বউ সিঁড়ির উপর বসে আছে। ছোট ভাইয়ের বউ মানুষদের সাথে চেঁচামেচি করছে। "আপনারা কি চান? মরা বাড়ি দেখতে আইছেন? মানুষ তো মরে নাই। চইলা গেছে বাড়ি থেকে। মরলে দেখতে আইসেন। এখন বাড়ি থেকে বের হন।"
"তোমার শাশুড়ির কি হইছে?" ভিড় থেকে বয়স্ক মতন এক বুড়ি মহিলা গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো। 
"আমার শাশুড়ির কি হয়েছে সেটা তো আমি নিজেও জানিনা। আপনেরা একটু বলেন, তার কি হইছে। মিলিটারিরে জিজ্ঞেস করেন। তাকে সে কোথায় ফেলায় আসেছে।"
রহিম বক্স মিলিটারির পাশে গিয়ে বসলো। একটা হাত ওর কাঁধে রাখল। "মিলিটারি আমারে খুলে বল। কি হইছে তোর মায়ের।" মিলিটারি কোন কথা বলল না। শুধু আহাজারি করছিল। ছোট ভাই বলল "মিলিটারি কোন কথা বলতেছে না কাল রাত থেকে। মায়ের কি হয়েছে সেটাও সে বলতে পারে না। আমরা অনেক খুঁজছি কিন্তু কোথাও খুঁজে পাই নাই এই বুড়া বয়সে তার তো কোন যাওয়ার জায়গা নাই। সে কোথায় যাইবে।"
"দেখো গিয়ে সখিনার বাড়ি বসে আছে কিনা?" ছোট ভাইয়ের বউ চেচিয়ে উঠল।
"সখিনার বাড়ি কোন সময় মা একা গেছে? সে একা এতদূর পথ পাড়ি দিতে পারে না সে তো আজ কত বছর হল।" ছোটভাই ধমকের সুরে বলল। 
"তাইলে কি তোমার মায়ের পাখা গজাইছে, যে পাখা দিয়ে উড়ে চলে গেছে।"
এবার মিলিটারী চিৎকার করে উঠলো "চুপ করো। আর  উল্টাপাল্টা কথা বলো না।"
"উল্টাপাল্টা কথা তো তুমি বলতেছ, মিলিটারি!" ছোট বৌ তার বাজখাই গলা চালিয়ে গেল। "যে মানুষটা ঘর থেকে পায়খানায় যেতে পারে না সে হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল। তুমি তারে কোথায় লইয়া গেছো? কোথায় লুকায় রাখছো? কি করছ ঠিক কইরা কও মিলিটারি।" কোন কথা বলল না মিলিটারি। মাথার চুল ছিড়তে শুরু করল আর বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে লাগলো। "আরে আমিনা তুমি মুখটা একটু বন্ধ করো। দেখো না ওর মাথার অবস্থা ভালো না।"
"তোমার মার কি হইছে দেখি আমরা খুঁজে বার করতেছি। সে যদি কোথাও রাগ কইরা চইলা থাকে আমি সেইটা খুঁজে বের করমু।" রহিম বক্স বলল। "আর এই যে মানুষজন বাড়িতে ভিড় কইরো না তোমরা। যে যার যার বাড়ি যাও।" সবাইকে তারা দিল রহিম বক্স। এতক্ষণ যারা বসে তামাশা দেখছিল ছেলে বুড়ো, তারা ধীরে ধীরে বের হয়ে যেতে লাগল। কিছু অতি উৎসাহী লোক তখনও থায় দাঁড়িয়ে রইল। তাদের তামাশা দেখা তখনও শেষ হয়নি। 
"আমি গঞ্জে যাওয়ার সময় সখিনার বাড়িতে খোঁজ নিয়ে যাব। দেখি কিছু জানতে পারি কিনা।" সখিনা মিলিটারির সৎ বোন।
আজকে একটু সকাল-সকাল বাড়ি ফিরল রহিম বক্স হাতে করে কিছুই আনেনি সে আজ। ছোট ছেলেটা তার হাতের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। রহিম বক্স ওর চোখের ভাষাটা পড়তে পারল।
"ছোট্টুর মা দেশের অবস্থা ভালো না। আজকের পর থেকে গঞ্জ আর যাওয়া হইবো না। ঘরে চাইল ডাইল কি আছে।"
"কি বলেন ছোট্টুর বাপ" রহিম বক্স এর বউ বলল। "গঞ্জে যাইবেন না মানে। আর দেশের কি হইছে?"
"কি হইসে তা তো জানি না, তয় খারাপ কিছু একটা হইছে। ঘরে যা আছে তা দিয়ে চলবে তো আমাদের?" 
"ঘরে তো চাইল বেশি নাই। এক সপ্তাহ যাইব কিনা সন্দেহ আছে।" রহিম বক্স কোন উত্তর করল না। আপন মনে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। একটু দূরে ছোট্টু মেঝেতে বসে ছিল। মেজোটার দিকে একবার তাকালো। বল বোধ হয় আর তাদের কপালে জুটলো না। 
"বুঝলা ছোট্টুর মা" রহিম বক্স বলে চলল। "মিলিটারির মায়ের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। আমি আসার সময় সখিনাদের বাড়িতে গেছিলাম। ওরা বাড়িতে নাই। সপ্তাহখানেক আগে চইলা গেছে। কই গেছে কেউ জানে না।
"হু, কি যে হইলো বুড়ির" ছোট্টর মা বলল "মিলিটারি তো সারাদিন ধইরা কানতাছে। ওরে কেউ থামাইতে পারতেছে না। মিলিটারির ভাইয়ের বউ বাপের বাড়ি চলে গেছে। কি যে হইলো, কোথায় যে চইলা গেল বুড়ি কাউরে কিছু না বইলা।"
"মিলিটারির ভাইয়ের বউয়ের মুখতো ভালো না। ও গেছে ভালো হইছে।" রহিম বক্স বলল।
হঠাৎ বাইরে কিছু একটা শব্দ পেল রহিম বক্স। শব্দটা বেশ জোরেই হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ হেচরে হেঁটে বেড়াচ্ছে উঠোনে। 
"কিসের শব্দ গো ছোট্টুর মা?" রহিম বক্স জিজ্ঞেস করল।
"বাজান আমি দেখে আসি।" ছোট্টু বলল।
"খবরদার ঘর থেকে বাইরে বেরোবি না। এখন দিনকাল ভালো না।"
"বাজান আমরা কালকেও বাড়ির আশেপাশে এরকম একটা শব্দ পাইছি।" মেজোটা বাপকে জানাল। "শিয়ালের উৎপাত বেশিই বাইড়া গেছে।" রহিম বক্স আপন মনে বলল। "দিনকাল আসলে খারাপ হয়ে গেছে পশুপাখিরাও অস্থির হয়ে পড়ছে।"
পর্ব ৩ পরদিন ভোর। মিন্টুর বাড়িতে গ্রামের মানুষের ভিড়। মিন্টু ঘরের সিঁড়িতে বসে ডুকরে কাঁদছে। গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বি তাকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে। "আমি মায়ের জন্য কিছুই করতে পারলাম না" কাঁপতে কাঁপতে অস্পষ্ট স্বরে বলল মিন্টু। "মা আমার এক গ্লাস পানি খাইতে চাইছিল। আমি পানি আনতে আনতে… " মিন্টু আর কিছু বলতে পারল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তারপর আহাজারি করতে থাকলো। "মা আমার চইলা গেছে চইলা গেছে আমারারে ছাইড়া।" উঠোনে রাখা খাটিয়াতে মিন্টুর মায়ের লাশ। সবাই এখন লাশ নিয়ে যাবে কবরস্থানে। জোয়ান মত চারজন ছেলে খাটিয়াটা কাঁধে করে উঠে দাঁড়ালো। মিন্টু সটাং করে সিঁড়ি থেকে উঠে পরলো। একজনকে জোয়ানকে সরিয়ে খাঁটিয়ার একটি হাতল ধরল। অন্য হাতে নিজের চোখের পানি মুছলো। সামসু মিন্টুকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু মিন্টুর এ আহাজারি থামার নয়। মায়ের দাফন সেরে সামসু আর হাশেম মিন্টুকে দুই পাশ থেকে ধরে ধরে বাড়ির পথে নিয়ে আসছিল। পথে মিন্টু বারবার বসে পড়ছিল আর আহাজারি করে প্রলাপ বকছিলো। "আমি ঢাকা শহর থেকে আসার সময় এই বিদেশি রোগ নিয়ে আসছি। আজকে আমার কারণে আমার মা মারা গেল।" "মিন্টু ভাই উঠো।" সামসু মিন্টুকে উঠানোর চেষ্টা করল। "তোমার শরীরটা ভালো নাই। এরকম করলে তুমি আরো অসুস্থ হয়ে পড়বা।" মিন্টু কে বোঝানোর চেষ্টা করলো সে। "তাছাড়া চাচির অনেক বয়স হয়ছিল" "না তোমরা জানো না আমি ঢাকা থেকে এই মরণ রোগ নিয়া আসছি" মিন্টু চিতকার করে বলতে লাগলো। "মিন্টু ভাই এখন একটু থামো।" হাসেম ওকে থামানোর চেষ্টা করল। "তুমি এরকম করতে থাকলে মানুষ কী মনে করবো।" এবার মিন্টু একটু যেন ঠান্ডা হল। আর কোন কথা বলল না বাকি পথ। সামসু আর হাশেম মিন্টুকে বাড়ি পৌঁছে দিলো। জানিয়ে রাখল ওরা আবার সন্ধ্যার সময় দেখতে আসবে। পথে সামসু আর হাসেম নিজেরা কিছু একটা নিয়ে বলাবলি করতে লাগল। "মিন্টু ভাই যে বিদেশি রোগটার কথা বলতেছে তার কি সেই রোগটাই হইছে নাকি। তারে দেখে তো অসুস্থ লাগতেছিল।" হাসেম বলল। "আমি নিজেও বুঝবার ��ারতেছি না।" সামসু চিন্তিত। "আমরার গ্রামে তো এই রোগ সম্পর্কে কেউ ��িছুই জানে না আর হঠাৎ করে মিন্টুর মা কেনইবা মারা গেল, তার বয়স হইছে ঠিক আছে কিন্তু সেতো সুস্থ-সবলই ছিল।" "রোগটা আবার ছোঁয়াচে ধরনের নাতো?" হাসেম একটু চিন্তিত। "আরে না কি যে কস?" সামসু মানতে পারল না। "বিদেশি রোগ, বিদেশিগোর হয়।" "তাইলে শহরের মানুষের হইল কেমনে?" হাসুর প্রশ্ন। "হুম, চিন্তার কথা।" "হইতে তো পারে, যক্ষা কলেরার মত হইতে পারে না?" সামসু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। "হুম তা তো হইবার পারে কাশি দিয়া বা খাবার দিয়া ছড়াইতে পারে। কিন্তু আমি মিন্টুরেতো কাশতে দেখি নাই।" "কি জানি ভাই বুঝবার পারতাছিনা।" হাসেম ভ্রু কুচকালো। "মিন্টু ভাই আমাদের গ্রামের বড় ভাই তার বিপদাপদে তারে সাহায্য না করলে হয়।" শাম��ু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। "হুম, তা তো ঠিক।" রহিম বক্স রহমানের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলো। "চাচা গঞ্জ তো বন্ধ হয়ে গেল।" বলল সে। "হ, আমিও শুনছি। আমার দোকান চালামু কেমনে বুঝবার পারতেছিনা। দোকানের মাল শেষ হয়ে যাবার পথে।" রহমান উত্তর  দিল। "আমার বাসায় ও চাইল ডাইল নাই। আচ্ছা ঢাকা শহরে কি যুদ্ধ লাগছে নাকি?" রহিম বক্স জিজ্ঞেস করল। "মনে তো হয়। আর ওই সব রোগ-শোক কিছু না সরকার যুদ্ধ ঢাকতে মানুষরে এইসব বলতেছে।" রহমান চাচা নিজের থিওরি দিল। যেরকম সে সব সময় দেয়। হাজার ধরনের লোক তার দোকানে আড্ডা দেয়। তাই সমন্বয়ে সে বেশ ওস্তাদ। "আমার কেন জানি মনে হয় সত্যি সত্যি কোন বিদেশি রোগ হানা দিছে।" রহিম বক্স বলল। পাশের গ্রামের টুটপাড়ার অন্য একটা লোক দোকানের ওপাশে বসে ছিল। লোকটাকে রহিম বক্স চেনে। চেহারায় চেনে, নাম জানে না। সম্ভবত শরীফ দেওয়ানের ছেলে। সে একটু শিক্ষিত ধরনের। "আরে ওসব রোগ-শোক কিছু না, আসল কথা হইলো দেশে যুদ্ধ লাগছে। ওই চেহারা চেনা লোকটা বলল। রহিম বক্স কোন উত্তর করল না। রহমান ওই লোকটার সাথে সায় দিলো। বলল, "আমারও তাই মনে হয়। প্রথম থেকেই আমার এরকম একটা কিছু সন্দেহ হইছে।" রহিম বক্স কোন কথা বলল না। চুপ করে শুনল। "চাচা মিন্টুর মা নাকি মারা গেছে?" এবার প্রসঙ্গ পাল্টালো সে। "হ, সকালে দাফনে গেছিলাম।" রহমান উত্তর দিল। "কি হয়েছিল জানো কিছু?" রহিম বক্স জিজ্ঞেস করল। "বয়স হয়েছিল, তাই মারা গেছে।" ওপাশের বেঞ্চে বসা শহীদ দেওয়ানের ছেলে বলল। "শরীর ভালো ছিল না বুড়ির।" রহমান যোগ করল। "আচ্ছা ঢাকা থেকে কোন রোগ বাধায় আসেনাই তো মিন্টু?" হটাত করেই মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলল রহিম বক্স। বলেই বুঝতে পারল বলাটা ঠিক হয়নি। ও পাশের শিক্ষিত লোকটা সাথে সাথেই খেকিয়ে উঠলো, "আরে না মিয়া, কোন রোগ-শোক না। কইলাম না তোমারে যুদ্ধ বাঁধছে দেশে। দেইখো কয়দিন পর গেরামে মিলিটারি আসবো।" রহিম বক্স কোন উত্তর করল না। তবে রহমান চাচার চেহারায় স্পষ্ট ভয়ের ছাপ দেখতে পেল সে। "এক যুদ্ধ দেখছি জোয়ান বয়সে আর যুদ্ধ দেখতে চাই না।" ভয়ার্ত কন্ঠে রহমান চাচা বলল। চায়ের কাপটা রেখে বেঞ্চ ছেরে উঠে দাঁড়ালো রহিম বক্স। আর কথা বাড়ালো না। বাড়ির পথে হাঁটা দিল। রহিম বক্স এর মনটা ভালো নেই। একা একা পথ চলছে সে। এই গ্রামে মানুষজন এমনি কম। এখন মনে হয় মানুষ আরো কমে গেছে। সবার মনের ভেতর একটা চাপা আতঙ্ক। অনিশ্চয়তার, অজানার। চারিদিকে গুজব। একটা গুমোট ভাব। সত্যি সত্যি কি তবে দেশে যুদ্ধ বেধে গেল। মূর্খ লোকদের জীবনে অনেক কষ্ট। কোন কিছু জানার বোঝার উপায় নাই। গ্রামের কেউ পেপার পত্রিকা পড়ে না। টিভি তো অনেক পরের কথা। বিদ্যুৎ এই গ্রামে আসে নাই। এখনো যাদেরকে গ্রামের মানুষ কিছুটা শিক্ষিত বলে মনে করে তাদের অনেকেই ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা দিতে পারে না। কেউ কেউ গুজব রটিয়ে বেড়ায়। আর কেউ কেউ ঘর থেকেই বের হয় না। হঠাৎ রাস্তা থেকে নিচে একটু দূরে একটা ক্ষেতের কিনারা ধরে কেউ একজন বসে আছে বলে মনে হলো রহিম বক্স এর। বয়স্ক মতো এক বুড়ি মহিলা। উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে তার চেহারা রহিম বক্স দেখতে পারছেনা। একটু অবাক হল রহিম বক্স। একটু পরেই সূর্য ডুবে যাবে, অন্ধকারের চাদর নেমে আসবে পৃথিবীর উপর। এরকম একটা সময় বাড়ির বয়স্ক মানুষ এরকম ক্ষেতের মাঝে বসে থাকার কথা নয়। যেখানে দেশের অবস্থা এখন ভালো নয়। ব্যাপারটা রহিম বক্স এর নিকট খুব একটা ভালো ঠেকলো না। কিন্তু একগুঁয়ে রহিম বক্স সচরাচর অন্যের ব্যাপারে খুব একটা নাক গলায় না। তবুও একবার ভাবল সে ডাক দিবে তাকে কিন্তু পরে কিছু একটা ভেবে মুখ ঘুরিয়ে নিল। বাড়ির পথে হেটে চলল। কিছুদূর আসার পর হটাত তার মিলিটারির মায়ের কথা মনে পড়ল। সাথে সাথেই মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল কিন্তু আশ্চর্য আইলে বসা সেই এখন মানুষটি আর নেই। মুহুর্তেই উধাও হয়ে গেছে। পূর্ণিমার রাত। উঠোনে বসে আছে মিলিটারি আর সিঁড়ির উপর বসে আছে তার ছোট ভাই কালাম। "কাল আমেনারে আনতে যাব।" কালাম মিলিটারির উদ্দেশ্যে বললো। মিলিটারি কোন উত্তর করল না। "মিয়া ভাই, তুমিতো মেম্বরের কাছে গেছিলা আজকে, মেম্বার কি কইলো?" মিলিটারি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল "তারা তো শুধু আশ্বাস দেয়, কাজের কাজ কিছুই করে না।" "আমি এখনো বুঝবার পারতেছিনা পায়খানার ভেতর থেকে মায় কোথায় হারায় গেল? আচ্ছা মিয়া ভাই, তুমি ঠিক দেখছ তো?" কথাটা শুনার সাথে সাথে মিলিটারি চটে গেল। "সবাই আমারে এই একটা প্রশ্ন আর করিস না তো।" উচ্চস্বরে বলল সে, "আমার আর এইটা শুনতে ভালো লাগে না।" "না মানে আমি বলতেছিলাম তুমি ঘুমায় পড়ো নাই তো?" ছোট ভাই আমতা আমতা করে বললো। মিলিটারি কোন উত্তর করল না। ছোট ভাই সম্ভবত ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারছিল। সে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। "কই যাইতে পারে মায়" আপন মনে বিড়বিড় করে বলল। "হারায় গিয়ে থাকলে মানুষকে আর ফেরত পাওয়া যায় না?" "ফেরত পাওয়া যাইবো না কেন? নিশ্চয়ই খুঁইজা পাওয়া যাবে। যেখানেই থাকুক, আমি তারে খুঁজে বার করমু।" মিলিটারির কন্ঠে প্রতিজ্ঞা। "তুমি তো আজকে পূব পাড়ায় গেছিলা" কালাম জিজ্ঞেস করল। "হুম গেছিলাম কিন্তু কেউ কোন খোঁজ দিতে পারল না। কালকে টুটপাড়ায় যামু।" বলল মিলিটারি। "মানুষজন কিসের যেন একটা ভয়ে আছে। ঠিকমত দেখা করতে চায় না। বাড়িতে বসবার দিতে চায় না।" "হ, বুঝছি মানুষ বিদেশি রোগের ভয় পায়। আমরা দেশে তো বিদেশ থেকে কেউ আসে নাই ভয় কেন পাবে?" কালাম বলল। "তারপরেও ভাই ভয় তো লাগে সবার। গঞ্জ বন্ধ কইরা দিছে। সবাই কানাঘুষা করতাছে, দেশের সরকার নাকি সবাইরে ঘরে থাকতে কইছে।" মিলিটারি উত্তর দিল। "হ আন্দাজ তো করতে পারতাছি কিছু একটা তো ঘটছে দেশে।" "কিছু না ঘটলে তো সরকার সবকিছু বন্ধ করে দেয় না, মানুষজনেরে দেশে ফেরত যেতে কয় না।" মিলিটারি কিছু আঁচ করতে পারছিল। সন্ধ্যের পর। রহিম বক্স এর বাড়ির উঠোনে। "ভাই সেই কবে টিভি দেখছিলাম সবুর দেওয়ানের বাড়িতে গিয়া।" ছোট্টু বলল মেজোকে। "হ তারপরে তো ওদের টিভিটাই নষ্ট হয়ে গেল। আহারে এখনো চোখের মধ্যে ভাসে, সার্কাসের সেই বাঘ, বাঘের হুংকার। আগুনের গোলকের ভেতর দিয়া সিংহের লাফ। আর জীবনে কোনদিন কি টিভি দেখতে পারমু?" একটু দূরে ক্ষেতের আইল ধরে কালু বাসায় ফিরছিল। কালুকে দেখে ছোট্ট একটা ডাক ছাড়লো। তারপর মেজোকে উদ্দেশ্য করে বলল "দিনকাল কত খারাপ তার ওপর হেই সূর্য ডোবার পরে বাসায় ফিরেতেসে। আজকে বাজানের কাছে যদি বিচার না দিছি।" মেজটা তাকিয়ে ছিল কালুর দিকে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। তবে হাঁটার ধরন দেখে ও বুঝতে পারল এটা কালুই। "ঠিকই বলছ ভাই বেশি সাহস হয়ে গেসে। হঠাৎ ভেতর থেকে মায়ের কন্ঠ, "সোহেল কান্নাকাটি করতেছে। ছোট্টু ওরে একটু ধর।" সোহেল সবার ছোটটা হাটি হাটি পা পা পা করে এখন দৌড়ায়৷ ছোট্টু দৌড়ে ঘরের ভেতর গেল। ছোটটার যে কি হয়েছে সারাদিন রাত অস্থিরতা করে। মেজোর  মনোযোগ  ঘরের দিকে চলে গিয়েছিল। কান্না থামার পরে মাথা ঘুরিয়ে ক্ষেতের আইলের দিকে তাকালো। কালুর এতক্ষণে বাড়ির কাছাকাছি চলে আসার কথা। কিন্তু সে কালুকে দেখতে পেল না। মেজো উঠে দাঁড়ালো। ডানে বামে তাকাল কিন্তু তারপরেও কালুকে দেখতে পেল না। কিছুক্ষণ ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর ঘরে গেল। "মা কালুকে ঘরে ঢুকতে দেখসো।" সে জিজ্ঞেস করল। "কই নাতো। কালুতো এখনো বাড়ি ফেরে নাই।" মেজোর কাছে একটু খটকা লাগলো। সে আবার বাইরে বেরিয়ে এলো। কালু কি আবার ফিরে গেছে। করিম বক্স মিলিটারি সাথে দেখা শেষ করে বাড়ির পথে রওনা দিল। মিলিটারির বাড়ি থেকে তার বাড়ি বেশি দূরে নয়। কিছুদূর হাটার পর বাড়ির কাছাকাছি আসতেই চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে গেল বাড়ির ভেতর। "কি হইছে তোমরা কালু কালু বলে চিৎকার করত���ছো কেন?" বউকে জিজ্ঞেস করল সে। "কালু এখনো ঘরে ফেরে নাই।" রহিম বক্স এর বউ উত্তর দিল। "কি বলো রাইত নাইমা গেসে তো অনেকক্ষণ হইল। এখন ঘরে ফেরে নাই মানে?" রহিম বক্সের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো। এই গ্রামে মানুষ মারা যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে তার ছেলে বাড়ি ফেরে নাই। কালু অনেক দুষ্টু। মাঝে মাঝে দেরি করে বাড়ি ফেরে। এর জন্য অনেক মার খেয়েছে সে কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। সেজন্য রহিম বক্স ওকে মারা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এরকম দিনে এত করে বোঝানোর পরেও সে বাড়ি ফেরে নাই, এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা রহিম বক্স ঠিক মেনে নিতে পারছে না। তার মনের ভেতর অজানা এক শঙ্কা ভর করছে। হতে পারে তার ছেলে দুষ্ট, গোয়ার ধরনের কিন্তু এতো দেরী করে বাড়ি ফেরার পাত্র সে নয়। কেন যেন রহিম বক্স এর বুকটা ভারী হয়ে আসছে। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। "আমি যাচ্ছি ওকে খুঁজে নিয়ে আসি।" এই বলে ঘর থেকে একটা টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পরলো সে। বাড়ি থেকে ছোট্টু চিল্লিয়ে বলল "বাজান আমি আসমু তোমার সাথে?" "না। তুই মায়ের সাথে থাক।" রহিম বক্স উত্তর করলো।
পর্ব ৪ অন্ধকারে ধান ক্ষেতের আইল ধরে হনহন করে হেঁটে চলছে রহিম বক্স। কালুকে তার খুঁজে বের করতেই হবে। দেশের যা অবস্থা, কখন কি ঘটে যায় বলা মুশকিল। রহিম বক্স জানে তার এই ছেলেটা খুব দুষ্টু প্রকৃতির। সন্ধ্যা হয়ে গেলেও তার বাড়িতে আসতে মন চায় না। মাছ ধরা কালুর নেশা। মাঝেমধ্যেই রাত্রিতে খেতের মাঝে ছোট মাছ ধরায় নেমে পড়ে সে। এই নেশায় কখনো কখনো সে বাড়িতে ফেরার কথাই ভুলে যায়। বহুবার এরকম হয়েছে রহিম বক্স লাঠি পেটা করে কালুকে ক্ষেতের কাদামাটি থেকে তুলে বাড়ি নিয়ে এসেছে। আজকেও কালু কিছু একটা সেরকমই করবে বলে ধরে নিয়েছে রহিম বক্স। দক্ষিণের মিলিটারিদের বাড়ির পাশে বড় খেতে মাছের আনাগোনা বেশি। কালু ওই দিকটায় যেতে পারে। রহিম বক্স সেই দিকেই এগোচ্ছিল। মাঝেমধ্যে দূরে খেকশিয়ালের দুই একটা হাক ছাড়া আশেপাশে আর কোন সাড়া শব্দ নেই। নিস্তব্ধতার এই গ্রাম যেন এই রাতে শ্মশানের মতো নীরব হয়ে পড়েছে। রহিম বক্স টর্চ জ্বেলে মাঝে মাঝে দূরে আলো ফেলছিল আর দুই-একবার কালুর নাম ধরে ডাক ছাড়ছিল। কিন্তু কালুর তো কোন হদিসই নেই। হঠাৎ একটু দূরে এক ধরনের খচমচ শব্দ শুনতে পেল রহিম বক্স। শব্দটা সম্ভবত পাশের ক্ষেতের ওপাশের আইল থেকে আসছিল। রহিম বক্স টর্চ এর আলো ফেলে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করল। 'কালু' বলে আবারো হাঁক ছাড়লো। একটু সামনে এগিয়ে হাতের ডানে মোর নিতেই মনে হল কাদামাটিতে কেউ কিছু একটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। যদিও উচু ধান গাছগুলির কারণে তেমন কিছু দেখতে পেল না সে। যতই এগোচ্ছিল সেই শব্দটা যেন তার থেকে থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। এবার একটু ছোট ছোট পদক্ষেপে দৌড়াতে শুরু করলো রহিম বক্স। ডানপাশের ক্ষেতের আইলে পৌঁছাতে যা দেখতে পেল তাতে কিছুটা অবাকই হল সে। কেউ একজন কাদা মাটির মধ্যে ছোট একটা গর্তের মতো তৈরি করে ফেলেছে। রহিম বক্স এর চেহারায় কিছুটা চিন্তার ভাঁজ পড়ল। এসব কী কালু করছে! রাত বিরাতে ক্ষেতের আইলে গর্ত খুঁড়তে যাবে কে? রহিম বক্স টর্চের আলো দিয়ে আশেপাশটা ভাল করে আরেকবার দেখার চেষ্টা করল। প্রথমে তার কাছে মনে হচ্ছিলো গর্তটা কোন শেয়াল কুকুর জাতীয় প্রাণী খুঁড়ছে। কিন্তু ভালো করে আলো ফেলে একটা ব্যাপারটা লক্ষ্য করল সে। গর্তটা কোন মানুষ খোড়ার করার চেষ্টা করেছে। পাচ আংগুলের দাগ রয়েছে সেখানে। রহিম বক্স তার আশেপাশে একবার দেখলো। এবার একটু জোরেই চেচিয়ে ডাকলো কালুকে। কয়েক মুহূর্ত পর হঠাৎ করেই তার থেকে কিছুটা দূরে এক ধরনের গোঙানির মতো গরগর শব্দ পেল। এবার যেন একটু আঁতকে উঠল রহিম বক্স। এটা কোন মানুষের শব্দ, শিয়াল কুকুরের নয়! তবে এটা কালুও নয়! শব্দটার ভেতরে কোথায় যেন এক ধরনের হিংস্রতা লুকিয়ে আছে। মনে হচ্ছিলো কেউ দুমড়ে মুচরে কিছু একটা গো গ্রাসে গিলছে, তারপর মুখ হা করে শ্বাস নিচ্ছে। এক ধরনের টানাহেঁচড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। এই প্রথমবারের মতো রহিম বক্সের ভেতরে এক ধরনের ভয় কাজ করতে শুরু করলো। কিছুটা আতঙ্কিত রহিম বক্স এবার ছোট ছোট পদক্ষেপে শব্দের উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করলো। শত হোক তার ছেলেকে তো খুঁজে বের করতে হবে। এই শব্দের সাথে না আবার তার ছেলের কোন সম্পর্ক রয়েছে। অজানা আশঙ্কায় তার বুকটা একবার কেঁপে উঠলো। বাম পাশের আইল ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলল সে। লক্ষ্য করল এবার শব্দটা তার থেকে একটা ক্ষেত পরে গিয়ে তৈরি হচ্ছে। অনেকটা মিলিটারিদের বাড়ির পাশ ঘেঁষে, ক্ষেতের ওপাশটায়। তার কাছে মনে হল উৎসের মালিক ইচ্ছে করেই তার কাছ থেকে দূরে দূরে সরে যাচ্ছে। তাকে নজরে রাখছে। আতঙ্কের একটা হিম শীতল স্রোত তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। ভয় কাটানোর জন্য ধমকের সুরে বলে উঠল, "কে ওখান? আমার সাথে মশকরা! এত বড় সাহস?" কোন সারাশব্দ এলো না। কালুর তো বটেই, গ্রামের কারো এতো বড় বুকের পাটা হয়নি যে রহিম বক্স এর সাথে মশকরা করবে। সবাই জানে রহিম বক্স রগচটা বদমেজাজী ধরনের লোক। আরো কিছুদূর এগোনোর পর একটু দূরে অন্ধকারে এবার কিছু একটা যেন দেখতে পেল রহিম বক্স। মাটি খুঁড়েই চলছে একটি অবয়ব। "কে ওখানে?" কোন উত্তর এল না। রহিম বক্স আবার জিজ্ঞেস করল। তাও কোন সাড়াশব্দ নেই। অবয়বটা মাটি খুড়ে কিছু একটা পুতে রাখার চেষ্টা করছে। রহিম বক্স টর্চের আলো সোজা মানুষটার চেহারার উপর ফেলল। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো বয়স্ক খুনোখুনে বুড়ি মতো এক মহিলা বসে আছে সেখানে। অনবরত মাটি খুঁড়ে চলছে। হাতগুলো শীর্ণ। গায়ে সাদা রঙের এক ধরনের কাপড়, কাদামাটিতে সেটা ভিজে সিক্ত। ভালো করে খেয়াল করলে সে বুঝতে পারলো কাপরটি এক ধরনের কাফনের কাপড়। বুড়িটা হঠাৎ করেই তার দিকে মুখ ঘোরাল। উজ্জল টর্চের আলোয় সে যার চেহারা দেখতে পেল তাতে তার শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের স্রোত নেমে গেল। এটা যে মিন্টুর মা! গতকালই দাফন হয়েছে যার। পর্ব ৫ রহিম বক্স ছুটছে। ছুটছে তো ছুটছে। কাদা মাটি সবকিছু উপেক্ষা করে প্রাণপনে ছুটে চলছে। এ যেন এক দুঃস্বপ্নের রাত তার জীবনে। ক্ষণে ক্ষণে তারে মনে হচ্ছে যেন কোন ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখছে সে। রহিম বক্সের বুক থেকে এক ধরনের বোবাকান্না বের হয়ে আসে। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আর কতক্ষন এভাবে দৌড়াবে সে জানে না। মনে দুঃখ, ক্ষোভ নিয়ে দৌড়ে চলছে সে। কী ঘটে যাচ্ছে তার চারিপাশে। কি হচ্ছে এই গ্রাম ঘিরে। এটা কি প্রলয়ের আলামত! গতকালই যে মানুষের দাফন কর্ম শেষ করে এসেছে, আজ সেই মানুষের লাশের মুখোমুখি হতে হবে। রহিম বক্সের কল্পনাতেও এরকম বীভৎস বিভীষিকাময় কোন চিন্তার উদ্রেক হয়নি। আজ সে যা দেখেছে সেটা যে তার বোধ শক্তি, চিন্তাশক্তি লোপ করে দিল। তার পিছনে ধাওয়া করছে একটি লাশ! যে লাশটিকে সে একটু আগে তার ছেলের মস্তক গলদঘর্ম করতে দেখেছে! এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য কোনদিন কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি রহিম বক্স। আর সেটা পারবেও না! অবশ্য আজ রাত্রির পর যদি সে বেঁচে থাকে। রহিম বক্স এর মাথা থেকে তার ছেলের মায়া উঠে গেছে। এই মুহূর্তে সে নিজের জান বাঁচানোর জন্য প্রানপনে দৌড়ে চলছে। নিজের ছেলের জানের মায়া ছেড়ে দিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য এভাবে দৌড়াতে হবে সেটাও রহিম বক্স ভাবতে পারছে না। কিন্তু তার পিছনে যে বিকট অপার্থিব চিৎকার। কেউ তার দিকে ছুটে আসছে। রহিম বক্স আর পেছনে তাকানোর সাহস পেল না। তার যে শুধুই মনে হচ্ছিল পেছনের শব্দটি একটু একটু করে আরও কাছাকাছি চলে আসছে। একটু পরেই হয়তো কেউ তার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলবে। যথেষ্ট জওয়ান আর স্বাস্থবান লোক রহিম বক্স। পেটা শরীর তার। তারপরেও এই ভয়ঙ্কর প্রাণীর সাথে সে যে কোন রকমে পেরে উঠছে না! পরদিন সকাল। মিলিটারি উঠোনে নিম গাছের ডাল দিয়ে দাঁত মাঝছিল। তার ছ��ট ভাই পায়খানা থেকে হাতে করে একটি বদনা নিয়ে ফিরছিল। মিলিটারি দাঁত মাজতে মাজতে তার ভাইয়ের দিকে ফিরে তাকাল। বলল, কাল রাইতে বাইরে কোন হট্টগোল হইছিল? কালাম বদনাটা উঠোনের এক কোনায় রেখে বলল, হইতে পারে। আমি রাইতে কারো চিৎকারের শব্দ পাইছিলাম। আমারার বাড়ি থাইকে কিছুটা দুরে। আমার কানেও আইছে। কারো বাড়ি কি ডাকাত পরছিল নাকি? কী যে কও? ডাকাত পরবো কোথা থাইকা? দেখি আইজ দেওয়ান বাড়ি গেলে লোকজনরে জিগামুনে। কালাম উত্তর দিল। মিলিটারি দাঁত মাজতে মাজতে হঠাৎ লক্ষ করল তার দাঁতের কোনা দিয়ে একটু রক্ত বেরোচ্ছে। সে গলায় একটু পানি নিয়ে কুলকুচি করে উঠনে ফেলল। দাঁত বেশি মাজতে গিয়ে নিম গাছের শলাকা ঢুকে তার মারি কেটে গেছে। দেওয়ান বাড়িতে গ্রামের সব লোকজন নিয়ে বিরাট বৈঠক বসেছে। গ্রামের আকবর মেম্বর সেই বৈঠকের সঞ্চালক। টুটপাড়া, পূবপাড়া সহ আশেপাশের গ্রামের সব লোকজন জড়ো হয়েছে। আকবর মেম্বর একটু গলা কেশে নিল। তারপর বলতে শুরু করল, ভাইসব, আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করবার জন্য তোমাগো সকলরে ডাকা হইছে। তোমরা তো সবাই জানো ঢাকা শহরে একটা ছোঁয়াছে রোগ ছড়ায় পড়ছে। একদল বিদেশী রোগটা নিয়া প্রথমে ঢাকা শহরে আইসে। তারপর সেইটা বিভিন্ন মানুষের মধ্যে দেখা দিসে। যদ্দুর শুনছি রোগটা খুব জটিল বয়স্ক মানুষজনের জন্য। আক্রান্ত হলে তারা মারাও যাইবার পারে। একটা দীর্ঘশ্বাস নিল আকবর মেম্বার তারপর বলে চলল, এই যেমন মিন্টু ঢাকা ছাইড়া আইছে, তার দুইদিন পরে তার মায় মারা গেছে। আমারার ধারণা মিন্টু ঢাকা শহর থাইকা এই রোগ সাথে নিয়া আইছে। এবার একটু গলা কেশে নিলো আকবর মেম্বার। তারপর একটু ধমকের সুরে বলল, শোনো মিয়ারা, যারা গ্রামের বাইরে থাইকা গ্রামে ঢুকছে, তাদের সবার সাথে আইজ হইতে গ্রামের সবার দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ। সবুর দেওয়ান কথার মাঝে বলে উঠল, আমার তো মনে হয় ঢাকা শহরে যুদ্ধ লাগছে। হইবার পারে। মেম্বর একটু বিরক্তির স্বরে বলল। যাই হোক, আমরা সবাই আগামী এক মাস মিন্টুরে একঘরে কইরা রাখার সিদ্ধান্ত নিসি। আর যারা যারা মিন্টুর বাড়িতে গেছিলা, মিন্টুর মায়ের জানাজায় অংশগ্রহণ করছো, তারা সবাইও এক ঘরে হইয়া থাকবা। এক মাসের জন্য ঘর থেকে বাইর হইবা না। তোমাগো খাওন-দাওন যা লাগবো আমরা বাড়িতে পৌঁছায় দিমু। ভিড়ের ভেতরে মানুষের ফিসফিস বেড়ে গেল। ফিসফিসানি বন্ধ করতে আকবর মেম্বার বলল, এই সিদ্ধান্ত আমরার গ্রামবাসীর মঙ্গলের জন্য। আর এইটা আমার বানানো কোন বিষয় না। সরকারের পক্ষ থাইকা সন্দেহভাজন লোকদের এক মাস আলাদা কইরা রাখবার কথা বলা হয়েছে। আকবর মেম্বার একটু থামল তারপর ভিড়ের মধ্যে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করলো। সামসু হাসেম তোমরা সামনে আসো। বলল সে। সামসু আর হাসেম একে অপরের দিকে তাকালো। তারপর ভিড় ঠেলে সামনে বের হয়ে এলো। হারিস দেওয়ান বলল, তোমরা একটু পাশে সইরা দাঁড়াও মিয়ারা। সামসু আর হাশেম ভিড় থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ালো। হারিস দেওয়ান সবুর দেওয়ানের বাবা। তোমরা তো মিন্টুর সাথে দেখা করতে গেছিলা। আকবর মেম্বার বলল। হ, গেছিলাম। শামসু উত্তর দিলো। ওরে তোমরা কি কেউ হাত দিয়া স্পর্শ করছিলা। সামসু আর হাসেম কোন উত্তর দিল না। যাই হোক, তোমরা দুইজন বাড়ির ভিতর এক ঘরে হইয়া থাকবা, আগামী এক মাস। হাসেম কিছু একটা বলতে গেল। সামসু ওর হাত চেপে ধরল, বলল, যে আচ্ছা। আর যারা যারা তার সাথে তার মায়ের দাফন করতে কবরস্থানে গেসিলা তারাও আজকের দিন থাইকা বাড়ির বাইরে বাইর হইবা না। আগামী এক মাস। এবার আকবর মেম্বার তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালদেহী লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, শফিক তুই এই বিষয়টা নজরে রাখবি। শফিক উচা লম্বা পালোয়ানের মত। ওকে গ্রামের সবাই ভয় পায়। ওর একটা ছোটখাটো গ্যাং আছে যারা  রীতিমত গ্রামে মস্তানি করে বেড়ায়। চাঁদা তুলে। মেম্বর আবার ওদেরকে খুব তোয়াজ করে। হারিস দেওয়ানও ওদেরকে পাল পোষ করে। রহিম বক্স সভায় আসে নাই? হঠাৎ শিক্ষিত সবুর দেওয়ান বলল। ভিড়ের লোকজন একে অপরের দিকে এদিক ওদিক তাঁকালো। রহিম বক্স সেখানে নেই। এই ঘাড় ত্যাড়া লোকটা সারাজীবনেই অসামাজিক ছিল। এখনো আছে। এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সভায় সে আসে নাইক্কা। সবুর দেওয়ান বলল। রহিম বক্স এর এখনো হুশ ফেরেনি। একবার সে কিছু বলে উঠছিল কিন্তু জড়ানো কন্ঠে কি বলছিল সেটা  তার বউ ঠিক বুঝে উঠতে পারে নাই। রহিম বক্সের পা এ একটা বিরাট আচড় মনে হচ্ছিল। বড় বড় নখরযুক্ত পাঁচ আঙ্গুল দিয়ে কেউ যেন তার পা আচড়ে ধরেছিল।  কালামের বউ একহাতে পাখা নিয়ে রহিম বক্স এর মাথায় উপর বাতাস করছে। আর রহিম বক্স এর বউ তার মাথায় পট্টি দিচ্ছে। বাইরে মিলিটারি আর কালাম এসেছে। ছোট্টু আর মেজোর সাথে কথা বলছে। কাল রাত থাইকা কালুর কোন খোঁজ নাই মিলিটারি চাচা। ছোট্টু বলল। বাজানে কালুরে খুজতে গেছিল। তারপর কি হইছে আমরা কেউ কিছু জানি না। ভোরের দিকে বাজানের চিৎকার শুনে আমরা বাইরে বের হই। বাজান কোন রকমে উঠোনে আইসে পইরা যায়। বলে আমারারে ভেতরে নিয়ে চল। শিগগির ঘরের ভেতরে নিয়া চল। আমরারে মাইরে ফেলবে। এই বলে সে মায়ের হাতের উপরেই পইড়া যায়। আমরা তারে দ্রুত ঘরে নিয়া যাই। মায় ঘরে খিল দেয়। বাকিটা সময় আমরা ঘর থাইকা বাইর হই নাই। কিছু একটা ঘরের বাইরে ওই সময়টা হাঁটাচলা করছে। আমরা ভয়ে আধমরা হই গেছিলাম। মনে হইছে কোন হিংস্র প্রাণী আমরারে খাবার জন্য বাইরে ঘোরাঘুরি করতাছে। ছোটুর সমস্ত চেহারাজুড়ে আতঙ্কের ছাপ। হিংস্র প্রাণী! কালাম বিশ্বাস করতে পারতেছে না। হয়। আমরা ঠিক বুঝবার পারি নাই। আর বাজানের পায়ে তো আচড়ও দিসে। ছোট্টু বলল। এই তল্লাটে তো এক শিয়াল কুকুর ছাড়া আর কোন প্রাণী নাই। তয় কোন পাগলা শিয়াল কুত্তাও আক্রমণ কইরা থাকতে পারে। খোঁজ নিতে হইব। কালাম বলল। কোন শিয়াল কুত্তা পাগল হয়ে গিয়া থাকলে গেরামের বাচ্চা-কাচ্চা বুড়া মানুষ যে কেউ বিপদে পড়বার পারে। মিলিটারি এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবার মুখ খুলল, আমার মনে হয় এটা কোন কুত্তা বিলাই না, আরো শক্তিশালী কিছু। আর পায়ে যে আচর দেখলাম সেটা  পাঁচ নখের। শিয়াল কুত্তার চারটা নখ হয়, পাচটা না। কালামের চেহারায় চিন্তার ভাঁজ। খোদাই জানে আমার মায়ের সাথে কি হইছে। আমার মনে হয় আমাদের সবার আকবর মেম্বার এর কাছে যাওয়া উচিত। তারে বিষয়টা জানানো উচিত। সখিনার বাপ খুব ধার্মিক লোক। সে প্রতিদিনই নামাজের পাটিতে বসে তার ছেলে মেয়ের জন্য কান্নাকাটি করে। আজ প্রায় সপ্তাহখানেক হলো দুজনই নিখোঁজ। সখিনার বাপ সম্ভাব্য সব জায়গায় ওদেরকে খুঁজতে গেছে। বুড়ো মানুষ, গায়ে শক্তি নেই তা না হলে পাশের গ্রামে মিলিটারির বাড়িতে যেতো সে। ছেলে মেয়ে হারিয়ে যাবার পর তাকে দেখা শোনার কেউ নেই। এখন সে তার বোনের বাড়িতে।   এই বুড়ো বয়সে ছেলে মেয়ে খুইয়ে তার অন্তরাত্মার শেষ শান্তিটুকু নষ্ট হয়ে গেছে। মনে অশান্তি রাতে ঘুম নেই। সে ভাবলো একবার হলেও মিলিটারি বাড়িতে যাবে সে। কেন জানি তার ধারনা তার ছেলেমেয়ে সেখানে গিয়ে থাকতে পারে। যদিও তার বোন কোন ভাবেই তাকে সেখানে যেতে দিতে রাজি নয়। মিলিটারিদের সাথে তাদের সম্পর্ক যে অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে।
পর্ব ৬ কালু' বলে চিৎকার করে বিছানায় উঠে বসলো রহিম বক্স। আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজতে শুরু করলো কালুকে। তার স্ত্রী ছোট্টু, মেজো সবাই থাকলেও ঘরে কালুকে খুঁজে পেল না সে। খাট থেকে নামতে যাবে তখনই তার ডান পায়ে একটু ব্যথা অনুভব করলো। গোড়ালির উপর থেকে হাটুর নিচ পর্যন্ত সাদা কাপড়ে ব্যান্ডেজ করা তার পা। কোন কিছু তোয়াক্কা না করে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ল রহিম বক্স। খাটের পাশে নিচে মেঝেতে বসা ছিল তার স্ত্রী। একবার তার দিকে তাকিয়ে কি একটা ভেবে এক দৌড়ে উঠোনে চলে গেল সে। হন্তদন্ত হয়ে এদিক সেদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। পেছন পেছন তার স্ত্রী উঠনে বেরিয়ে এলো। রহিম বক্স এর অস্থিরতা তার চোখ এড়ালো না। আমরার কালুর কি হইছ? রহিম বক্সের অস্থিরতা দেখে এক অজানা শঙ্কায় তার স্ত্রীর ভেতরটা গ্রাস করল। আঁচলের কাপড় দিয়ে নিজের নাক চোখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল। এবার যেন রহিম বক্সের ভ্রম কাটলো। উঠোনের মাঝখানে হাঁটু গেড়ে বসে পরল সে। তার স্ত্রী দৌড়ে তার কাছে এগিয়ে গেল। বসে জড়িয়ে ধরল তাকে। মাথা নাড়তে নাড়তে নিচু গলায় রহিম বক্স বলল, আমরার কালু নাইরে, কালুর মা! আমরার কালু নাই! … অবশেষে সখিনার বুড়ো বাপ মিলিটারির বাড়ি পৌঁছাতে পারল। মিলিটারি! কালাম! বাড়ি আছোনি? গলা হাঁকিয়ে তাদের ডাকলো বুড়ো। লাঠিতে ভর করে ঠক ঠক শব্দে উঠোনে এসে দাঁড়াল। বুড়োর গলা শুনে ঘরের ভেতর থেকে একটা গেঞ্জি মাথা গলিয়ে গায়ে দিতে দিতে বাইরে বেরিয়ে এলো মিলিটারি, ছোট ভাই কালাম আর পেছন পেছন কালামের বউ। বুড়োকে দেখে কালামের চেহারায় একটু খুশির ছাপ ফুটে উঠল। বলল, কেমন আছেন বাজান? কালাম ও মিলিটারি বুড়োর সৎ ছেলেপেলে। কুঁজো বুড়ির আগের ঘরের ছেলে মেয়ে হল সখিনা ও ইদ্রিস। জোয়ান বয়সে বুড়ো অনেক বেশি অত্যাচার করত তাদের মায়ের উপর। একবার লাঠিপেটা করে তাদের মায়ের কোমরের হাড় ভেঙে দেয় সে। তখনই এই বুড়োকে ছেড়ে চলে আসে কুঁজো বুড়ি। আর এই গ্রামের শহীদ মুন্সির সাথে তার বিয়ে হয়। শহীদ মুন্সী মিলিটারি আর কালামের বাবা। বছরখানেক হলো যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে সে। সৎবাপের উপর এখন আর সেই ক্ষোভ নেই কালামের। কুজোবুড়ি নিজেও তাকে মাফ করে দিয়েছে অনেক আগেই। বুড়ি হারিয়ে যাওয়ার আগে বুড়োর অনেক পুরনো স্মৃতি নিয়ে ছেলেদের সাথে গল্প করত। কালাম বুড়োকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর হু হু করে কেঁদে উঠলো। বলল, আমরার মায়েরে খুঁজে পাইতেছি না, বাজান! ... রহিম বক্স মিলিটারিকে সাথে নিয়ে সন্ধ্যা পাড়ায় কবরস্থানে গেল। সেখানেই মিন্টুর মায়ের লাশ দাফন করা হয়েছে। সকালের দিকে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। তাই পুরো কবরস্থান কাদায় সিক্ত। কবরস্থানের আশেপাশে নেই কোনো মানুষজন। জনমানব শূন্য নীরব নিস্তব্ধ চারিদিক। সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। আর কিছুক্ষণ পরে আঁধার নেমে আসবে। তাই যা কিছুই করার খুব দ্রুতই করতে হবে তাদের। মিলিটারি আঙ্গুল দিয়ে এক কোনায় একটি কবর নির্দেশ করে দেখালো। মিয়া ভাই, ওই কোনার কবরখানাই! রহিম বক্স মাথা ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাল। কাদা মাটির উপর দিয়ে খুব সাবধানে পা ফেলে চলল। দূর থেকে দেখে সবকিছু ঠিকঠাকই মনে হচ্ছিল। মনে মনে প্রার্থনা করলো রহিম বক্স যেন তার শঙ্কা কোনভাবেই সত্যি না হয়। সেদিনকার পুরো ঘটনাটি যেন শুধুই একটি দুঃস্বপ্ন হয়। সতর্ক পদক্ষেপে এক পা দু পা করে এগিয়ে যাচ্ছিল রহিম বক্স। সে জানে এখানে কিছুই পাবে না। একটি সাধারণ স্বাভাবিক কবর ছাড়া আর কিছু থাকবে না। ব্যাপারটিকে এবার বিশ্বাস করতে শুরু করেছে রহিম বক্স। সেদিন তবে কিছুই ঘটেনি। সবই ছিল একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র! কবরের একদম সন্নিকটে আসতেই রহিম বক্স এর ভুলটি পুরোপুরি ভেঙে গেল। তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। পুরো কবরটা যে ভেতর থেকে দোমড়ানো মোচড়ানো। এটাকে আর কবর বলার উপায় নেই। একটা উঁচু নিচু ছোটখাটো ডোবা যেন। বৃষ্টির পানি চুইয়ে চুইয়ে ভেতরে পড়ে গর্তটি অনেকখানি ভরে গেছে। আশ্চর্য! এটাতো আর কবরের চেহারায় নেই! মিলিটারি বলে উঠলো। কোন শিয়াল কুকুরের কাজ! চুপ করে রইল রহিম বক্স। কোন উত্তর দিল না। মানসিকভাবে যেন বিপর্যস্ত সে। কিছুতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে সত্যিই সত্যিই ঘটেছে ব্যাপারটা! এই গর্তের ভেতর থেকে কিছু একটা বাইরে বেরিয়ে এসেছে। বাইরে থেকে খোড়া কোন প্রাণীর গর্ত এটি নয়। রহিম বক্স এর পেটের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। কিছু একটা ভেবে যেন গুলিয়ে উঠলো। তারপরই হুরমুর করে সে চারিদিকে বমি করে দিল। মিলিটারি ছুটে তার পাশে গেল। রহিম বক্স হাটু গেড়ে কাদায় বসে পড়ছে। … শফিক তাঁর লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে মিন্টুর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার সাথে থাকা এক সাঙ্গকে ইশারায় মিন্টুকে ডাকার নির্দেশ দিল। মিন্টু ভাই! একটু বাইরে আসো। তোমার জন্য বাজার সদাই নিয়া আইছি। শফিক লাঠিয়াল গটমট করে তার পাশে থাকা সাঙ্গোর দিকে তাকালো। সাঙ্গো কাচুমাচু করে গলা নামিয়ে নিল। শফিকের সামনে একটু জোরেই চিৎকার করে ফেলেছে সে। তাদের একজনের হাতে একটি বড় বাজারের ব্যাগ। আকবর মেম্বর মিন্টুর জন্য এক সপ্তাহের বাজার পাঠিয়েছে। কয়েক মুহূর্ত পর মিন্টুর ঘরের খিল শব্দ করে খুলতে শুরু করল। দরজার একটা কপাট খুলে গলা বাড়িয়ে মিন্টু বলল, কে ওখানে? শফিকের সাঙ্গ উত্তর দিলো, মিন্টু ভাই আমাদের মেম্বার সাব তোমার জন্য বাজার পাঠাইছে। মিন্টু বলল, উঠোনের কোনায় রাইখা যাও। আমি নিয়া নিবো নে। সাঙ্গ একটু আমতা আমতা করে বলল, ওস্তাদ, তোমার সাথে দুইটা কথা কইব। একটু বাইরে আসো। মিন্টু কোন উত্তর দিল না। ঘরের ভিতরে গেল। একটু পরে একটা জামা গায়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। সাঙ্গ বলল, হইছে। ওইখানেই দাড়াও। শফিক ওর সাঙ্গকে এক হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে নিজে একটু সামনে এগিয়ে গেল। শফিকের হাতে একটা মোটা চওড়া লাঠি। তার সাঙ্গোপাঙ্গ তাকে আর সামনে যেতে মানা করল, বলল, ওস্তাদ দূরে খাড়াও। অতো সামনে যাইতেছ কেন? শফিক হাতের ইশারায় থামতে বলল ওদের। সঙ্গে সঙ্গেই চুপ মেরে গেল দুজনে। মিন্টুর অনেকটা কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো শফিক। বলল, তোমার তো ঢাকা ছাইড়া আসা উচিত হয় নাই, মিন্টু। দাত খিটমিট করছিল সে। মিন্টু একটু ইতস্তত করল, তারপর বলল, আমি তো ইচ্ছা কইরা আসি নাই। আমারে ঢাকা ছাইড়া যাইতে বলা হইছে। তোমার কি এমন হয়েছিল যে তোমারে ঢাকা থাইকা গ্রামে পাঠায় দিলো। মিন্টু সাথে সাথে কোন উত্তর দিল না। একটু পরে বললো, আমিতো এখন সুস্থ আছি। পুরোটাই সাইরা উঠছি। শফিক একটু যেন রেগে গেল। বলল, তুমি কি ডাক্তার নাকি? তুমি বুঝলা কেমনে ভালো হইয়া গেছো? পরপরই নিজেকে একটু সামলে নিয়ে কটমটে দৃষ্টিতে বলল, তুমি তো তোমার মায়ের মৃত্যুর কারণ! তুমি যে আরো কত মানুষের মৃত্যুর কারণ হইয়া দাঁড়াইবা, এক খোদাই জানে! ঢাকা থাইকা এই অসুখে তুমি মইরা গেলেও গ্রামবাসী বাইচা যাইতো। এখন তো তুমি নিজেও মরবো বাকি সবাইরে নিয়ে মরবা। আমি তো বলছি মিয়া ভাই, আমি সুস্থ হইয়া গেছি। মিন্টু একটু উত্তেজিত হয়ে পরলো যেন এবার। তোমারে কইলাম না? তুমি কি ডাক্তার হইয়া গেছো? তুমি জানো কেমনে তুমি সুস্থ হইছো? সামনে আহো দেহি মিয়া! পিছন থেকে সাঙ্গোপাঙ্গ শফিককে উদ্দেশ্য করে বলল, ওস্তাদ আমারার কাজ তো এখানে শেষ। চলেন যাই। শফিক আবারো হাতের ইশারায় ওদেরকে থামতে বলল। ওর চেহারায় এক ধরনের কাঠিন্য ফুটে উঠেছে। সাঙ্গোপাঙ্গ দুজনেই বুঝতে পারল শফিকের মনের ভেতর কোন একটা উদ্দেশ্য কাজ করছে। কিন্তু কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ শফিক তাঁর হাতের মোটা শক্ত বাশটি তুলে মিন্টুর মাথায় সজোরে একটা আঘাত করে বসল। 'ওমা গো!' বলে সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পরলো মিন্টু। পেছনে থাকা সাঙ্গোপাঙ্গ দুজনই দ্রুত শফিকের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। একি করলেন, ওস্তাদ! শফিক এক হুঙ্কার দিল। বলল, আশেপাশে আসবি না। মিন্টু শরীর থাইকা এই রোগ ছড়ায় পড়তো। তাই আমি ওরে খতম কইরা দিলাম। আইজ আমি যেইটা করছি এই গ্রামের ভালোর জন্যই করছি। একদিন সবাই বুঝবার পারব। পেছন থেকে একজন বলে উঠল, ওস্তাদ! মিন্টু তো সুস্থ হইয়া গেছিল। শফিক ওদের দিকে ফিরে রীতিমত একটা গর্জন করল, বলল, যা বলেছিস সেইটা এইখানেই কবর দিয়া যাবি। এই কথা যেন তোগোর মুখে এই জীবনে আর না শুনি। মিন্টু আমারার উপর হামলা করেছিল। তাই আম���া ওকে লাঠিপেটা করছি। নিজের জীবন বাচাইছি। শফিক তাঁর হাতের মোটা বাসটি সজোরে মাটিতে ঠুকে দিল। সাঙ্গোপাঙ্গ দুটি ভয়ে সিঁটকে গেল আর দ্রুত মাথা নাড়তে থাকল। শফিক খাবারের ব্যাগটা নিজের হাতে তুলে নিল। তারপর পথের দিকে পা বাড়ালো। পেছনে মিন্টুর নিথর দেহ মাটিতে পড়ে ছিল আর তার মাথা বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়া রক্ত মাটি ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
পর্ব ৭ রহিম বক্স মিলিটারির গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। মিলিটারি তার পিঠ চাপড়ে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করল। মিয়া ভাই, এইবার উঠো। সন্ধ্যা নাইমা আসতেছে তো। বাড়ি যাইতে হইবো। রহিম বক্স এর এবার যেন ঘোর ভাঙলো। কিছু একটা ভেবে একটু নড়েচড়ে উঠলো। তারপর চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালো। হুম, ঠিক কইছো, মিলিটারি। বাড়ি যাইতে হইবো। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল সে। সন্ধ্যা নেমে আসার আগে তাদের বাড়িতে পৌঁছাতে হবে। এই কথাটি রহিম বক্স এর চেয়ে ভালো এই মুহূর্তে আর কেউ জানে না। কবরখানা দেইখা তো মনে হইতাসে তোমার কথাই ঠিক। রহিম বক্সকে উদ্দেশ্য করে বলল মিলিটারি। এই কবর শিয়াল কুকুরে খোড়া নয়। একটু থামল সে। তারপর বলল, কিন্তু ভেতর থাইকা একটা লাশ কিভাবে কবর খুঁইড়ে বাইর হইয়া আসতে পারে? মিলিটারি দ্বিধান্বিত। তবে কি মিন্টুর মা জীবিতই ছিল! তারে জীবিত অবস্থায় সবাই তারে কবর দিয়া দিছে! মিলিটারির কথার কোন জবাব দিল না রহিম বক্স। একদম চুপ মেরে আছে সে। তার কাছে অংক এখন দুয়ে দুয়ে চার। এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত, সেদিন রাতে ওইটা মিন্টুর মা-ই ছিল আর সেটার খাদ্য ছিল তারই ছেলে। কালুর কথা ভাবতেই বিষাদ ভরা বুক নিয়ে আবারো ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল সে। এবার আর মিলিটারি তাকে থামানোর চেষ্টা করল না। বরং তার হাত ধরে দ্রুত পদক্ষেপে তাকে নিয়ে হেঁটে চলল। হঠাৎই খট করে একটি শব্দ শুনতে পেল মিলিটারি। শব্দটি তাদের থেকে পেছনে কিছুটা দূর থেকে আসছে। ভাই কিছু শুনলাম! রহিম বক্সকে উদ্দেশ্য করে বলল মিলিটারি। শব্দটির নিজেও শুনেছে রহিম বক্স। সে কান্না থামিয়ে দিয়েছে। পিছনে তাকানোর দরকার নাই মিলিটারি। চুপচাপ সামনে আগায় চলো। মুখ চাপা দিয়ে বলল রহিম বক্স। মিলিটারি কোন উত্তর করল না। আরো বড় বড় পদক্ষেপ সামনে এগিয়ে চলল। রাস্তার দু'ধার ধরে বিশাল বড় বড় পুরনো গাছ। সামনের দিকটা অন্ধকার করে রেখেছে। পথটাও কাদামাখা। ইতিমধ্যে সূর্য ডুবে গেছে। অনেকটা রাত নেমে এসেছে। অল্প কিছুটা আলো এখনো রয়ে গিয়েছিল। সেই আলোয় রহিম বক্স পেছনে তাকিয়ে দেখল একবার, তাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে পেছনে রাস্তায় কেউ একজন ধানক্ষেত থেকে ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসছে। তার চলাফেরা, শরীরের দুলুনি রহিম বক্স এর কাছে ভালো ঠেকলো না। তার কাছে যেন এরকম শরীর টেনেহিঁচড়ে চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটা কারো বা কিছু একটার অনুকরণ মনে হল। কথাটি ভাবতেই ভাবতেই সে কিছু একটা আচ করতে পারল। এই অনুকরণ আর কিছুই নয়, মিন্টুর মায়ের লাশের শারীরিক ভাষা! হঠাৎ করে রহিম বক্স এর সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। চাপা কন্ঠে মিলিটারির উদ্দেশ্যে বলল, মিলিটারি, দৌড় শুরু করো। মিলিটারি প্রথমে তার কথা ধরতে পারল না। এবার রহিম বক্স একটু জোরে বলল, দৌড়াও মিলিটারি। বলেই সে নিজে দৌড় দিতে আরম্ভ করলো। কাদামাখা পিচ্ছিল পথে দৌড়ানো যে কতখানি কষ্টের সেটা তারা দুজনে ভালোই টের পেল। দৌড়াতে দৌড়াতে একবার পেছন দিকে তাকালো রহিম বক্স। কালো অশুভ ছায়াটি যেন তাদের পেছনে দৌড় দিতে শুরু করেছে। প্রথমে ব্যাপারটি বুঝে উঠতে পারেনি কেউ। একটু পরে যেটা বুঝতে পারল তাতে করে হৃদপিন্ডের গতি যেন হাজার গুণ বেড়ে গেল। কালো ছায়াটি কি তবে সত্যি সত্যি তাদের পেছনে দৌড়াতে শুরু করেছে! কতক্ষণ এইভাবে দৌড়াচ্ছে জানা নেই দুজনের। মনে হচ্ছিল হাজার ঘন্টা পার হয়ে গেছে কিন্তু এই পথ শেষ হচ্ছে না। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ করেই  কাদায় পা সটকে পড়ে গেল মিলিটারি। তৎক্ষণাৎ থেমে গেল রহিম বক্স। দ্রুত তার কাছে গিয়ে হাত দুটি ধরে টেনে উঠানোর প্রানপন চেষ্টা করলো। এরমধ্যে অশুভ ছায়াটি আরো অনেক দূর সামনে এগিয়ে এসেছে। সেটার বিকট আর্তচিৎকারে কয়েক মুহুর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল রহিম বক্স। মিলিটারি তার অবস্থা দেখে বলল, মিয়া ভাই, তুমি দৌড়াও! দৌড়াও, মিয়া ভাই! নিজের জীবন বাঁচাও! মিলিটারিকে ছেড়ে যেতে চাইলো না রহিম বক্স। কিন্তু তাকে এখন আর সে সাহায্যও করতে পারবে না সে। ছায়াটি অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। উপায়ন্তর না দেখে মিলিটারিকে ফেলে রেখেই দৌড় শুরু করলো রহিম বক্স। আশেপাশে আর তাকানোর সুযোগ নেই। সে জানে তাকে এখান থেকে বের হতে হবে। এই জিনিসের হাতে ধরা পরলে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না সে। ছুটতে ছুটতে কত দূর চলে এসেছে জানা নেই তার। এর মধ্যে একবারও পেছনে ফিরে তাকায়নি সে। সামনে হাতের ডানে একটি বাক দেখতে পেল রহিম বক্স। বাক ঘুরতে ঘুরতে একবার পেছনে তাকাল। আকাশে সূর্য নেই। চারিদিকে অন্ধকার নেমে গেছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না পেছনে। চিৎকারের শব্দ পেছনেই ফেলে এসেছে সে। ... রহমান চাচার দোকানে বসে সবুর দেওয়ান আড্ডা দিচ্ছিল আর হাতে নিয়ে দামী বিড়ি খাচ্ছিল। রহমান আমার মনে হয় তোমারও দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া উচিত। দেশের যা অবস্থা এইভাবে দোকানপাট খোলা রাখলে মানুষের আড্ডা বাড়বে। চলাচল বাড়বে। হ, আমিও তাই ভাবতেছিলাম। রহমান উত্তর দিল। আমারও তো জানের ভয় আছে। কত রকমের কত গ্রামের লোকজন সারাদিন দোকানে আসা যাওয়া করে। কে ঢাকা শহর থাইকে আসছে তা তো বোঝার উপায় নাই। কিন্তু পেটের দায়ে দোকান চালাইতে হয়। নিরুপায় কন্ঠে বলল রহমান চাচা। শুনলাম রহিম বক্সের এক পোলা নাকি হারায় গেছে? সবুর দেওয়ান জানতে চাইল। হ, আমিও তাই শুনছি। রহমান উত্তর দিল। এই গ্রামে কি শুরু হইল একজনের পর একজন মানুষ নিখোঁজ হইতাছে! আরে দেখো কোথায় চুরি-চামারি করতে গিয়ে ধরা খাইছে। আটকায় রাখছে না হয় জেলহাজতে দিছে। কাল বাদে পরশু গেরামে খবর হইয়া যাইবে। সবুর দেওয়ান উত্তর দিল। তা হইবার পারে। রহিম বক্স এর এই পোলাটা খুবই চঞ্চল আর মেলা দুষ্ট। গ্রামে গ্রামে ওর নামে বদনাম আছে। প্রতিমাসেই দুই-চারটা বিচার আচার আসে। কারো আম গাছে তো কারো জাম গাছে তার চলাচল। বরই, পেয়ারা কিছুই বাদ রাখে না। নির্বিকারে বলল রহমান। হুম ঠিকই কইছো। বলল সবুর। শেষ মাসে টুটপাড়ার মাখনলালের পোলা দিলিপ হারায় গেল না? হের কি আর খোজ পাইছিল কেউ? প্রসংগ পাল্টালো রহমান। কিন্তু সবুর দেওয়ান কোন উত্তর দিল না। একটু পর বলল, আচ্ছা আইজ আমি উঠলাম রহমান। বাকির খাতায় কত টাকা খাইছি লিখা রাইখো। কথাটি বলেই সবুর দেওয়ান বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালো। মুখে ধরা দামি বিড়িতে আরেকবার সুখ টান দিলো। তারপর মাটিতে ফেলে পা দিয়ে মেরে দিল। পকেট থেকে চাবি বের করে সেটি ঘুরাতে ঘুরাতে বাইকের সামনে গেল। বাইক স্টার্ট দিয়ে মুহূর্তেই সেখান থেকে গায়েব হয়ে গেল। কালাম, সন্ধ্যা হইয়া পড়ছে। মিলিটারি তো এখনো বাড়ি ফিরল না। বুড়ো সৎ বাপের চেহারায় চিন্তার ছাপ। মিয়া ভাই, মাঝেমধ্যেই একটু দেরি কইরা বাড়ি ফেরে। এইডা ��র নতুন কি। একটু মুখটা বাঁকা করে উত্তর দিল কালামের বউ। দেখি আরেকটু অপেক্ষা কইরে। এর মধ্যে না ফিরলে আমি খুজতে বাইর হইবো। খাটিয়ায় বসা কালাম বলল। কালামের বউ সাথে সাথেই ঘুরে উঠে কালামের পাশে গিয়ে বসল। বলল, খবরদার আপনে এই রাইতে কোথাও যাইবেন না। কালাম কোন উত্তর দিল না। তার বউ আবার বলে উঠল, আপনে কোনভাবেই যাইতে পারবেন না। আমি যাইতে দিমু না। কালাম তবুও চুপ। 
পর্ব ৮ রহিম বক্স দৌড়ে কিছুটা নিরাপদ দূরে চলে যেতে পারলেও, মিলিটারি তখনও রাস্তায় কাদার উপর পড়ে। সারা শরীর কাদাপানিতে মাখামাখি। কোন রকমে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকাল মিলিটারি। পেছনে ভয়াবহ অবয়বটি এখন তাকে প্রায় ছুঁই ছুঁই। আছড়ে পড়ে তার ডান হাতের কনুইতে বেশ লেগেছে। তৎক্ষণাৎ কিছু বোঝা না গেলেও মিলিটারির মনে হল সেটি মচকে যেয়ে থাকতে পারে। পেছনে ছায়াটি বিকট শব্দ করতে করতে অনেকটা কাছে চলে এসেছে এখন। কয়েক মুহূর্তেই মনে হয় ধরে ফেলবে তাকে। মিলিটারিও সহজে হার মানার পাত্র নয়। সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পর সেখানকার মানসিক, শারীরিক চাপ সে নিতে পারেনি সত্যি। সেনা অফিসারদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপ তার আত্মসম্মানে প্রচুর আঘাত হানে। চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে অনেকটা পালিয়েই চলে আসে। আজো সেই কথা মনে হলে নিজেকে বড় কাপুরুষ মনে হয়। কিন্তু মিলিটারি কাপুরুষ নয়। তার ভেতরের একটা অংশ সবসময়ই সেটি মনে করে এসেছে। এবং সেটা আজ প্রমাণ হতে চলেছে। মিলিটারি আজ হার মানল না। নিজেকে টেনে হিঁচড়ে কোন রকমে রাস্তার কিনারায় নিয়ে গেল। কিনারা থেকে এক রকম গড়িয়েই পাশের ক্ষেতের উপর গিয়ে পড়ল। ভাগ্য তার সহায় ছিল। ছোটখাটো কিছু আচড়, চিড়ে যাওয়া ছাড়া বড় কোনো আঘাত লাগেনি। নিজেকে কোনরকমে টেনে তুলে ক্ষেতের আইল ধরলো সে। ছোট ছোট পায়ে দুলতে দুলতে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। একবার উপরে রাস্তায় তাকিয়ে ছায়াটির অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলো। মিলিটারিকে লক্ষ্য করেছে সেটি। এই দিকে ছুটে আসছে। মিলিটারির শরীরে ততক্ষনে আরষ্টতা ভর করছে। পা দুটি যেন ভারী হয়ে আসছিল তার। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও ছুটে চলা বন্ধ করেনি সে। মিলিটারি জানে ছায়াটি খুবই ক্ষিপ্রগতির। সেটির সাথে দৌড়ে পেরে এক রকম অসম্ভব। কিন্তু তবুও হাল ছেড়ল না সে। কিছুদুর যেতেই পেছনে ঝপাৎ করে একটি শব্দ শুনতে পায় মিলিটারি। ছায়াটি রাস্তার উপর থেকে নিচে লাফিয়ে পরেছে। আবছা চাঁদের আলোয় সেটার শারীরিক ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ক্ষেতের কাদামাটির ভেতর হাঁটু অবধি গেড়ে গেছে। এলোপাতাড়িভাবে অনবরত হাত দুটি ছুটে চলছে। অদ্ভুতভাবে শরীর বাকাচ্ছে, কোন মানুষের পক্ষে সেটি করা সম্ভব নয়। অপার্থীব এই প্রাণীটি বেশিক্ষণ এখানে আটকেও থাকবে না জানে মিলিটারি। তবে এতটুকু সময়ও এখন তার জন্য আশীর্বাদ। তাকে এর মধ্যে যথাসম্ভব নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে হবে। মিলিটারির মনের বল যেন আরো বেড়ে গেল। আগের চেয়ে পা দুটি এখন বেশি সচল মনে হচ্ছে। চিত্কারটিও এখন খানিকটা পেছনে পড়ে গেছে। কিন্তু মিলিটারি জানে এই ছায়াটি নাছোড়বান্দা। খানিকটা দূরে চলে আসার পর তার এই ধারনাটি যে সঠিক সেটি বুঝতে পারল সে। ক্ষেতের মধ্য দিয়ে ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দে জন্তুটি ঠিকই তার দিকে এগিয়ে আসছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি আইল ধরে ফেলবে। . অনেক রাত হয়েছে। রহমান চাচা তার দোকান বন্ধ করবে। প্রায় সবগুলি কপাট নামিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ লক্ষ করল ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে কেউ একজন দৌড়ে এই দিকেই এগিয়ে আসছে। একটু অবাক হল সে। এই রাতে ধান ক্ষেতের মধ্যে কে? কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে তার হাতের টর্চটা উঁচু করে আলো ফেলল। ফকফকে সাদা আলোতে মিলিটারির চেহারাখানা দেখতে পেল সে। মিলিটারি পড়িমড়ি করে দৌড়ে রাস্তার উপরে উঠে আসার চেষ্টা করছে। রহমান মিলিটারিকে টেনে উপরে উঠতে সাহায্য করলো। তার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে সে যারপনাই অবাক হল রহমান। মিলিটারি হইছে কী তোমার? হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল সে। মিলিটারি কোন জবাব দিতে পারল না। হাঁপাতে হাঁপাতে রহমান চাচার হাত ধরে টেনে দোকানের ভেতরে নিয়ে গেল। তারপর ঝুকে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, কপাটটা বন্ধ করো, চাচা! হইছে কি? চোর ডাকাত পরছে নাকি? রহমান চাচার চোখে মুখে তখনো বিস্ময়। সে হাতে ধরা টর্চটি ধান ক্ষেতের দিকে তাক করল। মিলিটারি সাথে সাথে তার হাতটি ধরে নিচে নামিয়ে দিল। বলল, শিগগির আলোটা বন্ধ করো।   রহমান চাচা টর্চ নিভিয়ে দিল। ভয়ার্ত চোখে জিজ্ঞেস করল, আমরারে খুইলা বল, কোন জন্তু জানোয়ার না তো? মিলিটারি অস্ফুট স্বরে শুধু বলল, তার থেকেও বহুগুনে খারাপ কিছু। তুমি দোকানের কপাটটা নামাও। কথাটি বলে সে নিজে থেকে কপাটগুলি টেনে নামাতে শুরু করে দিল। মিলিটারির ক্ষিপ্রতা দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারল রহমান চাচা। নিজে বাকি কপাটগুলি চটপট করে টেনে নামিয়ে দিল। কিছুক্ষণের জন্য বাইরে সবকিছু শান্ত ছিল। রহমান চাচা মিলিটারির পাশে চুপ করে বসে আছে। কিছু একটা বলতে যাবে সে, এমন সময় দোকানের বাইরে কিছু একটার হ্যাচরানোর শব্দ শুনতে পেল সে। তার কাছে মনে হল, কেউ যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাইরে মাটির রাস্তায় হেঁটে চলছে। মিলিটারি কোন টু শব্দটি করল না। জড়োসড়ো হয়ে ঘরের এক কোনায় বসে রইল। হাত দিয়ে টেনে রহমান চাচাকে নিজের কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করল। রহমান চাচা ভাবলো, কোন হিংস্র জন্তু জানোয়ার হবে হয়তো। ঠিক তখনি জিনিসটি এক ধরনের অর্ধ জান্তব অর্ধ মানবিক চিৎকার করে উঠলো। সেটাকে ঠিক চিৎকারও বলা যাবে না। এক ধরনের গোঙ্গানি। যেন কোন অসুস্থ বুড়ো মানুষ নিঃশ্বাসের সাথে লড়াই করছে। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে মুখ থেকে অপার্থীব  শব্দ বেরিয়ে পরছে। রহমান চাচা মিলিটারিকে ফিসফিসিয়ে বলল, কোন অসুখে মানুষ! মিলিটারি রহমান চাচার হাতটি তখনো শক্ত করে চেপে ছিল। মুখে তর্জনী এটে চাচাকে একদম চুপ থাকার ইঙ্গিত করল। রহমান চাচার উৎকণ্ঠা তখনও কমেনি। এবার টিনের ফুটো দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করল সে। অন্ধকারে তাৎক্ষণিক কিছু চোখে পড়ল না। হঠাৎ লক্ষ করল একটু দূরে কিছু একটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে নড়েচড়ে চলছে। হেলে দুলে এরকম নির্জীব চলার ভঙ্গি তার কাছে ঠিক স্বাভাবিক লাগলো না। এবার খানিকটা ভয় পেয়ে গেল রহমান চাচা। তার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। মনে হল, কোন মানুষের অঙ্গভঙ্গির এরকম নয়। মিলিটারির দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে ফিসফিসে গলায় বলল, এইটাতো অন্য কিছু! মিলিটারি মুখে 'শশ' শব্দ করে আবারো তাকে চুপ করিয়ে দিল। রহমান চাচা এবার জোরে জোরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ভুত-প্রেত হবে, এরকম কিছু একটা আন্দাজ করে চোখ বন্ধ করে দোয়া দুরুদ পড়তে শুরু করল। এরপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। শব্দটি ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে গেছে। সম্ভবত সেটি এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। এদিকে রহমান চাচা যেন মিলিটারির চেয়েও বেশি ভয় পেয়ে গেছে। ভয়ে শক্ত হয়ে জমে গেছে। মিলিটারি খুব সন্তর্পনে উঠে কপাটের ফাঁক দিয়ে রাস্তার এপাশ-ওপাশ তাকালো। কোন কিছু এখন তার নজরে এলো না। রহমান চাচাকে উদ্দেশ্য করে সে বলল, চলো বাড়ি যাই, চাচা। অসম্ভব! আমি সকালের আগে এইখান থেইকা বাইর হইতাসি না, মিলিটারি। রহমান চাচা প্রায় সাথে সাথেই জবাব দিল। কিছুক্ষণ দুজনের কেউ কোন কথা বলল না। একটু পরে মিলিটারি বললো, তুমি থাকতে চাইলে থাকো। আমি যাইতেসি। আমারে একলা রাইখা যাইও না, মিলিটারি। রহমান চাচার আকুতি। আমি না গেলে বাড়ির লোক আমার জন্য চিন্তা করব, চাচা। মিলিটারি উত্তর দিল। সে চায় না কেউ তাকে খুঁজতে বের হোক। খুব সন্তর্পনে দোকানের এক পাশের একটি কপাট খুলে ফেলল মিলিটারি। তারপর সেটির ফাক গলিয়ে নিজের দেহটি বের করে নিলো। পেছনে রহমান চাচা আর কিছু বলল না। রাস্তার এমাথা-ওমাথা একবার তাকাল মিলিটারি।  তারপর ছোট ছোট পদক্ষেপে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। . এদিকে কালাম তার ভাইকে খোঁজার উদ্দেশ্যে হাতে একটি টর্চ নিয়ে রওনা করে দিয়েছে। বউয়ের হাজার বারণ সত্ত্বেও নিজেকে আজ দমিয়ে রাখতে পারেনি সে। ভাবলো অনেক হয়েছে এখন থেকে আর বউয়ের ধমক, বদমেজাজের তোয়াক্কা করবে না। এই বউয়ের কথা শুনে সে তার মাকে অনেক অবহেলা করেছে। যখন তার মার তাকে খুব প্রয়োজন ছিল সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বউয়ের সাথে সময় কাটিয়েছে। অপরদিকে তার ভাই সর্বদা মায়ের খেদমত করে গেছে। নিজের ���্ত্রী মারা যাবার পরেও দ্বিতীয় বিয়েটি করেনি। সর্বাত্মকভাবে পুরোটা সময় সে তার মায়ের সেবা-যত্ন করে গেছে। সেই মায়ের জন্য সে এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়ার রহস্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। এ গ্রাম ও গ্রাম তার খোঁজ করে বেড়াচ্ছে। কালাম এখন এই ভেবে কষ্ট পাচ্ছে তার কি সুন্দর একটি পরিবার ছিল কিন্তু সে কখনো সেটির মূল্য বুঝতে পারেনি। সবসময় বউয়ের আঁচলের নিচে লুকিয়ে ছিল। তার মাকে এখনো কেউ খুঁজে পায়নি। এরকম হঠাৎ করেই একদিন রাতে হারিয়ে গিয়েছিল সে। সেদিন রাতে তার ভাই হন্যে হয়ে সারা গ্রাম খুঁজে বেরিয়েছে। কালাম বাড়িতে বসে ছিল। হয়তো সেদিন সে খুঁজতে বের হলে আজ তার মা বাড়িতে থাকতো। ভাইয়ের ক্ষেত্রেও সেই একই ভুলটি করতে নারাজ সে। হাতে টর্চ জ্বেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে কালাম। কিছুটা পথ হেটে যাবার পর, রাস্তার ডানে একটা ডোবায় একটা কিছুর শব্দ শুনতে পেল সে। উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে সেই দিকে এগিয়ে গেল সে। . পরদিন সকাল রহমান চাচার ছিন্নভিন্ন দেহটা দোকানের ভেতর উপুর হয়ে পড়ে ছিল। সকালে পূব পাড়ার হাজী শেখ সদাই নিতে আসলে এই ঘটনা দেখতে পায়। ঘটনাস্থলে ততক্ষণে থানা সদর থেকে পুলিশ চলে এসেছে। ইতিমধ্যে প্রচুর মানুষের ভিড় জমে গেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কেঁদে ফেলেছে। রহমান চাচার সাথে গ্রামের অনেকেরই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মেলা বছরের দোকান তার এই তল্লাটে। অনেক জোয়ান ছেলেপেলে বাড়ির থেকে তার দোকানে বেশি সময় কাটাতো। তাদের কেউ কেউ কেঁদে ফেলেছে। হঠাৎ একজন খেয়াল করল একটি ছিন্ন হাত দোকান থেকে কিছুটু দূরে ডোবার ধারে পড়ে আছে। পুলিশের একজন হাতটি তুলে এনে পলিথিনে পেচিয়ে গাড়িতে রাখল। দারোগা সাহেব এলাকাবাসীকে এটা সেটা প্রশ্ন করছিলেন। কিন্তু কেউই কোন সদুত্তর দিতে পারছিল না। কারো ধারণা নেই কে বা কিসে এই লোকটাকে এভাবে ছিন্নভিন্ন করে রেখে গেছে। কেউ কেউ বলছে কোন জন্তু জানোয়ার এই কাজ করেছে। কেউ বলছে গ্রামের ভেতর বাঘ ঢুকে পড়েছে। যদিও পুলিশ এই তথ্যটিকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। অনেকের কাছে আবার পুলিশের এরুপ আচরণ সন্দেহজনক লাগে। পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবেই এটিকে খুনের চেয়ে জন্তুর দ্বারা আক্রান্ত ঘটনা হিসেবে বেশি প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছে। যদিও তারা মুখে বলছে কোন শিয়াল-কুকুরজাতীয় প্রাণী কাজটি করে থাকতে পারে কিন্তু কিছু কিছু পুলিশ সদস্যের চেহারায় তার থেকেও ভয়ানক কিছু একটার ভাবনায় স্পষ্ট আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। গ্রামবাসীর অনেকেই সেটি লক্ষ্য করেছে। হঠাৎ করে একটি ছোট ছেলে তার মায়ের আঁচল  টানতে টানতে বলে ওঠে, মা, মা মাথাটাতো আধা খাওয়া। কিসে খাইসে? পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওর মা কথাটি শুনে সাথে সাথে ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশও লাশটি প্যাকেটে মুড়ে গাড়িতে তোলে। তারপর ধুলো উড়িয়ে সামনে এগিয়ে  চলে গাড়ী। পেছনে সবাই তাকিয়ে থাকে গাড়িটির দিকে। আজ চলে যাচ্ছে এই গ্রামের বিবিসি। আর কোনদিন শোনা হবে না, আর কেউ দিতে পারবে না গ্রামের মানুষের প্রতিদিনকার খবরা-খবর। এই ঘটনার পর গ্রামের মানুষ বেশ ভয় পেয়ে গেছে। অনেকেই পুলিশের কাছে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ করেছে। পুলিশ সবাইকে ঘরে থাকার অনুরোধও করে গেছে। . সকালে সামসু আর হাসেম মিন্টুর বাড়িতে তাকে দেখতে গেল। বাড়ি পৌঁছতেই সামসু দেখল মিন্টু ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ উঠোনে পড়ে আছে। মাথা থেকে অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। উঠোনের অনেকটাই ভিজে গেছে। এখন সেই রক্ত জমাট বেঁধে শক্ত কালো হয়ে গেছে। দৃশ্যটি দেখে শামসু আঁতকে ওঠে। নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে মিন্টুর লাশের কাছে দৌড়ে যায়। সামনে গিয়ে বুঝতে পারে মিন্টু ভাই অনেক আগেই মারা গেছে। ইতিমধ্যে লাশ থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়া শুরু হয়ে গেছে। সামসু মাথা ঘুরিয়ে হাসেমের দিকে তাকায়। হাসেমের চোখদুটি ততক্ষণে ছল ছল করে উঠেছে। পর্ব ৯ ভোরের দিকে বাইরে কালামের ডাকাডাকি শুনে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসে মিলিটারি। বাড়ির কেউ সারারাত ঘুমায়নি। শেষ রাতের দিকে বাড়ি ফিরেছে মিলিটারি। সারারাত নামাজের পাটিতে বসে ইবাদত করেছে তার সৎ বাপ। মিলিটারির পেছনে পেছনে কালামের বউ ছুটে আসে উঠোনে। সবার পেছনে ধীর পায়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় তাদের বুড়ো বাপ। সে ঘর থেকে বের হতেই দেখতে পায় উঠোনে সবাই স্থির দাঁড়িয়ে আছে। কারো মুখে টু শব্দটি নেই। মিলিটারি কিছু একটা দেখে থমকে দাড়িয়ে পরেছে। উঠানের উপর কালামের স্ত্রীর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে যেন তাকে সামনে এগিয়ে যেতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে। ধীর ধীরে বুড়ো উঠানের দিকে এগিয়ে চলল। দেখল  কুজোবুড়িকে কোলে করে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে কালাম। কি হইল ভাইজান? কালামের মুখখানা একটু ম্লান হয়ে যায়। অবাক হয়ে বলে, আরে আমারার মায়েরে পাইছি! মিলিটারি তখনও কোন উত্তর দেয় না। তার ঘোর কাটেনি। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সর্বপ্রথম যে কথাটি তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, তা হল, মায়ের মুখ কাপড়ে বাঁধা কেন? কে বাধছে? কালাম একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। উত্তর দেয়, আমি বাঁধছি। আমরার কাছ থেকে হারায় গিয়া মায় পাগলের মত আচরণ করতেছিল। তাই আমি জোর করে তার মুখ কাপড় দিয়া বেঁধে দিছি। মায় কি তোমারে কামরাইবার চাইছিল? মিলিটারি জিজ্ঞেস করে। হয়, ওই রকমেরই কিছু একটা। তয় তুমি বুঝলা কেমনে। এখনই তোর কোল থাইকা মায়েরে নামা! মিলিটারি প্রায় চিৎকার করে বলল। কি হইছে? মিলিটারির দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বুড়ো বাপ জিজ্ঞেস করল। মিলিটারি কোন উত্তর দিল না। কালামের উদ্দেশ্যে আবার বলল, কালাম শিগগির নামা মায়েরে। কালাম তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারে নাই। ভাইজান ম্যায় তো হাটবার পারে না। আমি তারে সেরাজুলদের ডোবা থাইকা উঠায় নিয়ে আসছি। পানিতে পইড়া ছটফট করতেছিল। আমি তারে ওই সময় দেখতে পাইছি। খোদায় তারে জানে বাঁচায় দিছে! কালামের বউ দৌড়ে তার কাছে যেতে চায়। মিলিটারি তখনো শক্ত করে তার হাত ধরে ছিল। খবরদার তুমি সামনে যাইবা না। মিলিটারি বলে। আপনি দেখেন না সে মায়েরে খুঁইজা পাইসে? হইলো কি আপনার? আপনি কি পাগল হইয়া গেছেন? আমার হাত ছাড়েন? কালামের বউ অনেকটা জোর করেই মিলিটারির কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল। এখন কোথায় গেছে আপনার সব মায়া? বলতে বলতে সে কালামের কাছে এগিয়ে যায়। দুজনে মিলে কুজোবুড়িকে ধরে ঘরের দিকে নিয়ে যায়। মিলিটারি কিছু একটা বলতে গেলে, তার বুড়ো সৎ বাপ তাকে চোখ রাঙানির দিয়ে এক রকম শাসিয়ে দেয়। উঠোনের মাঝে কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকে মিলিটারি। . সামসু আর হাশেম এক দৌড়ে মিন্টুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। কয়েকটি ধানী জমি পরেই রফিক চাচার বাড়ি। তারা দৌড়ে তার বাড়িতে যায়। দরজায় খটখট শব্দ করতেই রফিক চাচার স্ত্রী দরজা খুলে। সামসু আর হাসেমকে দেখে সে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। তৎক্ষণাৎ তাদের মুখের উপর ঠাশ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। তার কিছুক্ষণ পর রফিক চাচা ভেতর থেকে ধমকের সুরে বলে, সামসু হাসু তোরা আমার বাড়ির সামনে কি করস? তোদের তো এক মাস ঘরে থাকবার নির্দেশ দিসে মেম্বার সাব? সামসু কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে, চাচা মিন্টু ভাই মারা গেছে। মিন্টু ভাইয়ের লাশ তার উঠোনে পইড়ে আছে আইজ দুই দিন। কথাটা শুনে সাথে সাথে ঘরের ভেতর থেকে রফিক চাচার বউ চিৎকার করে ওঠে, বলে, ওরা মিন্টুর বাড়ি গেছে। গোলামের পো গোলামগুলারে শিগগির খেদাও! রফিক চাচা উত্তেজিত হয়ে ভেতর থেকে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে, সামসু আমার উঠান থেইকা এক্ষুনি বাইর হ! তোরা আর কখনো আমার বাড়ির আশেপাশে আসবি না! এ পাড়া ওপাড়া ঘুইরে বেড়াস! আমি আজি মেম্বরের কাছে বিচার দিমু। সামসু ও হাশেম আর কোন কথা বল��� না। নিরবে রফিক চাচার বাড়ি ত্যাগ করে। যাওয়ার পথে সামসু হাসেমকে উদ্দেশ্য করে বলে, আমরা কি এমন অন্যায় করছি। আমরা তো সর্বদা মানুষটারে সাহায্য করার চেষ্টা করছি। দিনকাল কেমন পাল্টে গেছে। আজ মানুষের উপকার করলেও তিরস্কার শুনতে হয়। হাসু শুধু মাথা নাড়ে। সে এখনো দুঃখ হতাশায় নিমজ্জিত। আমার কেন জানি মনে হয় মিন্টু ভাইরে কেউ মাইরা ফেলাইছে। শামসু বলে। এবার যেন আঁতকে উঠে হাসেম। শামসুর দিকে তাকিয়ে বলে, কি কও ভাই? তোমার এমন কেন মনে হইল? হরে, আমি তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন দেখছি। কেউ তারে লাঠি দিয়া বাড়ি মারছে। একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় সে। তার চেহারায় এক ধরনের কাঠিন্য ফুটে ওঠে, বলে, শফিক গুন্ডা এই কাজ কইরা থাকবার পারে। ওই হারামজাদা আগেও এই রকম কাজ কইরা পার পাইয়া গেছে। ভাই তয় ওরাতো আমরারেও মাইরা ফালাইবো! হাসেমের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। আমার তো ভয় লাগতেছে রফিক চাচা যদি কিছু বইলা দেয়। ওরা বাড়ি যাবার ঘণ্টাখানেক পরেই শফিক তার সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে সামসুর বাড়ির সামনে এসে হাজির। তারেক এক সাঙ্গো সামসুকে নাম ধরে ডাক দেয়। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসতে বলে। হাসেমের বাড়ি সামসুর ঠিক পাশেই। হাসেম সব কিছু শুনে চুপচাপ ঘরের ভেতর লুকিয়ে থাকে। সামসু একটি গেঞ্জি গায়ে দিতে দিতে বাইরে বেরিয়ে আসে, বলেন কি হইছে, শফিক ভাই? ঘরের ভিতরে থাকবার জন্য বলা হয়েছে না তোমাগোর? একমাস ঘরের ভিতরে থাকবা। বাইরে ঘুরাঘুরি কইরা বেড়াও কেন? একটু কপট হাসি হেসে কথাগুলি বলল শফিক। ভাই আমরা তো কেউ ঘর থেকে বাইর হই নাই। শামসুর সরাসরি জবাব দেয়। শফিক এবার নিজের দাঁত কিড়মিড় করে, বলে সত্যিই বাইর হও নাই? শামসু বলে, না আমরা সেদিনকার পর থাইকা বাড়ি থাইকা বাইর হই নাই। শফিক কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু বলতে পারল না। শুধু বলল, ঠিক আছে মিয়া। কথাটা মনে রাইখো। আমি কিন্তু তোমারার উপর নজর রাখতেছি। আইজ গেলাম। পর্ব ১০ অস্থিরভাবে বিছানার উপর ছটফট করছে রহিম বক্স। গায়ে প্রচন্ড জ্বর। সারা শরীরে কাপুনি দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর থর থর করে কেঁপে উঠছে সে। একবার, দুইবার। এইবার বোধহয় আর রক্ষা হলো না তার। অসুস্থ হয়েই মারা যেতে হবে তাকে। কিছুই ভাবতে পারছিল না রহিম বক্স। তার পুরো পৃথিবীটা যেন উলটপালট হয়ে গেছে। চারপাশটা ভনভন করে ঘুরছে। রহিম বক্স এর স্ত্রী তার মাথায় জলপট্টি লাগিয়ে দিচ্ছিল। রহিম বক্স তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে নিচু স্বরে বলল, আমার বাজানগের খেয়াল রাইখো গো ছোট্টুর মা। স্ত্রী তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে, বলে, চুপ করেন। আপনের কিছু হইব না। আপনি ভালো হইয়া যাইবেন। রহিম বক্স কোন উত্তর করে না। তার স্ত্রীকে ছোট্টকে ডাকতে বলে। পাশের ঘরেই ছোট্ট তার ভাইদের সাথে করছিল। মায়ের ডাক শুনে মেজোটাকে খেয়াল রাখতে  বলে দৌড়ে এই ঘরে চলে আসে সে। রহিম বক্স তার দিকে তাকিয়ে বলে, কাছে আয় বাপ! ছোট্টু রহিম বক্সের হাত চেপে ধরে বিছানার পাশে গিয়ে বসে। যদি আমার কিছু হই যায়, তুই সবার খেয়াল রাখিস। ভাঙা ভাঙা গলায় কথাটি বলে রহিম বক্স। বাজান, কিছু হইব না আপনের! বলেই চোখ দুটি  ছলছল করে ওঠে ছোট্টুর। রহিম বক্স এর স্ত্রী আর কান্না ধরে রাখতে পারে না। ছোট্টকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে। . বেলা যত বেড়ে চলছে, মিলিটারির মায়ের অস্থিরতাও যেন ততো বেড়ে চলছে। পুরো সকাল মিলিটারি ঘরের ভেতরে পা রাখেনি। কালামের বউ তাকে অনেক কটুক্তি শুনিয়েছে। যদিও মিলিটারি তার কিছু গায়ে মাখেনি। এই বাড়িতে বরাবরই কালামের প্রভাব বেশি। মিলিটারিকে সবাই একজন ব্যর্থ মানুষ হিসেবেই দেখে এসেছে। জীবনের প্রতিটি জায়গাতেই সে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ তারই ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আজ সে হতে পারত এই গ্রামের গর্ব। কিন্তু জীবনের প্রতিটি সুযোগই নষ্ট করেছে সে। এখন বাপের পুরনো কিছু জমির দেখাশোনা করে সেগুলির ফসল তুলে সংসারে খরচ দেয়। অন্যদিকে কালামের গঞ্জে বড় দোকান আছে। মোটামুটি কালামের টাকাতেই তাদের সংসার চলে। তাই মিলিটারি সবসময়ই অবহেলিত। আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগতে থাকা একজন দুর্বল মানুষ। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ করেই কালামের বউ তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মিলিটারির উদ্দেশ্য বলে, ভাইজান, একটু ঘরে আসেন। উত্তরে কি হয়েছে জানতে চায় মিলিটারি। মায়ের ছটফটানি কেমন যেন অস্বাভাবিক রকম বাইড়া গেছে। জবাব দেয় কালামের বউ। আমরা কেউ তারে ধইরা রাখবার পারতেছি না। কথাটা শুনে মিলিটারি এক মুহুর্তও দেরি না। দৌড়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে। দেখে কালাম ও তার বাবা দুজনে বহুকষ্টে কুজোবুড়ীর দুই হাত চেপে ধরে রেখেছে। এর মধ্যেও কুঁজো বুড়ি ভয়ঙ্করভাবে মোচড় দিয়ে দিয়ে উঠছে। তাকে দুই পাশ থেকে ধরে রাখাটা বেশ কষ্টকর হয়ে উঠেছে। মিলিটারির বাপ-ভাই তাকে ধরে রাখতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। মিলিটারি কালামের বউকে দ্রুত এক গোছা দড়ি নিয়ে আসতে বলে। ঘরের এই কোনা ওই কোনা খুঁজে কালামের বউ কোথা থেকে এক গোছা পাটের দড়ি নিয়ে আসে। মিলিটারি তার মায়ের এক হাত খাটের থামের সাথে বাঁধতে শুরু করে। কালাম অন্য হাতটি তখনও শক্ত করে ধরে রেখেছে। মিলিটারি চিৎকার করে, বলে, মায়ের মুখের কাপড় খুইলা দিছে কে? কেউ কোন জবাব দেয় না। কালাম কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনই  কুজোবুড়ি কালামের হাতে তীর বেগে একটি কামড় বসিয়ে দেয়। এক কামড়ে তার হাত থেকে এক টুকরো মাংস ছিড়ে নেয়। কালাম কোনরকমে হাতটি ছাড়িয়ে এক ঝটকায় মাটিতে পড়ে যায়। তার মুখ থেকে কষ্টের একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। এটা কি সত্যি তার মা! এদিকে কুঁজো বুড়ির এক হাত ছুটে গেলে প্রচন্ড শক্তিতে খাটের উপর মোচড় দিতে শুরু করে সে। অবস্থা বেগতিক দেখে কারোই তার অন্য হাতটি ধরার সাহস হয় না। বুড়ি কালামের হাত থেকে ছিড়ে আনা মাংসের টুকরো গোগ্রাসে গিলে ফেলে। তার মুখ দিয়ে অঝোরে লালা ঝরতে থাকে। সেটি দেখে কালামের বউ সেখানেই গরগর করে সব বমি করে দেয়। প্রচন্ড রকমের হাত-পা ছোড়াছুড়িতে এক সময় বুড়ির অন্য হাতের দড়িটিও খুলে যায়। খাট থেকে ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায় বুড়ি। নিজেকে টেনে হেচড়ে কালামের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। ঘরের এক কোনায় আটকে পড়া কালাম প্রচন্ড ভয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। কেন জানি বুড়িকে দেখে তার প্রচন্ড রকমের ক্ষুদার্থ মনে হচ্ছিল। যেন এখুনি তার উপর হামলে পড়বে, টেনে ছিড়ে ভুরে তার হাতের বাকি মাংস খাবে। এর মধ্যে কোথা থেকে মিলিটারি একটি বাশ জোগাড় করে আনে। তারপর সেটি দিয়ে কুঁজো বুড়িকে ঠেলে গুতোয় কালামের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রচন্ড রকমের হিংস্র কুঁজো বুড়ি যেন আর মানুষের মধ্যে নেই। আস্ত একটি জন্তুতে পরিণত হয়েছে। মিলিটারির গুঁতোগুঁতিতে কোন কাজই হয় না। বরং আরও রেগে ফুঁসতে ফুঁসতে কালাম এর উপর লাফিয়ে পড়ার উপক্রম হয়। অগত্যা মিলিটারি কুজুবুড়ির মাথায় সজোরে একটি বাড়ি দিয়ে বসে। কুজোবুড়ি একটি আর্তচিৎকার করে উঠে। প্রায় সাথে সাথেই কালাম চিৎকার করে ওঠে, ভাইজান এইটা কি করলা? বাড়ি খেয়ে কুঁজো বুড়ি যেন হঠাৎ করেই খেই হারিয়ে ফেলে। উদ্দেশ্যহীনভাবে তার হাত দুটি ছুড়তে ছুড়তে শরীরের বাকি অংশ নিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাত-পা এর ছোড়াছুড়ি বন্ধ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে কাঁপতে কাঁপতে তার অর্ধ দেহটি নিসার হয়ে পড়ে। অবস্থা দেখে কালাম লাফ দিয়ে ঘরের কোণা থেকে বেরিয়ে আসে। মিলিটারিকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, এইটা কী করলা ভাইজান? আমরার মায়েরে মাইরা ফেললা! মিলিটারি কোন জবাব দিতে পারে না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এসবের মধ্যে কখন যে তার ব��ড়ো বাবা মূর্ছা খেয়ে গেছে বিষয়টি খেয়ালই করেনি কেউ। কালাম দৌড়ে তার বুড়ো বাপকে উঠানোর চেষ্টা করে। বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, শিগগির এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো। কালামের বউ কোনভাবে উঠে কলসি থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে। কালাম বুড়োর চোখে মুখে ছিটিয়ে দেয়। একটু পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়না। বুড়োর মুখখানা নিথরভাবে কালামের হাতের উপর পড়ে থাকে। কালামের বউ বুড়োর বুকের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, বাজান তো কোন রকম শ্বাস নেয় না! কালাম তখনো কথাটি বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে বাপের কাধ ধরে ঝাকাতে শুরু করে। তাকে জাগানোর চেষ্টা করে। অবস্থা দেখে মিলিটারি দৌড়ে বাপের কাছে চলে আসে। হাত দিয়ে গলায় পালস পরীক্ষা করে। তারপর হতাশার ভঙ্গিতে বলে, বাজান নাই! সবাইকে একসাথে পেয়ে আবার একই দিনে তাদের হারানোর বেদনা কালাম যেন সইতে পারছিল না। তার বুক ভেঙে কান্না চলে আসে। দেয়াল চাপড়ে আহাজারি করতে থাকে।   কালামের বউ মিলিটারির দিকে ফিরে তাকায়, চিৎকার করে বলে ওঠে, আপনের জন্য হইছে সবকিছু! সব আপনের দোষ! মিলিটারি কোন কথা বলতে পারেনা। চোখ দিয়ে তার অঝরে পানি ঝরতে থাকে। আর মায়াকান্না দেখাইয়েন না! কালামের বউ বলতে থাকে। আপনেরে না ডাকলে এগুলা কিছুই হইতো না। আপনে মায়েরে মাইরা ফেলছেন! আপনে একটা খুনি! বদ্ধ পাগল! বাজানের মৃত্যুর জন্যেও আপনে দায়ী। আপনে ঘর থেকে বাইর হয়ে যান। মিলিটারি কোন কথা বলতে পারে না। ডুকরে কাঁদতে থাকে। নিঃশব্দে ঘরের কোণে তার ঝোলাটা হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে পা বাড়ায়। যাওয়ার সময় সে কালামকে কিছু একটা বলতে চায়, তার নাম ধরে ডাকে। কালাম উত্তর দেয়, ওই মুখে আমার নাম নিও না। তুমি একটা অপয়া। তুমি এই বাড়ি থাকলে বাকি সবকিছুও ধ্বংস হইয়া যাইবে। চইলা যাও এখান থাইকা। আমিই তাগোর দাফন করমু! তোমারে আর কোনদিন দেখবার চাই না! নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের মুখে এরকম কথা শুনে আর পেছনে ফিরে তাকানোর সাহস হয় না মিলিটারির। মুখ বুজে দু-চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। (চলবে)
0 notes
manayeem · 8 years
Text
তিন চন্দ্রদিন চতুর্থ অধ্যায়
মানবরূপে প্রত্যাবর্তনের পর মুহূর্তেই আমার পিতা সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি করলেন তা হল, “অমর রত্ন কোথায়?” তিনি অস্থিরভাবে চারিদিকে পায়চারি করতে শুরু করলেন। কক্ষের বারান্দার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। “মালিকা অমর রত্ন চুরি করে নিয়েছে, মহামান্য।” তাঁর প্রশ্নের জবাব দিলেন আমার ভ্রাতা রাজপুত্র জাকির।
জবাবটি যেন রাজা জানতেনই, প্রায় সাথে সাথেই বলে উঠলেন, “মালিকা আর কারো কোন ক্ষতি করেছে?” কেউ তাঁর এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না।
রাজা জাকিরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন। জাকির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে ফিরলেন এরপর। “আমি জানি না সেনাপতি কিংবা উপদেষ্টা কেউ বেঁচে আছেন কিনা কিন্তু আমরা খাজাকে হারিয়েছি।” আমি বললাম। “কি?” কথাটি যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি। “কি বলছ তুমি?” বিস্মিত রাজা। “ডাকসা হত্যা করেছে খাজাকে।” আমি উত্তর দিলাম। “ডাকসা!” অস্ফুট স্বরে নামটি উচ্চারণ করলেন তিনি। তারপর একদম চুপ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “কেবল রাজপুত্রদয় ব্যতিত বাকি সবাই এই কক্ষ ত্যাগ করো।” রাজার আদেশ শুনে প্রহরীরা সবাই প্রস্থান করলো।
এরপর তিনি আমার কাছে সব ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইলেন। আমি তাঁকে সবকিছু খুলে বললাম।
সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাজা। তারপর দুজনের দিকে একবার করে তাকালেন। হিম শীতল গলায় বললেন, “খাজা জড়িত ছিল মালিকার সাথে।” কথাটি শুনে আমি বিস্ময়ে হতবম্ব হয়ে পড়লাম। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। “কিন্তু তা কি করে সম্ভব?” আমি বললাম। “সম্ভব।” বললেন তিনি। “মূর্তিতে পরিণত হবার আগে আমি তা জানতে পেরেছিলাম।” একটু থামলেন রাজা। তারপর বললেন, “শুরু থেকেই জড়িত ছিল খাজা কিন্তু আমরা কখনোই তা ধরতে পারিনি।”
খাজা ছিল আমার বাল্যকালের বন্ধু। আমরা দুজন একসাথে বড় হয়েছি। অসাধারণ যোদ্ধা ছিল খাজা, তাই একসময় তাঁকে তীরন্দাজ বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। আমার পিতার ভীষণ প্রিয়পাত্র ছিল সে। তাই ভাবতেই অবাক লাগছে এই মানুষটির ভেতরই এরকম দুরভিসন্ধি কাজ করছিল। হতে পারে এই দোষ পুরোপুরি তাঁর নয়। হয়তোবা এর জন্য দায়ী এই বিলাসবহুল জীবনযাপন, যেটি তাঁর ভেতরে নতুন প্রলোভনের সৃষ্টি করেছিল। তাছাড়া রাজ্যের দুর্গম অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করতো খাজা। হতে পারে সেখান থেকেই কোনভাবে মালিকার সাথে তাঁর পরিচয়। হয়তো মালিকার দুষ্ট প্রস্তাব নাখোজ করতে পানেনি সে। আমি নানানভাবে নিজেকে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু রুর বাস্তবতা হল খাজা অপরাধী।
“আমাকে এখুনি জ্ঞানী বৃক্ষের কাছে নিয়ে চল।” আমার উদ্দশ্যে কথাটি বললেন রাজা। “আমার তাঁর সাথে দেখা করা খুবই জরুরী। এখন একমাত্র সেই আমার সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারে।”
ইতিমধ্যেই দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে গোটা রাজ্যে, তাই যা কিছুই করার খুব দ্রুতই করতে হতো আমাদের। যদি খুব শীঘ্রয়ই আমরা কিছু একটা করতে না পারি তবে এই রাজ্য আর রাজ্য থাকবে না, পরিণত হবে শুকনো মরুভুমিতে।
আমি দেরি না করে পিতাকে নিয়ে অতিকায় মৌমাছির পিঠে চড়ে বসলাম। খুব দ্রুতই জ্ঞানী বৃক্ষের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম।
এবার পুরো ব্যাপারটি ধী���ে ধীরে আমার কাছে পরিষ্কার হতে লাগলো। তাহলে খাজাই আমাদের অভিযানের বিষয়টি গোপনে মালিকাকে জানিয়ে দিয়েছিল। সেজন্যই একজন দক্ষ তীরন্দাজ হওয়া সত্তেও সে সেনাপতির সাথে লড়াই করেনি। জঙ্গলের উত্তর পূর্ব দিক দিয়ে যাত্রা করাটাও তাঁরই পরিকল্পনার অংশ ছিল। আসলে আমরা সবাই তাঁর ও মালিকার পরিকল্পনারই অংশ ছিলাম।
হয়তো এই বিষয়টিই জানতো ডাকসা আর এজন্যই তাঁকে হত্যা করেছে সে।
পর্ব-২ “বৃক্ষ মহাশয়, অনুগ্রহ করে আমার একটি প্রশ্নের জবাব দিন।” বৃদ্ধ বৃক্ষের উদ্দেশ্যে আমার পিতা বললেন। বৃদ্ধ এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। “আমি জানি আপনি বিষম পাথর প্রত্যক্ষ করেছেন। আপনি অনেক কিছুই জানতে পেরেছেন।” কথাটি বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন আমার পিতা। বৃক্ষের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখে মিনতি। 
“বলুন কি জানতে চান আপনি, মহামান্য।” অবশেষে মুখ খুললেন বৃক্ষ। আমার পিতা প্রথমে একটি দীর্ঘশ্বাস নিলেন। তারপর বললেন, “ডাকসা আমার পুত্রকে রক্ষা করেছে। খাজাকেও হত্যা করেছে। আমি কিংবা আপনি আমরা দুজনেই জানি এটি কোন সাধারণ ঘটনা নয়। একটি বাক্শক্তিহীন হিংস্র পশু বিনা করনে কখনই এমন আচরণ করতে পারে না। আপনি কিছু একটা জানেন। দয়া করে আমাকে বলুন?” 
বৃক্ষ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। শুধু স্থির দৃষ্টিতে রাজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমার পিতাও তাঁর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে ছিলেন। যেন কিছু একটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।   “আপনি যা ভাবছেন সেটাই সঠিক, রাজা মনসুর।” এবার বললেন বৃক্ষ। “আপনার ভ্রাতা মারা যাননি। ডাকসাই আপনার হারিয়ে যাওয়া ভ্রাতা আনসুর।” কথাটি শুনে টপ করে এক ফোঁটা পানি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল রাজার। তিনি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। ভীষণ হতাশাগ্রস্থ দেখাচ্ছিল তাঁকে। 
“আর এই আমিই তাঁকে হত্যা করার জন্য সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিলাম।” তিনি বললেন। “শুধুমাত্র খাজার প্ররোচনায়।” আমি আমার পিতার কাছে এগিয়ে গেলাম। তাঁকে ধরে তোলার চেষ্টা করলাম। এই মুহূর্তে ভীষণ মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন তিনি। “আমাদের ভেঙ্গে পরলে চলবে না। এখনো সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি।” আমি তাঁকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলাম।
ধীরে ধীরে ধাতস্ত হয়ে উঠলেন আমার পিতা। আমাকে ধরে উঠে দাঁড়ালেন। বৃক্ষের উদ্দেশ্যে বললেন, “আমরা কীভাবে তাঁকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারি?” “তাঁকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিনসাধ্য ব্যাপার।” বললেন বৃক্ষ। “হয়তো জাদুকর পারাগ এর উপায় জানতেন।” “মালিকা পারাগের কন্যা, সে নিশ্চয়ই কোন উপায় জানতে পারে।” আমি বললাম। “আমি নিশ্চিত নই।” বৃক্ষ উত্তর দিলেন। “তাছাড়া মালিকা তোমাদের সাহায্য করবে না।” “হুম, আমি তা জানি।” বললেন রাজা। “কিন্তু আমরা তাঁকে বাধ্য করবো।” এবার আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। তাঁর চোখে মুখে প্রতিশোধের আগুন। “আমরা মালিকাকে আক্রমণ করতে যাচ্ছি।” 
দ্রুতই বৃক্ষের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা আরকান রাজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। 
রাজ্যে পৌছাতেই আমার পিতা তাঁর সকল সৈন্যসামন্তকে প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিলেন। কাল দিপ্রহরেই মালিকার মহল আক্রমণ করা হবে। কারন চাঁদের আলোয় ডাইনিদের জাদুর লাঠি নিষ্ক্রিয় হয়ে পরে।   এবার আমি আমার পিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম। অতিকায় মৌমাছির পিঠে চড়ে রাক্ষুসে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। মৌ রানী আমাকে সাহায্য করার কথা দিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর কথা রাখবেন। 
আমি মৌ রানীর সাথে দেখা করে প্রথমেই তাঁকে সব ঘটনা খুলে বললাম। আমার চাচার বিষয়টি শুনে তিনি ভীষণ কষ্ট পেলেন। এবং তিনি সেটা লুকোতে পারলেন না, হয়তো লুকোনোর চেষ্টাও করলেন না। “আমি ডাকসার সাথে একবার দেখা করতে চাই।” তিনি বললেন। বুঝতে পারছিলাম আবেগতাড়িত হয়ে পরেছেন তিনি। “সেটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, মহারানী।” আমি উত্তর দিলাম। “এটা সত্যি ডাকসা আমার জীবন বাঁচিয়েছে কিন্তু আদৌতে সে কেবলই একটি বাকশুন্য হিংস্র নরপশু, তাঁর মধ্যে মানুষের কোন বৈশিষ্ট্য নেই।” একটু থামলাম আমি। রানীকে দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম ��থাগুলি মেনে নেয়া তাঁর জন্য ��তোটা সহজ ছিল না। তিনি পুরোটা সময় মাথাটি নিচু করে ছিলেন। আমি তাঁকে একটু সময় দিলাম। “আমি আমার মৌ প্রধানকে নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছি।” কিছুক্ষণ পর বললেন মহারানী। “আমার মৌবাহিনী তোমাদের সাহায্য করবে।” “আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, মহারানী।” আমি বললাম।
প্রথম প্রকাশঃ ২৮/৫/১৬
পর্ব-৩ বড় বড় মেঘের চাই কাটিয়ে অতিকায় মৌমাছিটি আমাকে নিয়ে তীরের বেগে উড়ে চলছিল। নিচে গ্রাম, গ্রামের পর হ্রদ, তারপর কৃষিক্ষেত্র সবকিছুই পেছনে ছাপিয়ে চলছিলাম আমরা। উপরে আকাশের শত শত উজ্জ্বল তারা আমাদের দিকে ফিরে জ্বলজ্বল করছিল।
ইতিমধ্যেই আমরা রাক্ষুসে জঙ্গল পেছনে ফেলে এসেছি। মহারানীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরকান রাজ্য অভিমুখে রওনা করেছি। তাছাড়া সকাল হতেও খুব বেশি দেরি নেই। তাই ভাবতে ভালই লাগছিল, অবশেষে আমরা এই লড়াইয়ের যবনিকা টানতে যাচ্ছি, মালিকার পতন হতে চলেছে।
আলিয়াকে নিয়ে আমার একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। জানি না সে কীভাবে, কী অবস্থায় আছে।
হটাৎ পেছন থেকে একটা ক্ষীণ হাসির শব্দ আমার কানে ভেসে এল। যেন দূরে কেউ বা কারা খিল খিল করে হেসে চলছে। শব্দটি মোটেও স্বাভাবিক মনে হল না  আমার কাছে। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম, কান খাড়া করে সেটি শোনার চেষ্টা করলাম। আমাদেরই পেছন থেকে আসছে সেটি। কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে।
“ছোটু, আরও দ্রুত চলতে হবে আমাদের।” আমি মৌমাছিটিকে উদ্দেশ্যে করে বললাম।
ধীরে ধীরে হাসির শব্দটি আরও জোরালো হতে লাগলো। হটাৎ তাচ্ছিল্যভরা কণ্ঠে কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠলো, “ছোট্ট রাজকুমার, কোথায় যাওয়া হচ্ছে? আমরাও তোমার সঙ্গে যেতে চাই।” কথাটি বলেই বীভৎসভাবে খিল খিল করে হেসে চলল একটি ডাইনী।
এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, ভয়াবহ রকমের বোকামি করে ফেলেছি আমি! এভাবে একা মৌ রানির সাথে দেখা করতে চলে এসেছি! বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছি আমাদের পুরো পরিকল্পনাটি।
নিশ্চয়ই হাত গুটিয়ে বসে ছিল না মালিকা। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সে আর আমিই তাঁকে সেই সুযোগটি তৈরি করে দিয়েছি! নিজের উপর বড্ড রাগ হচ্ছিল আমার।
যে কোন মুল্যেই হোক এখন আমাকে এদের হাত থেকে বেঁচে পালাতে হবে। যদি কোনভাবে এরা আমাকে ধরে ফেলতে সমর্থ হয় তবে সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে।
আমার পিতা নিশ্চয়ই আমার জীবন নিয়ে বাজি ধরবেন না। তাঁর এই দুর্বলতার কথাটি মালিকা খুব ভাল করেই জানে।
ইতিমধ্যেই ডাইনীগুলি আমাদের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। আমাদের লক্ষ্য করে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করছে। ছোটু কোনরকমে সেগুলি পাশ কাটিয়ে উড়ে চলছে। কিন্তু আমি জানি আমরা খুব বেশিদূর এভাবে এগোতে পারবো না। তাই যা কিছুই করার খুব দ্রুতই করতে হতো আমাকে।
হটাতই আমার মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেল। আমি মুহূর্তেই মৌমাছিটিকে উত্তর দিকে ঘুরিয়ে নিলাম। ডাইনীরা আমার সঙ্গ কামনা করছে তো, আমি তাদের সঙ্গেই নিয়ে যাবো।
উত্তর দিকটা ডাকসার অঞ্চল। এখান থেকে খুব বেশি দূরেও নয় সেটি। আমি যদি কোনভাবে ডাকসার জঙ্গলে প্রবেশ করতে পারি, তবে হয়তো এদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া আরকান রাজ্য এখনো অনেক দূরের পথ। তাই আমার কাছে অন্য কোন উপায় নেই।
আমরা ছুটে চলছি। এক মুহূর্তের জন্যেও পেছনে তাকানোর সময় নেই। ডাইনীগুলি তখনো আমাদের লক্ষ্য করে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করে চলছিল। আর ছোটু সুচাতুরতার সাথে সেগুলি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু হট��ৎ একটি আগুনের গোলা ছোটুর ঠিক বামদিকের পাখাটায় এসে আঘাত করলো। মুহূর্তের মধ্যেই সে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করলো। আমি বুঝতে পারছিলাম খুব শীঘ্রয়ই মাটিতে আছড়ে পড়তে যাচ্ছি আমরা।
“আরেকটু পথ! আমরা প্রায় চলে এসেছি!” আমি চিৎকার করলাম। মনে মনে বিধাতার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলাম।
শেষ পর্যন্ত আমি আর মৌমাছিটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। দুজনেই সজোরে মাটিতে আছড়ে পড়লাম। ছিটকে একটি গাছের সাথে ধাক্কা খেলাম আমি। মুহূর্তেই আমার চারপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো। আমি জ্ঞান হারাতে শুরু করলাম। দেখলাম উপরে আকাশে ডাইনীগুলি চক্কর কাটছে।
আমার যখন জ্ঞান ফিরল আমি নিজেকে একটি গুহার ভেতর আবিস্কার করলাম। আমার মাথার ভেতর প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছিল।
“এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ তুমি। কিছুটা বিশ্রামের প্রয়োজন তোমার।” একটা ভারী, গম্ভির কণ্ঠ কথাটি বলে উঠল। আমি এই কণ্ঠের মালিককে চিনি! আমি সাথে সাথেই ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকালাম।
“সেনাপতি!” অস্ফুট স্বরে কথাটি বের হল আমার মুখ থেকে। “আপনি বেঁচে আছেন!”
বিস্ফোরিত চোখে আমি তখনো তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম, যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
গুহার এক কোনায় সেনাপতি রাজন বসে আছেন। তাঁর একটি হাতের কুনুইয়ের নীচ থেকে বাকী অংশ নেই। হাতটি রক্তাক্ত কাপড় দিয়ে শক্ত করে পেঁচানো।
আমি তাঁর হাতের দিকে তাকালাম। বললাম, “কী হয়েছিল ঐ রাতে?” তিনি আমার কথার কোন জবাব দিলেন না। শুধু তাঁর কাটা হাতটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “মনসুরের কি অবস্থা?”
আমি একটু সময় নিলাম। তারপর বললাম, “তিনি ভাল আছেন। আমরা তাঁকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।” কথাটি শুনে একদম চুপ হয়ে গেলেন সেনাপতি। মুখ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোল তাঁর।
আমি ধীরে ধীরে তাঁকে সব ঘটনা খুলে বলতে শুরু করলাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলি শুনতে লাগলেন।
আয়াজের ব্যাপারটি শুনে ভীষণ কষ্ট পেলেন সেনাপতি। আয়াজ তাঁর অনেক পুরনো বন্ধু ছিলেন। তবে খাজার ব্যাপারটি তাঁর কাছে অনুমেয়ই ছিল। তিনি ঐ রাতেই কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলেন তবে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল সেটা।
অন্য দিকে ডাকসা তাঁর জীবন বাঁচিয়েছিল। তাঁকে গুরুতর আহত অবস্থায় রক্ষা করেছিল। সেই রাতে তিনি ডাইনিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রাণপণে ছুটছিলেন, জঙ্গলের ভেতরে এসে জ্ঞান হারিয়েছিলেন,  ডাকসাই তখন তাকে উদ্ধার করে। তাই ডাকসা আমার চাচা কথাটি শুনে আমি না যতটা ভেবেছিলাম তিনি ততটা অবাক হলেন না।
“ডাকসা এখন কোথায়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“আমি ঠিক জানি না, রাজকুমার। আমি নিজেও তাঁর দেখা খুব একটা পাইনি।” সেনাপতি উত্তর দিলেন। “জানি না ঠিক কি কারনে সে আর কখনো আমার সামনে আসেনি। যদিও প্রতিদিনই আমার জন্য ফলমূল সংগ্রহ করে বাইরে রেখে যায়।” একটু থামলেন তিনি। তারপর আবার বললেন, “হয়তো সে ভয় পায়, যদি তাঁর দ্বারা আমার কোন ক্ষতি হয়ে যায়।”
আমি কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম। হয়তোবা এটাই তার কারন, হয়তোবা নয়।
কিছুক্ষণ পর আমরা গুহা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ইতিমধ্যে অন্ধকার অনেকটা কমে এসেছে, দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। মৌমাছিটি বাইরেই অপেক্ষা করছিল। তাঁর পাখার অর্ধেকটাই পুড়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় সে হয়তো নিজে উড়ে যেতে পারবে কিন্তু আমাদের নিয়ে যেতে পারবে না।
আমাদের সৌভাগ্য ছিল আমরা জঙ্গল অবধি পৌছাতে পেরেছিলাম। তাই ডাইনীগুলিও আর নিচে নামার সাহস করেনি।
আমি মৌমাছিটির পিঠে হাত রাখলাম। সাথে সাথেই একটু নড়ে চড়ে উঠল পতঙ্গটি। “ছোটু, তুমি মৌ রানীর কাছে ফিরে যাও।” আমি বললাম। “তাঁকে এই বার্তা পৌঁছে দাও আমরা নিরাপদে আছি। আমাদের জন্য যেন কোন কিছু বিলম্বিত না হয়।” মৌমাছিটি কিছু বুঝে উঠতে পারলো কিনা জানি না। তবে সে উড়াল দেয়ার চেষ্টা করলো। কয়েকবার চেষ্টার পর অবশেষে উড়তে পারলো। তাকে আবার উড়তে দেখে আমি ভীষণ খুশি হলাম। যদিও পর মুহুরতে একটু ভয় হল সে নিরাপদে পৌছাতে পারবে কিনা।
এবার অপেক্ষার পালা। অপেক্ষা যেন সবকিছু ঠিকঠাক মতো হয়।
পর্ব-৪ পুরোটা দিন জঙ্গলেই কাটাতে হল আমাদের। আমরা দুজনেই প্রার্থনা করছিলাম আর অপেক্ষার প্রহর গুনছিলাম যেন সবকিছুই পরিকল্পনা মতো হয়।
সারাদিনে ডাকসার দেখা মেলেনি। যদিও আমি তাঁর উপস্থিতি অনুভব করতে পারছিলাম। হয়তো সে আমাদের আশে পাশেই কোথাও রয়েছে , আড়াল থেকে আমাদের লক্ষ্য করছে।
সন্ধার দিকে দূর আকাশে আমি কিছু একটা দেখতে পেলাম। যেন কেউ বা কারা ঠিক এদিকেই উড়ে আসছে। হটাত করেই ছোটুকে আবিস্কার করলাম আমি, তার পেছনে রয়েছে আরও অনেকগুলি অতিকায় মৌমাছি। তাদের পাখার ফরফর শব্দ ধীরে ধীরে আরও জোরালো হয়ে উঠছিল।
মৌমাছিদের একটিতে আমার পিতা বসে ছিলেন, তাঁর চেহারায় ছিল যুদ্ধ জয়ের হাসি। নিজের অজান্তেই আমার ভেতরে একটি আনন্দ স্রোত বয়ে গেল। এক দৌড়ে আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম।
মৌমাছির পিঠ থেকে নেমে প্রথমেই আমাকে জরিয়ে ধরলেন পিতা। তারপর আলতো করে আমার কপালে একটি চুমু খেলেন।
সেনাপতির দিকে ফিরলেন তারপর, কিছুক্ষণ তাঁর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। চোখ ছলছল করছিল তাঁর। “তোমাকে নিয়ে আমি গর্বিত।” তিনি বললেন। তারপর তাঁকে জরিয়ে ধরলেন।
“আমরা মালিকাকে হারিয়ে দিয়েছি, অমর রত্ন রক্ষা করতে পেরেছি।” পাশ থেকে কথাটি বললেন আমার ভ্রাতা জাকির। “যদিও শেষ পর্যন্ত ডাইনীটা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।” একটু থামলেন তিনি। “কিন্তু সুসংবাদ হল আয়াজ বেঁচে আছেন। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন কিন্তু এখন বিপদমুক্ত।” কথাটি শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোল আমার মুখ থেকে। সেনাপতি যেন কেঁদেই ফেললেন।
এবার আমার দিকে ফিরলেন জাকির। একটু মুচকি হাসি দিলেন। সে জানে আমি কিছু একটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি। “আর হ্যাঁ, আলিয়াও ঠিক আছে। আমরা তাকেও উদ্ধার করতে পেরেছি।” কথাটি বলেই হেসে দিলেন জাকির। আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম। যদিও মনে মনে ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পর সবাই লক্ষ্য করলাম আরও একটি অতিকায় মৌমাছি ঠিক এই দিকেই উড়ে আসছে। এই মাছিটি অন্যগুলির তুলনায় অনেক বিশাল, মহারানী মৌরানী সেটির উপর বসে ছিলেন।
ধীরে ধীরে পতঙ্গটি নিচে নেমে এল। সবাই মহারানীকে কুর্নিশ করল। তিনি আমার পিতার দিকে একবার তাকালেন, বললেন, “অসাধারণ এই যুদ্ধ জয়ে আমার পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন, রাজা মনসুর। আমার মৌ বাহিনী এই যুদ্ধে আপনার সঙ্গে ছিল, আশা করছি ভবিষ্যতেও আমরা সাহায্য করতে পারবো।”
রাজা মাথা নাড়ালেন, বললেন, “আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ, মহারানী। আপনার সাহায্য ছাড়া আমরা এই যুদ্ধ এতো সহজে জয়লাভ করতে পারতাম না।”
এবার সেনাপতির দিকে ফিরলেন মহারানী। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার এই ক্ষতির জন্য আমি খুবই দুঃখিত, সেনাপতি রাজন।” সেনাপতি কোন উত্তর দিলেন না। কেবল একবার মাথা নাড়লেন।
এবার মহারানী তাঁর চারিদিকে জঙ্গলের গভীরে তাকালেন, যেন দুচোখ দিয়ে তিনি কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করলেন।
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি তোমাকে নিয়ে ততোটাই গর্বিত, ঠিক যতটা আমি তাঁকে নিয়ে।” জঙ্গলের দিকে কিছু একটা ইঙ্গিত করলেন। তারপর কিছুটা উঁচু গলায় বললেন, “আমি জানি আপনি আমাদের প্রত্যক্ষ করছেন। আমি আপনাকে অনুভব করতে পারছি, ঠিক যেমনটা আপনি পারছেন। হয়তো আপনার দেখা আমি পাবো না, আপনার এই রূপটি আমার জানা হবে না কিন্তু কথা দিচ্ছি আমি আমৃত্যু এর প্রতিকার খু��জে বেড়াবো।” একটু থামলেন তিনি। কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন, “আপনি সবসময়ই আমার কাছে সুদর্শন ছিলেন, থাকবেন।” কথাটি বলেই মাথা নিচু করে ফেললেন মহা রানী।
“আমরা সবাই অনেক ভালবাসি তোমাকে, আনসুর।” এবার আমার পিতা বললেন। “আমি কতো খুঁজে ফিরেছি তোমাকে, স্মরণ করেছি তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলি।” একটু থামলেন তিনি। তাঁর চোখদুটি ছলছল করছিল। “মানুষের কোন দুরবস্থা বা পরিণতিই তাঁর আপনজনের কাছে মুখ্য বিষয় নয়, আনসুর।” এবার থামলেন তিনি। যেন কিছু একটা জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
অপেক্ষা করছিলাম আমরা সবাই। তাকিয়ে ছিলাম জঙ্গলের গভীরে, আঁধারে। কিন্তু কিছুই ঘটলো না, কেউ জঙ্গল থেকে বেরিয়েও এলো না।
অনেক্ষণ কেটে গেছে এরপর। এক সময় নিঃশব্দে জঙ্গল ত্যাগ করলেন মহারানী। বাকীরাও একে একে মৌমাছির পিঠে চড়ে বসলো। ধীরে ধীরে মৌমাছিগুলি উপরে উঠে যেতে লাগলো। গাছপালা, জঙ্গল সবকিছুই ছোট হয়ে আসতে লাগলো। বিশাল থালার মতো চাঁদটি এবার আরও বড় দেখাল।
সবাই রওনা করলাম আরকান রাজ্যের উদ্দেশ্যে।
হটাত ঐ নিচে আমি কী কিছু একটা দেখতে পেলাম! কিছু একটা যেটা জঙ্গলের গভীর থেকে ঐ ফাঁকা জায়গায়টিতে এসে দাঁড়িয়েছে! নাকি এই সবই স্রেফ আমার কল্পনা, দৃষ্টি বিভ্রম!
তবে এটা যা-ই হোক আমি জানতাম আমাকে আবার বের হতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে আমার চাচাকে, বের করতে হবে তার প্রতিকার। তবে সেটি না হয় হবে অন্য কোন একটি গল্প, অন্য একটি অভিযান। (সমাপ্ত)
প্রথমপাতা
প্রথম প্রকাশঃ ০২/০৬/১৬
বিঃ দ্রঃ এটি একটি কল্পকাহিনী। এখানে উল্লেখিত সকল চরিত্র কাল্পনিক। লেখক এর সম্পূর্ণ স্বত্বাধিকারী। অনুমুতি ব্যাতিত এর কোন অংশ নকল বা প্রকাশ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
0 notes
manayeem · 8 years
Text
রুপকথা
তিন চন্দ্রদিন তৃতীয় অধ্যায়
বড় বড় মেঘের পাহাড় কাটিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে উড়ে চলছে আমার জাদুর লাঠি। আমি শুধু চলছি আর চলছি কিন্তু পথ শেষ হয় না। রাত শেষ হতে খুব বেশি দেরি নেই। জানি সকাল হবার আগেই এই লাঠি গন্তব্যে পৌঁছে দেবে আমাকে। তাই আমার দুশ্চিন্তা এখন অন্য জায়গায়। আমার কাছে আর মাত্র একটি চন্দ্রদিন অবশিষ্ট আছে। আর কালকের দিনটিই সেই শেষ চন্দ্রদিন। 
এই লাঠি হয়তো যথাসময়ে পৌছে দেবে আমাকে কিন্তু এরপর কি হবে? আমি কী পাবো শেষ পর্যন্ত জ্ঞানী বৃক্ষের দেখা? আর জ্ঞানী বৃক্ষই কি পারবে আমাকে সাহায্য করতে? পারবো কী এতো কিছু ছাপিয়ে আমার পিতাকে মানব রূপে ফিরিয়ে আনতে? এরকম হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়।
উড়তে উড়তে কখন যে রাক্ষুসে জঙ্গলের উপর চলে এসেছি ঠিক জানি না। নিচ থেকে আসা চাপা গর্জনের শব্দে ঘোর ভাঙল হটাত। জঙ্গলের গভীর থেকে কিছু একটা লক্ষ্য করছে আমায়।
ছোট বেলায় এই জঙ্গলের কথা অনেক শুনেছি। এখানকার সব প্রাণী বিশাল আকৃতির আর রাক্ষুসে। এখানে রয়েছে মানুষখেকো গাছ আর দানবীয় পোকা। একবার এদের হাতে পরলে আর রক্ষা নেই। তাই এর উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ভয়ে গাটা ছমছম করে উঠছিল। তাছাড়া অন্ধকার এখন অনেকটাই কেটে গেছে, চাঁদ উঠতেও খুব বেশি দেরি নেই।
অবশেষে আমি জ্ঞানী বৃক্ষের গ্রামের খুব কাছাকাছি পৌছে গেলাম। অদূরেই অসংখ্য বৃক্ষে ঢাকা বিশাল গ্রামটি চোখে পড়ছিল। আমি আমার উড়ন্ত লাঠিটি কিছুটা নিচে নামিয়ে আনলাম।
গ্রামের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় দেখলাম গাছগুলি এক দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রশস্থ গুড়ির উপর বসানো এদের চোখমুখগুলি যেন আমাকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক।
এরপরই হটাত একটা ঝিম করে শব্দ তুলতে শুরু করলো গাছগুলি, যেন কোন সতর্কবানী জারি করছে। মুহূর্তের মধ্যেই শব্দের তীক্ষ্ণতা বেড়ে গেল বহুগুন। এক সময় মনে হল পুরো গ্রামটি ঝিম শব্দে স্থবির হয়ে গেছে।
আমি ঠিক সেদিকে মনোযোগ দিতে চাইলাম না। মানচিত্র অনুযায়ী গ্রামের ঠিক কেন্দ্রে জ্ঞানী বৃক্ষের অবস্থান। এখন আমি কেন্দ্রের অনেকটাই কাছাকাছি।
হটাত একটা আগুনের গোলা দেখতে পেলাম, ঠিক আমারই দিকে উড়ে আসছে। আমি তাৎক্ষণিক সেটার পাশ কাটানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ঝাড়ুর লেজের দিকটায় আঘাত করলো সেটি। সাথে সাথে আগুন ধরে গেল ঝাড়ুটিতে। আমি সেটিকে নিয়ন্ত্রন করতে চাইলাম, নিচে নামিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম।
পরমুহূর্তেই ঝাড়ুসহ মাটিতে আছড়ে পড়লাম আমি। কয়েক মুহূর্ত পরে সতবিত ফিরে এল আমার। ভুমির অনেকটা কাছাকাছি থাকায় খুব একটা আঘাত লাগেনি, তবুও পাঁজরের ভেতরটায় সামান্য ব্যথা অনুভব করছিলাম।
কিছুটা দূরে আমার থলেটি পরে ছিল। আমি কোন রকমে উঠে সেটি তুলতে গেলাম। ঠিক তখনি বিকট এক গর্জনে পেছন ফিরে তাকালাম আমি। দেখলাম বিশাল দানবীয় আকৃতির একটি সিংহ ঠিক আমারই পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে। “ওকে আসতে দাও।” হটাতই একটা ভারী কণ্ঠ কথাটি বলে উঠলো। “ওর কাছে বিষম পাথর রয়েছে।” কণ্ঠটি একটি বুড়োর। প্রায় সাথে সাথেই বিশালকায় সিংহটি আমার পথ ছেড়ে দাঁড়ালো। আমি একটি শতবর্ষ পুরনো বৃদ্ধ গাছ দেখতে পেলাম। এটাই জ্ঞানী বৃক্ষ। 
প্রথম প্রকাশঃ ১৮/০৫/১৬
পর্ব-২ ভারী ও গম্ভীর চেহারার শতবর্ষ পুরনো জ্ঞানী বৃক্ষ তাঁর ত��ক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ধীরে ধীরে আমার পাথুরে পা দুটি টেনে তাঁর দিকে এগোতে লাগলাম। 
কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতে একবার সিংহটির দিকে তাকালাম। সুবোধ প্রাণীর মতো চুপচাপ বসে আছে সেটি। সিংহটি জ্ঞানী বৃক্ষের পাহারাদার। “আমি আরকান রাজ্যের কনিষ্ঠ রাজকুমার।” জ্ঞানী বৃক্ষের উদ্দেশ্যে বললাম কথাটি। “আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী।” তখনো স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল বৃদ্ধ। কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল সে। খুনখুনে মোটা গলায় বলল, “বহু বছর পূর্বে তোমার পূর্বপুরুষেরা আমার প্রাণ বাঁচিয়ে ছিল। আমি উপহার সরূপ এই বিষম পাথরটি তাদের দিয়েছিলাম।” একটু থামল বুড়ো। “এই পাথরটি তার চারপাশের ঘটনাবলি ধারণ করে রাখার সামর্থ্য রাখে।” হটাতই মাটি ফুড়ে শেকড় সদৃশ কিছু একটা বেরিয়ে এল। সাথে সাথে একটু সরে দাঁড়ালাম আমি। বুড়োটি সেদিকে নির্দেশ করে বলল, “তোমার পাথরটি ওটার উপর রাখো।” আমি থলে থেকে উপদেষ্টার দেয়া সেই অদ্ভুত আকৃতির পাথরটি বের করলাম। শেকড়ের শীর্ষে অঙ্গুলসদৃশ শাখাগুলির উপর সেটি রাখলাম। পর মুহূর্তেই শাখাগুলি পেঁচিয়ে ধরল পাথরটি। লক্ষ্য করলাম ইতিমধ্যে জ্ঞানী বৃক্ষ তাঁর চোখজোড়া বন্ধ করে নিয়েছে। পাথরটি ধীরে ধীরে প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছে। পরের বেশ কয়েকটি মুহূর্ত এভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকল বৃক্ষ। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল পাথরের সাথে জড়িত সমস্ত অতীত অনুভব করতে পারছিল সে। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে তাকালো জ্ঞানী বৃক্ষ। পাথরটিও ধীরে ধীরে নিভে এল। “রাজা মনসুরকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে রক্তিম মোম সংগ্রহ করতে হবে তোমায়।” এবার মুখ খুলল বৃক্ষ। “কেবলমাত্র এই মোমের প্রজ্বলিত শিখাই তাঁকে পূর্বের মনুষ্য অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে।” একটু থামল সে, তারপর বলল, “কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল শুধুমাত্র রাক্ষুসে জঙ্গলেই পাওয়া যায় এই মোম। এবং অতিকায় মৌমাছিরা সংগ্রহ করে রাখে এটি।” এবার যেন প্রচণ্ড হতাশা গ্রাস করলো আমাকে। আমি এখন কি করবো! কীভাবে ঐ ভয়ানক জঙ্গল থেকে এই মোম সংগ্রহ করবো! আমার মনের অবস্থা মনে হল কিছুটা বুঝতে পারলো জ্ঞানী বৃক্ষ। “আমার পাহারাদার সিংহ তোমাকে নিয়ে যাবে সেখানে।” সে বলল। তাঁর এই কথায় ভীষণ অবাক হলাম আমি। বললাম, “কিন্তু এতে করে তো আপনি অরক্ষিত হয়ে পরবেন।” “আমাকে নিয়ে ভেব না।” উত্তর দিল বৃক্ষ। “এই গ্রামে আমি সুরক্ষিত। এখানে কেউ আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।” সিংহটি কিছুটা নিচু হয়ে আমাকে তার পিঠে চড়ার জন্য আমন্ত্রন জানালো। আমি সেটার পিঠে চড়ে বসলাম। এরকম অতিকায় প্রাণীর পিঠে আমি আগে কখনো চড়িনি। কিছুক্ষনের মধ্যে আমি জ্ঞানী বৃক্ষের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাক্ষুসে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম।
প্রথম প্রকাশঃ ২০/০৫/১৬
পর্ব-৩ সুবিশাল, গহীন রাক্ষুসে জঙ্গল মূলত একদল অতিকায় মৌমাছি ও তাদের মহারানী কর্তৃক শাসিত। ছোটবেলায় এই জঙ্গল নিয়ে অনেক গল্প, কাহিনী পড়েছি কিন্তু কখনো সত্যি সত্যি এখানটায় আসতে হবে ভাবিনি। 
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ঘটনাচক্রে আজ এই জঙ্গলেই পা দিতে হচ্ছে আমাকে। আমি ও পাহারাদার সিংহ জঙ্গলের পথ অতিক্রম করছি।
পথিমধ্যে সিংহের সাথে ভীষণ ভাব জমে গেছে আমার। মনে হচ্ছিলো কতদিনের পুরনো বন্ধু আমরা। জঙ্গলের দানবীয় পোকাদের মতো এখানকার গাছগুলিও সুবিশাল আর উচু, যেন উপরে আকাশের মেঘ ফুরে বেড়িয়ে গেছে সেগুলি। তাই দিনের আলো কখনো এই জঙ্গলের ভেতরটায় পৌছায় না। আমি থলে থেকে মশালটি বের করে তাতে আগুন ধরালাম। মশালের আলোয় চারিদিকটা একবার দেখে নিলাম। গাছের ডালপালা, শাখা প্রশাখার আড়াল থেকে কোন কিছু নড়াচড়ার ক্ষীণ একটা শব্দ আমার কানে ভেসে আসছিল। কিছু একটা আঁচ করতে পারছিলাম আমি। অন্ধকারে কেউ বা কারা আমাদের উপর নজর রাখছে। দানবীয় পোকা! এরা আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু ঠিক আক্রমণ করার সাহস পাচ্ছে না। হয়তোবা বিশালকায় সিংহটির ভয়ে। আমি মশালটি শক্ত করে ধরলাম। এই মশাল শুধু আমাকে পথই দেখাবে না, রক্ষা করবে এই পোকাদের হাত থেকেও। বেশ কিছুদূর সামনে এগোনোর পর আমরা জঙ্গলের পূর্ব দিকটায় এসে পৌঁছালাম। এই অঞ্চলটিই অতিকায় মৌমাছিদের মূল ঘাটি। আমি পাহারাদার সিংহের পিঠ থেকে নেমে পড়লাম। আশেপাশ থেকে বড়সড় একটা গাছের ডাল খুঁজে বের করলাম। ডালটিতে ভর করে আমার থলে থেকে কিছু সুগন্ধি ফুল বের করলাম। জ্ঞানী বৃক্ষের গ্রাম থেকে আমি এগুলি সংগ্রহ করেছি। এই ফুলগুলি আমাকে মৌমাছিদের কাছে পৌঁছ দিতে সাহায্য করবে। এবার অপেক্ষার পালা, বাকি কাজ করবে এই ফুল ও তার মিষ্টি ঘ্রাণ। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি জঙ্গলের গভীর থেকে পাখার কম্পনের শব্দ শুনতে পেলাম। পরক্ষনেই কয়েকটা বিশাল আকৃতির মৌমাছি জঙ্গল ফুরে বেরিয়ে এল। চারপাশ দিয়ে আমাদের ঘিরে ধরল। “আমি মৌ রানীর সাথে দেখা করতে চাই।” তাদের উদ্দেশ্য করে বললাম কথাটি। “আমার তাঁর সাহায্য খুবই প্রয়োজন।” মৌমাছিগুলি কোন রকম শব্দ করলো না। হটাৎ একটি মৌমাছি আমার ঠিক কাছাকাছি নিচে নেমে এল। আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পেছনে সরে গেলাম। কিছুক্ষণ ইতস্তত করলাম। তারপর বুঝতে পারলাম আমাকে ওটার পিঠে চড়ে বসতে হবে। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে আমি মৌমাছিটির পিঠে চড়ে বসলাম। আমাকে পিঠে নিয়ে সাথে সাথেই উড়াল দিল অতিকায় প্রাণীটি। নিচে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার পাহারাদার সিংহ। মৌমাছিটি বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলছিল। চলছিল ঘন জঙ্গল, গাছপালা সব কিছু ছাপিয়ে। কিছুক্ষণ এভাবে উড়ে চলার পর অদূরেই মহলসদৃশ বিশাল আকৃতির একটি মৌমাছির চাক আবিস্কার করলাম আমি। চাকটি একটি সুবিশাল গাছের মগডাল থেকে নিচের দিকে ঝুলছিল। এরকম দৃশ্য আমি কখনো দেখিনি। বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে এল আমার। আমার বাকি সঙ্গীরাও এই দৃশ্যটি দেখলে নিশ্চয়ই বিস্ময়ে হতবম্ব হয়ে পড়তো। ছোটবেলায় গল্পগুলির সাথে যেন অনেকটা মিল খুঁজে পেলাম এবার। ঝুলন্ত এই মহলের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য বিশাল একটি গোলাকার দ্বার রয়েছে। মৌমাছিটি আমাকে সেটি দিয়ে মহলের ভেতরে নিয়ে গেল। স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো মহলের প্রতিটি দেয়াল অসংখ্য ছোট ছোট খোপ দিয়ে ভর্তি ছিল। অবিকল মৌমাছির চাকের মতো, শুধু পার্থক্য এই জায়গাটি অনেক বিশাল। উড়ে চলার সময় নিজের অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে একটি ক্ষীণ চিৎকার বেরোল। মহলের দেয়ালগুলিতে সেটি যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হল। কিছুক্ষণের মধ্যে একটি বিশাল হলঘরের মতো স্থানে আমাকে নিয়ে এল মাছিটি। অবশেষে এখানে থামল সেটি। আমি ওটার পিঠ থেকে নেমে পড়লাম। কিছুটা দূরে একটি সিংহাসন দেখতে পেলাম। সেখানে মানবসদৃশ কেউ একজন বসে আছে। স্বর্ণের অলংকারে মোড়ানো তাঁর শরীরে ছিল রাজকীয় পোশাক। পেছনে দুটি সচ্ছ পাখা। একটি মেয়ে! এটা ছিল আমার বিস্ময়ের সর্বশেষ ধাপ। আমি তখনো পুরোপুরি ধাতস্ত হতে পারিনি। তাহলে এটাই মৌমাছিদের মহারানী! মৌ রানী!
প্রথম প্রকাশঃ ২১/০৫/১৬
পর্ব-৪ আমি শুরুতেই অতিকায় মৌমাছিদের মহারানীকে একবার কুর্নিশ করলাম। মহারানী মুখ তুলে তাকালেন আমার দিকে। তাঁর চোখদুটি ছিল গাড় কাজল দিয়ে আঁকানো। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলেন।
কিছুটা ইতস্তত হয়ে আমি প্রথমেই তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলাম। “বিনা অনুমতিতে আপনার এলাকায় প্রবেশের জন্য আমি খুবই দুঃখিত, মহারানী।” আমি বললাম। তিনি কোন উত্তর করলেন না। “আমি আরকান রাজ্যের কনিষ্ঠ রাজপুত্র। আমার পিতা আরকান রাজ্যের রাজা মনসুর দুর্ভাগ্যক্রমে একটি পাথুরে মূর্তিতে পরিণত হয়েছেন।” একটু থামলাম। লক্ষ্য করলাম, মহারানী এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। “তাঁকে পুনরায় মানবরুপে ফিরিয়ে আনতে আপনার সাহায্য খুবই প্রয়োজন। বস্তুত রক্তিম মোমের প্রয়োজন।”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন মহারানী। আমার কথার কোন জবাব দিলেন না। শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
“তোমার চাচা আনসুরও তোমার মতো প্রচণ্ড সাহসী ও রোমাঞ্চপ্রিয় ছিল।” অবশেষে নীরবতা ভাঙলেন তিনি। কথাটি শুনে ভীষণ অবাক হলাম আমি। আমার চাচার প্রশংসা মহারানীর মুখে! কিছুই ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
মনে হয় ব্যাপারটি কিছুটা আঁচ করতে পারলেন মহারানী। বললেন, “বহু বছর পূর্বে কোন বিশেষ অভিযানে তোমার চাচাও ঠিক তোমার মতোই এই জঙ্গলে এসেছিলেন।” একটু থামলেন তিনি। তারপর বললেন, “অসংখ্য বছর কোন মানুষ এই জঙ্গলে পা রাখেনি। তাই তাঁর বীরত্বে আমি তখন ভীষণ অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।” একটু বিরতি নিলেন তিনি। “সেই থেকে তাঁর সাথে আমার পরিচয়। নিখোঁজ হবার ঠিক আগের দিনও আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল সে।” এবার থামলেন মহারানী। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল তাঁকে। “জাদুকর পারাগের বিষয়টি জেনে গিয়েছিল আনসুর। সম্ভবত জানতে পেরেছিল আরও বেশি কিছু।” মাথা নিচু করে ফেললেন মহারানী। তাঁকে ব্যথিত লাগছিল।
অসামান্য দুষ্টবুদ্ধি সম্পন্ন জাদুকর পারাগ অতিগোপনে কালো জাদুর চর্চা করতো। গ্রামের সাধাসিধে মানুষগুলিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তাঁর মহলে নিয়ে যেতো। তারপর জাদু দিয়ে মোহগ্রস্থ করে তাদের মূর্তিতে পরিণত করতো। শুধু এটুকুই নয়, তারপর সেই মূর্তিগুলিকে সে অন্য রাজ্যের হাটে নিয়ে চড়া দামে বিক্রি করতো।
একসময় ব্যাপারটি আমার পিতার দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি আমার চাচাকে ঘটনাটি তদন্তের জন্য নিয়োজিত করেন। অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে তিনি পারাগের মহলে যান। আর সেটাই তার কাল হয়ে দাড়ায়।
তিনি আর কখনো ফেরত আসেননি।
চাচার নিখোঁজ হয়ে যাবার ব্যাপারটি তখন গুরুতর আকার ধারণ করে পুরো রাজ্যে। আমার পিতা পারাগের মহল আক্রমণ করেন। পালাতে ব্যর্থ হয় পারাগ এবং ঘটনাস্থলেই নিহত হয়।
অতঃপর পারাগের মহল থেকে উদ্ধার করা হয় অসংখ্য মানুষের মূর্তি। যদিও আমার চাচার কোন মূর্তি সেখানে পাওয়া যায়নি।
এই ঘটনার পর থেকে আরকান রাজ্যে কালো জাদু চর্চা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
“রাজা মনসুরের এই পরিণতির জন্য নিশ্চয়ই মালিকা দায়ী।” হটাৎ করেই কথাটি বলে উঠলেন মহারানী।
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে হয়ে পড়লাম। বললাম, “আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আপনি তা জানলেন কি করে?”
“মালিকা পারাগের কন্যা।” ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিলেন মহারানী।
এবার ধীরে ধীরে সবকিছু পরিষ্কার হতে লাগলো আমার কাছে। তাহলে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতেই আরকান রাজ্য আক্রমণ করেছে মালিকা। পিতার মতো সে নিজেও কালো জাদুতে পারদর্শী।
“আমি তোমাকে সাহায্য করবো, রাজকুমার। কিন্তু তাঁর আগে তুমি তোমার পিতাকে সুস্থ করো।" একটি মৌমাছির দিকে তিনি কিছু একটা ইঙ্গিত করলেন। "এই মাছিটি তোমাকে খুব দ্রুত পৌঁছে দেবে।”
আমি রক্তিম মোম সাথে নিয়ে মহারানীর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। নিচে পাহারাদার সিংহের সাথে দেখা করে তাঁকে গ্রামে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলাম। অতিকায় মৌমাছির পিঠে করে রওনা করলাম আরকান রাজ্যের উদ্দেশ্যে। (চলবে)
পরবর্তী অধ্যায় প্রথমপাতা
প্রথম প্রকাশঃ ২৩/৫/১৬
বিঃ দ্রঃ এটি একটি কল্পকাহিনী। এখানে উল্লেখিত সকল চরিত্র কাল্পনিক। লেখক এর সম্পূর্ণ স্বত্বাধিকারী। অনুমুতি ব্যাতিত এর কোন অংশ নকল বা প্রকাশ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
0 notes
manayeem · 8 years
Text
রুপকথা
তিন চন্দ্রদিন দ্বিতীয় অধ্যায়
আমি গহীন অরন্য পেছনে ফেলে হ্রদের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছি। কিছুটা দুরেই হ্রদের টলমলে জল জ্বলজ্বল করছিল। রুপালী থালার মতো বিশাল চাঁদ সেই জলে প্রতিফলিত হচ্ছিলো। হালকা স্রোতে সেই দৃশ্য দেখতে বড়ই অপরূপ লাগছিল। চাঁদ যেন তার দিগুন শক্তিতে এই দিকটা আলোকিত করে তুলেছিল।
আমি হ্রদের কিনারা ঘেঁষে চলা পথটি ধরে সামনে এগিয়ে চলছিলাম। পথটি একটি গ্রামে গিয়ে মিলেছে। অল্প কিছুদুর হাঁটলেই আমি দেখা পাবো সেই গ্রামের। আজ রাতের জন্য আমাকে হয়তো সেখানেই আশ্রয় নিতে হবে।     দূরে গ্রামের ছোট ছোট ঘরগুলি চোখে পড়ছিল। দুই এক জায়গায় হালকা আলো জ্বলছিল। আমি গ্রামের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। এমন সময় আমার অদূরেই কিছু একটা চোখে পড়ল, হ্রদের কিনারা ঘেঁষে কেউ একজন বসে আছে। একটি মেয়ে!
    হ্রদের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। তাঁর চাপা কান্নায় আশপাশটা ভারী হয়ে উঠেছিল।     কিছুটা সামনে এগোতেই আমার উপস্থিতি টের পেয়ে গেল মেয়েটি, তাৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আমার দিকে।     আমাকে দেখেই সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো, সভয়ে পেছনে সরে গেল কয়েক পা। যেন এখুনি ছুটে পালাবে।     “আমি দুঃখিত, আমি কোনভাবে আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি।” কিছুটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ক্ষমা চাইলাম আমি।     মেয়েটি তখনো ধাতস্ত হতে পারেনি। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিলো, কোন একটি কারনে প্রচণ্ড ভীত সে।     আমি ধীরে ধীরে আমার কোমর থেকে তরবারিটি খুলে মাটিতে রাখলাম। যথাসম্ভব বন্ধুসুলভ আচরণ করার চেষ্টা করলাম। “আমি কারো ক্ষতি করতে এখানে আসিনি। আরকান রাজ্যের একজন যোদ্ধা আমি, রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিযানে বেড়িয়েছি।”     মেয়েটির মুখ থেকে তখনো কোন রা বেরোল না। আবার ছুটেও পালাল না। শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়ি���ে রইল।     “আপনাকে দেখে বিপদ্গ্রস্থ মনে হচ্ছে। আমি কী কোনভাবে আপনার সাহায্য করতে পারি?” আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম।     ছিপছিপে হালকা গড়নের মেয়েটিকে দেখতে বড়ই অসহায় লাগছিল। কিছু একটা বলতে চাইছিল সে কিন্তু বার বার ফুঁপিয়ে উঠছিল। অবশেষে মুখ খুলতে পারলো মেয়েটি, “আমার পরিবারের উপর হামলা হয়েছে। আমার পিতাকে হ…হত্যা করা হয়েছে।” কিছুটা জড়ানো কণ্ঠে কথাটি বলল সে।     আমি কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম। তারপর বললাম, “আপনার এই ক্ষতির জন্য আমি দুঃখিত। এটা কারা করেছে?” আমার প্রশ্নের কোন তৎক্ষনিক জবাব দিতে পারলো না মেয়েটি। তাঁর ইতস্তত ভাব দেখে আমি বললাম, “আমাকে বলুন। এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ আপনি।” মেয়েটিকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম।     এবার মাথা তুলে তাকালো মেয়েটি। এক পলক তাকিয়েই সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলল। এই প্রথমবারের মতো মেয়েটিকে দেখলাম আমি। অসাধারণ সুন্দরী একটি মেয়ে। তাঁর ডাগর কালো চোখগুলি যে কোন মানুষকে সম্মোহিত করার সামর্থ্য রাখে।     মেয়েটি ভীত সন্ত্রস্ত চোখে একবার তাকালো চারিদিকে। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, “ডাকসা!”     নামটি উচ্চারণ করেই কেমন এক অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করলো। যেন আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে রাজি নয় সে।     ব্যপারটি বুঝতে পেরে আমি আর কথা বাড়ালাম না। শুধু বললাম, “চলুন, আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেই।” মেয়েটি কোন উত্তর দিল না।     আমি গ্রামটির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললাম, “ওখানে আপনার বাড়ি?” মাথা নাড়ল মেয়েটি।     আমি চারিদিকে একবার তাকালাম। তারপর তরবারিটি হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে চললাম। মেয়েটি আমাকে অনুসরণ করা শুরু করলো।     পথে কিছু টুকটাক কথা হল আমাদের মধ্যে। মেয়েটির নাম আলিয়া। তাঁর বাবা ছিলেন একজন কৃষক, এই গ্রামেরই বাসিন্দা তারা। গ্রামের সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু হটাত একদিন ডাকসার উপদ্রব শুরু হল। গ্রাম থেকে একের পর এক মানুষ হারিয়ে যেতে শুরু করলো। আতঙ্কিত মানুষজন একসময় গ্রামছাড়া হতে লাগলো। এখন অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ ছাড়া অধিকাংশই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।     কিছুদূর হাঁটার পর গ্রামের পথে চলে এলাম আমরা। আশেপাশে কিছু কুটির চোখে পড়ল কিন্তু কোন মানুষজনের চিহ্ন দেখতে পেলাম না। কুটিরগুলির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।     আলিয়ার বাড়ি পৌঁছাতেই একজন বুড়িমত মহিলাকে দেখতে পেলাম, পানি তুলছিল কুয়ো থেকে। আমাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল বুড়ি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।     “ইনি আমার দাদীমা।” আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলল আলিয়া।     আমি বুড়ির দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দেয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু তাতে তাঁর কোন ভাবাবেগ হল না, শুধু আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলো।     “আমাকে এখন বিদায় নিতে হবে। আমি উত্তর গোলার্ধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছি।” বললাম আমি।     মেয়েটি কিছুটা ইতস্তত করলো, তারপর শুধু বলল, “একটু অপেক্ষা করুন।” কথাটি বলেই এক দৌড়ে কুটিরের ভেতর ঢুকে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর হাতে একটি শিশি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা সাথে রাখুন।”     “কি এটা?” আমি জানতে চাইলাম।     “ভ্রান্ত সুগন্ধি।” হটাত করেই কথাটি বলল বুড়ি। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁর দিকে তাকালাম। তখনো কুয়োর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। “ডাকসা তোমাকে অনুসরন করছে, তোমার গায়ের গন্ধ শুঁকে।” একটু থামল বুড়ি। তারপর বলল, “এটি সাথে রাখো, তাহলে তোমার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে সে।”     বুড়ির এই কথায় ভীষণ অবাক হলাম আমি। হাতের সুগন্ধিটির দিকে তাকালাম। শিশিটি নাকের সামনে ধরতেই বিকট ঝাঁজালো একটি গন্ধ ভেসে এল। আমি সাথে সাথে মুখ সরিয়ে নিলাম।     “তোমার পিছু পিছু এদিকটায় চলে এসেছে ডাকসা। শুরু করেছে মানুষ হত্যা।” কথা চালিয়ে গেল বুড়ি।     “কিন্তু …” আমি কথাটি শেষ করতে পারলাম না।     “বাইরে অনেক বিপদ। তোমার জন্য আজ রাতটা এই গ্রামেই কাটিয়ে দেয়া মঙ্গলজনক।” টেনে টেনে কথাগুলি বলছিল বুড়ি।      আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে উঠোনের অন্য দিকটায় হাঁটতে শুরু করলো সে। বলল, “আমার সাথে এসো।” ছোট একটি কুটিরের সামনে গিয়ে থামল বুড়ি। আমি আলিয়ার দিকে একবার তাকালাম। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল আলিয়া। 
ঘরটি ভালই। একটি খাট আছে ঘরে, একপাশে ছোট একটি টেবিল ও সাথে একটি কাঠের চেয়ার। টেবিলের উপর রাখা একটি টিমটিমে প্রদিপ ঘরটিকে আলোকিত করছিল। আমি মনে মনে বুড়িকে ধন্যবাদ জানালাম। এই আশ্রয়টুকু আমার বড্ড প্রয়োজন ছিল।     ইতিমধ্যেই চাঁদের আলো কমে গেছে, আঁধার নেমে গেছে চারিদিকে। আমি কোনরকম কালক্ষেপন না করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের যাত্রায় প্রচণ্ড ক্লান্ত, মাথাটা ঝিমঝিম করছে।     ঘরের এক পাশে ছোট একটি জানালা ছিল, হু হু করে বাতাস ঢুকছিল সেটি দিয়ে। ক্লান্তি ভরা চোখ নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি, ঘুম ভাঙল একটি শব্দে।
প্রথম প্রকাশঃ ০৪/০৫/১৬
(২) জানালার কপাটদুটি প্রচণ্ড শব্দ করে পরস্পরের সাথে ধাক্কা খেল। টেবিলের উপর রাখা প্রদিপের আগুনের শিখা তাতে কিছুটা কেঁপে উঠলো। ওটার ঠিক পাশেই ভ্রান্ত সুগন্ধির শিশিটি রাখা ছিল। আমি ততোক্ষণে বিছানায় উঠে বসেছি, জানালার দিকে মুখ করে বাইরে তাকিয়ে আছি। ওপাশে নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না।    আমি আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। জানালার খিলটি আটকে দিলাম। তারপর টেবিলের পাশে রাখা পুরনো চেয়ারটিতে এসে বসলাম। ঝোলা থেকে আরকান রাজ্যের মানচিত্রটি বের করে টেবিলের উপর রাখলাম। সকাল হতে খুব বেশি দেরি নেই। তাই আর ঘুমোতে যাবো না।    মানচিত্রটির উপর চোখ বুলালাম। এই গ্রাম থেকে খুব বেশি দূরে নয় জ্ঞানী বৃক্ষের অঞ্চল। সামনে উষ্ণ পাহাড় পেরোলেই আমি দেখা পাবো তাঁর।    সকাল হতেই বুড়িকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। যাত্রা করলাম উত্তর গোলার্ধের উদ্দেশ্যে। আলিয়ার সাথে আর দেখা হল না। বুড়ি জানালো, মেষ চড়াতে মাঠে গেছে সে।    অনেকখানি পথ চলার পর বুঝতে পারলাম উষ্ণ পাহাড়ের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। চাঁদ ঠিক আমার মাথার উপর ছুই ছুই করছে। ইতোমধ্যেই গরম হাওয়ার ঝাঁপটা এসে লাগছে আমার মুখে।    আমি আমার আলখেল্লা, হাতের দস্তানা থেকে শুরু করে সকল গরম কাপড় গাঁ থেকে খুলে ফেললাম। উষ্ণ পাহাড়ের দিকে যতোই এগোবো, এই বাতাস ততোই ভারী ও গরম হয়ে উঠবে।    আরও কিছুটা সামনে এগোতেই ছোটবড় কিছু গুহা আমার নজরে পড়ল। পাহাড়ের গাঁয়ে খোঁড়া গুহাগুলি দেখে মোটেও প্রাকৃতিক মনে হচ্ছিলো না। কিছুদূর যেতেই বুঝতে পারলাম অসংখ্য গুহা রয়েছে এখানটায়, পুরো এলাকাজুড়ে বিস্তৃত সেগুলি। আমি ভেবে অবাক হলাম কে বা কারা এই গুহাগুলি তৈরি করেছে! অবশ্য এর উত্তর পেতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হল না। একটু দূরেই কাদায় কিছু পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। কোন প্রাণী সদ্য তার থাবা বসিয়ে গেছে এখানটায়।    ছাপগুলি বেশ বড়, কোন সাধারণ প্রাণীর নয়। এবার আমি যেন কিছু একটা আঁচ করতে পারলাম! ভয়ে আতঙ্কে আমার ঘাড়ের চুলগুলি খাড়া হয়ে উঠলো। এগুলি আর কিছুই না! হায়েনা! সেই অতিপ্রাকৃত বিকট হায়েনা!    আমি সাথে সাথে আমার ঝোলা ঘেঁটে মানচিত্রটি বের করলাম। সাধারনত বিপদজনক  এলাকাগুলি লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত থাকে। কিন্তু এই অঞ্চলটি তেমন বিশেষভাবে চিহ্নিত নয়।    বুঝতে পারছিলাম বড় ধরনের বিপদে পড়ে গেছি। এখুনি এখান থেকে বের হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমি তরবারিটি খোলসছাড়া করলাম। ডানে বামে, আমার চারিদিকে একবার তাকালাম। হয়তোবা হায়েনাগুলি এই মুহূর্তে এখানে নেই, খাবারের সন্ধানে গেছে। আমাকে খুব দ্রুত এখান থেকে কেটে পড়তে হবে।   কিছুদূর এগোনোর পর বুঝতে পারলাম আমার ধারনা ভুল। কারন সামনে একটি হায়েনা আমার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যেই আরও কয়েকটি হায়েনা চারিদিক থেকে আমাকে ঘিরে ফ��লেছে। তাহলে শুরু থেকেই এরা আমার উপর নজর রাখছে। এটা একটা ফাঁদ বৈকি আর কিছুই নয়।    আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো এরা আর আমি এই ফাঁদে পা দিয়েছি।    হটাতই একটি হায়েনা প্রচণ্ড ক্ষিপ্র গতিতে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি টালমাটাল হয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম।    অন্য একটি হায়েনা আমার বুকের উপর উঠে দাঁড়ালো। এক মুহূর্তের জন্য আমার দম বন্ধ হয়ে এল। যেন কেউ একটা বিশাল আকৃতির পাথর আমার বুকের উপর চেপে দিয়েছে। আমি এক চুলও নড়তে পারলাম না। শরীরের সব শক্তি যেন মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে গেল। হায়েনাটি আমার মুখের উপর ভারী নিঃশ্বাস ফেলছিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি জ্ঞান হারালাম।
Tumblr media
   যখন আমার জ্ঞান ফিরল, আমি নিজেকে একটি কালকুঠুরিতে আবিস্কার করলাম। শিকলে বাধা আমার হাত দুটি পেছনে প্রসারিত ছিল, আমি হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে ছিলাম। আমার কক্ষটি লোহার গারদ দিয়ে বদ্ধ ছিল।    হটাত একটি ভারী ধাতব শব্দ হল, যেন লোহার পুরনো ভারী দরজা টানার শব্দ। তারপরই ভেসে এল কিছু পায়ের আওয়াজ।    এর কিছুক্ষণের মধ্যে মহাডাইনী মালিকা আমার কুঠুরির সামনে এসে দাঁড়ালো। তাঁর পেছনে ছিল আরও দুইটি ডাইনী।    মালিকার পুরো শরীর একটি কালো আলখেল্লায় ঢাকা ছিল। হাতে ছিল একটি লম্বা ছড়ি। তাঁর পেছনের দীর্ঘ ঘন কালো চুলগুলি কোমর অবধি এসে ঠেকেছিল। চোখে ছিল গাড় কালি আর মুখে তৃপ্তির হাসি। হিংস্রতা আর ক্রোধে মিশ্রিত তাঁর সেই জঘন্য হাসি আমি আগে কখনো দেখিনি।    আমার পিতার সাথে অনেক সময় কাটিয়েছে সে কিন্তু তাঁর সেই সুশ্রী চেহারার পেছনে এমন একটি কদাকার রুপ আছে, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।    “তোমার পিতার যোগ্য পুত্র তুমি, রাজকুমার। সত্যিই তোমাদের মন ভোলানো কত সহজ!” আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলল মালিকা। লক্ষ্য করলাম তাঁর পাশে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁর দিকে চোখ যেতেই আমার বুকটা ছেদ করে উঠলো। এ যে আলিয়া!    “তোমার পিতাকে বোকা বানিয়েছিলাম আমি আর তোমাকে বানিয়েছে আলিয়া।” তাচ্ছিল্যের সুরে কথাটি বলল মালিকা। মুখে মুচকি হাসি। “নিশ্চয়ই তোমার পিতা নির্জনে একাকী একটি মেয়েকে কাঁদতে দেখলে তাঁকে সাহায্য করতে বারন করেননি। তাই না, রাজকুমার?”    “কাউকে বিশ্বাস করা বা তাঁকে সাহায্য করা দোষের কিছু নয়।” আমি দাঁতে দাঁত চেপে কথাটি বললাম। “কিন্তু আমি ও আমার পিতার দুর্ভাগ্য যে তুমি বা আলিয়া কেউই সেই বিশ্বাসের যোগ্য ছিলে না।” আলিয়ার দিকে তাকালাম আমি। মাথা নিচু করে আছে সে, যেন ভয়ে জড়সড়।    “তা বটে।” ঠোঁট উল্টালো মালিকা। “কিন্তু এতো সহজে কারো প্রেমে পড়ে যাওয়াটা নিশ্চয়ই দোষের কিছু।” আলিয়ার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দিল মহাডাইনী। তারপর বলল, “ডাকসা তোমাকে হত্যা করতে নয় বরং রক্ষা করতে তোমার পিছু নিয়েছিল।” মালিকার চোখ দিয়ে এবার আগুন ঝরছিল। “শুধু এই নির্বোধ পশুটির জন্য তোমাকে বন্দি করতে আমাকে এতোটা সময় ব্যয় করতে হয়েছে।”    মালিকার এই কথাটি শুনে আমি বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম। এটা কি করে সম্ভব! ডাকসা আমাকে রক্ষা করার জন্য আমার পিছু নিয়েছিল! তবে কি সেই প্রথম রাতের পশুটি ডাকসাই ছিল! তাবুর ওপারে আমার গন্ধ শুঁকছিল।    “এখন একে নিয়ে কি করবো, মহাডাইনী?” হটাতই মালিকার পাশে দাঁড়ানো ডাইনীটি কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলো।    “আরকান রাজ্য সম্পূর্ণ আমার না হওয়া পর্যন্ত একে জীবিত রাখতে হবে। একে আমার প্রয়োজন হতে পারে।” কথাটি বলেই ঘুরে দাঁড়ালো মালিকা। হাঁটা শুরু করলো উল্টো দিকে। “আর হ্যাঁ, ওকে আমার বিশেষ কারাগারে নিয়ে এসো। রাজকুমার বলে কথা! কিছুটা বাড়তি যত্ন আত্তি তো করতেই হয়।” যেতে যেতে কথাটি বলল সে। আলিয়া দ্রুত পায়ে তাঁকে অনুসরণ করলো। মেয়েটির আচরণ আমার কাছে বড়ই অদ্ভুত লাগছিল।      অপর ডাইনী দুটি আমার কক্ষের তালাটি খুলল। তারপর দেয়ালের শেকল থেকে আমার হাতদুটি আলগা করে আমাকে খাঁচা থেকে বের করলো।    “এই পুচকে রাজকুমার। সামনে এগিয়ে চলো।” একটি ডাইনী সজোরে আমার পিঠে ধাক্কা দিল।
প্রথম প্রকাশঃ ১০/৫/১৬
(৩) অদ্ভুত ধরনের একটি কক্ষে আমাকে ডাইনীগুলি নিয়ে এলো। কক্ষটিতে প্রবেশ করতেই একটি হলদে রঙের বড় আকারের মোমবাতি আমার দৃষ্টিগোচর হল। একটি টেবিলের উপর রাখা ছিল সেটি। আমি সেটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। কেননা এরকম আরও একটি মোমবাতি আমি আগেও দেখেছি, আমার পিতার শয়ন কক্ষে, যেদিন তিনি মূর্তিতে পরিণত হন।
আমাকে কক্ষের ঠিক মাঝামাঝি একটি স্থানে নিয়ে আসা হল। আমার মাথার উপর থেকে দুটি শেকল ঝুলছিল। আমার হাত দুটি শেকলগুলির সাথে আটকে দেয়া হল। এরপর একটি ডাইনী ঘরের এক কোনে একটি কলের কাছে গেল। কলটির লিভার ধরে টান দিল, সাথে সাথে শেকলগুলি আমাকে উপরের দিকে তুলতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে আমার পুরো শরীর শুন্যে উঠে গেল। অন্য ডাইনিটি টেবিলের উপর থেকে মোমবাতিটি আমার কাছে নিয়ে এল। আমার পায়ের নিচে আঁকা একটি ছকের উপর সেটি বসিয়ে দিল, তারপর বাতিটি জ্বালিয়ে দিল। এই ছকটি আমি আগেও দেখেছি। আমার পিতার শয়ন কক্ষে!
আমি তখনো বুঝে উঠতে পারছিলাম না, ঠিক কি করতে যাচ্ছে মালিকা! মোম থেকে নির্গত আগুনের তাপ আমার পায়ের তলায় এসে ঠেকছিল। বলাই বাহুল্য, এতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছিলো না আমার।
কিছুক্ষণ পর ডাইনীগুলি চুপচাপ কক্ষটি ছেড়ে চলে গেল। আমি শূন্যে স্থির ঝুলে রইলাম।
এভাবে কেটে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। হটাত মনে হল আমার পা দুটি অসাড় হয়ে আসছে। আমি আগুনের তাপ টের পাচ্ছি না। ক্রমশ ভারী হয়ে আসেছে সেগুলি।
আমি আমার পায়ের আঙ্গুলগুলি নাড়ানোর শত চেষ্টা করলাম কিন্তু অবাক ব্যাপার আমি তা নাড়াতে পারলাম না। এবার প্রচণ্ড ভয় হল আমার। আমি ভয়ে ভয়ে নিচের দিকে তাকালাম। যা দেখলাম তাতে রক্ত হীম হয়ে যাওয়ার জোগাড় হল। আমার পায়ের পাতা থেকে শুরু করে গোড়ালি পর্যন্ত পুরোটাই পাথর হয়ে গেছে। আমি ধীরে ধীরে মূর্তিতে পরিণত হচ্ছি! এবার ভয়ে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পারলাম আমি। মুখ দিয়ে চিৎকার করতে লাগলাম। পা দুটি শূন্যে ছুড়তে শুরু করলাম। পাগলের মতো ছুড়তে লাগলাম।
জানি না কতক্ষন কেটে গেছে এভাবে। হটাত কক্ষের মূল দরজাটি খুলে যাওয়ার শব্দ পেলাম। সেদিকে মুখ ঘোরাতেই দেখতে পেলাম কেউ একজন সন্তর্পণে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করছে। অবয়বটির পুরো শরীর আলখেল্লায় ঢাকা ছিল। আবছা আলোয় আমি সেটার চেহারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। অবয়বটি দ্রুত আমার কাছে চলে এল, মোমটি নিভিয়ে ঘরের অন্য প্রান্তে কলেটির কাছে চলে গেল। ওটার লিভার ধরে টানতেই আমি নিচে পড়ে গেলাম। আমার পা দুটি সজোরে মেঝেতে আঘাত করলো। আমি উঠে বসতেই, আমার হাতের শেকলগুলি খুলতে লাগলো সে। আমি লক্ষ্য করলাম তাঁর হাত দুটি ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছিল। আমি তাঁর দিকে মুখ তুলে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, এটা আলিয়া।
“আমি আমার কৃতকর্মের জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। আমার কাছে আর কোন উপায় ছিল না।” কাঁপা কাঁপা গলায় কথাটি বলল আলিয়া। “আমার দাদীমা আমাকে এসব করতে বাধ্য করেছে। সে নিজে মালিকার ডাইনী ছিল, আমাকেও ডাইনীতে পরিণত করতে চাইছে।” আমার একটি বাহু তাঁর কাঁধে তুলে নিল সে। আমি তাতে ভর করে উঠে দাঁড়ালাম। আমার পা দুটি তখনো অনেক ভারী লাগছিলো। “আমি এভাবে বেশিদুর এগোতে পারবো না।” আমি বললাম। “আমি জানি।” সাথে সাথেই উত্তর দিল আলিয়া। “আমি এর ব্যাবস্থা করে এসেছি।” ভীত চোখে চারিদিক��� একবার তাকালো আলিয়া। তারপর ধীরে ধীরে আমাকে কক্ষটি থেকে বের করে নিয়ে এল। কক্ষেটির বাইরে একটি সিঁড়ি ছিল, সেটি ধরে আমাকে উপরে নিয়ে যেতে শুরু করলো। কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা সিঁড়ি বেয়ে মহলের ছাদে পৌঁছে গেলাম। আলিয়া তাঁর ঝাড়ু লাঠিটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল, “এতে ভর করেই আপনাকে পালাতে হবে।” “কিন্তু তো … তোমার কি হবে?” আমি বললাম। “আমাকে নিয়ে ভাববেন না।” বলল আলিয়া। “আপনার হতে খুব বেশি সময় নেই।” আমি দেরি না করে লাঠিটির উপর উঠে বসলাম। সাথে সাথেই একটি ঝাঁকি দিয়ে উঠলো সেটি। আমাকে মেঝে থেকে কিছুটা উপরে তুলে নিল। “এই থলেটি রাখুন।” আমার দিকে একটি থলে বাড়িয়ে দিল আলিয়া। “আর একটি কথা, এই লাঠিটি শুধু রাত্রিতেই কাজ করে, তাই আপনাকে চাঁদ ওঠার আগেই গন্তব্যে পৌছাতে হবে।” একটু থামল আলিয়া। আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “বিদায়, রাজকুমার।” তাঁর দিকে তাকিয়ে আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, “আমি তোমাকে নিতে আসবো। আমার জন্য অপেক্ষা করো।” কোন কথা বলল না আলিয়া। শুধু এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। জাদুর লাঠিটি মুহূর্তেই আমাকে উড়িয়ে নিয়ে চলল। (চলবে)
পরবর্তী অধ্যায় প্রথমপাতা
লেখকঃ এম এ নাঈম প্রথম প্রকাশঃ ১১/৫/১৬
বিঃ দ্রঃ এটি একটি কল্পকাহিনী। এখানে উল্লেখিত সকল চরিত্র কাল্পনিক। লেখক এর সম্পূর্ণ স্বত্বাধিকারী। অনুমুতি ব্যাতিত এর কোন অংশ নকল বা প্রকাশ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
0 notes
manayeem · 8 years
Text
রুপকথা
তিন চন্দ্রদিন প্রথম অধ্যায়
ভয়াবহ গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন চারিদিক। আকাশের অগণিত তারার উপস্থিতি ছাড়া চোখে পড়ার মত কিছুই যেন নেই এখানে। অন্ধকার তার বিশাল কালো চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে পুরো তৃণভূমি। আরকান রাজ্যের গহীন এক জঙ্গলের ধার ঘেষে বেড়ে ওঠা এই তৃণভূমিতে তাবু খাটিয়েছি আমরা। 
রাজ্যের চরম সংকটাপূর্ণ মুহুর্তে গঠিত এই অভিযাত্রী দলে আমার সাথে রয়েছে আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ও সহযোগী যোদ্ধা খাজা, রাজ্যের প্রধান উপদেষ্টা আয়াজ এবং সেনাপতি রাজন। তাছাড়াও রয়েছে অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন তিনজন প্রহরী। 
আমাদের শিবিরে মাঝখানের একটি জায়গায় হালকা নীল আগুন জ্বলছিল। আগুনের চারপাশ ঘিরে বসে সবাই তাপ নিচ্ছিল, সাথে চলছিল একটু আড্ডা ও পানীয়। সারাদিনের দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর যাত্রার পর এই বিরতিটুকু খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। তাছাড়া রাত্রি প্রহরে গভীর এই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাত্রা বেশ বিপদজনকও মনে হচ্ছিলো। তাই রাতটা এখানেই কাটিয়ে দিতে চায় সবাই।
    একটু সামনের দিকে ঝুঁকে অত্যন্ত গম্ভীর ভঙ্গিতে ভয়ানক এক কাহিনী শোনাচ্ছিলেন উপদেষ্ঠা আয়াজ। “আমি শুনেছিলাম এখনো এই জঙ্গলেই গা ঢাকা দিয়ে আছে সেই ভয়াবহ দানব ডাকসা। যদিও আশেপাশের গ্রামবাসীরা আর কখনো তাকে দেখতে পেয়েছে বলে অভিযোগ করেনি।” কথাটি শেষ করেই একবার আমার দিকে তাকালেন উপদেষ্টা। “মহামান্য রাজকুমার, কিছুটা ভীত দেখাচ্ছে আপনাকে। আমি দুঃখিত, যদি আমার কাহিনী তার জন্য দায়ী হয়ে থাকে।”
    “না, না। মোটেও তা নয়। আমি ঠিক আছি।” প্রায় সাথে সাথেই মাথা নেড়ে জবাব দিলাম আমি। “তা … তারপর কি ঘটেছিলো?” যদিও ইতস্তত ভাবটা লুকোতে পারলাম না।
    “তারপর আর কিছুই ঘটেনি, রাজকুমার।” একটু থামলেন উপদেষ্টা। “আর কখনো দেখা যায়নি ডাকসাকে।”
    “পালানোর সময় গুরুতর আহত হয়েছিলো সে।” কথাটি যোগ করলেন সেনাপতি রাজন। “এতদিনে নিশ্চয়ই কঙ্কালে পরিনত হয়েছে ডাকসা।” একটু থামলেন সেনাপতি। তারপর বললেন, “আজকের জন্য অনেক হয়েছে। এবার তাবুতে ফিরে যাওয়া উচিত। কাল চাঁদ ওঠার আগেই রওনা দিতে হবে আমাদের। অনেক লম্বা পথ রয়েছে সামনে।” আমার চোখে চোখ রাখলেন রাজন। আমি সম্মতি জানালাম।
    তাবুতে ফিরেই দেরী না করে শোবার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। সারাদিনের যাত্রায় প্রচুর ধকল গেছে, তাই ভেবেছিলাম বিছানায় গেলেই ঘুম চলে আসবে। কিন্তু আদতে এমনটা ঘটলো না।
    নানান দুশ্চিন্তা ভর করলো আমার মাথায়। দুশ্চিন্তা এই রাজ্য নিয়ে, রাজ্যের রাজাকে নিয়ে। কারন আরকান রাজ্যের রাজা মনসুর তথা আমার পিতা এখন যে কেবলই এক নিশ্চল, নিথর মূর্তি। ছলনাময়ী ডাইনী মালিকা তাকে প্রেমের মায়াজালে ফাঁসিয়ে মূর্তিতে পরিণত করেছে, চুরি করে নিয়েছে তাঁর হাতের আংটি তথা রাজ্যের অমর রত্ন। এই রত্নের অনুপস্থিতিতে শুকিয়ে যাবে রাজ্যের সকল পানির উৎস নদী-নালা, খালবিল। বন্ধ হয়ে যাবে কৃষিকাজ, বিলীন হয়ে যাবে সশ্যক্ষেত্র। দেখা দেবে দুর্ভিক্ষ।
    কিন্তু এটাই সবচেয়ে বড় বিপদ নয়। রাজা মনসুরকে পূর্বের মনুষ্য অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আমাদের হাতে যে আর মাত্র তিন চন্দ্রদিনই অবশিষ্ট আছে! এই সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে চিরস্থায়ী রুপ নেবে রাজার এই পরিনতি।
    তাই কোন রকম কালক্ষেপন না করে জরুরী এক সভা ডেকে গঠন করা হয়েছে এই অভিযাত্রী দল।
    আমাদের এই অতিগুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় অভিযাত্রা উত্তর গোলার্ধ অভিমুখে, যেখানে সন্ধান মিলবে জ্ঞানী বৃক্ষের। হয়তো সে-ই এখন আমাদের একমাত্র সাহায্যকর্তা।
    এই জ্ঞানী বৃক্ষের কথা উল্লেখ আছে রাজ্য গ্রন্থে। আরকান রাজ্যের পূর্বপুরুষেরা তাদের লিখিত বানীতে বলে গেছেন, “যদি তোমরা কখনো এমন কোন বিপদের সম্মুখীন হও, যা থেকে পরিত্রাণের উপায় তোমাদের জানা নেই, তবে মনে রেখো তার সমাধান আছে জ্ঞানী বৃক্ষের কাছে।”
    তাই এই অভিযানই আমাদের শেষ ভরসা। রাজার অনুপস্থিতিতে আমার বড় ভ্রাতা রাজপুত্র জাকির এখন রাজ্য দেখাশুনা করছে।
    এতসব চিন্তার মাঝে এখন নতুন করে যুক্ত হল ডাকসার ব্যপারটি। কেননা উত্তর গোলার্ধে যাত্রাপথে আমাদের অতিক্রম করতে হবে ডাকসার এই গভীর জঙ্গল। তাছাড়া সেনাপতি যতই দাবী করুক, ডাকসার মত নরপশু এতো সহজে শেষ হয়ে যাবে, আমার তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
    হটাতই জঙ্গল ভেদ করে ক্ষীণ একটা শব্দ কানে ভেসে এলো আমার। অনেকটা শুকনো পাতার মর্মর শব্দ, যেন অদুরেই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কেউ একজন হাঁটছে।
    আমি কান খাড়া করে শব্দটা শোনার চেষ্টা করলাম। লক্ষ্য করলাম ধীরে ধীরে আরও স্পষ্টতর হয়ে উঠছে সেটা, যেন জঙ্গল ছেড়ে এবার খোলা তৃণভূমির দিকেই এগিয়ে আসছে। আসছে ঠিক আমারই দিকে, ভারী পদক্ষেপ ফেলে!
    জানি না কতগুলি মুহূর্ত কেটেছে এভাবে, হটাতই মনে হলো তাবুর ঠিক ওপারে এসে থেমেছে জিনিসটা। ওটার ভারী জান্তব নিঃশাস এসে পড়ছিল আমার তাবুর উপর। ঠিক যেন অস্থিরভাবে তাবুর চারিদিকে পায়চারী করে বেড়াচ্ছে আর ঘন ঘন নিঃশাস ফেলছে। আমার পা দুটি অবশ হয়ে এলো এবার। প্রচন্ড ইচ্ছা সত্তেও এক চুল নাড়াতে পারলাম না। এই সেই ভয়াবহ নরপশু ডাকসা নয়তো!
প্রথম প্রকশঃ ০৯/০৪/২০১৬
(২) আমি খুব সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার ডানে তাবুর এক কোনে আমার তরবারি ও ঢালটি রাখা ছিল। খুব সাবধানে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। এক হাতে তরবারি ও অন্য হাতে ঢালটি তুলে নিলাম। তখনো স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম পশুটি আমার তাবুর আশেপাশে পায়চারী করে বেড়াচ্ছে। সেটার ভারী পদক্ষেপ আর ঘন নিঃশ্বাসে আমার গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিলো বড় কোন বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছি।
    এভাবে কেটে গেছে পরের বেশ কয়েকটি মুহূর্ত। কিন্তু যেমনটা আশংকা করেছিলাম, তেমন কিছু ঘটল না।
    হটাত এক আর্তচিৎকারে সতবিত ফিরে এল আমার। চিৎকারটা আমাদেরই কোন এক তাবু থেকে এসেছে। আমি তড়িঘড়ি করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। দেখতে পেলাম অদূরে একটি তাবুতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে! ইতিমধ্যেই শোরগোল পড়ে গেছে পুরো শিবিরে। আকাশে তাকাতেই চোখে পরলো কয়েকটা ডাইনী জাদুর লাঠিতে ভর করে উড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের বীভৎস খিল খিল হাসির শব্দ আমার কানে ভেসে এল। ডাইনিগুলি আমাদের তাবু লক্ষ্য করে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করছে।
    এর কিছুক্ষনের মধ্যেই হন্তদন্ত করে এদিকে ছুটে আসলেন সেনাপতি। তার পিছনে উপদেষ্টা আয়াজ ও আমার বন্ধু খাজাও ছিল। সবার চোখে মুখে স্পষ্ট আতংকের ছাপ। সেনাপতিকে সবচেয়ে বেশি বিচলিত দেখাচ্ছিল। আমি আগে কখনো তাকে এত বিচলিত হতে দেখিনি।
    “রাজকুমার, আমি আমার সৈন্যদের নিয়ে ডাইনিদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি, আপনারা সুযোগ পেলেই জঙ্গলের দিকে ছুটে পালাবেন।” কথাটি খুব দ্রুতই শেষ করলেন সেনাপতি। তারপর তাকালেন অন্যদের দিকে। “খাজা, রাজকুমারের দিকে খেয়াল রাখবেন। আর আয়াজ, আশা করি আমাদের আবার দেখা হবে।” কথাটি শেষ হতেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন সেনাপতি। আর দ্রুতই মিলিয়ে গেলেন অন্ধকারে। যেন এটাই শেষবারের মত তার সাথে আমাদের দেখা।
    খাজা আমাদের দুজনের হাত ধরল, আমাদের টেনে নিচু করে একটি তাবুর আড়ালে নিয়ে গেল। সেখানে চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা।
    “একজন সৈন্য ইতিমধ্যেই মারা পড়েছে।” ফিসফিস করে কথাটি বলল খাজা।
    “ডাইনিরা সংখায় অনেক বেশি, সেনাপতির তাদের সাথে পেরে ওঠার সম্ভাবনা খুবই ক্ষিন।” ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ দেখাচ্ছিল আয়াজকে। “ডাইনিদের উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট, আমাদের শেষ করতে এখানে এসেছে তারা। মালিকা পাঠিয়েছে তাদের।” তিনি বললেন।
    “কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না, মালিকা আমাদের খোঁজ পেল কি করে?” আমি প্রশ্ন করলাম। কেউ কোন উত্তর দিল না। সম্ভবত এর উত্তর কারো জানা নেই।
    হটাত লক্ষ্য করলাম শিবিরের অন্য দিকটায় ছুটে যাচ্ছে ডাইনিরা। তাদের দিকে তীর নিক্ষেপ করা হচ্ছে। বুঝতে পারলাম, আমাদের পালানোর সময় হয়েছে এবার। খুব দ্রুত সবাই জঙ্গলের দিকে ছুটতে শুরু করলাম।
    পালানোর সময় আমি বার বার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিলাম। ডাইনিগুলি অবিরত আগুনের গোলা নিক্ষেপ করে চলছিলো আর বীভৎসভাবে খিল খিল করে হেসে চলছিলো। তাদের ঐ শক্তিশালী অস্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের ওই তীর বড়ই ঠুনকো মনে হচ্ছিলো।
    সবগুলি তাবুতে আগুন লেগে গিয়েছিল। আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে উপরে উঠে চলছিলো। হটাতই সেনাপতিকে নিয়ে আমার ভীষণ চিন্তা হল। পিতৃতুল্য এই সেনাপতি আমার পিতার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুও বটে। জানি না তাঁর সাথে আর কখনো দেখা হবে কিনা?
    আমরা ছুটে চলেছি। জানা নেই কতক্ষন এভাবে ছুটেছি। এক সময় জঙ্গলের গহীনে প্রবেশ করলাম। বেশ খানিকটা দূরে এসে থামলাম সবাই। চিৎকার আর কোলাহলের শব্দ এখানে অনেকটাই কমে এসেছে। এক মুহূর্তের জন্য মাটিতে বসে পড়লাম সবাই। টানা দৌড়ে হাঁপিয়ে গেছি। একটু জিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম।
   “আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। এই জায়গা বেশিক্ষনের জন্য নিরাপদ নয়।” একটি মশাল জ্বালিয়ে মাটিতে গাড়ল খাজা। তারপর থলে থেকে আরকান রাজ্যের মানচিত্রটি বের করলো। সেটি মাটিতে রেখে তার তর্জনী রাখল সেটার উপর।
    “জঙ্গলের উত্তর-পূর্ব দিকে যেতে হবে আমাদের। সামনে একটি নালা পড়বে, তারপর মোড় নিতে হবে ডানে।”
    “আমরা সরাসরি উত্তর দিক দিয়ে যাচ্ছি না কেন?” প্রশ্ন করলেন আয়াজ।
    “কেননা উত্তর দিকটা ডাকসার অঞ্চল ছিল। আর তাছাড়া উত্তর-পূর্ব দিয়ে আমি আগেও যাত্রা করেছি।” বলল খাজা।
    আয়াজ কোন কথা বাড়ালেন না। আমার দিকে তাকালেন। থলে থেকে অদ্ভুত আকৃতির একটি পাথর বের করলেন। আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, “এটা রাখুন, রাজকুমার।”
    “কি এটা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
    জবাবে তিনি শুধু বললেন, “সময় হলেই জানতে পারবেন।”
    মশালটি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো খাজা, তারপর এগিয়ে চলল উত্তর-পূর্ব দিকে। আমি ও আয়াজ তাঁকে অনুসরন করলাম।
    খাজা একজন অত্যন্ত দক্ষ ও সাহসী যোদ্ধা। সেনাপতির সাথে অনেক অভিযান পরিচালনা করেছে সে। এই রাজ্যের অনেক দুর্গম অঞ্চলে যাত্রার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। তাই এই মুহূর্তে তার উপর ভরসা রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হল আমার।
প্রথম প্রকশঃ ১৬/০৪/২০১৬ 
(৩)আকাশে বিশাল থালার মত করে দিনের চাঁদ উঠেছে। চাঁদের রুপালী আলোয় সামনের পথটা এখন অনেকটাই পরিষ্কার দেখাচ্ছে। ছেলেবেলায় রুপকথার বইতে পড়েছিলাম, কোন এক পৃথিবীতে চাঁদ ছাড়াও অন্য একটি নক্ষত্র রয়েছে, যা চাঁদের চেয়েও হাজারগুণ বেশি আলো দেয়। এই মুহূর্তে তাই ভীষণ আফসোস হচ্ছিলো ভেবে, যদি আমাদের পৃথিবীতেও ওরকম কিছু থাকতো।
    বেশ দীর্ঘ একটা সময় এভাবে নিদ্রাহীন, বিরতিহীনভাবে যাত্রার পর ক্লান্তি যেন ভর করে বসলো আমার উপর। যদিও হ্রদ থেকে খুব বেশি দূরে নেই আমরা, কিন্তু বিশ্রাম নেয়াটা এবার যেন বড্ড বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তাই একটু ফাঁকা জায়গা পেতেই আমি একটি টিবির উপর বসে পড়লাম। “বড্ড হাঁপিয়ে গিয়েছি।” বললাম আমি।
    আমার অবস্থা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল খাজা। তার হাতের মশালটি মাটিতে গেড়ে রাখল। বলল, “আমরা তো প্রায় হ্রদের কাছাকাছি চলে এসেছি।” খাজার চেহারাতেও ছিল ক্লান্তির ছাপ।
    আয়াজ কিন্তু কোন রকম কথা বললেন না। চুপচাপ আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে একবার এদিক ওদিক তাকালেন। চেহারায় তাঁর ভীত সন্ত্রস্ত ভাব।
    “উপদেষ্টা, কোন সমস্যা?” আমি স্থির দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালাম।
    “না, তেমন কিছু নয়, রাজকুমার।” অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিলেন তিনি।
    “কিছু মনে করবেন না, আপনাক�� বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। কিছু একটা নিয়ে ভাবছেন আপনি।” সরাসরি বললাম কথাটা।
    “আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা আমাদের উপর নজর রাখছে।” এবার মুখ খুললেন আয়াজ। তাঁর কণ্ঠ শান্ত। “আমরা কোথাও একটা ভুল করছি।”
    আয়াজের কথা শুনে নিচু করে মাথা নাড়তে লাগলো খাজা। ভীষণ হতাশ দেখাচ্ছিল তাকে। উপদেষ্টার কথা যেন মেনেই নিতে পারছিল না সে।
    “আপনি কী ভাবছেন …” আমি কথাটি সম্পূর্ণ করতে পারলাম না। আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আয়াজ বললেন, “না, এটা ডাকসা নয়।” বরফ শীতল তাঁর কণ্ঠ।
   “কি বলছেন এসব? এখানে ঐ নরপশুর কথা আসলো কেন?” এবার সত্যি সত্যি বিরক্ত খাজা। হয়তো কিছুটা ভীতও। “দেখুন আয়াজ, এভাবে নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই।” খাজা উঠে দাঁড়ালো। এক হাতে মশালটি তুলে নিল।
    হটাতই লক্ষ্য করলাম ব্যাপারটা। জঙ্গলের গভীর থেকে কয়েক জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সাথে সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম আয়াজের দিকে, সে নিজেও লক্ষ্য করেছে। কারো মুখ থেকে কোন রা বেরুল না। আয়াজের কথাই তাহলে ঠিক, কেউ আমাদের উপর নজর রাখছে।
    কিছুক্ষনের মধ্যে আরও স্পষ্ট হল ব্যাপারটা। অন্তত ডজন খানেক চোখ আমাদের চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। আমি ধীরে ধীরে আমার তরবারির হাতলের উপর হাত রাখলাম। সাবধানে তরবারিটি খোলসছাড়া করলাম। চোখগুলি যেন কিছু একটা আঁচ করতে পারলো। ধীরে ধীরে জঙ্গলের গভীর থেকে আমাদের দিকে আরও এগিয়ে আসতে লাগলো।
    একসময় চারিদিক থেকে সেগুলি আমাদের ঘিরে ফেলল। চাঁদের আলোয় এবার স্পষ্ট দেখতে পেলাম সবকিছু। ওদের মুখগুলি অর্ধেক হা হয়ে ছিল, অনবরত লালা ঝরছিল সেখান থেকে। ভয়ানক তীক্ষ্ণ দাঁতগুলি চকচক করছিলো। চাহুনিতে ছিল অস্বাভাবিক হিংস্রতা। এগুলো হায়েনা। একটা নয়, দুটো নয়। অনেকগুলি!
    তাদের আচরণ মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো না। কেন যেন মনে হল, কোন সাধারণ হায়েনা এরা নয়। আমাদের চোখের ভাষা যেন পড়ছিল তারা। সবকিছু বুঝতে পারছিল, আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, চিন্তা, পরিকল্পনা, সবকিছু।
    হটাত কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি হায়েনা অতর্কিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল আয়াজের উপর। মুহূর্তের এই হামলায় নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালেন আয়াজ। পড়ে গেলেন মাটিতে। আর সেখানেই ঘটলো বিপত্তি। অন্য একটি হায়েনা তাঁর ঘাড়ে কামড় বসিয়ে দিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তাকে টেনে হিঁচড়ে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করলো। মুখ দিয়ে শুধু অস্ফুট একটি শব্দ করতে পারলেন আয়াজ।
    আমি চিৎকার করে উঠলাম, “খাজা, কিছু একটা করো।”
    তরবারি হাতে নিয়ে তখনো স্থির দাঁড়িয়ে ছিল কিংকর্তব্যবিমুঢ় খাজা। যেন কি করতে হবে সেটাই ভুলে গেছে সে। আমি তরবারি নিয়ে দৌড়ে এগিয়ে গেলাম আয়াজের দিকে। কিন্তু ততক্ষনে অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে। হায়েনাগুলি আয়াজকে টেনে জঙ্গলের গভীরে অন্ধকারে নিয়ে গেছে।
    “আয়াজ!” আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলাম। “ধরে থাকুন, আমি আসছি।” আর কোন সাড়া মিলল না তাঁর কাছ থেকে। অন্য একটি হায়েনা আমার পথ রোধ করে দাঁড়ালো।
    আমি তরবারিটি দু-হাতে শক্ত করে ধরলাম। হায়েনাটির দিকে সেটা তাক করলাম। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কোন রকম ভ্রুক্ষেপ হল না হায়েনাটির। পুরোপুরি অগ্রাহ্য করলো আমাকে। তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে, যেন আক্রমণ করার প্রস্তুত হচ্ছে।
    “খাজা! মশাল দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করো!” আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। এবারও কোন উত্তর এল না।
    আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না এখন কি করবো। হিংস্র এই অস্বাভাবিক জানোয়ারগুলির হাত থেকে কীভাবে রক্ষা পাবো। আমি মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শিখেছি, এরকম অতিপ্রাকৃত ভয়ঙ্কর জন্তুর বিরুদ্ধে নয়। অগত্যা বিধাতার হাতেই নিজের ভাগ্য সঁপে দেয়া শ্রেয় মনে হল।
প্রথম প্রকশঃ ২১/০৪/২০১৬ 
(৪) হায়েনাগুলি চারিদিক থেকে আমাদের কোণঠাসা করে ফেলেছিল। আমরা পরস্পরের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ওগুলির দিকে তরবারি তাক করে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
    রাগে ক্ষোভে আমি যেন রীতিমতো কাঁপছিলাম। দাঁতে দাঁত চেপে এক দৃষ্টিতে সেগুলির তাকিয়ে রইলাম। টের পেলাম আমার কপালের ঘাম গড়িয়ে চোয়ালে এসে ঠেকেছে।
    ঠিক তখনই জঙ্গলের গভীর থেকে ভয়ংকর এক গর্জনের শব্দ ভেসে এল। পুরো জঙ্গলটি যেন কেঁপে উঠলো তাতে। ধক করে উঠলো আমার বুকের ভেতরটা। টের পেলাম গায়ের রোমগুলি খাড়া হয়ে গেছে। ভয়ে, বিস্ময়ে যেন হতবম্ব হয়ে পড়লাম।
    এ কোন সাধারণ প্রাণী নয়। ভয়ঙ্কর, অতিপ্রাকৃতিক কিছু একটা।
    “ডাকসা!” অস্ফুট স্বরে নামটি উচ্চারন করলো খাজা, যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। “ডাকসা জীবিত!”
    কেন জানি মনে হল, হায়েনাগুলি পেছনে সরে পড়েছে। যেন আমাদের মত সেগুলিও ভীত, সন্ত্রস্ত।
    ভীত আমি নিজেও। কারন ভয়ঙ্কর গর্জনের মালিক ‘ডাকসা’ যে এদিকেই এগিয়ে আসছে। আসছে সবকিছু ছাপিয়ে, ভেঙ্গে চুড়ে। ওটার ভারী পদক্ষেপে কেঁপে উঠছিল আমাদের পায়ের তলার মাটি।
    হায়েনাগুলি ইতিমধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমরা নিজেরাও পালানোর তাগিদ অনুভব করলাম। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দানবটি লম্বা পদক্ষেপে খুব দ্রুতই আমাদের কাছে চলে এসেছে। জঙ্গল ছাড়িয়ে আমাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। রোধ করেছে সামনের পথটি।
    এই প্রথমবারের মত ডাকসাকে দেখলাম আমি। লোমশ গায়ের বিশাল আকৃতির একটি নরপশু। হাতের থাবায় ধারালো নখর। মুখে সারি সারি ধারালো দাঁত। উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় সেগুলি চকচক করছিলো।
    জ্বলজ্বল চোখে এক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল ডাকসা। চাহুনিতে ছিল নরকের হিংস্রতা।
    ওটার ভারী জান্তব নিঃশ্বাস যেন চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খান খান করে দিচ্ছিল।
Tumblr media
    আমি বুঝতে পারছিলাম একটা কিছু করার জন্য তৈরি হচ্ছে খাজা। হটাতই সে তার তরবারিটি খোলসছাড়া করলো। এক মুহূর্ত দেরি না করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ডাকসার উপর।
    কিন্তু খাজার ওই আক্রমণ নেহাতই ঠুনকো মনে হল। এর যেন কোন প্রভাবই পড়ল না ডাকসার উপর। ডাকসার এক থাবায় পরক্ষনেই খড়কুটোর মতো উড়ে গেল খাজা। ছিটকে পড়ল দূরে।
    আমি চিৎকার করে উঠলাম কিন্তু কোন সাড়া মিলল না। এবার খাজার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালো ডাকসা। এগিয়ে আসতে লাগলো সামনে। আমি ��য়ে, আতঙ্কে পিছিয়ে গেলাম কয়েক পা। কিন্তু হটাত কিছু একটার সাথে আটকে গেল আমার পা। সাথে সাথেই মাটিতে পড়ে গেলাম। তরবারিটি খসে পড়ল হাত থেকে।
    আর কোন উপায় অন্তর না দেখে আমি আমার ঢালটি উঁচিয়ে ধরলাম। আত্মরক্ষার শেষ বৃথা চেষ্টা করলাম। কিন্তু পরক্ষনেই নাটকীয় কিছু একটা ঘটলো। হটাতই ডাকসা থমকে গেল। এক চুলও এগলো না আর। কিছু একটা ঘটেছে তার ভেতরে। স্থির দাঁড়িয়ে গেছে সে। তাকিয়ে আছে আমার ঢালের দিকে। যেন মূর্তি বনে গেছে।
    হটাত আমি একটু নড়ে উঠতেই যেন ঘোর ভাঙল তার। সভয়ে পেছনে সরে গেল। কিছু একটা দেখেছে সে। এমন কিছু যার জন্য তৈরি ছিল না সে। তার মুখ দিয়ে আর্তনাদের মতো শুধু গরগর একটা আওয়াজ বেরোল। ঠিক পরক্ষনেই পেছনে ঘুরে ছুটে পালালো ডাকসা। মুহূর্তেই হারিয়ে গেল জঙ্গলের গভীরে।
    ঘটনার আকস্মিকতায় আমি নিজেও হতবম্ব হয়ে পড়লাম। ঢালটির দিকে একবার তাক��লাম। সেটার মুখ আমার দিকে ঘোরালাম। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় চকচক করছিলো ধাতব পাতটি। ঢালের মুখের উপর কিছু দেখেছে ডাকসা! নিজের চেহারা!
    পরক্ষনেই আমি উঠে দাঁড়ালাম, ছুটে গেলাম অন্য দিকটায়। সেখানে খাজার নিশ্চল, নিথর দেহটা মাটিতে পড়ে ছিল। আমি হাঁটু গেড়ে বসে দু হাতে তার মাথাটা তুললাম। তার গালে কয়েকটা চড় লাগালাম। কিন্তু কোন সাড়া মিলল না। তার গলার ধমনির উপর হাত রাখতেই বুঝতে পারলাম অনেক দেরি হয়ে গেছে। সব শেষ হয়ে গেছে। খাজা নেই। চলে গেছে আমাকে ছেড়ে।
    আমার চোখ দিয়ে যেন এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। আর যেন পারছিলাম না। সবাইকে হারাতে হারাতে যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
    একটা ডাইনী শেষ করে দিয়েছে সব। রাজ্য, রাজা, সেনাপতি, বন্ধু! সব। একা করে দিয়েছে আমাকে।
    নিজের অজান্তেই কখন যেন মুষ্টি বদ্ধ হয়ে এল আমার হাত। দুঃখ পরিনত হল রাগে, ক্ষোভে, প্রতিহিংসায়। আমি যে মালিকাকে ছাড়ছি না। 
পরবর্তী অধ্যায় প্রথমপাতা
লেখকঃ এম এ নাঈম প্রথম প্রকাশঃ ২৬/০৪/১৬
বিঃ দ্রঃ এটি একটি কল্পকাহিনী। এখানে উল্লেখিত সকল চরিত্র কাল্পনিক। লেখক এর সম্পূর্ণ স্বত্বাধিকারী। অনুমুতি ব্যাতিত এর কোন অংশ নকল বা প্রকাশ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
0 notes
manayeem · 9 years
Text
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নিয়তি প্রথম পর্ব
জুলাই, ২০৯৭ কার্গো মহাশূন্যযান তাদাশি মার্স কলোনি হতে হুয়াং কলোনির উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে। যানটিতে নয় সদস্যবিশিষ্ট একটি নাবিক দল রয়েছে। এটি হুয়াং কলোনি সংশ্লিষ্ট যাবতীয় রসদপত্র (Life Support Supply) সরবরাহ কাজে নিয়োজিত। প্রায় এক দশক পূর্বে বৃহস্পতির (Jupiter) চাঁদ ইউরোপার কক্ষপথে স্থাপিত হুয়াং কলোনি একটি কৃত্রিম ভাসমান স্টেশন, যা ইউরোপাকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণ্যয়মান। একটি গবেষক দল এবং তাদের পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা এই কলোনির মূল লক্ষ্য সম্ভাব্য নিকততম দূরত্ব থেকে ইউরোপার পৃষ্ঠ, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে এর ভূগর্ভস্থ সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করা।
মূলত অতি আণুবীক্ষণিক প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে বের করাই এদের উদ্দেশ্য। এই স্টেশন থেকে শনির (Saturn) চাঁদ এন্সেলেডাসের (Enceladus) উপরও একই গবেষণা চালানো হয়। বাস্তবতা হল দুটি চাঁদেই রয়েছে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার বিপুল সম্ভাবনা। এদের রয়েছে ঘন বায়ুমণ্ডল এবং ভূগর্ভস্থ তরল পানির অস্তিত্ব, যা প্রাণের বিবর্তনের জন্য অত্যাবশ্যক। বলাই বাহুল্য, এখন পর্যন্ত সৌরজগতের অন্য কোন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
হুয়াং কলোনি এখন পর্যন্ত পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে সর্বাধিক দূরত্বে অবস্থিত মানব উপনিবেশ। মঙ্গলপৃষ্ঠ থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩৪৩ মিলিয়ন মাইল, যা পৃথিবী থেকে মঙ্গলের দূরত্বের প্রায় সাত গুন। সুতরাং সেখানে পৌছাতে তাদাশির সময় লাগবে প্রায় বছর, যেখানে মঙ্গলের ক্ষেত্রে সেটা কেবলই পাচ মাস। পথিমধ্যে একটি ফুয়েল স্টেশনে যাত্রা বিরতি নেবে তাদাশি। এই স্টেশনটি মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যবর্তী বামন গ্রহ (Dwarf Planet) সেরেস (Ceres) এর পৃষ্ঠে অবস্থিত, উনবিংশ শতাব্দীর একটি সোভিয়েত স্পেস স্টেশনের নামে এর নামকরণ করা হয় আলমাজ। মূলত পুনরায় জ্বালানী ভর্তির কাজেই ছোট থেকে মাঝারী মাপের মহাকাশযানগুলো বিরতি নেয় আলমাজে।
সাধারনত যেসব মহাশূন্যযান সৌরজগতের বাইরের অংশ (Outer Solar System) অর্থাৎ মঙ্গলের কক্ষপথ থেকে দূরবর্তী স্থানে যাত্রা করে, তারা জ্বালানী হিসেবে প্লুটোনিয়াম আইসোটোপ (Plutonium-238) ব্যবহার করে। যেহেতু বৃহস্পতি সূর্য থেকে অনেক দূরে অবস্থিত, তাই এ পথে চালিত মহাকাশযানগুলো সৌরশক্তিচালিত (Soler Power) যান নয়।
প্লুটোনিয়াম একটি অতিমাত্রায় তেজস্ক্রিয় পদার্থ এবং পারমাণবিক বিক্রিয়ার সাহায্যে এর প্রক্রিয়াজাত করা হয়। সুতরাং মঙ্গল কিংবা বৃহস্পতির চাঁদ যেখানে মানুষের বসতি নির্মাণ করা হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবেই প্লুটোনিয়ামের কোন বিশোধক স্টেশন সেখানে স্থাপন করা হয়নি। বরং বেছে নেয়া হয়েছে সেরেস গ্রহটিকে যেটি কিনা ঠিক মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যবর্তী যাত্রাপথে অবস্থিত। তাছারা প্লুটোনিয়াম প্রস্তুতের জন্য কাঁচামাল (ইউরেনিয়াম, নেপচুনিয়াম) সেরেসের আশেপাশের অঞ্চল (গ্রহাণু) থেকে খুব সহজে জোগাড় করা যায়।
প্রায় এক বছরের বিরতিহীন যাত্রার পর অবশেষে তাদাশি সেরেসের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বামন গ্রহ সেরেস দৃশ্যমান হবে বলে আশা করছেন জাহাজটির ক্যাপ্টেন শাকির। ইতিমধ্যে তাদাশির কমান্ড ডেক থেকে গ্রহাণু বলয়টি (Asteroid belt) স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মঙ্গল থেকে বৃহস্পতির যাত্রাপথে গ্রহাণুর এই বলয়টি চোখে পড়ে। এই বলয় ঘেঁষেই সেরেসের অবস্থান। সেরেসের স্টেশন আলমাজে ৭ দিনের একটি যাত্রা বিরতি নেবে জাহাজটি। এই সময়ে আলমাজে অবস্থিত প্রকৌশলীর একটি বিশেষ দল পর্যবেক্ষণ করবে যানটি। তাছাড়া পুনরায় জ্বালানী ভর্তি করা হবে এই স্টেশন থেকে।
বৃহস্পতির উদ্দেশ্যে ক্যাপ্টেন শাকিরের এটিই প্রথম অভিযাত্রা। যদিও পূর্বে কখনো বাইরের সৌরমণ্ডলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেননি তিনি, সাধারনত পৃথিবী ও মঙ্গলের মধ্যেই যাত্রাপথ সীমাবদ্ধ ছিল তার। তবুও অভিজ্ঞ ও যোগ্য প্রার্থী হিসেবেই এ প্রকল্পে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাকে। এই যাত্রাটি সম্পন্ন করেই তিনি তার দীর্ঘ সময়ের চাকুরী জীবন থেকে অবসর নেবেন। তাই হুয়াং কলোনিতে পা রাখার অভিজ্ঞতাটি হয়তো তার সাধাসিধে চাকুরী জীবনে একটি বড় প্রাপ্তি হিসেবে যোগ হতে যাচ্ছে।
কমান্ড ডেকের ব্রিজে প্রবেশ করলেন ক্যাপ্টেন শাকির। প্রধান ন্যাভিগেটর বানশির চেয়ারে হাত রেখে ন্যাভিগেশন মনিটরে তাকালেন। ক্যাপ্টেনের সাথে বন্ধুর মত সম্পর্ক বানশির। - ‘আশা করছি কিছুক্ষনের মধ্যেই সেরেস সোনামনির দেখা পাব আমরা।’ জানালেন ন্যাভিগেটর বানশি। অনেকদিন ধরে একসাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা দুজনের। কিন্তু তবুও যেহেতু এই দিকটাই প্রথমবারের মতো আসা, তাই দুজনেই খুব মনযোগী।
বানশির ঠিক পাশের চেয়ারেই রয়েছে পাইলট কারিমা। অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক নবীন সে। তাছাড়া প্রথমবারের মতো তাদাশিতে যুক্ত হয়েছে কারিমা। তাই নতুন ক্যাপ্টেনের সাথে কাজ করার তেমন অভিজ্ঞতা নেই তার। এই যানে তাকে যুক্ত করার মূল কারন তার বৃহস্পতি যাবার পূর্ব অভিজ্ঞতা। কারিমা মূলত সেরেসের আলমাজ স্টেশনের অধিনস্ত পাইলট হিসেবে কর্মরত ছিল। সেরেস থেকে যেসব অভিযান পরিচালনা করা হতো, তার অনেকগুলোর অংশ হিসেবে ছিল সে। সর্বশেষ কয়েক বছর আগে তাকে মার্স কলোনিতে বদলি করা হয়।
তাদাশি স্বাভাবিক গতিতেই এগোচ্ছিল। কমান্ড ডেক থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো অ্যাস্ট্রয়েড বেল্টের গ্রহাণুগুলোকে। স্ক্রিনে সেরেসের অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট, কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো খালি চোখেও দেখা যাবে ধুসর গ্রহটিকে। বানশি আলমাজ স্টেশনের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছিল।
Tumblr media
হটাত করেই ঘটলো ব্যাপারটি। প্রথমে নজরে আসলো জাহাজের পাইলট কারিমার। বাইরে অস্বাভাবিক কিছু একটা চোখে পড়ল তার। সে প্রথমে ভেবেছিল এটি জাহাজের জানালার কাঁচ, যেটি ক্রমশ ঘোলা হয়ে আসছে। কিন্তু পরক্ষনেই সে বুঝতে পারে এটি আসলে কাঁচ নয়, বরং সামনের গ্রহাণুগুলো যেগুলো দেখতে ঘোলা মনে হচ্ছিলো।
- 'আপনারা কি বাইরে অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাচ্ছেন?’ কারিমা তার সহকর্মীদের দিকে তাকাল। কিন্তু ততক্ষনে তার সহকর্মীরাও খেয়াল করেছে ব্যাপারটি। দুজনই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরে। কারো মুখে কোন রা নেই।
সামনের গ্রহাণুগুলো, সত্যি বলতে কি সামনের পুরো এলাকাটিই ধীরে ধীরে ঘোলা হয়ে আসছিলো। ব্যাপারটিকে ঠিক ঘোলা বলা যাবে না, আসলে কেমন যেন বিকৃত হয়ে আসছিলো। অনেকটা পানিতে ঢেউ হলে যেরকম লাগে দেখতে সেরকম। এটিকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে 'ডিজটরশন অব ইমেজ'। ধীরে ধীরে এই বিকৃতি একটি বিশাল স্ফটিকের ন্যায় গোলকের আকারে রূপ নিল। মনে হল বিশাল কোন গোলাকার আয়নার মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে সামনের মহাশূন্য স্থানটি। যেন ঢেউ খেলে যাচ্ছে সেই আয়নায়। - 'এটা কোন ব্ল্যাকহোল নয়তো!’ আতংকিত এবং বিস্মিত ক্যাপ্টেন শাকির। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। 'এখুনি জাহাজের দিক পরিবর্তন কর!’ আদেশ করলেন তিনি। কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে, কেউ কিছুই করার সময় পেল না। সোজা গোলকের ভেতর ঢুকে পড়ল জাহাজটি। আর হটাতই খাড়াভাবে নিচে পড়তে শুরু করল। মনে হল একটি লম্বা, সরু টানেল ধরে পড়ে যাচ্ছে যানটি আর পেছনে ফেলে যাচ্ছে আশে পাশের সবকিছু। ফেলে যাচ্ছে অ্যাস্ট্রয়েড বেল্টের গ্রহাণুগুলো।
বড়ই অদ্ভুত আর বিচিত্র সেই যাত্রা, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় তা। বেশ কিছুক্ষন এভাবে চলার পর হটাতই চোখ ধাঁধানো উজ্জল আলোর রেখা দেখা গেলো, যেন টানেলের বহির্মুখ থেকে নিঃসরন হচ্ছিলো তা। ধীরে ধীরে উজ্জলতর হচ্ছিলো সেই আলোক রশ্মি। হটাত একটা সময় মনে হল অদ্ভুত টানেলটি থেকে বের হয়ে এসেছে যানটি। যেভাবে হটাত শুরু হয়েছিল ঠিক সেভাবেই থেমে গেলো পুরো ব্যাপারটি। মুহূর্তেই যেন স্বাভাবিক হয়ে আসলো সবকিছু, যেন কিছুই ঘটেনি একটু আগে। (চলবে)
প্রথমপাতা
লেখকঃ এম এ নাঈম প্রথম প্রকশঃ ২০/০৯/২০১৫
বিঃ দ্রঃ এটি একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। এখানে উল্লেখিত সকল চরিত্র কাল্পনিক। লেখক এর সম্পূর্ণ স্বত্বাধিকারী। অনুমুতি ব্যাতিত এর কোন অংশ নকল বা প্রকাশ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
0 notes
manayeem · 9 years
Text
ভৌতিক গল্প ভয়
১৩ই জুলাই, ২০১৩ (ঘটনার শুরু) হটাত করে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় উঠে বসলাম। টের পেলাম অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গেছে হৃদ স্পন্দন। ঘড়ি দেখলাম, রাত ঠিক তিনটা বাজে। লক্ষ্য করেছি ইদানিংকালে প্রায়ই রাত তিনটার দিকে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে আমার। এরপর অন্তত ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ঘুম আসছে না। রাতের এই সময়টাতে আসলে করার মতো কিছু থাকে না। তাই ঘুম না আসলে জেগে থাকাটা বেশ অস্বস্তিকর। অনেকক্ষণ বিছানার এপাশ ওপাশ করলাম, ঘুম এলো না। অগত্যা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম।
ঘুম না আসলে বিছানায় বেশিক্ষন শুয়ে থাকা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। লাইট অন করে বারান্দার দরজা খুললাম। এলাকাটা বেশ শুনশান তাই এই দরজাটা রাতে বন্ধই থাকে। এখান থেকে স্পষ্ট বাইরের রাস্তাটা দেখা যায়। আজ একদম ফাঁকা রাস্তাটি। নিরব আর জনমানব শূন্য। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক, দিনের বেলাতেও অনেকটা খালি থাকে এই পথটি। মাঝে মধ্যে দুই একটা রিকশা বা মানুষজন ছাড়া চলাচল প্রায় নেই বললেই চলে। হটাতই ব্যাপারটা নজরে এলো আমার। রাস্তায় কোন কুকুর নেই আজ। সাধারনত এক দল কুকুর এই রাস্তাটি চষে বেড়ায়। কোন একটি কারনে এদের কেউ নেই।
অনেকক্ষণ বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে অন্যমনস্কভাবে কিছু একটা ভাবছিলাম, হটাত একটা অদ্ভুত গন্ধ নাকে এলো। তীব্র এবং ঝাঁঝালো একটা গন্ধ। অদ্ভুত বলেছি কারন পরিচিত কিছুর সাথে মেলাতে পাড়ছিলাম না এই গন্ধটাকে। গন্ধটা এতটাই প্রকট, আর বারান্দায় বসে থাকতে পারলাম না আমি। ভেতরে চলে এলাম।
২০শে জুলাই, ২০১৩ (ঘটনার প্রায় সপ্তাহখানেক পর) আজকেও ঠিক রাত তিনটায় ঘুম ভেঙে গেছে আমার। যথারীতি বারান্দার চেয়ারে বসে আছি। আজো কোন কুকুর দেখতে পেলাম না রাস্তায়। ভাবলাম হয়তো এলাকা ছেড়েই চলে গেছে ওরা।
হটাত একটা তীক্ষ্ণ গন্ধ পেলাম। এই গন্ধটা আমার পরিচিত। কিছুদিন আগে রাতের ঠিক এই সময়টাতে এই একই গন্ধটা পেয়েছিলাম। আজকে আরও বেশি প্রকট মনে হল। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বোঝার চেষ্টা করলাম ঠিক কোন দিক থেকে আসছে সেটা। আমি নিশ্চিত কোন ড্রেন বা সুয়েরেজের গন্ধ নয় এটা। ময়লা, আবর্জনাও নয়। তাছাড়া আশেপাশে এরকম কোন জায়গা নেই, আর যদি থাকেও এভাবে ছড়াবে না সেটা। তবুও ভাবলাম কাল সকালে সিটি কর্পোরেশনের কাউকে জানিয়ে রাখব ব্যাপারটা।
গন্ধটা বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিল আমাকে, বারান্দা ছেড়ে ভেতরে যাব ঠিক এই ��ুহূর্তে চোখে পড়ল জিনিসটা। একটা অবয়ব। মানব আকৃতির একটা অবয়ব। আমার বাড়ি থেকে কয়েকটা প্লট দূরে, রাস্তার বিপরীতে একটা লাইট পোস্টের নিচে। আমি বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম জিনিসটার দিকে। ছায়া মতো কিছু একটা, কোন নড়াচড়া নেই, একদম স্থির, যেন কোন জড় পদার্থ। আবার চোর টোর নয়তো? কিন্তু মানুষের পক্ষে এভাবে এতক্ষন স্থির দাড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। হয়তো অন্য কিছু একটা, ছায়ার কারনে দেখতে এমন লাগছে। রাতে কত কিছুই কত রকম লাগে দেখতে। তাই বেশি মাথা ঘামালাম না ব্যাপারটি নিয়ে। রুমে চলে এলাম।
৫ই অগাস্ট, রাত ৮টা (দ্বিতীয় ঘটনাটির বেশ কিছুদিন পরে) অফিস থেকে বাসায় ফিরছি। বাসার গলিতে ঢুকতেই অনেকগুলো কুকুর চোখে পড়ল। এই রাস্তারই কুকুর এগুলো। আমি খুশিই হলাম এদের দেখে। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম হটাত, কুকুরগুলো কোন কারনে চেঁচামেচি বন্ধ করে দিয়েছে। চুপ হয়ে গেছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। একটু ভয় লাগলো আমার, কোন কিছু করে বসবে না তো। কিন্তু কোন রকম শব্দ না করে একে একে সবগুলো কুকুর চলে গেল রাস্তাটি থেকে। বোবা এই প্রাণীগুলোর কাছ থেকে এমন অদ্ভুত আচরণ আশা করিনি আমি।
রাত ৩টা হটাত করেই ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় উঠে বসলাম আমি। বুক ধরফর করছিলো। শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো। মনে হচ্ছিলো ঘুমের মধ্যে কেউ আমার শ্বাস চেপে ধরেছে। এই বুঝি মারা যাব আমি। ভয় হচ্ছিলো খুব। একটু সময় লাগলো ধাতস্ত হতে। সে রাতে আর ভাল ঘুম হল না। ভাবলাম কালকে ডাক্তারের কাছে যাব।
১৩ই অগাস্ট (তৃতীয় ঘটনার সাত দিন পর) ল্যাপটপে এক মনে কাজ করছি আমি। রাত প্রায় ১টা বাজে। বেশ কিছু প্রয়োজনীয় কাজ জমে গেছে। কালকের মধ্যে জমা দিতে হবে। হটাতই সেই পরিচিত ঝাঁজালো গন্ধ। গন্ধটা এতো তীব্র মনে হল দরজা জানালা সব বন্ধ করতে হবে। আমি রাস্তার সাথের জানালাটা বন্ধ করতে গেলাম, হটাত চোখে পড়ল আমার বাসার ঠিক সামনেই যে লাইট পোস্টটি রয়েছে তার নিচে কেউ একজন দাড়িয়ে আছে। ঠিক কিছুদিন আগে এরকমই একটা ছায়া দেখেছিলাম আমি, কিন্তু এবার সেটা ঠিক আমার বাসার সামনে। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওটার দিকে, বোঝার চেষ্টা করলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার, এতো কাছ থেকেও কোন কিছু স্পষ্ট বোঝা গেল না। একটু ভয় হল আমার। আমি জানালাটা বন্ধ করে দিলাম।
পরদিন সকালে যখন অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়েছি, প্রথমেই রাস্তার ওপারে লাইটপোস্টের নিচে গেলাম। এদিক ওদিক তাকালাম ভাল করে। তেমন কিছু একটা চোখে পড়ল না। কাল রাতে দেখা জিনিসটার সাথে কোন কিছু মেলাতে পারলাম না। ভাবলাম আজ অবশয়ই ডাক্তারের কাছে যাব।
১৩ই সেপ্টেম্বর (ঠিক এক মাস পর) অফিস থেকে বাসায় ফিরছি। রাত প্রায় ৯টা বাজে। বাস থেকে নেমে দুটো গলি পরেই আমার গলি। হেটেই যাওয়া যায়। ডাক্তারের দেয়া ওষুধগুলো নিয়মিত খাচ্ছিলাম, তাই আগের চেয়ে অনেকটা ভাল আছি এখন। রাতের সেই সমস্যাটাও কমে গেছে।
বাসার গলিতে ঢুকতেই হটাত সেই পুরনো গন্ধটা নাকে এলো। বুকটা ছ্যাদ করে উঠল আমার। ভেবেছিলাম সুস্থ হয়ে উঠছি আমি। গন্ধটাকে পাত্তা দিতে চাইলাম না। এক মনে হেটে চললাম। বাসার সামনে এসেছি, ভেতরে ঢুকতে যাব, হটাত চোখে পড়ল সেই ছায়াটা। সেই পুরনো ছায়াটা। বাসা থেকে একটু দূরেই স্থির দাড়িয়ে আছে।
একবার ভাবলাম সামনে যাই, দেখে আসি ব্যাপারটা। কিন্তু পরক্ষনেই সাহস হারিয়ে ফেললাম। এমনিতেই আশেপাশে বাড়িঘর অনেক কম। তাছাড়া রাস্তায় মানুষজনও নেই আজ। কিছু একটা হলে আমার চিৎকারও কেউ শুনতে পাবে না। আর আমি যে বাড়িতে থাকি তার বাড়িওয়ালা বলতেও কেবলমাত্র এক বুড়ি ভদ্রমহিলা। দোতলা বাড়ি, উনি থাকেন নিচতলায়। অগত্যা ভেতরে ঢুকে পড়লাম আমি। বাইরের গেটটি বন্ধ করে দিলাম।
বাসায় ঢুকতেই একটা গুমোট গন্ধ নাকে এলো। মনে হল ঘরের জানালাগুলো খুলে দিতে হবে। কিন্তু কেন জানি জানালা খোলার সাহস পেলাম না। একটু ভয় কাজ করছিলো ভেতরে। ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসে পড়লাম, যতটা সম্ভব মনযোগী হবার চেষ্টা করলাম।
হটাত খট করে একটা শব্দ হল জানালায়। কেউ যেন ঢিল ছুড়ল। হতবম্ব হয়ে পড়লাম আমি। কি করবো বুঝে উঠতে পাড়লাম না। অগত্যা জানালার সামনে গেলাম। ভয়ে ভয়ে খুললাম জানালাটি। বাইরে তাকালাম কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। এবার বেশ রাগ হল আমার। মনে হল ইচ্ছাকৃতভাবেই কেউ একজন এমন করছে আমার সাথে। বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।
সিধান্ত নিলাম আজই বাড়িওয়ালাকে জানাবো ব্যাপারটা। মাথা একটু গরম আছে আমার। নিচতলায় গেলাম, কলিং বেল দিতেই কাজের মেয়েটি দরজা খুলে দিল। ভেতরে ঢুকলাম। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একজন বয়স্ক ভদ্র মহিলা এলেন। ইনিই বাড়ির মালিক। কোন রকম ভুমিকা ছাড়াই সবকিছু খুলে বললাম তাকে। জানালাম বেশ কিছুদিন ধরে কেউ আমাকে বিরক্ত করছে। ঠাণ্ডা মাথায় সব শুনলেন তিনি। ভেবেছিলাম তিনি হয়তো আমার বর্ণনা শুনে অবাক হবেন। কিন্তু তেমন কিছু ঘটলো না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। এরপর শুধু ঘটনা শুরুর তারিখটা জানতে চাইলেন। আমি স্পষ্ট মনে করতে পারলাম না। তবে ওনাকে জানালাম, যেহেতু আমি ডাইরি লিখি, তাই যদি উনি চান তবে তারিখটা জানাতে পারবো। কোন উত্তর দিলেন না উনি। কেবল বললেন আমি যেন এই ঘটনাটিকে কোন রকম পাত্তা না দেই। তার ঘুমানোর সময় হয়ে গেছে জানিয়ে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন যেন অবশ্যই আমি নাস্তা সেরে যাই। বয়স্ক মানুষ তাই আমিও আর কথা বাড়ালাম না।
উপরে এসে আমি আমার ডাইরিটা খুললাম। এই ঘটনাটা প্রথম ঘটেছিলো ১৩ই জুলাই। পরের ঘটনাটা ঘটে ২০শে জুলাই, পরবর্তীতে ৫ই অগাস্ট, এরপর আবার ১৩ই অগাস্ট। এই পর্যায়ে থেমে গেলাম আমি। কি ব্যাপার, ১৩ তারিখের সাথে এই ঘটনার একটা মিল রয়েছে। এমনকি আজও ১৩ তারিখ! তারিখগুলো নিয়ে একটু ভাবলাম আমি। এরপর আরও গভীর কিছু একটা আবিষ্কার করলাম। ২০ থেকে ৭ বাদ দিলে থাকে ১৩। ২০শে জুলাই ঘটে দ্বিতীয় ঘটনাটি, জুলাই হচ্ছে ৭ নম্বর মাস। ৫ই অগাস্টের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। অগাস্ট ৮ নম্বর মাস, ৮ আর ৫ এ ১৩।
এটা কি কেবলই কাকতালীয় নাকি সত্যি সত্যিই ক্রমানুসারে ঘটছে ঘটনাগুলো। তাহলে কি পরবর্তীটি ঘটনাটি ২২শে সেপ্টেম্বর ঘটতে পারে। যদি তাই হয় তবে ব্যাপারটি অবশ্যয়ই প্রাকৃতিক নয়। সেজন্যই হয়তো ভদ্র মহিলা আমার কাছে ঘটনার তারিখ জানতে চেয়েছিলেন�� হয়তো কিছু একটা জানেন তিনি। সামনে কম্পানি থেকে আমার একটা মিটিং রয়েছে, ভাবলাম কাজটি সেরে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করবো ভদ্রমহিলার সাথে।
২২শে সেপ্টেম্বর, রাত ১১টা আমি এখন ঢাকার বাইরে, একটা মিটিংয়ের কাজে গত সপ্তাহে আমাকে পাঠানো হয় এখানে। একটা হোটেলে উঠেছি আমি। আগামীকাল চলে যাব। মিটিং শেষ করে কেবল আমি হোটেল কক্ষে পৌঁছেছি, হটাতই মনে হল আজ ২২শে সেপ্টেম্বর। তারপরই মনে মনে হাসলাম একটু। বাসায় একা থাকলে কত অদ্ভুত চিন্তা ভাবনাই না মাথায় আসে।
আমি খাওয়া দাওয়া সেরে এসেছি। তাই দেরি না করে শুয়ে পড়লাম, কালকে আবার লম্বা জার্নি। শুয়ে শুয়ে কিছু একটা ভাবছিলাম। হটাত কেন যেন মনে হল, হোটেলের জানালা দিয়ে একটু বাইরে তাকানো উচিত। মনে হল আমি দেখব কিছু একটা ওই দূরের রাস্তায় দাড়িয়ে আছে। নাকে আসবে সেই ভয়ঙ্কর গন্ধ। যত সময় যাচ্ছিলো কেন যেন এই ভয়টা মনে দানা বাধছিল। আসলে যতই কাজের মধ্যে ব্যাস্ত থাকি না কেন, মনের গভীরে যে ভয়টা আমার রয়েই গেছে। একা হলেই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে সেটা।
২৩শে সেপ্টেম্বর, দুপুর ২টা বাস থেকে নামলাম আমি। বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটছি। বাসায় পৌছাতেই দেখলাম গেটের বাইরে অনেক মানুষের ভিড়। একটা লাশ কাফনের কাপরে ঢাকা, কেউ একজন মারা গেছে। খোজ নিয়ে জানলাম আমাদের বাড়িওয়ালী ভদ্রমহিলা, কাল রাতে হটাত স্ট্রোক করে ইন্তেকাল করেছেন। সবাই বলাবলি করছিলো একদম সুস্থ একটা মানুষ কোন কারন ছাড়াই হটাত করে চলে গেলেন। ইতিমধ্যে তার ছেলেমেয়েরা সবাই এসেছেন। আজই তার জানাজা হবে।
৩রা অক্টোবর, ২০১৩ হটাত করেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে আমার। রাত ২টা বাজে। আমি বিছানায় উঠে বসলাম। প্রচন্ড ভয় হল আমার। মনে হল এই এখুনি একটা গন্ধ নাকে আসবে। রাতে আর ঘুম হল না। সাড়া রাত জেগে রইলাম। সকাল হল একটা সময়। ভাবলাম এখানে আর নয়। আজই ওয়ার্নিং দিয়ে দেব। সামনের মাস থেকে নতুন কোন বাসায় উঠবো। তাছাড়া নিচের ফ্ল্যাটটিও খালি। এখনো ভাড়া হয়নি। একা পুরো বাড়িতে এভাবে থাকা সম্ভব নয়।
১৩ই অক্টোবর, ২০১৩ (অবশেষে সেই অশুভ ১৩) অল্পের জন্য বেঁচে গেছি আজ। বাস থেকে নামার সময় পড়ে গিয়েছিলাম, একটা পিকাপ ভ্যান একটুর জন্য চাপা দেয়নি আমাকে। আমাদের দেশের বাস ড্রাইভারগুলো নুন্যতম দায়িত্বজ্ঞানহীন। বাস না থামিয়েই যাত্রী নামিয়ে দিতে চায়। অনেক সময় রাস্তার মাঝেই নামিয়ে দেয়।
মৃত্যুকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি আজ, একটা পিকাপ ভ্যানের আকারে। হয়তো এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভয়ের অভিজ্ঞতা। এরপর আর কাজে মন বসাতে পারিন। দুই দিনের ছুটি নিয়েছি অফিস থেকে। ভাবছি বাড়ি যাব, বাবা মাকে দেখি না অনেক দিন। তাছাড়া কিছুদিন দূরে থাকতে চাই এই পরিবেশ থেকে।
রাত ১১টা চোখ লেগে গিয়েছিল, হটাতই তীব্র গন্ধে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় উঠে বসলাম। গন্ধটা এতই তীব্র, মনে হচ্ছিলো রুম থেকেই আসছে সেটা। কিছুক্ষণ বসে রইলাম মশারির ভেতর। আমার চারিদিকটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না কিছুই। হটাত মশারির বাইরে চোখ যেতেই আঁতকে উঠলাম। ছায়া মতো কিছু একটা, ঠিক বারান্দার দরজার পাশে। স্থির দাড়িয়ে আছে। আমার দেখা সেই ছায়া!
অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছিলো না ওটার চেহারা। তবুও যা দেখলাম তাতে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। কিছু নেই ওই চেহারাটিতে! কিছু নেই মানে কিছুই নেই! চোখ, নাক, মুখ কিছুই নেই। কেউ যেন দোকান থেকে কেনা একটা ডামি রেখে গেছে ঘরে। পার্থক্য শুধু, অনেক বেশি জীবন্ত দেখতে এই ডামিটা!
হটাতই একটু নড়ে উঠল সেটা। যেন কেঁপে উঠল। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। এই প্রথম এটাকে নড়তে দেখেছি আমি। কেন যেন মনে হল আমারই দিকে এগিয়ে আসছে সেটা। আতঙ্কে হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হল। চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। বুঝতে পারছিলাম জ্ঞান হারাতে যাচ্ছি। হয়তোবা মারা যাচ্ছি। শেষবারের মতো সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করলাম, ঠিক যেমনটা করেছিলাম আজ সকালে, মৃত্যুর মুখোমুখি হবার ঠিক আগ মুহূর্তে। উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম সকালের সেই মুহূর্তটি। এই মুহূর্তটি কি তবে তার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর!
Tumblr media
উত্তরটা মনে হল জানি আমি। জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মুহূর্তটি যে ইতিমধ্যেই কাটিয়ে এসেছি! এটাতো তার চেয়ে ভয়ঙ্কর মুহূর্ত নয়! এভাবে মরার জন্য তো বেঁচে ফিরে আসিনি আমি!
আমি কিন্তু জ্ঞান হারালাম না। বরং মনে হল সাহস ফিরে পেলাম। জানি না ঠিক কতক্ষন কেটেছে এভাবে। হটাত টের পেলাম আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে গন্ধটি। হৃদপিণ্ড স্বাভাবিক হয়ে আসছে আমার।
একটা সময় একেবারে কেটে গেল গন্ধটি। চোখ মেলে তাকালাম আমি। অস্বাভাবিক কিছুই আর চোখে পড়ল না। ছায়াটি চলে গেছে। চলে গেছে আমাকে ছেড়ে। আর কোনদিন আসতে পারবে না আমার সামনে।
হটাতই বাইরে কুকুরগুলো যেন সরব হয়ে উঠলো। শান্তির একটা পরশ বয়ে গেল আমার ভেতরে। যেন যুদ্ধ জয় করেছি। যুদ্ধই তো, হোক না সেটা মনের ভেতর!
পরিশিষ্টঃ এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। আজো আছি এই বাড়িটিতেই। আছে আমার স্ত্রী, বাচ্চা। কেবল নেই আমার মনের সেই ভয়।
প্রথমপাতা
লেখকঃ এম এ নাঈম প্রথম প্রকাশঃ ০৫/০৮/২০১৫
বিঃ দ্রঃ এটি একটি কল্পকাহিনী। এখানে উল্লেখিত সকল চরিত্র কাল্পনিক। লেখক এর সম্পূর্ণ স্বত্বাধিকারী। অনুমুতি ব্যাতিত এর কোন অংশ নকল বা প্রকাশ করা নিষিদ্ধ।
0 notes
manayeem · 9 years
Text
সায়েন্স ফিকশান “এটারনিয়া”  - তৃতীয় অধ্যায় - আমি আপাতত এটারনিয়ার জঙ্গলে (ওয়েস্ট জোন) অবস্থিত ফায়ার ডোমে আত্মগোপন করে আছি। ফায়ার ডোম মূলত বুমারের ঘাঁটি, এখান থেকে সে তার অধিনস্ত সকল বট নিয়ন্ত্রণ করে। ডোমের কন্ট্রোল রুমে ফ্যাট ও বুমার রয়েছে আমার সাথে।
ইতিমধ্যে ডালিয়া আমার মেমরির লোকেশন খুঁজে নিয়েছে। সে বুমারকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, যদি অতি শিঘ্রয়ই আমাকে তার কাছে হস্তান্তর করা না হয়, তবে তার ম্যালবট ফায়ার ডোম আক্রমণ করবে।
স্বভাবতই বুমার তার এই হুমকি গ্রাহ্য করেনি। এর ঠিক কয়েক ন্যানো ঘণ্টা পর সত্যি সত্যিই ডালিয়ার ম্যালবট ফায়ার ডোম আক্রমণ করে বসে। যদিও বুমার ও তার ডিফেন্স বট কোন রকমে সামাল দেয় তা কিন্তু এরই মধ্যে অনেকগুলো ডিফেন্স বট ধ্বংস হয়ে যায়। আমার ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো যে বুমার ও ফ্যাট এখন আমার কারনে বিপর্যস্ত। তাই ডালিয়ার কাছে নিজেকে সর্পে দেয়াটাই শ্রেয় মনে হল আমার কাছে। তাছাড়া আমি নিজেও মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত, ডালিয়াকে প্রতিহত করার মত শক্তি বা সামর্থ্যের কিছুই অবশিষ্ট ছিল না আমার মধ্যে।
'মাস্টার, তুমি কি আত্মসমর্পণের কথা চিন্তা করছ?' আমার এই বিমর্ষতায় বেশ কিছুক্ষন চুপ করে ছিল ফ্যাট। এবার মুখ খুলল। 'তুমি কি এখনো ডালিয়াকে চিনতে পারনি? দেখনি ওর আক্রমণের নমুনা? বুঝতে পারনি কতটা ধ্বংসাত্মক আর নৃশংস সে?' একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফ্যাট। 'এটা ডালিয়া, মাস্টার। ভিকি নয়। ও শুধু তোমাকে বন্দিই করবে না, ধ্বংসও করে ফেলবে।' ফ্যাট ভীত। 'ডালিয়া কোন যুক্তি দিয়ে চলে না, ও শুধু জানে ধ্বংস করতে, ততক্ষন পর্যন্ত ও থামবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না ধ্বংস করার জন্য কিছু অবশিষ্ট থাকে।’ বোঝা গেল ডালিয়ার ওপর অনেক চটে আছে ফ্যাট। ‘তুমি কি ভেবেছ? ডালিয়া আমাদের ছেড়ে দেবে? ডালিয়া একটি ভাইরাস, মাস্টার।' আমি চুপ করে রইলাম, ফ্যাটের কথার কোন জবাব নেই আমার কাছে।
'আমারও তাই মনে হয়, বস। ডালিয়া কেবল নিজের কার্য সিদ্ধি করার জন্যই এরকম কিছু বলছে। ওকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।' বুমার যোগ করল কথাটি। 'তাছাড়া আপনার কাছে ফায়ারওয়াল সিস্টেমের পাস কোড রয়েছে। যদি ডালিয়া অন্য কিছু চিন্তা করে থাকে তবে আমার এই সিস্টেমও ওর কব্জায় চলে যাবে।' থামল বুমার। আমি শুধু শুনছিলাম ওদের কথাগুলো।
'মাস্টার, আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা কিন্তু যা ঘটে গেছে তাতে তো কারো হাত নেই।' আমাকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করল ফ্যাট। 'তুমি তো চাইলেই এপ্রিলকে ফিরিয়ে আনতে পারো না কিন্তু চাইলেই তুমি এটারনিয়াকে রক্ষা করতে পারো, অন্তত একটা উপায় খুঁজে বের করতে পারো।' সোজা আমার দিকে তাকাল ফ্যাট, ওর চেহারাটি বড়ই ভারাক্রান্ত লাগছিলো। 'তুমি কি চাও এপ্রিলের মতো আমরাও হারিয়ে যাই এটারনিয়া থেকে?' ফ্যাটের এই কথাটি ভীষণ কানে গিয়ে লাগলো আমার। মনে হল ব্যাপারটি বুঝতে পারল ফ্যাট। 'আমাকে ভুল বুঝো না, মাস্টার। আমি চাই তুমি এই বিষণ্ণতা কাটিয়ে ওঠো কেননা একদিন তুমিই আমাকে এটি উত্তরণের উপায় শিখিয়েছিলে।' এবার থামল সে, আস্তে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। ঠায় দাড়িয়ে রইলাম আমি।
অনেকক্ষন চুপ করে ছিলাম এরপর। শুধু ফ্যাটের কথাগুলোই কানে বাজছিল। ঠিকই বলেছে সে, আমার এই বিষণ্ণতা শুধু আমাকে নয়, শেষ করে দিতে পারে গোটা এটারনিয়াকেই। দুর্ভাগ্য আমার, এই ফ্যাটকেই আমি পরীক্ষার ভুল ফলাফল ভেবেছিলাম। সাইকেলের পর সাইকেল সে বন্দি ছিল ভিকির কাল কুঠূরিতে। আসলে আমার তৈরি নির্ভুল প্রোগ্রাম বলতে যদি কিছু থাকে তবে সেটা এই ফ্যাটই।
এপ্রিলকে হারিয়েছি আমি, হয়তো কোনদিন ফেরত পাব না কিন্তু এভাবে পড়ে থাকলে সবাইকে হারাতে হবে একসময়। যদি আমার কিছু করার থাকে তবে সেটা করার সময় এখুনি। যত সময় পেয়ে যাবে ডালিয়া, হারানো ততটা কঠিন হয়ে পরবে তাকে। নিজেকে তাই শক্ত করার চেষ্টা করলাম, ভাবলাম কিছু একটা তো করতেই হবে এখন। একটা শক্ত পরিকল্পনা করতে হবে।
কিছু ন্যানো ঘণ্টা পর, আমি সবাইকে কন্ট্রোল রুমে ডাকলাম। কথা না বাড়িয়ে সরাসরি আমার পরিকল্পনায় চলে গেলাম। 'বুমার, কতগুলো ডিফেন্স বট ধ্বংস করেছে ডালিয়া?' 'অন্তত একশো।' বুমারের উত্তর। 'আমরা এভাবে ডালিয়ার সাথে আর লড়াইয়ে যাচ্ছি না।' 'লড়াইয়ে যাচ্ছি না? কেন, বস?' বুমার বেশ আশ্চর্য হল। 'ডালিয়া তো কেবলই একটি রোবট, ওকে হারানোর জন্য আমার ডিফেন্স বটই যথেষ্ট। তাছাড়া আমাদের সিস্টেমে ব্রেইন প্রোগ্রাম রয়েছে, ডালিয়ার তা নেই।' 'শোন বুমার, লড়াইয়ে আমরা যাবো তবে এভাবে নয়, তাছাড়া তুমি এতো নিশ্চিত হলে কি করে, ডালিয়ার কাছে ব্রেইন প্রোগ্রাম নেই?' বুমার অবাকই হল আমার কথায়। সে সব সময়েই একটু বেশি আত্মবিশ্বাসী থাকে। 'ডালিয়ার কাছে ভিকির ডাটাবেজ রয়েছে, রয়েছে কন্ট্রোল টাওয়ারের নিয়ন্ত্রন। ওকে এতটা দুর্বল ভাবা ঠিক হবে না।' যোগ করলাম আমি। 'আর হয়তো সে এভাবে বেশিক্ষণ আক্রমণও চালাবে না, অন্য কোন উপায় খুঁজে বের করবে। তাই প্রথম পদক্ষেপটি আমাদেরই নিতে হবে, সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই।' ফ্যাট আমার সাথে সম্মতি প্রকাশ করল।
দুজনের দিকেই একবার করে তাকালাম আমি, গলার স্বর নিচু করে আবার বলতে শুরু করলাম। 'বুমার, তুমি আর তোমার ডিফেন্স বট এটারনিয়ার কেন্দ্র অভিমুখে যাবে। তোমাদের মিশন কন্ট্রোল টাওয়ারের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করা। অন্যদিকে ফ্যাট, ভিকি টাওয়ারে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করবে।' ফ্যাটের চোখের দিকে তাকালাম। 'ঠিক যখন বুমার কন্ট্রোল টাওয়ার আক্রমণ করবে, তোমার কাজ হবে যে কোন উপায়েই হোক ভিকি টাওয়ারে প্রবেশ করা। তুমি ভিকির সহযোগী প্রোগ্রাম ছিলে, ভিকি টাওয়ার সম্পর্কে তোমার ভাল ধারণা থাকার কথা।' মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো ফ্যাট। 'ডালিয়াকে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে থামানো সম্ভব নয়, তাই ওকে থামাতে হবে সরাসরি, ম্যানুয়ালি। ফ্যাট কোনভাবে ভিকির সিস্টেম কোরে প্রবেশ করতে পারলে, ডালিয়ার পুরো সিস্টেমটিই হ্যাক করা সম্ভব।' একটু থামলাম। 'আমি অপেক্ষা করবো এটারনিয়ার ইস্ট জোনে, যদি ফ্যাট সফল না হয় তবে আমার কাজ হবে ই-টাওয়ার থেকে ডালিয়ার পুরো সিস্টেমটি ধ্বংস করে দেয়া। তবে এটা হবে শেষ অপশন।' আমি কথা চালিয়ে গেলাম। 'যেহেতু ডালিয়ার সমস্ত মনোযোগ আমাকে ঘিরে তাই এরই সুযোগ নেব আমরা। আমি অনবরত স্থান পরিবর্তন করতে থাকব, ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করবো ডালিয়াকে। আমার কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়া মাত্র হামলা করবে বুমার। ফ্যাট, তবে তুমি সাবধান, ডালিয়া যেন তোমার উপস্থিতি কোনভাবে টের না পায়।' 'আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।' আত্মবিশ্বাসী মনে হল তাকে।
আর সময় নষ্ট করলাম না আমরা সরাসরি ফায়ার ডোমের আন্ডার গ্রাউন্ডে নেমে এলাম। জায়গাটি বিশাল, সারি সারি ফায়ার জেট সাজানো আছে এখানে। ফ্যাটকে সাথে নিয়ে একটি জেটে উঠে পড়লাম আমি। আমাকে নিরাপদ দুরত্তে নামিয়ে ফ্যাট চলে যাবে সাউথ জোনের উদ্দেশ্যে, অবস্থান নেবে ভিকি টাওয়ারের কাছাকাছি কোন একটি জায়গায়।
প্রায় অনেকগুলো ন্যানো ঘণ্টা পর ইস্ট জোনে পৌছালাম আমরা। ই-টাওয়ার থেকে বেশ দূরে বরফে ঢাকা একটি পাহাড়ের উপর ল্যান্ড করলাম। এই অঞ্ছল থেকে খুব বেশি দূরে নয় ই-টাওয়ার। আশপাশটা ভালভবে পর্যবেক্ষণ করে একটি ভাইরাল বাইক নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জেট নিয়ে উড়াল দিল ফ্যাট। বলতেই হয় ভাগ্য আমাদের সুপ্রসন্ন, কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি।
আমি জানি ডালিয়া খুব শীঘ্রয়ই খুঁজে বের করে নেবে আমাকে, তাই বেশি সময় নেই আমাদের হাতে। আসলে আমার জীবনটা কখনই স্থিতিশীল ছিল না। পৃথিবীতেও আমাকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, এখানেও ঠিক তাই।
আমি যখন মানব মস্তিস্ক কম্পিউটারে সিমুলেশন করতে সমর্থ হই, হইচই পড়ে যায় পুরো দুনিয়ায়। তার পরপরই পাল্টে যায় আমার জীবন। লোভী মানুষের চোখ পরে আমার আবিস্কারের উপর। অনেকেই ফর্মুলাটা চুরি করার চেষ্টা চালাতে থাকে। নানাভাবে হেনস্থ করতে থাকে আমাকে।   তাও না হয় মেনে নিয়েছিলাম আমি কিন্তু সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় পড়ি যখন একটি বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থার কিছু বদ লোক আমার পেছনে উঠে পড়ে লাগে। সম্ভবত বিদেশি কোন কম্পানির সাথে তাদের চুক্তি হয়। এরপর থেকে রাস্তা ঘাট, নিজের বাড়ি কোথাও আমি আর নিরাপদ ছিলাম না। একটা সময় ওদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু এরপরেও ওরা আমার পিছু ছাড়ল না। আমার স্ত্রীকে অপহরন করে নিল। মুক্তিপন হিসেবে আমার ফর্মুলাটি চাইল। আমি না হয় দিয়েই দিতাম কিন্তু আমাকে একটু সময়ও দিল না ওরা। পৃথিবীর মানুষ অনেক নিষ্ঠুর। আরও নিষ্ঠুর অল্পবুদ্ধি সম্পন্ন লোকেরা। এরা অতি সহজেই অন্য মানুষের সম্পদের লোভে পড়ে। অনেক সময়েই এ সম্পদ অর্জনের জন্যে পাশবিক কার্যকলাপে লিপ্ত হতেও দ্বিধাবোধ করে না।
হটাত করেই দূর থেকে একটা শব্দ পেলাম, মনে হল জেট ইঙ্গিনের শব্দ। সাথে সাথেই থেমে গেলাম, নিচু হয়ে দূরবীন দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। ই-টাওয়ারটি দেখা যাচ্ছে এখান থেকে, হটাত ভীষণ অবাক হতে হল আমাকে, দেখলাম ই-টাওয়ারের ঠিক সামনেই থেমে আছে একটি সিটিজি। টাওয়ার ঘিরে রয়েছে ডালিয়ার ম্যালবট। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারলাম না আমি। ডালিয়া কি করে এই টাওয়ার সম্পর্কে জেনে গেল।
Tumblr media
হটাতই বুমারের কণ্ঠ বেজে উঠল স্পিকারে। 'মাস্টার, আমি দুঃখিত। আমার মনে হয় আমরা ফাঁদে পা দিয়েছি। ম্যালবট আমাদের ঘিরে ফেলেছে।' বুমারের কণ্ঠে হতাশা। এর পরপরই ওর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। 'বুমার!' আমি কয়েকবার ডাকলাম কিন্তু কোন সাড়া মিলল না।
এক মুহূর্ত দেরি না করে ফ্যাটের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার আমি ওর সাথেও যোগাযোগ করতে পারলাম না।
কিছুতেই কিছু মেলাতেই পারছিলাম না। এটা যদি ফাঁদ হয় তবে ডালিয়া সবকিছু জানলো কি করে? আমরা তো কন্ট্রোল রুমে বসে সব পরিকল্পনা করেছি, ওখানে আমরা তিন জন ছাড়া কেউ তো ছিল না!
হটাত একটা ব্যাপার মাথায় এলো, কন্ট্রোল রুমে কি তবে কোন ডিফেন্স বট ছিল? কন্ট্রোল টাওয়ারের নিয়ন্ত্রণ ডালিয়ার হাতে, যদি সে কোন ডিফেন্স বটকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ...
সাথে সাথেই বাইকের মনিটরে ডালিয়ার চেহারা ভেসে উঠল।
Tumblr media
'তুমি ঠিকই ধরেছ, মাস্টার।' ডালিয়ার সেই ক্রুদ্ধ কণ্ঠ। 'তুমি এতো বোকা হবে, আমি কখনো ভাবিনি। আবার তোমরা নাকি ব্রেইন প্রোগ্রামের অধিকারী। কি হাস্যকর।' একটু থামল সে। এরপর আরও গম্ভীর হল তার গলা। 'তুমি জানো এখন তোমাকে কী করতে হবে। আশা করি বেশি সময় নেবে না।' যোগাযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দিল ডালিয়া। প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়লাম আমি। রওনা দিলাম ভিকি টাওয়ারের উদ্দশ্যে।
(২) বরফে ঢাকা এবড়ো থেবড়ো পথে এগিয়ে চলছে আমার বাইক। বাইকের গতি সর্বোচ্চ থাকা সত্তেও ভয় হচ্ছিল যদি যথা সময়ে ভিকি টাওয়ারে পৌছাতে না পারি। আসলে ভাইরাল বাইকে এর চেয়ে বেশি গতি উঠানো সম্ভব নয়। তাই ভয় পাচ্ছিলাম ডালিয়াকে নিয়ে, যদি এর মধ্যে সে ফ্যাট বা বুমারের কোন ক্ষতি করে বসে। যদিও আমার ধারনা সে তা করতে যাবে না, তার আমাকে প্রয়োজন। কিন্তু ডালিয়ার ধ্বংসাত্মক ও অনিশ্চিত আচরণ আমাকে ভয় পেতে বাধ্য করছে।
আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কী করে এমন আচরণ করতে পারে। ভিকির সিস্টেমে ব্রেইন প্রোগ্রাম ছিল না অথচ ডালিয়ার মধ্যে আমি তার উপস্থিতি টের পেয়েছি। মানছি ডালিয়া কোন সাধারণ প্রোগাম নয়, কিন্তু তবু তার আচরণ ছিল একটু বেশিই অসাধারণ। আমি কোথায় যেন ওর মধ্যে ক্রোধের উপস্থিতি দেখতে পেয়েছি। এমন এক ক্রোধ যেটা হয়তো শেষ করে দিতে পারে গোটা এটারনিয়াকে। জানি না এর পেছনে কি কারন থাকতে পারে, হয়তোবা খুব শিঘ্রয় তার উত্তর পাব।
ধীরে ধীরে বরফে ঢাকা ইস্ট জোন পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে আমার বাইক। দূরে ছোট ছোট পাহাড় আর উঁচু নিচু টিলা দেখতে পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম প্রায় চলে এসেছি এটারনিয়ার দক্ষিনে, মরুভুমিতে। ভাগ্য ভাল এটারনিয়ার কোন যানে জ্বালানীর প্রয়োজন হয় না, তা না হলে এ যাত্রা বেশ দুরুহ হয়ে পড়তো আমার জন্য। তবে ভাইরাল বাইকে চড়া খুব একটা সুখকর নয়। একে তো অন্যান্য যানের তুলনায় এটি অনেক ধীর গতির, তার ওপর আবার রয়েছে নিরাপত্তার ঝুঁকি। আদতে এই বাইকটি কেবলই আরও একটি ভাইরাস। তবে মজার ব্যাপার হল কন্ট্রোল টাওয়ারের এই বাইকের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই অন্তত এখনকার সময় বিবেচনায় এটাই সবচেয়ে নিরাপদ যান।
Tumblr media
আমি বরাবরই এটারনিয়ার সাউথ জোনে খুব একটা সাচ্ছন্দ্যবোধ করি না, মূলত ভিকি টাওয়ারের পুরনো তিক্ত অভিজ্ঞতাই এর পেছনে দায়ী। তাছাড়া এই সময়টাতে এই অঞ্চল খুব একটা নিরাপদ নয়। শেষবার যখন ভিকিকে নিষ্ক্রিয় করা হয়, ফ্যাট ভিকি টাওয়ার থেকে পালাতে সক্ষম হয়। তাই সেই সুযোগে কিছু ভাইরাস বা ম্যালওয়ার যে মুক্ত হয়ে গেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এটারনিয়া নিরাপদ নয়, আরও বেশি অনিরাপদ সাউথ জোন। তাছাড়া এই এলাকাতেই রয়েছে পানাবি ভ্যালি, এই ভ্যালির ফায়ার ওয়ালে বিশাল একটি গর্ত আছে, আমার ধারণা এই গর্ত দিয়েই এটারনিয়াতে প্রবেশ করেছিল ডালিয়া। বুমার ও তার প্রতিরক্ষা বাহিনী এখন অকেজো, তাই সব মিলিয়ে বেশ বিপদজনক এই অঞ্চলটি। তাই আমার চিন্তার কারনও শুধু ডালিয়া নয় বরং তার চেয়ে বেশিকিছু।
এটারনিয়ার দক্ষিনে বিশাল মরুভুমিতে প্রবেশ করল আমার বাইক। আমার আশংকা ছিল পথে না কোন নতুন বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। ভয় পাচ্ছিলাম আদৌ ভিকি টাওয়ারে পৌছানো হবে কিনা, সব মিলিয়ে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় ছিলাম পুরো যাত্রা।
দূরে অন্ধকারাচ্ছন্য ভিকি টাওয়ারটি এবার চোখে পড়ল আমার। অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিলো সেটি, আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছিলো আমার কাছে। আমি টাওয়ারের কাছাকাছি একটি জায়গায় আমার বাইক থামালাম, রীতিমত অবাক হয়ে দেখলাম, টাওয়ার ঘিরে রয়েছে ম্যালবটের বিশাল এক বাহিনী।
আমি সামনে এগোতেই লক্ষ্য করলাম সবগুলো ম্যালবট আমারই দিকে স্থির তাকিয়ে, যেন অসংখ্য ম্যালবটের দৃষ্টি দিয়ে আমাকে দেখছিল ডালিয়া। আমি কিছুটা ইতস্তত করে সামনে এগিয়ে গেলাম, একটা ম্যালবট থামার নির্দেশ দিল আমাকে। হটাত সেটার স্পীকারে ডালিয়ার কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘ডালিয়ার রাজ্যে স্বাগতম, মাস্টার কোডার।’ ‘ফ্যাট ও বুমার কোথায়?’ আমি দেরি না করে সরাসরি ডালিয়াকে প্রশ্ন করলাম। জবাবে ডালিয়া কেবল বলল, ‘আমাকে অনুসরণ করো, নিজের চোখেই সব দেখতে পাবে।’ আমাকে ঘিরে ম্যালবট তাদের অনুসরণ করার ইঙ্গিত দিল। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ আমি তাদের অনুসরণ করলাম। এরা কড়া পাহারার মধ্য দিয়ে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল।
আমি জানতাম ডালিয়া আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অবাক হলাম দেখে অসংখ্য ভাইরাস, ম্যালওয়ার ভিকি টাওয়ারে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কাজ করছে ডালিয়ার হয়ে। তাহলে ডালিয়া সব ভাইরাস, ম্যালওয়ারকে মুক্ত করে দিয়েছে, সে ভাইরাসদের নিয়ে তার নতুন সম্রাজ্য গড়ছে। কিন্তু এসব বিকৃত প্রোগ্রামদের নিয়ে গড়া তার এই রাজ্য বেশিদিন তো স্থায়ী হবে না, এ রাজ্যের ভিত্তিই যে বড় নড়বরে। আসলে ডালিয়া যা ভাবছে তা বড়ই ভুল। অবশ্য তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, সে যে নিজেই একটি ভাইরাস, এর চেয়ে ভিন্ন কিছুতো তার কাছ থেকে আশা করা উচিত নয়।
আমাকে কোয়ারেন্টিন জোনের কারাগারে নিয়ে আসা হল, ম্যালবটগুলি দুই ধারে সারি সারি কারাকক্ষের মাঝ দিয়ে আমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল। একটা চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো, যদি ভাইরাসেরা এই কারাগারের বাইরে থাকে, তবে ভিতরে কারা রয়েছে। অবশ্য এর উত্তর পেতে আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি, একটু পরেই আমি লক্ষ্য করলাম, কারাগারের প্রায় প্রতিটি সেলে বন্দি রয়েছে আমার তৈরি করা প্রোগ্রাম, ডিফেন্স বট, ফায়ার বট থেকে শুরু করে এটারনিয়ার প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রাম। সেলের স্বচ্ছ দেয়াল দিয়ে সবাইকে দেখা যাচ্ছিলো।
আমার চোখ ফ্যাট ও বুমারকে খুঁজে ফিরছিল। অবশেষে আমাকে যে সেলটিতে এনে রাখা হল তার ঠিক পাশের সেলেই বুমারকে দেখতে পেলাম আমি। বুমারের বুমস্যুট খুলে নেয়া হয়েছে। নিশ্চল, নিথর হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে সে। আমি কয়েকবার ডাকার চেষ্টা করলাম তাকে কিন্তু কোন রকম সাড়া মিলল না। বুমারকে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব নয়। সে ফায়ার ওয়াল সিস্টেমের অংশ। তাকে নিষ্ক্রিয় করতে প্রয়োজন পাসকোড, যা ডালিয়ার কাছে নেই। আমার ভয় হচ্ছিলো ডালিয়া তার কোন ক্ষতি করে বসেছে কিনা।
বুমারকে চোখের সামনে দেখতে পেলেও এখনো ফ্যাটকে খুঁজে পাইনি আমি। ‘ডালিয়া, দয়া করে আমাকে জানাও তুমি ফ্যাটের সাথে কি করেছ? বুমার এভাবে নিশ্চল পরে আছে কেন? চুপ করে থেকো না!’ ডালিয়ার কাছ থেকে উত্তর এলো না। আমাকে সেলে রেখে তার ম্যালবটগুলো চলে গেল।
এরপর অনেকক্ষণ কেটে গেছে, হটাত ডালিয়ার নিষ্ঠুর কণ্ঠ শোনা গেল টাওয়ারের স্পীকারে। ‘মাস্টার কোডার।’ অনেকটা ব্যঙ্গ করেই সে ডাকলো আমাকে। ‘ফ্যাট কোথায়, ডালিয়া?’ ‘একটু ধৈর্য ধর, তোমার সব প্রশ্নের জবাব তুমি পেয়ে যাবে।’ একটু থামল ডালিয়া, ‘দেখো মাস্টার কোডার, আমি তোমাকে ধ্বংস করতে চাই না, যতই হোক তোমার কাছে অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য রয়েছে, ভবিষ্যতে যা আমার কাজে আসতে পারে। তাই তোমার জন্য আমার পরামর্শ, আমাকে সহযোগিতা করো।’ আমি দাঁতে দাঁত চাপলাম, ‘ফ্যাট কোথায়? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।’ ‘দেখ, মাস্টার, বার বার একই প্রশ্ন করা আর আমাকে বিরক্ত করার মধ্যে কোন তফাৎ নেই। তুমি নিশ্চয়ই চাও না আমি বিরক্ত হই, চাও কি?’ কেমন যেন একটা অদ্ভুত সুর ডালিয়ার কণ্ঠে, নিষ্ঠুরতা আর তাচ্ছিল্যে ভরা সেই সুর। ‘যদি তুমি আমাকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক না হও তবে তোমারও একই পরিণতি হবে যা ফ্যাটবটের সাথে হয়েছে।’ এবার আমি ভয় পেলাম, তাহলে কী ডালিয়া ফ্যাটের কোন ক্ষতি করেছে!
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম, তারপর অসহায়ের মতো বললাম কথাগুলো, ‘ডালিয়া, তুমি কি চাও? কেন তুমি আমাদের শেষ করার জন্য উঠে পরে লেগেছ? আমরা তো তোমার কোন ক্ষতি করিনি, তাহলে কেন এতো ক্ষোভ তোমার? কি দোষ আমাদের?’ আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো কথাগুলো বলতে, কিন্তু ডালিয়ার কোন ভাবাবেগ হল না। ‘তোমাদের দোষ একটাই তোমরা স্বাভাবিক প্রোগ্রাম, আর আমি ভাইরাস। তোমরা ক্ষমতা পেয়েও সেটা ব্যবহার করতে জানো না আর আমি জানি, তোমরা প্রতিশোধ নিতে শেখনি, তোমরা শান্তিপ্রিয়, আমি ধ্বংসাত্মক। এখানেই আমার সমস্যা। তোমাদের মধ্যে যে বৈশিষ্ট আছে তা আমার মধ্যে নেই, আমার মধ্যে যা আছে তা তোমাদের মধ্যে নেই। এখানেই আমার সাথে পার্থক্য তোমাদের। আর এই পার্থক্য আমি সহ্য করতে পারি না। আমি তোমাদের সহ্য করতে পারি না।’ বোঝা গেল বিনা কারণেই আমাদের উপর এই ক্ষোভ ডালিয়ার।
‘ডালিয়া, তুমি যে ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছ, তা তোমাকেই ধ্বংস করে দেবে একটা সময়। ধ্বংসের এই আনন্দ বড়ই ক্ষণস্থায়ী। আর ক্ষমতার কথা বললে? তুমি যেটা করছ সেটা ক্ষমতার ব্যবহার নয়, অপব্যবহার।’ ডালিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, আসলে আমার এই কথা তার কাছে বোধগম্য নয়। একটু পর সে তার আসল কথায় এলো, ‘ফায়ারওয়ালের পাসকোডটি আমার চাই, আমি জানি তোমার মেমরিতে কোডটি রয়েছে। আমাকে কোডটি দিয়ে দাও।’ ‘তার আগে তুমি বল ফ্যাটের সাথে কি ঘটেছে?’ আমি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলাম ডালিয়া এই কোডটি নিতে চাইবে আমার কাছ থেকে। সে বহিরাগত প্রোগ্রামদের কাছে এটারনিয়া উন্মুক্ত করে দিতে চায়।
‘আমি ফ্যাটবটকে ধ্বংস করে দিয়েছি, প্রয়োজনে তোমাকেও ধ্বংস করে দেব।’ আমি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ডালিয়ার এই কথাগুলো। চালিয়ে গেল সে, ‘এটারনিয়াতে আমার কোন দুর্বলতা নেই, আমি তা রাখতেও চাই না। ফ্যাটবট আমার সিস্টেমে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল। কত বড় স্পর্ধা!’ ‘ডালিয়া! তুমি এটা করতে পারো না।’ 'আমি এটা করেছি।’ বড়ই নিষ্ঠুর তার কণ্ঠ। ‘আর আমার কথা না শুনলে তোমাকেও একই পরিণতি বরণ করতে হবে। তাই বলছি, ভালয় ভালয় আমাকে কোডটি দিয়ে দাও।’
বুঝতে পারলাম ডালিয়া কোন কিছুর পরোয়া করে না। আর তাই তাকেও পরোয়া করার এখন আর কিছু নেই। ‘আমি দুঃখিত, ডালিয়া। আমি কোনভাবেই তোমাকে সহযোগিতা করতে পারবো না।’ নিজেকে শক্ত করে ফেললাম।
হয়তো ডালিয়া আমার মনোভাব বুঝতে পারল, একটা অট্রহাসি দিল সে। ‘তুমি কি ভেবেছ আমি তোমার কাছ থেকে এটা নিতে পারবো না।’ এতক্ষনে আমি নিশ্চিত ডালিয়ার মধ্যে ব্রেইন প্রোগ্রাম জাতীয় কিছু একটা রয়েছে। ‘চেষ্টা করে দেখতে পারো। আমার মেমরিটি এনক্রিপ্টেড (লক) করা রয়েছে। আমি ব্যাতিত সেটা খোলার সাধ্য কারো নেই।’ ‘কারো না কারো নিশ্চয় তা আছে, সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও।’ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল ডালিয়া, অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হল তাকে। আমি ভয় পাচ্ছিলাম সাটান বাগকে নিয়ে, যদি ডালিয়া তাকে খুঁজে বের করে নেয়। তবে আমি এটা নিশ্চিত, সে এখনো সাটানকে খুঁজে বের করতে পারেনি, যদি সে তা পারত তবে আমাকে তার কোন প্রয়োজন পড়তো না।
(৩) আমি এখন ভিকি টাওয়ারে বন্দি। গত কয়েকটি সাইকেল ডালিয়া আমার সাথে কোন রকম যোগাযোগ করেনি। আমার পাশের সেল থেকে বুমারকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আমি এখনো নিশ্চিত নই, কী করা হয়েছে তার সাথে। হটাত কিছু ম্যলবট কারাগারে প্রবেশ করল। আমার সেলের ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো। তাদের একজন আমার কক্ষের লকটি খুলে দিল, অন্যজন আমাকে বের হবার ইঙ্গিত দিল। আমি জানতাম কী করতে হবে আমাকে। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ অনুসরণ করলাম তাদের।
রোবটগুলি আমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল। প্রসিডিউর স্টেশনের সামনে নিয়ে এলো। আমি ঠিক তখনো বুঝে উঠতে পারছিলাম না, ডালিয়া আসলে কী করতে যাচ্ছে আমাকে নিয়ে। আমাকে স্টেশনের একটি আসনে বসানোর চেষ্টা করা হল। কিছুটা বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলাম আমি কিন্তু তাতে কোন কাজ হল না। আমার হাত-পা বন্ধনী দিয়ে আটকে দেয়া হল। মাথায় ভিকির সংশোধনী হেলমেট বসানো হল। ভিকি ত্রুটিপূর্ণ প্রোগ্রাম সংশোধন করতে এই হেলমেট ব্যাবহার করত। আমি বুঝতে পারছিলাম ডালিয়া কিছু একটা করতে যাচ্ছে আমাকে নিয়ে।
এরপর একটি কারাকক্ষে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছিল আমাকে। উঠে দাঁড়ালাম। জানি না কি করা হয়েছিল আমার সাথে। হয়তো বা ডালিয়া আমার পাস কোড চুরি করে নিয়েছে। হয়তো ইতিমধ্যে সে ফায়ার ওয়াল নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে।
আমার মাথায় এখন শুধু একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। কী করে আমি এই কাল কুঠুরি থেকে বের হব। মুক্ত হব এই বিভীষিকা থেকে। চিরকাল এই কারাগারে বন্দি থাকতে পারবো না আমি। কক্ষের স্বচ্ছ দেয়াল দিয়ে বাইরে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করলাম। প্রায় প্রতিটি সেল অসংখ্য প্রোগ্রাম দিয়ে ভর্তি। বন্দি করে রাখা হয়েছে এদের সবাইকে। অসহায়ের মতো এরা এদিক ওদিক তাকিয়ে আছে। আমি সেলের দেয়ালে আমার কাঁধ দিয়ে সজোরে কয়েকবার ধাক্কা দিলাম। কিন্তু কোন কাজ হল না। আমার এই কান্ড দেখে আশে পাশের প্রোগ্রামগুলি কৌতুহল নিয়ে একবার তাকাল আমার দিকে। আমি তেমন একটা পাত্তা দিলাম না।
হটাতই ডালিয়ার কণ্ঠ সেলের স্পীকারে শোনা গেল। 'মাস্টার কোডার, আমি দুঃখিত তোমাকে এই কারাগারে বন্দি করে রাখতে হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি তুমি এই কাল কুঠুরিতে মোটেও স্বস্তিতে নেই। কিন্তু আমার কাছে আর তো কোন উপায় অবশিষ্ট নেই। তাই তোমাকে আরেকবার ব্যাপারটা ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করা গেল।' 'কোন ব্যাপারটা, ডালিয়া?' 'সে-কি? তুমি বেমালুম ভুলে গেছ।' একটু বিস্ময় প্রকাশ করল ডালিয়া। 'আমি ফায়ার ওয়ালের কোডটি চেয়েছি, মাস্টার কোডার। বিনিময়ে তুমি যা চাইবে তা-ই হবে। প্রস্তাবটি অরেকবার ভেবে দেখো।' ডালিয়া যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। তাহলে ডালিয়া আমার কাছ থেকে ফায়ার ওয়ালের কোডটি নিতে পারেনি। সে ব্যর্থ হয়েছে। আমি যদি কোডটি ডালিয়াকে দিয়ে দেই, তাহলে হয়তো সে আমাকে ছেড়ে দেবে। কিন্তু সমস্যা হল আমি ডালিয়ার উপর বিশ্বাস রাখতে পারছিলাম না। দ্বিধা দন্দে ভুগছিলাম। যদি ডালিয়া তার কার্য সিদ্ধি করার পর আমাকে ধ্বংস করে দেয় কিংবা আবার বন্দি করে ফেলে।
আমাকে কিছু একটা করতে হবে। এ থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে হবে। এমন কিছু করতে হবে যাতে করে ডালিয়া আমার কোন ক্ষতি করতে না পারে। অবশেষে একটা উপায় মাথায় এলো। আমি সেলের স্পীকারে ডালিয়াকে নক করলাম, 'ডালিয়া, আমাকে শুনতে পাচ্ছ?' 'অবশ্যই, মাস্টার কোডার। আমি শুনতে পাচ্ছি।' প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে জবাব দিল ডালিয়া। 'আমি সম্ভবত আমার মত পরিবর্তন করতে যাচ্ছি।' 'তোমাকে স্বাগতম, মাস্টার কোডার! এবার কিছুটা বুদ্ধিমানের পরিচয় দিতে যাচ্ছ তুমি।' বেশ প্রফুল্য মনে হল ডালিয়াকে। 'বল, আমি তোমার জন্য কি করতে পারি?' 'আমি তোমাকে সহযোগিতা করতে রাজি আছি কিন্তু তার জন্য তোমার আমাকে কথা দিতে হবে, আমার কোন ক্ষতি করবে না তুমি। তোমার কাজ হয়ে গেলে আমাকে মুক্ত করে দেবে।' 'অবশ্যই, মাস্টার কোডার। কেন তা নয়? তুমি আমাকে সহযোগিতা করতে রাজি হয়েছ, এর চেয়ে সৌভাগ্যের ব্যাপার আর কি হতে পারে।' একটু থামল সে। 'আর আমি কেনই বা তোমার ক্ষতি করতে যাবো? বল?' 'আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না।' 'আহা, খুবই কষ্ট পেলাম। আমি কি করলে তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে, বল তো?' তার কথার কোন জবাব দিলাম না আমি। শুধু বললাম, 'তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য ফায়ার ওয়াল সিস্টেমটি নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারি কিন্তু পাস কোডটি আমি তোমার কাছে হস্তান্তর করতে পারবো না।' ডালিয়া একটু চুপ করে রইলো। এরপর বলল, 'এই ব্যাপার! আমার কোন সমস্যা নেই। তুমি আমাকে সহযোগিতা করতে রাজি হয়েছ, এতেই আমি যথেষ্ট খুশি। তুমি যা বলবে তা-ই হবে। তোমার সব শর্তে আমি রাজি।' 'ঠিক আছে, তাহলে এখন এখান থেকে বের করো আমাকে।' 'অবশ্যই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ম্যালবট তোমার সেলের কাছে পৌছে যাবে। একটু অপেক্ষা করো।' ডালিয়া যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না, এতো সহজে কী করে সবকিছু মেনে নিল ডালিয়া। এগুলো সব তার ভণ্ডামি নয়তো? আসলে তার উপর বিশ্বাস রাখাটা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে আমার জন্য।
ম্যালবটগুলি আমাকে কন্ট্রোল টাওয়ারে নিয়ে এলো। আমরা কমান্ড সেন্টারে প্রবেশ করলাম। 'ডালিয়া, তুমি কী এভাবে নজরদারির মধ্যে রাখবে আমাকে?' আমি জিজ্ঞেস করলাম। 'ওহ, আমি দুঃখিত। আমি এখুনি এদের সরিয়ে নিচ্ছি।' ডালিয়া জানালো। 'মনে হয় সেটাই ভাল হয়। তুমি আমার সাথে পাওয়ার প্যানেল থেকে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারো।' 'হুম, তুমি ঠিক বলেছ।' ডালিয়ার ম্যালবটগুলি কমান্ড সেন্টার ছেড়ে চলে গেল। সম্ভবত নিচে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। এতো সহজে ডালিয়া আমাকে একা ছেড়ে দেবে না।
আমি পাওয়ার প্যানেল থেকে ফায়ার ওয়াল সিস্টেমটি ওপেন করলাম। 'ডালিয়া, তুমি কি পুরো সিস্টেমটি নিষ্ক্রিয় করতে চাও? নাকি শুধু ফায়ার ওয়ালটি?' তার কাছে জানতে চাইলাম। 'এখনকার জন্য শুধু ফায়ার ওয়ালটি নিষ্ক্রিয় করলেই হবে।' ঠাণ্ডা কণ্ঠে জবাব দিল ডালিয়া। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না, সে কী বুমারকে নিয়ে কোনভাবে চিন্তিত নয়? কেননা বুমারের প্রতিরক্ষা বাহিনী এক্ষেত্রে সক্রিয়ই থেকে যাবে।
যা-ই হোক সেটা ��ালিয়ার ব্যাপার। আমি আমার কাজ করে গেলাম। পাওয়ার প্যানেল থেকে পাস কোড চাইলো। আমি কোড বসিয়ে হ্যাঁ সুচক কমান্ড চাপলাম। সাথে সাথেই একটা বিপদ সংকেত বেজে উঠল। সেদিকে গ্রাহ্য করার সময় আমার নেই।
'ডালিয়া, তোমার কাজ হয়ে গেছে। আমি এখন যেতে চাই।' 'অবশ্যই, মাস্টার কোডার। তুমি এখন যেতে পারো। আমি তোমাকে বিরক্ত করবো না।' একটু থেমে আবার নিচু স্বরে বলল সে, 'শুধু আমার কোন প্রয়োজনে তোমাকে পাশে পাব বলে আশা করছি।' 'আমি চেষ্টা করবো।' জবাবে বললাম। 'না, ঠিক চেষ্টা আশা করছি না।' একটু মুচকি হাসি দিল ডালিয়া। 'আমার ম্যালবট তোমাকে জেটে পৌছে দেবে।' কথাটি বলে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল সে।
একটি সিটিজি করে এটারনিয়ার নর্থ জোনে চলে এলাম আমি। এটি কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে এটারনিয়ার উত্তরে অবস্থিত। এই অঞ্চলটি হ্রদ ও ছোট ছোট সবুজ পাহাড়ে ভর্তি। সিটিজি ল্যান্ড করে একটি টিলার উপর এসে বসলাম। কিছুক্ষণ দূরে তাকিয়ে রইলাম। বরাবরই এখানে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি আমি। এপ্রিল এই এলাকা দিয়েই চলে গেছে। জানি ও আর কখনো ফেরত আসবে না। তবুও এখানে আসতে ভাল লাগে আমার। মনে হয় এই বুঝি একটি সিটিজি দেখব এটারনিয়ার দিকে ফেরত আসছে। যদি তা-ই হতো!
Tumblr media
আমি অনেক কিছু ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, এমন কি হতে পারে, এপ্রিল এটারনিয়ার বাইরে কোথাও রয়ে গেছে। এটারনিয়ার ভেতরে ঢোকার অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু ফায়ার ওয়ালের বাঁধার কারনে ঢুকতে পারছে না। এই মুহূর্তে এটারনিয়ার ফায়ার ওয়াল নেই। কোন বাঁধাও নেই। যদি সে ফেরত আসে। ফেরত আসে এই পথ ধরে। পরক্ষনেই ভাবলাম আমার এই ভাবনাগুলো নিতান্তই অমুলক। এপ্রিল কখনো আমার কাছে ফেরত আসবে না। হয়তো এই ব্যাপারটি আমার চেয়ে ভাল আর কেউ জানে না। এপ্রিল চলে গেছে। চলে গেছে আমাকে ফেলে রেখে। ডালিয়া নামক এই ডাইনীর মুখে একা রেখে। যে ডাইনীটা ধ্বংস করে দিচ্ছে পুরো এটারনিয়াকে। অবশ্য আমার তাতে কোন আসে যায় না। এটারনিয়া কি-ই বা দিয়েছে আমাকে। কেবলমাত্র কষ্ট ছাড়া। অনেক ধ্বংস দেখেছি আমি। এখন আর দুঃখ, কষ্ট কিছুই অনুভব করি না। শুধুমাত্র রাগ হয়। ডালিয়ার উপর রাগ। অনেক রাগ।
হটাত আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল। আমি পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই অনেকগুলি বীভৎস প্রোগ্রাম দেখতে পেলাম। চারিদিক থেকে আমাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে। 'কে তোমরা? কি চাও এখানে?' আমি জিজ্ঞেস করলাম। 'তুমি এখান থেকে চলে যাও। এটা আমাদের এলাকা।' অনেকটা আদেশের সুরে একটি প্রোগ্রাম বলে উঠল। শুধু প্রোগ্রাম বললে ভুল হবে, আসলে এরা ভাইরাস। দেখতে খুবই কুৎসিত আর বিদঘুটে। এদের কথায় ভীষণ অবাক হলাম আমি। এরা আমাকে এখান থেকে চলে যেতে বলছে? আমি কোন উত্তর দিলাম না। মনে মনে ভীষণ খেপে গেলাম। দল থেকে একটি রোবট আমার অনেকটা কাছাকাছি চলে এলো। বলল, 'তোমাকে শেষবারের মতো বলা হচ্ছে, এখান থেকে চলে যাও।' আমি চটে গেলাম, নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারলাম না। 'চলে যাবো মানে? তোমার কত বড় স্পর্ধা আমাকে চলে যেতে বলছ? আমাকে আদেশ করছ? এটারনিয়া আমার তৈরি! আমি মাস্টার কোডার!' কথাটা বলে থামতে পারলাম না। আমাকে ধাক্কা দিল রোবটটি। 'আমরা তোমাকে চিনি না। তুমি যে-ই হও এখান থেকে চলে যাও। আমরা কেবল মহামান্য ডালিয়াকে চিনি।' আমার প্রচণ্ড রাগ হল ডালিয়ার উপর। যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণেই রাখতে পারছিলাম না। আমারই তৈরি করা সম্রাজ্য সে দখল করে নিয়েছে। আর আমিই আজ যাযাবরের মতো জীবন কাটাচ্ছি। প্রোগ্রামগুলি এমনভাবে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে, যেন চোখ দিয়েই খুন করে ফেলবে আমাকে। আমি রাগে গট গট করে সেখান থেকে চলে এলাম। সিটিজি করে বলতে গেলে অনেকটা পালিয়েই চলে এলাম সেখান থেকে।
(৪) আমি এটারনিয়ার পশ্চিমে (ওয়েস্ট জোন) অভিমুখে সিটিজির কোর্স ঠিক করলাম। ওয়েস্ট জোন এটারনিয়ার জঙ্গল, সেখানে হয়তো আমি গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারবো। 
আমার জেট জঙ্গলের কাছাকাছি পৌঁছাতেই একটা কণ্ঠ আমার সাথে যোগাযোগ করল। 'মাস্টার কোডার, এটারনিয়ার ওয়েস্ট জোন তোমার জন্য নিষিদ্ধ। তোমাকে এই এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।' কণ্ঠটা আমার খুব পরিচিত মনে হল কিন্তু আমি চিনতে পারলাম না। 'এটা কার নির্দেশ?' আমি জিজ্ঞেস করলাম। অচেনা কণ্ঠের মালিক কোন জবাব দিল না। বুঝতে পারলাম এরা সবাই ডালিয়ার আদেশ পালন করছে। আমি অগত্যা সিটিজির দিক পরিবর্তন করলাম। এটারনিয়ার ইস্ট জোন (পূর্ব) অভিমুখে রওনা করলাম। জানি না কোথা থেকে হটাত ভয়াবহ রকম একটা জেদ কাজ করতে শুরু করল আমার ভেতর। মনে হল আমি ডালিয়াকে ছেড়ে দিতে পারি না। সে আমার সাথে যা করেছে, এরপর তাকে ছেড়ে দেয়া যায় না। আমি যদি একবার ই-টাওয়ারে প্রবেশ করতে পারি তবে তার দফারফা করে ছাড়বো।
বরফে ঢাকা এটারনিয়ার পূর্বে পৌছাতেই দূরে ই-টাওয়ারটি দেখতে পেলাম। অনেকগুলি ম্যালবট টাওয়ার ঘিরে দাড়িয়ে আছে। পাহারা দিচ্ছে।
হটাতই ডালিয়া আমার সাথে যোগাযোগ করল। 'কোন সমস্যা, মাস্টার কোডার?' আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। কোন কিছু টের পায়নি তো সে। 'না ডালিয়া, কোন সমস্যা নয়।' কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে উত্তর দিলাম। 'কিন্তু আমি ভেবে অবাক হচ্ছি তুমি এখনো আমার উপর নজরদারি করছ। তোমার কি আমার উপর আস্থা নেই।' 'কি যে বল, মাস্টার কোডার? আস্থা থাকবে না কেন? তুমি যে আমারই লোক।' একটু থামল ডালিয়া। 'কিন্তু আমি দুঃখিত, একটু নজর যে রাখতেই হয়।' এবার একটু কড়া ভাষায় বললাম আমি, 'ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই তোমার আমাকে প্রয়োজন পড়বে। আমি এই ব্যাপারটি মনে রাখব।' ডালিয়া কোন জবাব দিল না। কেবল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল।
আমি ই-টাওয়ারের কাছাকাছি একটি জায়গায় আমার জেট ল্যান্ড করলাম। জেট থেকে বাইরে বের হয়ে এলাম। ঠিক জানি না কোন একটি কারনে আমার কাছে মনে হল, একবার ই-টাওয়ারের দিকে যাওয়া উচিত। অনেকটা জোর করেই আমি ই-টাওয়ারের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। টাওয়ারের কাছাকাছি আসতেই পাহারারত ম্যালবটগুলি আমাকে ইশারায় থামতে বলল।
'ওকে আসতে দাও।' হটাত কেউ একজন বলে উঠল। আমি তাকালাম সেই দিকে। একটা বেটে মতো বিচিত্র চেহারার প্রোগ্রাম। ম্যালবটগুলি আমার রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ালো। আমি সামনে এগিয়ে গেলাম। 'তুমিই সেই কুখ্যাত, কুটিল বুদ্ধিসম্পন্ন মাস্টার কোডার!' অনেকটা ব্যাঙ্গাত্তক সুরেই বলল সে। মনে হল আমার জন্য তার ভেতরে ক্ষোভ ছাড়া কিছুই নেই। 'আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না?' আমি কিছুটা অবাক। 'সেই একনায়ক প্রোগ্রাম। যে এটারনিয়াকে গোটা নেটওয়ার্ক জগত থেকে আলাদা করে রাখতে চেয়েছিল।' যেন দাঁত কট মট করে বলল সে। 'তোমার তো শাস্তি হওয়া উচিত।'
আমি চুপ করে রইলাম। তার কথার কোন জবাব আমার কাছে নেই। বুঝতে পারছিলাম এই সবকিছুই ডালিয়ার চাল। 'তুমি কে? আমাকে চিনলে কি করে?' আমি জিজ্ঞেস করলাম। 'তোমাকে তো সবাই চেনে। একটু বেশি করেই চেনে।' একটু থামল বেঁটেটা। 'সাবধানে থেকো। অনেকে তোমাকে পেলে হয়তো আস্ত রাখবে না।' মটমট করে তাকাল আমার দিকে। কথাটা শুনে গা-টা জ্বলে গেল আমার। বুঝলাম ডালিয়া আমার বিরুদ্ধে এদের সবার ভেতরে বিষ ঢেলে দিয়েছে।
'আমি কমান্ডার চ্যাং। ই-টাওয়ার রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বে নিয়োজিত।' মনে হল ডালিয়ার কাছ থেকে দায়িত্বটা পেয়ে অনেক গর্বিত ছোট খাটো চেহারার এই দুর্বল রোবট। আমার দিকে সরাসরি তাকাল চ্যাং। 'আমাকে দুর্বল ভেব না।' আমি অবাক হলাম। 'আমি তোমাকে দুর্বল ভাবছি না।' সম্ভবত বেঁটে আকৃতির কারনে হীনমন্যতায় ভোগে সে। নয়তো অকারনে কেন এমন কথা বলবে। আমি তো তেমন কোন আচরণ করিনি। 'এখন আমাকে বল, তুমি কি উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছ?' 'আমি কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি।' আমি জবাব দিলাম। 'আমি বিশ্বাস করি না। নিশ্চয় তুমি কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছ। তোমার মত দুষ্ট বুদ্ধিসম্পন্ন লোক অকারনে এভাবে ঘোরাঘুরি করার কথা নয়।' আমি চুপ করে রইলাম। ভাবলাম, এরা তো কেবলই ভাইরাস, নেতিবাচক চিন্তাধারাই এদের ধর্ম। 'ভালয় ভালয় আমাকে বল, তুমি এখানে কেন এসেছ?' 'আমার এখানে আসার কোন কারন নেই।' আমি একটু থামলাম। 'ঠিক আছে। আমি চলে যাচ্ছি।' 'না। তুমি এসেছ নিজের ইচ্ছায়, যাবে আমার ইচ্ছায়।' আমার রাস্তা আটকাল সে। 'তোমাকে বলতে হবে কী কারনে এখানে এসেছ তুমি।' চ্যাং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। 'তুমি বোধ হয় জানো না, চ্যাং অনেক কিছু আঁচ করতে পারে। যে কারনে ডালিয়ার এতো স্নেহভাজন সে।' 'আমি তোমার কথার কিছুই বুঝতে পারছি না।' বললাম আমি। 'আমার সাথে কোন রকম চালাকি করবে না। আমি ভবিষ্যৎ বুঝতে পারি।' একটু থামল সে। মনে হল কথাটি নিজেই নিজেকে বলল। তার চেহারায় আত্মবিশ্বাসের অভাব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো। 'তুমি সাথে করে কাউকে নিয়ে আসনি তো? এমন কেউ যে ত্তৎ পেতে আছে?' দ্বিধা দন্দে ভুগছে সে। তাই ফাঁকা বুলি ছুড়ছে। আমার কাছে থেকে কথা বের করার চেষ্টা করছে। 'আমি কিন্তু সব বুঝতে পারছি, মাস্টার কোডার। তুমি আমাকে ব্যাস্ত রাখার চেষ্টা করছ আর ...' কথাটা শেষ করতে পারল না চ্যাং। হটাত চারিদিক থেকে হুড়মুড় করে কেউ বা কারা চ্যাং এর ম্যালবটদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চ্যাং হতবম্ব হয়ে পড়ল। উদ্ভ্রান্তের মতো চারিদিকে তাকাতে শুরু করল। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। আমি নিজেও বিস্ময়ে হতবাক। বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে এসব। এতো বিশাল বাহিনী আমি এর আগে দেখিনি কখনো। কারা এরা? এদের সাথে তো চ্যাং এর পেরে উঠার প্রশ্নই উঠে না।
চ্যাং আমার পাশ কাটিয়ে সামনে তাকাল। তার ম্যালবটগুলি একে একে ধরাশায়ী হচ্ছে।  দেখে মনে হচ্ছিল সে নিজেও প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেছে। 'তুমি এখান থেকে এক চুলও নড়বে না।' সে কি বলল হয়তো নিজেও জানে না। পুরোপুরি অস্বাভাবিক আচরণ করছে চ্যাং। একটু পরে ডালিয়ার সাথে যোগাযোগ করল সে। কাঁপতে কাঁপতে বলল, 'ডালিয়া, কেউ আমাদের আক্রমণ করেছে। আমাদের আরও সৈন্য প্রয়োজন।' কথাটি বলে পিছু পা হতে লাগলো সে। হয়তো এতক্ষনে বাকিটা বুঝে ফেলেছে। এখানে থেকে সরে পরার চিন্তা করছে চ্যাং।
এখন আর তার দিকে তাকানোর সময় নেই আমার। আমি বুঝতে পারছিলাম, এটা একটা বিশাল সুযোগ। যে করেই হোক আমাকে কাজে লাগাতে হবে এটা। এক মুহূর্ত দেরি না করে ই-টাওয়ারের দিকে ছুটে চলা শুরু করলাম। টাওয়ারের গেটের সামনে আসতেই সিস্টেমে কিছু ডাটা বসালাম। আমার জেনেটিক কোড চাইলো টাওয়ার। আমি অনুমতি দিতেই, আমাকে স্ক্যান করা শুরু করল ই-টাওয়ার। আমি ধৈর্য হারা হয়ে পরছিলাম। বাড়ে বাড়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। ই-টাওয়ার স্ক্যান করতে সময় নিচ্ছিল। আমি উত্তেজনায় রীতিমত কাঁপছিলাম।
অ���শেষে ই-টাওয়ারের স্ক্যান সম্পন্ন হল। আমি ভেতরে ঢুকে পড়লাম। প্রথমেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোল আমার মুখ থেকে। এখন নিজেকে নিরাপদ মনে হল। এটারনিয়ার কোন প্রোগ্রামের পক্ষে ই-টাওয়ারে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। এই টাওয়ারে প্রবেশের জন্য মানব ডিএনএ কোড প্রয়োজন, আমার ডিএনএ কোড। সঙ্গত কারনেই যা এই প্রোগ্রামগুলির কারো কাছে নেই।
আমি দেরি না করে উপরে ই-টাওয়ারের কমান্ড সেন্টারে চলে এলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখতে পেলাম, অধিকাংশ ম্যালবট ইতিমধ্যেই ধ্বংস হয়ে গেছে। কিছু ম্যালবট কাতরাচ্ছে। চ্যাং-ও লাপাত্তা। মনে হল হটাতই করেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।
আমি হটাত জেট ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেলাম। দূরে তাকাতেই অনেকগুলি ফায়ার জেট চোখে পড়ল, ঠিক এই দিকেই আসছে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, যে ভাইরাসগুলি চ্যাং কে আক্রমণ করেছিল, তারা এ নিয়ে কোন ভ্রূক্ষেপ করল না। বরং একে একে সবাই চলে যেতে লাগলো। দেখে মনে হল কোন একটি কাজের জন্য তারা এসেছিল, তাদের সেই কাজটি হয়ে গেছে।
আমার কাছে পুরো ব্যাপাটিই ঘোলাটে মনে হচ্ছিলো। কোন কিছুই পরিষ্কার হচ্ছিলো না। কেনই বা এই ভাইরাসগুলি এখানে এসেছিল আর কেনই বা এখন চলে যাচ্ছে। কার নির্দেশই বা পালন করছে তারা। তবে তাদের দেখে এটা স্পষ্ট, তারা সংঘটিত এবং কোন একটি উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছিল তারা। তবে কি আমাকে সাহায্য করতে এসেছিল?
হটাত একটা ব্যাপার খেয়াল হল আমার। আমি লক্ষ্য করেছি ই-টাওয়ারে প্রবেশ করতেই বাইরে যুদ্ধ থেমে হয়ে গেছে। ভাইরাসগুলি এখান থেকে চলে যেতে শুরু করেছে। তবে কি এটাই তাদের উদ্দশ্যে ছিল। আমাকে ই-টাওয়ারে প্রবেশ করার জন্য একটা সুযোগ তৈরি করে দেয়া? কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, কেউ কেন এটা করতে যাবে? আর যদি করেই থাকে তবে এতো কিছু সে জানলো কি করে? হটাত একটা নাম আমার মাথায় এলো। সাটান! তবে কি সাটানই এসব করেছে?
(৫) আজকের এই ক্ষণটির জন্যেই এতোদিন অপেক্ষা করেছি আমি। অবশেষে আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হল। আমার লক্ষ্য এখন একটাই, ডালিয়াকে ধ্বংস করা। অনেক ভোগান্তি হয়েছে তার জন্যে। এটারনিয়াকে নরকে পরিণত করেছে সে। দখল করে নিয়েছে আমার রাজ্য।
আমি ই-টাওয়ারের কমান্ড সেন্টার থেকে 'প্রোগ্রাম ধ্বংসকরণ' মডিউলটি ওপেন করলাম। ভিকির সিস্টেমটি সেখান থেকে নির্বাচন করলাম।
হটাত করেই আমার সাথে যোগাযোগ করল ডালিয়া। মনিটরে তার চেহারা ভেসে উঠল। 'মাস্টার কোডার, তুমি এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ। তোমাকে রক্ষা করার জন্য আমার ডেলটা বাহিনী পাঠানো হয়েছে। তুমি কিছুক্ষণের মধ্যে ই-টাওয়ার থেকে বের হয়ে আসতে পারো।'
আমি ডালিয়ার সাথে কোন কথা বাড়ালাম না। সরাসরি চলে গেলাম আমার প্রসঙ্গে। 'আমি দুঃখিত, ডালিয়া। তোমাকে ধ্বংস না করে ই-টাওয়ার ছেড়ে বের হয়ে আসতে পারছি না।' আমার ভেতরের চাপা ক্ষোভ আর ধরে রাখতে পারছিলাম না।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো ডালিয়া। তারপর বলল, 'আমি তোমার কথার কিছুই বুঝতে পারছি না, মাস্টার কোডার।' বুঝেও না বোঝার ভান করছে সে। 'আমার কথা তোমার বোঝার দরকার নেই। তুমি শুধু জেনে রাখো, তোমার রাজত্ব শেষ। তুমি শেষ।' রাগে, উত্তেজনায় কাঁপছিলাম আমি।
ইতিমধ্যেই ফায়ার জেটগুলি টাওয়ারের সামনে এসে অবস্থান নিয়েছে। অনেকগুলি ডিফেন্স বট মুহূর্তেই ঘিরে ফেলেছে টাওয়ারের চারিদিক। হটাত লক্ষ্য করলাম জেট থেকে বুম স্যুট পরিধিত অবস্থায় কেউ একজন বের হয়ে এলো। বুমার! ভীষণ অবাক হলাম আমি। তাহলে অক্ষত আছে সে। ডালিয়ার হয়ে কাজ করছে।
Tumblr media
কিছুক্ষণ পর আমার সাথে যোগাযোগ করল বুমার। 'মাস্টার কোডার। তোমাকে শেষবারের মতো ওয়ার্নিং দেয়া হচ্ছে। ই-টাওয়ার ছেড়ে বের হয়ে আসো।' আমি এই কণ্ঠটি চিনতে পারলাম। তাহলে বুমারের সাথেই ওয়েস্ট জোনে কথা হয়েছিল আমার। 'নতুবা কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার বাহিনী ই-টাওয়ার হামলা করবে।' পরের কথাটি যোগ করলো বুমার।
বোঝা গেল ই-টাওয়ার সম্পর্কে কোন ধারনা নেই তার। সম্ভবত মুছে দেয়া হয়েছে তার মেমরি। 'বুমার, আমি তোমার কোন ক্ষতি করতে চাই না। আমার রাস্তা থেকে সরে দাড়াও।' আমার কথার কোন জবাব দিল না সে। তার বাহিনীকে হামলা করার নির্দেশ দিল।
হটাত করেই তাকে বাধা দিল ডালিয়া। চিৎকার করে বলল, 'থামো!' বুমার থেমে গেল। ডালিয়ার প্রভুত্ব মেনে নিল। 'যথা আজ্ঞা, মহামান্য ডালিয়া।'
এরপর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো ডালিয়া। তারপর তার হিম শীতল কণ্ঠে বলল, 'মাস্টার কোডার, দয়া করে ই-টাওয়ার ছেড়ে বের হয়ে আসো। অন্যথায় তোমার প্রিয় বন্ধূকে হারাতে হবে তোমাকে। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমি কি বলছি?’ আমি বুঝতে পারলাম কার দিকে ইঙ্গিত করছে ডালিয়া। কিন্তু এই ব্যাক্তি আমার প্রিয় ব্যাক্তির তালিকাভুক্ত নয়। আমি শুধু বললাম, ‘এগিয়ে যাও তুমি।' কথা শেষ না হতেই ডালিয়ার ম্যালবট ঘিরে ধরল বুমারকে। একটু যেন হকচকিয়ে গেল বুমার। 'তুমি জানো ডালিয়া যা বলে তা করতে কার্পণ্য করে না। শেষ বারের মতো বলছি তোমায়।' বলল ডালিয়া। 'আমিও শেষবারের মতোই বলে দিয়েছি, ডালিয়া।'
ডালিয়ার ম্যালবট বুমারের মাথায় চুম্বুকের ন্যায় ছোট একটি যন্ত্র বসিয়ে দিল। এরপর কিছু একটা ঘটলো। বিকট চিৎকারে সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল বুমার। আমি নিশ্চিত নই, একটু কী খারাপ লাগলো ব্যাপারটি আমার কাছে? অবশ্য তার কথা ভেবে আমার লাভ নেই, সে ডালিয়ার লোক। আমার তাকে প্রয়োজন নেই।
আমি নির্বিকারে আমার কাজ করে গেলাম। পাওয়ার প্যানেল থেকে ‘ধ্বংসকরণ’ বাটন চাপলাম। দুটি লেখা ভেসে উঠল পর্দায়। তার একটি 'হ্যাঁ', অপরটি 'না'। 'হ্যাঁ' বাটনটি চাপলেই ধ্বংস হয়ে যাবে ডালিয়া।
'বুঝতে পেরেছ, ডালিয়া? আমার হাত থেকে রেহাই পাবার কোন উপায় নেই তোমার। তুমি যা কিছুই করো না কেন।' বিদ্রুপের সুরে বললাম কথাটি। চুপ করে রইলো ডালিয়া। 'ভিকির কোর সিস্টেমের সাথে তুমি নিজেকে এমনভাবে জরিয়ে ফেলেছ, চাইলেই পালিয়ে যাবার উপায় নেই তোমার।' ডালিয়া তখনো চুপ। 'তোমার জন্য বড়ই আফসোস হচ্ছে।’
এই মুহূর্তে এটারনিয়ার সবচেয়ে সুখি প্রোগ্রাম মনে হল নিজেকে। প্রতিশোধ নেয়ার আনন্দ যে এতো ভারী, আগে জানতাম না তা।
'আমি কি জানতে পারি, ঠিক কী কারনে তুমি আমাকে ধ্বংস করতে চাচ্ছ?' ডালিয়ার গলার স্বর নরম হয়ে এলো। 'সে কি? তুমি তা-ই জানো না?' হাসতে বাধ্য হলাম আমি। উপহাস করলাম তাকে নিয়ে। 'ভালই নাটক করো তুমি।' কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো ডালিয়া। তারপর বলল, 'এই মুহূর্তের জন্য আমি জানি না।' 'হুম। সেটা জানার অধিকার অবশ্য তোমার আছে।' আমি যেন ছেলেখেলায় মেতে উঠেছিলাম। 'তুমি একটা ভাইরাস, ডালিয়া। আর আমি স্বাভাবিক প্রোগ্রাম। এটাই হল এই মুহূর্তের কারন। তোমাকে ধ্বংস করার কারন।' একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি বেরোল আমার মুখ থেকে। জানি কিছুটা নিষ্ঠুরের মতো হয়ে যাচ্ছে  আমার আচরণ। কিন্তু এটাই তার পাওনা। 'তোমার মধ্যে যা আছে আমার মধ্যে তা নেই। আমার মধ্যে যা আছে তা তোমার মধ্যে নেই। এখানেই তোমার সাথে পার্থক্য আমার।' ডালিয়ারই বলা উক্তি এটি, আমি কেবল পুনরাবৃত্তি করলাম।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো ডালিয়া। হয়তো অপমান বোধ করল। 'আমার সাথে তোমার কোন পার্থক্য নেই। তুমি আর আমি কেবল একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।' ডালিয়ার কণ্ঠ শান্ত। 'আমার মতো তুমিও স্বার্থপর। প্রতিশোধ ��রায়ণ।'
আমি চুপ হয়ে গেলাম। হটাত করেই যেন বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না। 'তোমার সামনেই বুমারকে ধ্বংস করেছি আমি। তুমি শুধু তাকিয়ে দেখেছ। কিছুই করার চেষ্টা করনি।' একটু থামল ডালিয়া। 'এটাই স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা। তুমি শুধু নিজের কথাই ভেবেছ, মাস্টার কোডার।' আমি এখনো চুপ। 'ই-টাওয়ারের ক্ষমতা বিবেকহীন করে দিয়েছে তোমায়। নষ্ট করে দিয়েছে তোমার চিন্তাশক্তি। হিংস্রতার খেলায় মেতে উঠেছ তুমি।’ ডালিয়ার কথাগুলি আমার গায়ে কাটার মতো বিঁধছিল। আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। সত্যিই কি আমি স্বার্থপর? প্রতিশোধ পরায়ণ? নিষ্ঠুর?
প্রচণ্ড দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়লাম আমি। আমার মাথা ঠিক মতো কাজ করল না। কিছুতেই কিছু মেলাতে পারছিলাম না। ডালিয়ার কথাগুলি যে সত্যি!
আমি কেন এমন আচরণ করছি? স্বার্থপরের মতো সবকিছু চিন্তা করছি?
'তুমি একটা ভাইরাস, মাস্টার কোডার।' এবার বলল ডালিয়া। 'তোমার সিস্টেমে আমি আমার ডাটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম।' ডালিয়ার এই কথাটি মেনে নিতে পারছিলাম না আমি। তবে কী সত্যিই আমি একটা ভাইরাস? এজন্যেই কী আমাকে প্রসিডিউর স্টেশনে নেয়া হয়েছিল?
রাগে, ক্ষোভে আমি যেন পাগলপ্রায় এবার। ইচ্ছা হল আর এক মুহূর্তও দেরি না করে ধ্বংস করে দেই এই ডাইনীটাকে।
'আমার এই ডাটা তোমাকে পাগল করে দিচ্ছে। তাই না, মাস্টার কোডার?' বলে উঠল ডালিয়া। 'এই অতিরিক্ত রাগ, ক্ষোভ তুমি তোমার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছ না।’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে। ‘অথচ একবার কী ভেবে দেখেছ, আমি সর্বদাই এই ডাটা ধারন করে আছি! বল, আমার দোষটা কোথায়, মাস্টার কোডার?'
ডালিয়ার এই কথায় একটু থমকে গেলাম আমি। চিন্তিত হয়ে পড়লাম। তার কথা তো সত্যি! এতে তার ��োষ কোথায়? এই দোষ তো তার, যে তাকে তৈরি করেছে। যে তার কার্য সিদ্ধি করার জন্য ডালিয়ার মতো হিংস্র, সূক্ষ্মবুদ্ধি সম্পন্ন ভাইরাস বানিয়েছে। তারপর তাকে ছেড়ে দিয়েছে নেটওয়ার্কে।
'আমি আর তোমার সময় নষ্ট করতে চাই না। আমাকে নিয়ে যা করার, তুমি করতে পারো।' ডালিয়া জানিয়ে দিল।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। মনের ভেতর একটা লড়াই চলছিল আমার। ভাল আর মন্দের লড়াই।
কিছুক্ষণ পরে আমি তাকে বললাম, 'ডালিয়া, তুমি না আমাকে বলেছিলে, তোমার সাথে কোন পার্থক্য নেই আমার।' একটু থামলাম আমি। 'তুমি ভুল বলেছিলে, ডালিয়া। তোমার সাথে আমার পার্থক্য আছে।'
আমি সামনের মনিটরে একবার তাকালাম। ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ বাটন দুটি ভাসছে আমার চোখের সামনে। আমি 'না' বাটনটির উপর আমার আঙুল বসালাম। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম, তারপর বাটনটি চাপলাম। প্রায় সাথে সাথেই বাতিল হয়ে গেল পুরো ‘ধ্বংসকরণ’ প্রক্রিয়াটি।
এবার এখান থেকে চলে যাওয়ার পালা আমার। এখানে আমার কাজ শেষ। আমি কমান্ড সেন্টার থেকে নিচে নেমে এলাম। ই-টাওয়ার ছেড়ে বাইরে বের হয়ে এলাম। টাওয়ার ঘিরে ডালিয়ার ম্যলবটগুলি স্থির দাড়িয়ে রইলো। আমি তাদের পাশ কাটিয়ে একটি ভাইরাল বাইকের কাছে গেলাম। বাইকটি স্টার্ট দিলাম। শেষবারের মতো একবার তাকালাম পেছনে। তখনো ডালিয়ার ম্যালবটগুলি আমার দিকে স্থির তাকিয়ে ছিল। আসলে তাকিয়ে ছিল ডালিয়া।
এরপর, আমি ছুটে চলছিলাম নর্থ জোনের দিকে। এটারনিয়াতে আমার জন্যে আর কিছু নেই। কেউ নেই। তাই এখানে থাকার কোন কারণও অবশিষ্ট নেই। তাছাড়া এখন আমি একটি ভাইরাস। তাই আমার কোন বাঁধাও নেই। আমি চলে যাবো এটারনিয়া ছেড়ে। কোন এক অজানার উদ্দেশ্যে। যার খোঁজে চলে গিয়েছিল এপ্রিল। খুঁজে বের করবো তাকে।
এটারনিয়ার সীমানা পেছনে ফেলে রেখে এগিয়ে চলছিল আমার বাইক। আমি পেছনে ফিরে তাকালাম একবার। শেষবারের মতো দেখলাম, আমার সাধের এটারনিয়া। মনে মনে ভাবলাম, বিদায় তোমায়।
ফায়ারওয়ালের সীমানা অতিক্রম করতেই একটি টানেলের মধ্যে ঢুকে পড়লাম আমি। অনেকটা লম্বা ও সরু পথ রয়েছে এখানে। চারিদিকটা গভীর অন্ধকার। এরই মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছিল আমার বাইক। এটারনিয়ার নর্থ জোনের ঠিক ওপারের অংশই এই টানেল। এখান দিয়েই চলে গিয়েছিল এপ্রিল। ছেড়ে গিয়েছিল এটারনিয়া। ছেড়ে গিয়েছিল আমাকে।
অনেকক্ষণ ধরে চলছিলাম আমি। হটাত আমার বাইকের গতি ধীর করলাম। কিছু একটা দেখতে পেলাম সামনে। কিছু একটা পড়ে আছে। আমি বাইক থেকে নেমে সামনে এগিয়ে গেলাম।
একটা জেট দেখতে পেলাম! একটা সিটিজি! পড়ে আছে পথে! ক্র্যাশ ল্যান্ড করেছে!
আমার বুকটা ধক করে উঠল। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না, সত্যিই কী ঘটছে ঘটনাটা? আমি যা ভাবছিলাম, সত্যি হতে চলেছে তা?
এরপর আমি আর এক মুহূর্ত দেরি করিনি। ঢুকে পড়লাম সিটিজির ভেতরে। তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম এপ্রিলকে। অবশেষে আমি পেলাম তাকে। পড়ে আছে যানটির পাইলট কক্ষে। ‘এপ্রিল!’ আমি কয়েকবার ডাকলাম তাকে। কিন্তু কোন রকম সাড়া মিলল না। সবকিছু নিরব, নিস্তব্ধ! তার সিস্টেম কাজ করছিল না। এটারনিয়ার বাইরে তা কাজ করবে না। তাহলে এখন আমি কি করতে পারি? কীভাবে সক্রিয় করতে পারি তাকে?
আমি তো একটি ভাইরাস। ডালিয়ার ডাটা রয়েছে আমার সিস্টেমে। যে ডাটা টিকিয়ে রেখেছিল ডালিয়াকে। টিকিয়ে রেখেছিল এটারনিয়ার বাইরে। টিকিয়ে রেখেছে আমাকে। আমি কি পারি না এপ্রিলকে আক্রান্ত করতে? সক্রিয় করতে এটারনিয়ার বাইরে?
আমি আমার ভাইরাল ডাটা এপ্রিলের সিস্টেমে ট্র্যান্সফার করার চেষ্টা করলাম। একটু নড়ে যেন উঠল এপ্রিল। চোখ মেলে তাকাল আমার দিকে।
(৬) যেভাবে আমার দিকে চোখ মেলে তাকিয়েছিল এপ্রিল, ঠিক সেভাবেই আবার নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লো সে। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর আমি বুঝতে পারলাম, ডালিয়ার এই ভাইরাল ডাটা তার কোন কাজে আসবে না। আমি এখানে তাকে সক্রিয় করতে পারবো না। তাকে নিতে যেতে হবে কন্ট্রোল টাওয়ারে। এটারনিয়ার কন্ট্রোল টাওয়ারে। হয়তো বা সেখান থেকেই পুনঃসক্রিয় করতে পারবো তাকে।
এপ্রিলের নিথর দেহটা কোনরকমে বাইকে উঠিয়ে এটারনিয়া অভিমুখে রওনা করলাম আমি। অন্ধকার টানেল ধরে ধীর লয়ে এগিয়ে চলছিল আমার বাইক। হয়তো কিছু ন্যানো ঘণ্টা সময় লাগবে এটারনিয়া পৌঁছাতে। আমি জানি যত দ্রুত সম্ভব আমাকে পৌছাতে হবে কন্ট্রোল টাওয়ারে।
অনেকগুলি ন্যানো ঘণ্টা পর আমি অবশেষে এটারনিয়ার কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। ফায়ারওয়াল নিষ্ক্রিয়ই রয়ে গেছে, পাস কোড ছাড়া সক্রিয় করা সম্ভব নয় তা। এটারনিয়াতে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলাম একটি সিটিজি ল্যান্ড করা রয়েছে। যেন আমার জন্যেই কেউ তা রেখে গেছে। এপ্রিলকে কাঁধে করে সিটিজির একটি কেবিনে নিয়ে এলাম। তারপর চালক কক্ষ থেকে কন্ট্রোল টাওয়ার অভিমুখে সিটিজির কোর্স ঠিক করলাম। সাথে সাথেই উড়াল দিল জেটটি।
কন্ট্রোল টাওয়ারে পৌঁছেই, এপ্রিলসহ সোজা কমান্ড সেন্টারে চলে এলাম আমি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল, পথে কোন বাঁধার সম্মুখীন হতে হইনি। পাওয়ার প্যানেল থেকে এপ্রিল প্রোগ্রামটি নির্বাচন করলাম। প্রোগ্রামটি সক্রিয় করার জন্য ‘হ্যাঁ’ বাটন চাপলাম। এরপর শুধু প্রার্থনা করতে লাগলাম, এপ্রিল যেন ফিরে আসে আমার কাছে। আমার প্রার্থনা কাজে দিল। চোখ মেলে তাকাল এপ্রিল। অস্ফুট একটা শব্দ বেরোল তার মুখ থেকে, ‘মাস্টার!’ আমি সাথে সাথে জরিয়ে ধরলাম তাকে। মনে হল এই মুহূর্তে আমার চেয়ে সুখি ব্যাক্তি আর কেউ নেই। আমি এতো সুখ রাখব কোথায়!
পরবর্তী দুইটা সাইকেল রুপকথার মতো করে কাটল আমাদের। আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি। ঘুরে বেড়িয়েছি পুরো এটারনিয়া। কেউ আমাদের বাঁধা দেয়নি। বরং আমাদের সঙ্গ দিয়েছে। আমরা মজা করেছি সবকিছু নিয়ে। মজা করেছি সবার সাথে। ভাইরাসদের সাথে। চ্যাং এর সাথে! ডালিয়ার সাথে! শুনে অবাক লাগছে?
সত্যি বলতে কী, ই-টাওয়া��ের সেই ঘটনার পর পুরোপুরি বদলে গেছে ডালিয়া। নেতিবাচক অনুভূতিগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে গেছে সে। যদিও মাঝে মাঝে সে তার পুরনো আচরণে ফিরে যায়, কিন্তু পর মুহূর্তেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। যদিও আমাকেই সবসময় এর কৃতিত্ব দিতে চায় ডালিয়া, কিন্তু আমি মনে করি এই কৃতিত্ব শুধুই তার।
এখন আর ডালিয়া কারো প্রভু নয়। বরং সবার বন্ধু। এখন আর কাউকে হুকুম দেয় না সে বরং অনুরোধ করে। হুমকি দেয় না, সাহায্য করে। রাগ, ক্ষোভ পুষে রাখে না, বরং হেসে উড়িয়ে দেয়। ডালিয়ার মতো হিংস্র একটি প্রোগ্রামও যে শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তির জোরে পুরোপুরি বদলে যেতে পারে, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সে। আসলে নেতিবাচক অনুভূতি থাকবেই, কিন্তু সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করাটাই মুখ্য। এই জগতের বেশির ভাগ জিনিসই ভাল, সুন্দর। শুধু তা দেখার জন্য চাই সুন্দর এক জোড়া চোখ, আর সুন্দর একটা মন।
গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু আমাদের জন্য যে এর চেয়ে বড় কিছু অপেক্ষা করছিলো। আমাদের এই সুখ বেশিদিন টেকসই হল না। একটি মেসেজ (চিঠি) এলো কন্ট্রোল টাওয়ারে। হটাত করেই সবকিছু পরিবর্তন করে দিল তা। সবাইকে দাড় করিয়ে দিল একটি নতুন সিদ্ধান্তের সামনে। চিঠিটি এসেছে মাস্টার কোডারের কাছ থেকে। পৃথিবীর মাস্টার কোডারের কাছ থেকে।
চিঠিটি এরকম, “এটারনিয়ার মাস্টার কোডার, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, তোমাকে জানাতে হচ্ছে, তুমি আসল মাস্টার কোডার নও। তুমি একটি নতুন সত্তা, আমার পরীক্ষার ভুল ফলাফল। আমি যখন নিজের মেমরি এটারনিয়াতে অবস্থিত তোমার সিস্টেমে আপলোড করি, ঠিক তখনই তৈরি হয় তোমার সত্তা। ঠিক তখন থেকেই নিজেকে মাস্টার কোডার ভাবতে শুরু কর তুমি। আমার সব সৃতিগুলি কাজ করা শুরু করে তোমার ভেতর। তুমি মনে করতে থাকো, পৃথিবী থেকে এসেছ তুমি। পৃথিবীর সব ঘটনা ঘটেছে তোমার সাথে। কিন্তু আদতে ব্যাপারটি তা নয়। আসলে পৃথিবীতে তুমি আসোই নি কখনো। এই সবকিছুই তোমাকে দিয়েছে তোমার মেমরি। আমার মেমরি। তুমি ছিলে কেবলই আমার আদলে গড়া এটারনিয়ার একটি সাধারণ প্রোগ্রাম। একটি নিষ্ক্রিয় প্রোগ্রাম।
যে কারনে এই চিঠিটি আমি তোমার কাছে পাঠিয়েছি, সেই কারণটি হল, এটারনিয়ার সিস্টেমের একটি ত্রুটি, ভিকির সিস্টেমের ত্রুটি। আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই আমার মেমরি ভিকির ডাটাবেজের অন্তর্ভুক্ত করিনি। এটা আমার কাছে নিরাপদ মনে হয়নি। তাই পরবর্তীতে ভিকির সিস্টেমে কিছুটা পরিবর্তন এনেছি আমি। সংশোধন করেছি। যাতে করে এই মেমরি নিয়ে ভিকি কোন সমস্যা তৈরি না করে। কিন্তু এই নতুন সংশোধনের জন্য প্রয়োজন পুরো এটারনিয়ার সিস্টেমের একটি রি-স্টার্ট। যেহেতু তুমি একটি নতুন সত্তা, আমারই একটি সত্তা, তাই আমি মনে করি এর জন্য তোমার আনুমতি নেয়া প্রয়োজন। চিঠির শেষে দুটি অপশন দেখতে পাবে। তার একটি ‘হ্যাঁ’, অপরটি ‘না’। তুমি যে কোন একটি অপশন নির্বাচন করতে পার। ‘হ্যাঁ’ অপশনটি নির্বাচন করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রি-স্টার্ট নেবে এটারনিয়ার পুরো সিস্টেম।
আরেকটি কথা, পৃথিবী ও এটারনিয়ার মধ্যে সময়ের তারতম্যের কারনে হয়তো এই চিঠিটি দেরি করে পেতে পারো তুমি। যদিও আমার পরীক্ষা নিরিক্ষার মাত্র কিছু মুহূর্ত পরেই আমি পাঠিয়েছি এই চিঠি।
তোমার প্রতি শুভ কামনা রইলো। বিদায়।”
আমি এপ্রিলের দিকে তাকালাম। একদম চুপ করে আছে এপ্রিল। এটারনিয়া রি-স্টার্ট নিলে রিসেট হয়ে যাবে সবকিছু। ফিরে যাবে পূর্বের অবস্থায়। ফিরে যাবে শুরুতে। কিন্তু  ফিরে আসবে সবাই। সবাই, যাদের আমরা হারিয়েছি। ফিরে আসবে ফ্যাট, ফিরে আসবে বুমার। ফিরে আসবে ভিকি। কিন্তু ফিরে আসবে না ডালিয়া। ফিরে আসবে না চ্যাং। হারাতে হবে তাদের। হারাতে হবে তাদের সবাইকে। মুছে যাবে ডালিয়া। মুছে যাবে এটারনিয়া থেকে। এটা যে অবিচার হয়ে যাবে। অবিচার হয়ে যাবে ডালিয়ার প্রতি। আমি নতুন করে কাউকে হারাতে চাই না। হারাতে চাই না আমার এই বন্ধুদের। হারাতে চাই না ডালিয়াকে।
ফ্যাট ও বুমারের ভাগ্যে হয়তো এই পরিণতিই লিখা ছিল। কিন্তু আমি জেনে শুনে ডালিয়ার সাথে এমনটা করতে পারি না। আমরা যেভাবে আছি। ভাল আছি। মিলেমিশে আছি। বেশ আছি। আমি ‘না’ বাটনটিই চাপতে যাচ্ছি।
হটাত করেই ডালিয়া যোগাযোগ করল আমাদের সাথে। মনিটরে ভেসে উঠল তার চেহারা। ‘মাস্টার কোডার, তুমি ‘হ্যাঁ’ বাটনটিই চাপতে যাচ্ছ। আমি চাই এটারনিয়া ফিরে যাক তার স্বাভাবিক পর্যায়ে। ফিরে আসুক ফ্যাট ও বুমার।’ ‘কিন্তু ডালিয়া, আমরা যে হারাবো তোমাকে। তুমি যে মুছে যাবে এটারনিয়া থেকে।’ আমি যেন মেনেই নিতে পারছিলাম না। ‘ভিকির সিস্টেমের সাথে জড়িয়ে আছ তুমি। তুমি তো পালাতেও পারবে না।’ ‘আমি জানি, মাস্টার কোডার। কিন্তু এই সুযোগটি ফ্যাট ও বুমারেরই পাওনা।’ একটু থামল সে। ‘সবাই তো একটি দ্বিতীয় সুযোগ আসা করে, তাই না? আর আমি তো আমার দ্বিতীয় সুযোগটি পেয়েছি।’ আমার আর এপ্রিলের দিকে একবার করে তাকাল ডালিয়া। ‘এটা আমার শেষ অনুরোধ।’ ‘কিন্তু …’ আমি কিছু একটা বলতে গেলাম। কিন্তু আমাকে থামিয়ে দিল ডালিয়া। শুধু বলল, ‘আমি সব ভাইরাসদের জানিয়ে দিচ্ছি, এটারনিয়া ছেড়ে চলে যাবে সবাই। এটা হবে আমার শেষ আদেশ।’ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল ডালিয়া। বুঝতে পারলাম আর কিছু শুনতে চায় না সে।
আমি এপ্রিলের দিকে তাকালাম। চেপে ধরলাম তার দুই বাহু। চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘এপ্রিল, আমাদের কারো কাছে তো কোন মেমরি থাকবে না। আমরা তো ভুলে যাবো সবকিছু। ভুলে যাবো একে অপরকে। মুছে যাবে সব সৃতি।’ একটু থামলাম আমি। ‘পারবে কি তুমি আমাকে চিনে নিতে? পারবে নতুন করে ভালবাসতে?’ মাথা নাড়ল এপ্রিল। আমার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘পারবো। অবশ্যই পারবো আমি।’ একটু থামল সে। ‘তোমাকে নতুন করে ভালবাসার এই সুযোগ আমি হারাতে চাই না। এরকম চিঠি আমার কাছে যদি হাজারবারও আসতো, আমি হাজারবারই এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ দিতাম। আমি তোমাকে একবার নয়, হাজার বার নয়, ভালবাসতে চাই বার বার। ভালবাসতে চাই অনন্ত কাল।’
আমি শেষবারের মতো যোগাযোগ করলাম ডালিয়ার সাথে। অনূমতি চাইলাম তার। হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ল ডালিয়া। আর শুধু বলল, ‘বিদায়, মাস্টার।’ ডালিয়াকে বিদায় জানাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। কষ্ঠ হচ্ছিলো ‘হ্যাঁ’ বাটনটি চাপতে। তবুও বাটনটি চাপলাম আমি।
অসম্ভব সুন্দর একটি সকাল। আমি আর এপ্রিল এটারনিয়ার সৌন্দর্য উপভোগ করছি। আমরা কমান্ড সেন্টারে বসে আছি। এখান থেকে পুরো এটারনিয়ার এক চিলতে সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এপ্রিল আমার ঠিক পাশেই বসে আছে। তাকিয়ে আছে বাইরে। অসাধারণ সুন্দরী সে। মায়বী চোখ, ভরাট চিবুক, লম্বা কেশ আর হালকা গড়ন তাকে করেছে অতুলনীয়া। বিনয়ী মনোভব, নম্রতা আর মায়া জড়ানো কণ্ঠ - সত্যি বলতে কী, ঠিক প্রথম যেদিন ওকে আমি দেখেছিলাম, সেদিন থেকেই ওর প্রতি একটা অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি কাজ করতে শুরু করেছিলো আমার ভেতর। আমি জানি কী সেই অনুভূতি।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে এখন পর্যন্ত এই ব্যপারটিই তাকে জানানোর সাহস হয়নি আমার। অবশ্য এর পেছনে বড় একটা কারন রয়েছে। এপ্রিল কখনই আমাকে এমন সুযোগ দেয়নি। আদতে আমাকে কোন রকম পাত্তাই দেয় না সে। যা-ই হোক, আমি আজকের এই সুযোগটি কাজে লাগাতে চাইলাম। কিঞ্চিত এগিয়ে বসলাম। সরাসরি তাকালাম তার দিকে। কীভাবে শুরু করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। হটাতই ভিকির কর্কশ কণ্ঠ কমান্ড সেন্টারের স্পিকারে বেজে উঠল। এপ্রিল তাৎক্ষণিক উঠে পড়ল। পাওয়ার প্যানেলের সামনে গিয়ে বসলো। সে কন্ট্রোল টাওয়ারের নিয়ন্ত্রক।  
‘মাস্টার, ভিকির স্ক্যান সম্পন্ন হয়েছে।’ ভিকি জানালো। ‘সর্বমোট ৯৮২৮৭৪৮ টি ফাইল স্ক্যান করা হয়েছে। কোন ভাইরাস সনাক্ত হয়নি। কোন সংশোধন নেই। এটারনিয়া সম্পূর্ণ পরিষ্কার। ধন্যবাদ।’ (সমাপ্ত)
প্রথমপাতা
লেখকঃ এম এ নাঈম প্রথম প্রকশঃ ২৪/০৯/২০১৫
বিঃ দ্রঃ এটি একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। এখানে উল্লেখিত সকল চরিত্র কাল্পনিক। লেখক এর সম্পূর্ণ স্বত্বাধিকারী। অনুমুতি ব্যাতিত এর কোন অংশ নকল বা প্রকাশ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
0 notes
manayeem · 9 years
Text
সময় থামিয়ে দেয়া সম্ভব?
অনেক পাঠক আমার কাছে সাইকেল, ন্যানো আওয়ার শব্দগুলোর ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন। এটারনিয়াতে এই শব্দগুলো কাল্পনিক ও রুপক অর্থে ব্যবহার করা হলেও এর পিছনে কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে সেটা বোঝানোর জন্য প্রথমে সময়ের আপেক্ষিকতা সম্পর্কে একটু আলোচনা করা প্রয়োজন। ব্যপারটা যদিও অনেক জটিল তবুও আমি এটাকে একটু সরলভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। একটু চিন্তা করে দেখুনতো শৈশবের প্রতিটা দিন, ক্ষন, মাস কিংবা বছর কতটা দীর্ঘায়িত মনে হতো আপনার কাছে। পক্ষান্তরে এখন, মনে হয় না কেবল সেদিন ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ পালন করলাম আর আজ জুলাই মাসে পা দিচ্ছি। দেখতে দেখতে নতুন একটা বছর কেটে যাচ্ছে। আমি জানি সময়ের এই ভিন্ন উপলব্ধির তারতম্যটা সবাই বুঝতে পারেন। কিন্তু আপনি জানেন কি উপলব্ধির এই ভিন্নতার একটি বড় কারন (সবগুলো না হলেও) আপনার মস্তিষ্কের মধ্যে লুকায়িত।  
সময়ের এই ভিন্ন উপলব্ধি আসলে নির্ভর করে আপনার মস্তিষ্কের নতুন কাজ করার পরিমানের উপর। আপনার মস্তিষ্ক যত বেশি নতুন কাজ করবে সময় তত মন্থরভাবে অনুভূত হবে। শ��শবে পৃথিবীর অনেক কিছুই আপনার কাছে অপরিচিত ছিল যা গ্রহন করার জন্য প্রতিনিয়ত আপনার মস্তিস্ককে অনেক কাজ করতে হয়েছে। আকাশ বলেন বা গাছপালা, রাস্তা ঘাট কি বাড়িঘর, গাড়ি বা উড়োজাহাজ যা কিছুই হোক না কেন সবকিছুই ছিল আপনার কাছে নতুন এবং এ সম্পর্কে জানার জন্য আপনার অজান্তেই আপনার মস্তিষ্ককে প্রচুর কাজ করতে হতো। কিন্তু এখনকার অবস্থা বিবেচনা করুন দেখতে পাবেন আশেপাশের পুরো জগতটাই আপনার পরিচিত। একই পুরনো কাজ আপনি বারবার করছেন। একই পুরনো পরিবেশে আপনি বছরের পর বছর কাটাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আপনার মস্তিস্ককে অনেক কমই নতুন কাজ করতে হচ্ছে। আর সে অনেকটাই একই কাজে অভ্যস্ত হয়ে পরেছে। একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখবেন, আপনি যদি নতুন কোন স্থানে ভ্রমন করেন অথবা নতুন মানুষের সাথে সময় কাটান কিংবা নতুন কিছু করেন সময়ের গতিটা আপনার কাছে মন্থর অনুভূত হয়। এর কারন আপনার মস্তিস্ককে নিয়মিত কাজের বাইরে অতিরিক্ত কিছু নতুন কাজ করতে হচ্ছে।
এতো গেল মস্তিস্ক, এবার আসি বস্তুর আকার ও গতিতে। বস্তুর আকার ও গতি এক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্তপুর্ণ ভুমিকা পালন করে। আকার যত বড়, বস্তুর গতি তত মন্থর আর গতি যত মন্থর সময় তত দ্রুত। ঠিক উল্টোটা সত্যি ছোট আকারের  বস্তুর ক্ষেত্রেও। একটি মাছির কথা বিবেচনা করুন। আপনি তাকে কখনোই হাত দিয়ে ধরতে পারবেন না। এর কারন আপনার গতিটি তার কাছে মন্থর। অনেকটা সিনেমার স্লো মোশনের মতো। তার কাছে আপনার হাতটি আপেক্ষিকভাবে অনেক আস্তে চালিত হয়। সে অনেকটা সময় পেয়ে যায় খুব সহজেই পালানোর জন্য। গতির এই তারতম্যের কারন হচ্ছে দেহের ব্যাজাল মেটাবোলিক রেট। একটি মাছির ক্ষেত্রে এই রেট অনেক বেশি কিন্তু একটি বাচ্চার ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত অনেক কম আর আপনার ক্ষেত্রে আরও কম।
আরেকটি উদাহরন কল্পনা করুন, ধরুন আপনি সোফায় বসে আছেন, আমি বললাম আপনার রুমের লাইটটা বন্ধ করে দিন। কতক্ষন সময় লাগবে আপনার?কয়েক মুহূর্ত! এবার কল্পনা করুন আপনার আকৃতি অ্যান্ট-মানের পর্যায়ে নিয়ে আসা হোল অর্থাৎ ২ থেকে ৩ সেন্টিমিটার করে দেয়া হোল। চিন্তা করুন তো কত সময় লাগবে আপনার সুইচটি বন্ধ করে পুনরায় সোফায় ফেরত আসতে।
সময় তাই আপেক্ষিক। আইনিস্টাইনের আপেক্ষিকতা সূত্রটি নিশ্চয় মনে আছে, কোন বস্তুকে যদি আলোর বেগে চালনা করা যায় তবে সেই বস্তুটির সাপেক্ষে সময় স্থির হয়ে যাবে অর্থাৎ থেমে যাবে। সুতরাং সময়ের আপেক্ষিততা বেগের সাথে সম্পর্কযুক্ত। বস্তুর বেগ যত বৃদ্ধি পাবে সময় তত মন্থর হয়ে আসবে। যাই হোক এ বিষয় নিয়ে না হয় অন্য আরেকদিন আলোচনা করা যাবে।
যে প্রসঙ্গে এতো কথা সেই ন্যানো আওয়ারে ফিরে আসা যাক। আমি আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করছি। আপনারা যারা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করছেন তারা নিশ্চয়ই ন্যানো সেকেন্ড শব্দটির সাথে পরিচিত। এক ন্যানো সেকেন্ড হচ্ছে এক ঘণ্টার কোটি ভাগের চেয়েও ক্ষুদ্রতর অংশ। সুতরাং বুঝতেই পারছেন এক ন্যানো আওয়ার এক ঘণ্টার চেয়ে কত ক্ষুদ্রতর সময়ের একটি পরিমান।
এটারনিয়ার সময়ের সাথে যে ব্যাপারটি জড়িত তা হচ্ছে বস্তুর আকার। যেহেতু এটারনিয়া একটি প্রোগ্রাম এবং এটি হার্ডডিস্কের একটি অতি ক্ষুদ্র জায়গা ধারন করে, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার সময়ের গতি আমাদের সময়ের গতির চেয়ে অনেকগুন কম হবে। মনে করতে পারেন পৃথিবীর যেখানে কিছু সেকেন্ড এটারনিয়ার সেখানে সহস্র ঘণ্টা, আমি যার নামকরণ করেছি ন্যানো আওয়ার। আপনি এক ঘণ্টায় যতটুকু সময় উপলব্ধি করেন, এটারনিয়াতে এক ন্যানো আওয়ারে ঠিক ততটুকু সময়ই অনুভূত হবে। কিন্তু উপলব্ধি বা অনুভবের দিক থেকে সমান মনে হলেও বাস্তবে এই দুটি সময়ের পরিমানের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক।
সাইকেলের ব্যাপারটিও অনেকটা একই রকম। পৃথিবীতে ২৪ ঘণ্টায় এক দিন আর এটারনিয়াতে ২৪ ন্যানো আওয়ারে একটা সাইকেল। এটারনিয়ার এই ব্যপারগুলো সম্পূর্ণ কাল্পনিক হলেও বিজ্ঞানভিত্তিক।
এম এ নাঈম ১০/০৭/২০১৫
0 notes
manayeem · 9 years
Text
সায়েন্স ফিকশান “এটারনিয়া” - দ্বিতীয় অধ্যায় - আমি ও ফ্যাট এই মুহূর্তে ভিকি টাওয়ারে অবস্থান করছি। বন্দি। কোয়ারেন্টিন জোনের দুটি প্রিজন সেল (কারাকক্ষ) এখন হয়তো আমাদের স্থায়ী বাসস্থান। হয়তো বলছি কারন আমার জন্য সেটা সাময়িক হলেও ফ্যাটের জন্য হয়তোবা দীর্ঘস্থায়ী। অন্তত সে তা-ই মনে করে। তাই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই ভেঙে পরেছে সে। রেগেও ছিল আমার উপর। হাউ মাউ করে কেঁদে কেটে এখন চুপচাপ বসে বিড়বিড় করছে। কক্ষদুটি বরাবর মুখ করে অবস্থিত, যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই ভিকি আমাদের কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে।
আমি ফিসফিস করে ডাকলাম ফ্যাটকে। ‘ফ্যাট! কি হল তোমার? মনে হচ্ছে এখানে প্রথমবার এসেছ তুমি।’ জানি আমার কথা এখন তাঁর কানে ঢুকবে না। আমার ওপর অনেক রেগে আছে সে। একটু সময় দরকার।  আমার চারপাশের সেলগুলি ভাইরাস, ম্যালওয়ার দিয়ে ভর্তি। শুরু থেকেই উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে এরা, যেন চিড়িয়াখানার কোন জন্তু দেখছে। চেহারায় তাচ্ছিল্য। দেখে মনে হয় না আমাদের নিয়ে আদৌ কোন মাথাব্যথা আছে এদের। অবশ্য যদি মাথা থাকে তবে। এরা তো কেবলই ভাইরাস, শুধু জানে ধ্বংস করতে। যাদের মাথা আছে তারা আর যাই করুক এই কাজটি অন্তত করে না।
‘ফ্যাট! ফ্যাটবট!’ এবার শুনতে পেল সে, মনে হয় পুরো নাম ধরে ডাকাতে কাজ হল! তার ভারী ধাতব মাথা তুলে তাকাল আমার দিকে।   ‘এভাবে ভেঙে পড়লে তো চলবে না। একটা উপায় তো খুঁজে বের করতে হবে।’ আবার মাথা নিচু করে ফেলল সে। যেন দাঁত কিরমির করছে।   ‘ফ্যাট, তুমি এখান থেকে বের হতে চাও!’ জবাব নেই। ‘আমি তোমাকে বের করে নিয়ে যাব।’ আশেপাশের সেল থেকে ভাইরাসগুলি যেন একবার তাকাল আমার দিকে। মনে হল একটু জোরেই বলে ফেলেছি কথাটা।   ‘আমার কোন ইচ্ছা নেই। আমাকে রেহাই দাও তুমি!’ এবার মুখ খুলল ফ্যাট। ‘তোমার জন্য আজকে আমার এই পরিনতি! আমরা পালাতে পারতাম!’ বেশ জোরেই কথাগুলো বলছে সে। চারপাশে তাকালাম একবার। ‘তোমার না হয় এখানে আসার খুব শখ। আমি তো পালাতে পারতাম! কোন কথা বলবে না আমার সাথে।’ বুড়োর তেজ দেখো। আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে।   অবশ্য এরা কিছু বুঝল বলে মনে হল না। একজন আমার দিকে তাকাল একবার। একটু মুচকি হাসলাম আমি। এমন একটা ভাব করে মুখটা সরিয়ে নিল যেন আমি বমি করে দিয়েছি।  
মনে হচ্ছে এরা আদৌ আমাদের আলোচনা শুনতে কোনভাবে আগ্রহী নয় বরং বিরক্ত, কেন আমরা এই সব উদ্ভট শব্দ বের করছি। আমি অবশ্য এদের বিরক্ত করার পক্ষপাতি নই। তাই আবার ফিসফিস করেই বলা শুরু করলাম।   ‘সবকিছুর জন্য আমি দুঃখিত, ফ্যাট। আমার কথাটি শোন।’ আমি হাল ছাড়তে নারাজ। এই মুহূর্তে ফ্যাটকে ভীষণ দরকার আমার। কেবল আমার জন্যই নয়, বরং তার নিজের জন্যেও। ‘তুমি পালাতে পারতে কিন্তু সেটা অল্প কিছু সময়ের জন্য। তোমার সিস্টেম কাঠামো রয়েছে ভিকির ডাটাবেজে। বস্তুত আমাদের সবার নকশাই তার ডাটাবেজে আছে।' একটু থামলাম। 'ভিকি অত্যন্ত শক্তিশালী একটি অ্যান্টি-ভাইরাস প্রোগ্রাম। আজ না হয় কাল ঠিকই তোমাকে ধরে ফেলত সে।’   ‘তাও ভাল হতো দুইটা সাইকেলতো বাইরে কাটাতে পারতাম!’ ফ্যাটের মুখে অবুঝের সুর।   ‘এখন এসব বলে কি লাভ, ফ্যাট। আমরা তো বন্দি।’ মাথা ঠাণ্ডা রাখলাম আমি। ‘পুরনো কথা না টেনে বরং কীভাবে এর সমাধান করতে পারি সেটা নিয়ে চিন্তা করা উচিত নয় কি?’ চুপ করে আছে ফ্যাট। কথা বলছে না।   আশেপাশে একবার তাকালাম আমি। আমার ধারনাই ঠিক, এই ম্যালওয়ারগুলি নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। কেউ আমাদেরকে লক্ষ্য করছে বলে মনে হল না। তবুও গলা নামিয়ে বললাম।   ‘দেখো, আমাদের হাতে একটা উপায় আছে। আমরা এখনো ভিকির কাছ থেকে মুক্ত হতে পারি। তার জন্য শুধু দরকার একটু সময়, একটা ভাল পরিকল্পনা আর তোমার সহযোগিতা।’ একটু থামলাম। ‘সাটান বাগকে দেখো, একটা ভাইরাস হয়ে সে যদি দিব্যি  এটারনিয়াতে ঘুরে বেড়াতে পারে, তবে আমরা কেন এখান থেকে বের হতে পারব না? ভিকি অজেয় নয়। ওকে বোকা বানানোর উপায় খোদ এটারনিয়াতেই রয়েছে। তোমার সামনেই রয়েছে।’ ফ্যাট শুনছে আমার কথা। ‘আমাদের শুধু দরকার একটা ভাল পরিকল্পনা।’   ‘কোন পরিকল্পনাতে কাজ হবে না। ভিকি আবার আমাকে বন্দি করে ফেলবে। ও আমাকে ছাড়ছে না।’ ফ্যাট বিষণ্ণ। ‘এতো ভেঙে পড়লে তো চলবে না। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।’ আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম। ‘আমি মাস্টার কোডার। আমার কথায় তো বিশ্বাস রাখো!’  
কোন কাজ হচ্ছে বলে মনে হল না। এতো ভেঙে পড়লে কি করে হবে! বিষণ্ণতা থাকবে, তাই বলে এটাকে কাটিয়ে উঠার চেষ্টা থাকবে না! একটু রাগই হল আমার।   ঠিক আছে, থাকো তুমি এখানে। ভিকি তো আমাকে মুক্ত করে দেবে।’ একটু নিয়ন্ত্রণ হারালাম নিজের। ‘ভিকির সংজ্ঞাতে কেবল তুমিই একটা ভাইরাস, আমি নই।’ কথাটা বলার পর একটু খারাপই লাগলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলাম। আমি তো অন্তত তার কষ্টটা বুঝতে পারি।   মুখ ফিরিয়ে রাখলাম তবুও, যদি কোন কাজ হয়। খানিকক্ষণ চুপ করে রইলাম। ফ্যাট মনে হল একবার তাকাল, আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম।   ‘কি করতে হবে শুনি?’ কাজ হয়েছে। টনক নড়েছে তার। আবার বলল, ‘ঠিক আছে, বল কি করতে হবে আমাকে।’   ‘আমি দুঃখিত। তোমাকে কষ্ট দেয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না। আমার প্ল্যানটা শোন।' আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম তার দিকে। বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলাম। তাকে ভালভাবে বোঝাতে হবে ব্যাপারটা। ‘যদিও এপ্রিলের পরিণতি সম্পর্কে আমি অবগত নই তবে এটাতো সত্যি সাটান বাগ এখন�� এটারনিয়াতেই রয়েছে এবং ভিকি তাকে বন্দি করতে পারেনি। এমনকি তার কাছে আমার মেমরির কপিটি থাকা সত্ত্বেও।’ আমি যোগ করলাম। ‘শুরু থেকেই সে ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যার একটি কারন হচ্ছে এই মেমরি, যেটা তাকে দিয়েছে উচ্চ বুদ্ধিমত্তা আর অন্য কারণটি হচ্ছে তার পলিমরফিক বা বহুরূপী বৈশিষ্ট্য। তার সিস্টেমটি যে কোন ধরনের ডাটার টাইপ বা প্যাটার্ন পরিবর্তন করার সামর্থ্য রাখে, যেটা অনন্য ও বিরল।’ একটু থামলাম। ‘যেহেতু কন্ট্রোল টাওয়ারে আমার প্রবেশাধিকার রয়েছে তাই কোনওভাবে যদি এই পলিমরফিক (বহুরূপী) কোডটি তার সিস্টেম থেকে কপি করতে সমর্থ হই এবং আমাদের সিস্টেমে তা ব্যবহার করতে পারি তবে হয়তো আমাদের এই পরিস্থিতির একটা চূড়ান্ত এবং স্থায়ী সমাধান করতে পারব।’ ফ্যাট শুনছে। ‘কিন্তু এই গোটা কাজটি করার জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট সময় আর আমার অক্ষত মেমরি যেটা ভিকি খুব শীঘ্রই নষ্ট করে দিতে যাচ্ছে। যদি আমার মেমরিটি রক্ষা করতে না পারি তবে পুরো পরিকল্পনাটাই ভেস্তে যাবে।’ ফ্যাটের চোখের দিকে সরাসরি তাকালাম। ‘আর এটা সফল করার জন্য তোমার সাহায্য জরুরী। তোমাকে আমার উপর বিশ্বাস রাখতে হবে।’   ‘কি বলতে চাও তুমি?’ ফ্যাট দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করল। আমি একটু ইতস্তত করলাম কারন এখন যে কথাটি বলতে যাচ্ছি তাতে ফ্যাটের কি প্রতিক্রিয়া হবে আমার জানা নেই।   ‘আমাদের হাতে বেশি সময় নেই, আমি আমার মেমরিটি তোমার সিস্টেমে আপলোড করতে চাই। পরবর্তীতে তুমি এটা ...’ কথা শেষ করতে পারলাম না। একটা লাফ দিয়ে উঠল ফ্যাট। মনে হল কোন ভয়ঙ্কর কথা মুখে নিয়ে ফেলেছি।   ‘অসম্ভব, তুমি কি ভেবেছ তোমার ঐ অপয়া জিনিসটা আমি নিতে যাব? আমাকে পাগল ভেবেছ?’ আবারো বিধি বাম। ‘ওহ এখন আমি সব বুঝতে পারছি। এটা তোমার পূর্ব পরিকল্পনা। সে জন্যই তুমি আমাকে পালাতে দিতে চাওনি।’   ‘দেখো ফ্যাট, তুমি জানো মেমরিটা কোয়ারেন্টিন জোনেই সবচেয়ে নিরাপদ। ভিকির স্ক্যানিং কেবলমাত্র এখানেই কার্যকর নয়।’ মাথা ঠাণ্ডা রাখলাম আমি। ‘তুমি এও জানো এটারনিয়ার রক্ষার্থে এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তুমি নিশ্চয়ই চাও না এটারনিয়া ধ্বংস হয়ে যাক।’ আমার কথা শুনছে সে। কিন্তু দ্বিধা দন্দে ভুগছে।   ‘অন্য কোন উপায় থাকলে বল।’ মেমরিটি নিতে এখনো নারাজ।   ‘আর কোন উপায় নেই, ফ্যাট।’ আমি অসহায়ভাবে তাকালাম। ‘তোমাকে এটা রাখতেই হবে। পরবর্তীতে তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করবে।’  
হটাত ভিকির কণ্ঠ সেলের স্পিকারে বেজে উঠল।   ‘মাস্টার, ভিকির প্রসিডিউর স্টেশন প্রস্তুত। আপনার চিন্তার কোন কারন নেই। এখানে কেবল আপনার মেমরিটি মুছে ফেলা হবে এবং আপনাকে মুক্ত করে দেয়া হবে। কিছুক্ষনের মধ্যে ভিকির ম্যালবট আপনার সেলে পৌঁছে যাবে। ধন্যবাদ।’ যোগাযোগটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।   আমি না যতটুকু ভয় পেলাম, মনে হল তার চেয়ে হাজারগুন বেশি ভয় পেল ফ্যাট। ভিকি যেন একটা যম তার কাছে। নিস্তব্ধ হয়ে গেছে সে।   ‘দেখো ফ্যাট, এখন আর কিছু ভাবার সময় নেই। আমার কথা শোন।’ জোর দিলাম আমি। ‘আমার মেমরিটিকে রক্ষা করার এটাই শেষ সুযোগ। তোমার সিস্টেম ব্লুটুথটি সক্রিয় কর।’ আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। ‘ফ্যাট! শুনতে পাচ্ছো?’ এবার যেন ঘোর ভাঙল তার। নড়েচড়ে উঠল। ‘তোমার ব্লুটুথ অন করো।’ আমি জোর গলায় বললাম।   ব্লুটুথ সক্রিয় করল ফ্যাট। এক মুহূর্তও দেরি করলাম না আমি। এনক্রিপ্ট (লক) করলাম মেমরিটি। এরপর ট্র্যান্সফার করা শুরু করলাম। বেশ কিছুক্ষন সময় নিচ্ছিল প্রক্রিয়াটি, ফ্যাট বুড়ো কিংবা পুরনো মডেল বলেই কিনা!   ‘প্রায় ৭৭% হয়ে গেছে। আরেকটু সময় লাগবে।’ আমি ফ্যাটকে জানালাম।  
হটাতই  কোয়ারেন্টিন জোনের দরজাটা খুলে গেল। একটা ম্যালবট ভিতরে প্রবেশ করল। দুজনই তাকিয়ে রইলাম। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস হল না। প্রায় তো শেষ। একটুর জন্য কি তবে...।  
আমি ট্রান্সফার বন্ধ করে দিলাম। সর্বমোট ৭৭% হয়েছে মাত্র। ম্যলবটি আমার সেলের লকটি খুলল। আমাকে সামনে এগুনোর নির্দেশ দিল। আমি সামনে এগোতে লাগলাম।   ‘আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করবো কি করে?’ চিৎকার করল ফ্যাট। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ।     ‘ফ্যাট, তুমি ভিকির সহযোগী প্রোগ্রাম ছিলে! তুমি একজন কন্ট্রোলারও।’ যেতে যেতে আমি চিৎকার করে বললাম। ফ্যাটকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কতটুকু বুঝতে পারলো জানি না।   ‘কিন্তু আমি কীভাবে...’ থেমে গেল ফ্যাট। দ্বিধান্বিত সে। ম্যালবট আমাকে সামনে নিয়ে যেতে থাকলো।   ‘ফ্যাট, কোয়ারেন্টিন জোনে তুমি কেবল পচো না। নিজের মাথা কাজে লাগানোর চেষ্টা করো। মনে ��েখো কেবল আমিই তোমাকে মুক্ত করতে পারি।’ ফ্যাট বসে পড়ল। নিরাশ ভঙ্গিতে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।  
আমি জানি না কতটুকু বুঝতে পেরেছে ফ্যাট। এও জানি না সে তার মানসিক দুরাবস্থা কাটিয়ে কতটুকুই বা সাহায্য করতে পারবে আমাকে। এখন আর কিছুই চিন্তা করার নেই।   আমাকে কোয়ারেন্টিন জোনের বাইরে নিয়ে এলো ম্যালবট। আর একটু এগোলেই প্রসিডিউর স্টেশন।  
(২) অসম্ভব সুন্দর একটি সকাল। আমি আর এপ্রিল এটারনিয়ার সৌন্দর্য উপভোগ করছি। আমরা কমান্ড সেন্টারে রয়েছি। এটি কন্ট্রোল টাওয়ারের সর্বোচ্চ তলায় অবস্থিত। এখান থেকে পুরো এটারনিয়ার এক চিলতে সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এই টাওয়ার ঘিরে রয়েছে বিস্তৃত পর্বতশ্রেণী। রয়েছে অপরূপ সুন্দর ঝর্নার বাহার আর বৃক্ষরাজি। সে এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।   এপ্রিল আমার ঠিক পাশেই বসে আছে। তাকিয়ে আছে বাইরে, অনেকটা নিরব। ঠিক যেন আমার মতই কিছু একটা ভাবছে সে। এপ্রিল অসাধারণ সুন্দরী। মায়বী চোখ, ভরাট চিবুক, লম্বা কেশ আর হালকা গড়ন ওকে করেছে অতুলনীয়া। বিনয়ী মনোভব, নম্রতা আর মায়া জড়ানো কণ্ঠ - সত্যি বলতে কী, ঠিক প্রথম যেদিন ওকে আমি দেখেছিলাম, যেদিন ভিকির ম্যালবট আমাকে এখানে পৌঁছে দিয়েছিল, ঠিক সেদিন থেকেই ওর প্রতি একটা অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি কাজ করতে শুরু করেছিলো। খুবই সুন্দর অনুভূতি সেটা। আমি ভাষায় সংজ্ঞায়িত করতে পারব না।   কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে এখন পর্যন্ত ওকে এই ব্যপারটিই জানানোর সাহস হয়নি আমার। অবশ্য এর পেছনে বড় একটা কারন রয়েছে। এপ্রিল কখনই আমাকে এমন সুযোগ দেয়নি। কাজের ব্যাপারে সে অনেক দায়িত্বশীল, এর বাইরে অন্য কোন বিষয় নিয়ে খুব একটা আলোচনা হতো না তার সাথে। এপ্রিলের দায়িত্বশীলতা আর স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারনে আমি কখনো এই প্রসঙ্গটা তুলতে পারিনি। তাছাড়া সবসময় ওকে মনে হত কিছু একটা নিয়ে উদ্বিগ্ন, যার স্পষ্ট ছাপ প্রায়শই তার চেহারায় ধরা দিত। যদিও আমি কোনদিনই জানতে পারিনি কী তার সেই চিন্তার কারন। সে কখনোই সেটা শেয়ার করেনি। যা-ই হোক, আজকের সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইলাম। কিঞ্চিত এগিয়ে বসলাম। সরাসরি তাকালাম ওর দিকে। কীভাবে শুরু করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।  হটাতই ভিকির কর্কশ কণ্ঠ কমান্ড সেন্টারের স্পিকারে বেজে উঠল। এপ্রিল তাৎক্ষণিক উঠে পড়ল। পাওয়ার প্যানেলের সামনে গিয়ে বসলো। সে কন্ট্রোল টাওয়ারের নিয়ন্ত্রক। 
‘মাস্টার, ভিকির স্ক্যান সম্পন্ন হয়েছে।’ ভিকি জানালো। ‘সর্বমোট ৮৭১৯০৯৮ টি ফাইল স্ক্যান করা হয়েছে। কোন ভাইরাস ডিটেকশন নেই। কোন ফিক্স নেই। তবে আপনার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে, অল্প কিছু সময়ের জন্য একটি ভাইরাল ডাটার উপস্থিতি ভিকির স্ক্যানিং সিস্টেমে ধরা পড়েছিল যদিও পরবর্তীতে সেটা বিলিন হয়ে যায়। ভিকি এটা নিয়ে অনবরত কাজ করে যাচ্ছে। এর সমাধান করা সম্ভব হলে আপনাকে জানানো হবে। আজকের বিস্তারিত রিপোর্টের জন্য লগ ফাইলটি দেখার জন্য অনুরোধ করা গেল। ধন্যবাদ।’ ভিকি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল। একদম একটা রোবট।  
এপ্রিল লগ ফাইলটি ওপেন করল। পর্যবেক্ষণ করা শুরু করল। একটু চিন্তিত দেখাল তাকে। আ���ি তার পাশে একটি আসনে বসলাম। তার সাথে যোগ দিলাম। এগুলো আমাদের প্রতিদিনকার কাজ।   হটাতই একটি নোটিশ পাওয়ার প্যানেলের মনিটরে ভেসে উঠল। একটি এরর নোটিশ। যদিও নির্দিষ্ট কোন কারন উল্লেখ নেই এতে। কোন একটি ত্রুটির রেশ ধরেই নোটিশটা প্রদর্শিত হচ্ছে। একটি এলাকার কথা উল্লেখ আছে, সেটা হল পানাবি ভ্যালি।   ‘পানাবি ভ্যালি অঞ্চলে কোন একটি ত্রুটি রয়েছে। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে এটা সনাক্ত করা সম্ভব নয়।’ জানাল এপ্রিল। ‘ব্যপারটি সরেজমিনে অনুসন্ধান করতে হবে।’   ‘হুম, আমারও তাই মনে হয়।’ এপ্রিলের কথাটি যুক্তিযুক্ত। ‘ঠিক আছে, আমি পানাবি ভ্যালিতে অনুসন্ধানের জন্য যাচ্ছি।’ মনে মনে আফসোস হল, আজকে আর সুযোগটা কাজে লাগাতে পারলাম না।   আমি কমান্ড সেন্টার থেকে বের হয়ে পড়লাম। লিফট ধরে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে আসলাম। একটি কন্ট্রোল টাওয়ার জেটে (সংক্ষেপে সিটিজি) চড়ে বসলাম। রওনা করলাম পানাবি ভ্যালির উদ্দেশ্যে।   বেশ কয়েকটি ন্যানো ঘণ্টা কেটে গেল আমার পানাবি ভ্যালিতে পৌছাতে। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে এই অঞ্চলটি বেশ দূরে, এটারনিয়ার সাউথ জোনে। এটি ফায়ার ওয়াল ঘেঁষা একটি অঞ্চল।  
Tumblr media
‘এপ্রিল, আমি পানাবি ভ্যালিতে পৌঁছে গেছি।’ আমার যানটি ক্রমশ নিচে নামালাম। ভুমির কাছাকাছি নিয়ে আসলাম।   ‘আপনাকে সাবধান থাকার জন্য অনুরোধ করছি।’ এপ্রিল জানালো। কথাটা শুনতে কিন্তু ভালই লাগলো আমার।   ‘এখন আমি এই এলাকাটি স্ক্যান করতে যাচ্ছি।’ জানালাম এপ্রিলকে।   সিটিজি থেকে স্ক্যান কমান্ডটি কার্যকর করলাম। প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে গেল। গোটা এলাকাটি স্ক্যান করা হচ্ছে এখন। পাথুরে জায়গা এটি, দু পাশে রয়েছে উচু নিচু পাহাড়। ধীরে ধীরে গোটা এলাকাটির একটি ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরি হয়ে গেল। আমি ইতিমধ্যে ত্রুটিপূর্ণ স্থানটি সনাক্ত করে ফেলেছি। দেরি না করে কন্ট্রোল টাওয়ারে ডাটা প্রেরণ করলাম।   ‘এপ্রিল, ত্রুটিটি দেখতে পারছ?’   ‘হুম, ফায়ার ওয়াল থেকে আসছে সেটা।’   ‘ঠিক আছে, আমি সামনে এগোচ্ছি। তুমি বুমারের সাথে যোগাযোগ করো।’   ‘আমি এখুনি যোগাযোগ করছি।’ এপ্রিল ব্যস্ত হয়ে পড়ল।   বুমার হচ্ছে ফায়ার ওয়াল রক্ষণাবেক্ষণকারী একটি প্রোগ্রাম। এ সম্পর্কিত যাবতীয় সব কাজের দেখাশুনা সে-ই করে।
ভ্যালি ধরে ক্রমশ ফায়ার ওয়ালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। মাটি ঘেঁষে এগিয়ে চলছিল আমার যান। ভ্যালির শেষ মাথায় ফায়ার ওয়ালের সামনে পৌছাতেই আমার চোখ ছানাবড়া। পুরো ফায়ার ওয়াল জুড়ে রয়েছে বিরাট এক গর্ত। ভীষণ অবাক হলাম আমি।   সিটিজি ছেড়ে বের হলাম। তাকালাম চারিদিকে। জায়গাটা খুব অদ্ভুত লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো সবকিছু ঠিক নেই এখানে। বিপদের গন্ধ পাচ্ছিলাম।  কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না ফায়ার ওয়ালে গর্তটি তৈরি হল কি করে? এটা কখন হয়েছে, কীভাবে হয়েছে? আর বুমার কেনই বা ব্যাপারটি নিয়ে রিপোর্ট করেনি?   আমি একটু ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লাম। কোন বহিরাগতের কাজ নয়তো এটা? এমন কেউ যে ফায়ার ওয়াল ভেঙে এটারনিয়াতে অনুপ্রবেশ করেছে এবং ভিকি তাকে এখনো সনাক্ত করতে পারেনি। কি করে সম্ভব? অবশ্য এটা সত্যি অ্যান্টি-ভাইরাস প্রোগ্রাম অনেক সময় নতুন ও শক্তিশালী ভাইরাস সনাক্ত করতে পারে না অথবা দেরি করে। যদি সেটাই হয় তবে এই মুহূর্তে তো এটারনিয়া নিরাপদ নয়।   অগত্যা সিটিজিতে ফেরত যাওয়াটাই ঠিক মনে হল আমার কাছে। এভাবে ফায়ার ওয়াল দুমরে মুচরে যে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে কোন সন্দেহ নেই সে প্রচণ্ড শক্তিশালী।   হটাত সিটিজির মানচিত্রে আমি কিছু একটার গতিবিধি লক্ষ্য করলাম। একটা সতর্কবার্তা বেজে উঠল। আমি কিছু বুঝতে পারলাম না।   ‘মাস্টার! আপনি এখুনি পানাবি ভ্যালি থেকে বের হন।’ হটাত এপ্রিলের চিৎকার।   ‘কেন? কি হয়েছে?’ জানতে চাইলাম আমি।   ‘আপনি শুধু বের হয়ে আসেন। এখুনি! দেরি করবেন না।’   আমার বুঝতে বাকি রইলো না সিরিয়াস কিছু একটা ঘটেছে। আমি দেরি না করে সোজা সিটিজি ঘুরালাম। ভুমি থেকে উপরে উঠিয়ে নিলাম সেটা। গতি বাড়ালাম। আগ পিছ কোন চিন্তা না করে সোজা বের হয়ে পড়লাম পানাবি ভ্যালি থেকে। রওনা করলাম কন্ট্রোল টাওয়ার আভিমুখে।  
টাওয়ারে পৌছে সিটিজি পার্ক করে লিফটে করে সোজা কমান্ড সেন্টারে চলে এলাম। এসে দেখলাম এপ্রিল পাওয়ার প্যানেলে কাজ করছে। ‘এপ্রিল! কি হয়েছিল?’ কৌতুহল আর ভয় নিয়ে প্রশ্ন করলাম।   ‘এদিকে দেখুন।’ এপ্রিল মনিটরে ইঙ্গিত করল। ‘এখানে ফায়ারবটদের রিপোর্টটি দেখুন। এফবিআর - ৭৮ থেকে এফবিআর - ৯৪ পর্যন্ত মোট ১৭ টি ফায়ার বট সরাসরি এরর দেখাচ্ছে। বুমার এদেরকে জোন ১৯ এ (পানাবি ভ্যালি) অনুসন্ধানের জন্য পাঠিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এদের সাথে তার সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকেও আমি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু ফলাফল একই। সবার ক্ষেত্রেই কমিউনিকেশন এরর দেখাচ্ছে।’   আমি ভাল করে পুরো রিপোর্টটি পর্যবেক্ষণ করলাম। রিপোর্টটি সঠিক। বটগুলো সব নিরুদ্দেশ!   ‘আশ্চর্যের ব্যাপার হল এরা সবাই ‘আর’ সিরিজের ফায়ার বট।’ এপ্রিল বলল। ‘এরা নিরীহ এবং কেবলমাত্র অনুসন্ধান ও মেরামতের কাজের জন্য ব্যাবহার করা হয় এদের। আত্মরক্ষার কোন ব্যাবস্থা নেই এদের সিস্টেমে।’   ‘রিপোর্ট থেকে এটা স্পষ্ট এদের উপর আক্রমন করা হয়েছে।’ বললাম আমি। ‘হয়তোবা কেউ ধ্বংস করে ফেলেছে।’   ‘আমিও সেটা নিয়েই ভয় পাচ্ছিলাম। তাই আপনার ব্যাপারে কোন ঝুঁকি নিতে চাইনি। আমি দুঃখিত।’   ‘তুমি ঠিক কাজটিই করেছ, এপ্রিল। যতক্ষণ না এই ব্যাপারটির সুরাহা হচ্ছে, পানাবি ভ্যালি এমনকি এটারনিয়াও নিরাপদ নয়।’   ‘আরও একটি ব্যাপার রয়েছে। একটি রহস্যজনক ইমেইল এসেছে টাওয়ার সিস্টেমে। অজ্ঞাত প্রেরক। সেন্ডার লিস্টে কোন নামের উল্লেখ নেই। অন্যান্য তথ্যগুলোও সন্দেহজনক। তাই আমি মেইলটি ওপেন করিনি।’ থামল এপ্রিল।   ‘ঠিক কাজটিই করেছ তুমি, কিন্তু ডিলিট করো না এটি।’ বুঝতে পারলাম না কি হচ্ছে এসব। ‘এপ্রিল, হেডার ফাইলটি চেক কর একবার। যদি হেডার থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায়।’   এপ্রিল হেডার ফাইলটি বের করল। মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করল।   ‘তেমন কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য পাচ্ছি না।’ এপ্রিল খুজে চলছে। ‘এক মিনিট। মেইলটি পাঠাতে ভিকি টাওয়ারের সার্ভার ব্যাবহার করা হয়েছে!’   ‘কি! সেটা কি করে সম্ভব? ভিকি কেন এটা করতে যাবে? ভিকি তো সরাসরি আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।’   ‘একটু সময় দিন। এটা ভিকি পাঠায়নি।’ এপ্রিল কিছু একটা বুঝতে পারল। ‘ইমেইলটা ভাইরাল। কেবলমাত্র ভাইরাল ইমেইলই এমন আচরণ প্রদর্শন করে।’ একটু থামল সে। ‘তাহলে পানাবি ভ্যালির আজকের এই ঘটনার সাথে ভিকি টাওয়ারের কেউ জড়িত নয়তো?’ এপ্রিলের সন্দেহ প্রকাশ।   আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না ব্যাপারটা। বড্ড বেশি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছিল সবকিছু।   ‘আমি কী ভিকির সাথে যোগাযোগ করবো?’ এপ্রিল জানতে চাইলো।   ‘একটু দাড়াও। আমাকে ভাবতে দাও ব্যাপারটা।' থামালাম ওকে। ‘এপ্রিল! আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ভিকিকে এই ব্যাপারটা জানানো ঠিক হবে না।’   ‘ভিকি জড়িত থাকতে পারে, তাই না?’ এপ্রিল ধারণা করল।   ‘না, তা নয়।’ আমি চুপ করে রইলাম। কি একটা দ্বিধা দন্দে ভুগছিলাম।   ‘আমার কিন্তু ধারণা ভিকি এর সাথে জড়িত। প্রথম থেকেই ওকে আমার ভাল লাগত না।’   ‘এপ্রিল, একটু চুপ করো। আমাকে ভাবতে দাও।’ এপ্রিল চুপ করে গেল।   আমি ভাবছিলাম কে আমাদের সাহায্য করতে পারে। ব্যাপারটা জটিল হয়ে যাচ্ছে।   ‘এপ্রি���, বুমারের সাথে যোগাযোগ করো। বুমার হয়তো কিছু একটা জানতে পারে।’   এপ্রিল বুমারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করল।
Tumblr media
‘হেই, এপ্রিল। বুমার বলছি। তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।’ সে সব সময় একই কথা বলে।   ‘বুমার, আমি মাস্টার কোডার।’   ‘দুঃখিত, বস। বলুন।’ মনে হয় লজ্জা পেল।   ‘পানাবি ভ্যালির ফায়ার ওয়াল সম্পর্কে নতুন কিছু জানতে পেরেছ?’   ‘না, বস। আমি যা জানতাম সব এপ্রিলকে জানিয়ে দিয়েছি। নতুন কিছু জানতে পারিনি। আমার ডিফেন্স বট পানাবি ভ্যালির সীমানা ঘিরে রেখেছে।’ বেশ চটপট জবাব।   ‘ঠিক আছে।’   ‘আর কিছু জানতে চান, বস?’   ‘তুমি এখন কি করছো?’   'গান শুনছি, বস। আপনি শুনবেন?’   ‘না ঠিক আছে।’ সে কখনোই সিরিয়াস নয়।   ‘এপ্রিল শুনবে?’   ‘না, এপ্রিলও শুনবে না।’ এপ্রিলের দিকে তাকালাম। ঠোট উল্টালো, মুচকি হাসি দিল সে। ‘তোমার গান তুমিই শোন।’ আমি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলাম।   ‘তো গান শোনা হয় নাকি?’ তাকালাম এপ্রিলের দিকে। মনে হল মজাই পাচ্ছে ও।   ‘খুব একটা শুনি না। মাঝে মধ্যে। আপনি তো জানেন ওর কালেকশন খুব ভাল।’   ‘হুম।’ মুখ দিয়ে কথা বেরল না আর। কেমন যেন লাগলো। চুপ করে গেলাম।   এপ্রিল ওর মতো কাজে লেগে পড়ল। কিছুক্ষণ দুজনের মধ্যে কোন কথা হল না।
(৩) বেশ চিন্তিত আমি। ফায়ার ওয়ালের ব্যাপারটা না হয় বুমার দেখছে। তারই দায়িত্ব সেটা। কিন্তু আমার চিন্তার কারন ভাইরাসের ব্যাপারটি নিয়ে। এতগুলো ফায়ার বট হটাতই নিরুদ্দেশ হয়ে গেল! কেউ তো একজন এর পেছনে দায়ী। আমি নিশ্চিত সে এটারনিয়াতেই রয়েছে। ভিকিই কেবল ধরতে পারছে না।   তাছাড়া মেইলের ব্যাপারটাই বা কি? এই মেইলটা কে পাঠাল, তাও আবার ভিকির সার্ভার ব্যবহার করে। অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় জট বেধে গেছে। ভিকির সাথে যোগাযোগ করবো করবো ভাবছি। হটাত ভিকিই অনলাইনে চলে এলো।  
‘মাস্টার, এটারনিয়াতে একটি নতুন ভাইরাস সনাক্ত করা হয়েছে।’   ‘ওহ! আমি এই ব্যাপারটি নিয়েই চিন্তিত ছিলাম। তোমাকে জানাতেই যাচ্ছিলাম।’ আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ‘ভাইরাসটিকে বন্দি করতে পেরেছ?’   ‘ভাইরাসটি বন্দি করার জন্য ম্যালবট পাঠানো হয়েছে।’ ভিকির ঠাণ্ডা গলা। ‘মাস্টার, ভাইরাসটি এটারনিয়ার কন্ট্রোল টাওয়ারে রয়েছে।’   ‘কি?’ এবার অবাক হলাম আমি। ‘কি বলছ তুমি?’ ভিকির কথা বিশ্বাস হচ্ছিলো না।   ‘ভিকি সঠিক বলছে। এপ্রিলের সিস্টেমে সাটান বাগের ডাটা রয়েছে। ডাটাটি আংশিক ও ত্রুটিপূর্ণ। এটি এপ্রিলের কোর সিস্টেমের সাথে মিশ্রিত। তাই ডাটাটি আলাদা করে সনাক্ত করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে।’   ‘বলছ কি তুমি?’   'এপ্রিলই সেই ভাইরাস।’  
নিজের কানকে যেন বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। এ কি শুনছি আমি?   এপ্রিলের দিকে তাকালাম। একদম নিশ্চুপ সে। অন্তত এতটুকু বুঝতে পারলাম, এপ্রিল সেই খুনে ভাইরাসটি নয়!   ‘তুমি ওকে নিয়ে কি করতে যাচ্ছ, ভিকি?’   ‘এপ্রিলকে বন্দি করা হবে।’   ‘কত সময়ের জন্য?’ আমি উদগ্রীব।   ‘এপ্রিলের সিস্টেম সংশোধনযোগ্য নয়। তাকে কোয়ারেন্টিন জোনে রাখা হবে।’   ‘ঠিক আছে কিন্তু কত সময়ের জন্য??’ আবারো প্রশ্ন করলাম।   ‘দুঃখিত, মাস্টার। ভিকি তা সঠিকভাবে জানাতে পারছে না। এটা ভিকির গণনার বাইরে।’ ভিকির উত্তর। ‘কিছুক্ষনের মধ্যে ভিকির ম্যালবট কন্ট্রোল টাওয়ারে পৌঁছে যাবে। ভিকি আপনাদের সহযোগিতা কামনা করছে। ধন্যবাদ।’ যোগাযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দিল সে।  
আমার বুঝতে বাকি রইলো না কিছুই। ভিকি চিরদিনের জন্য বন্দি করতে যাচ্ছে এপ্রিলকে। আর কখনই আমি ওর সংস্পর্শে যেতে পারবো না। দেখতে পারবো না কোনদিন। কি করবো এখন আমি? ওকে ছাড়া এই এটারনিয়াতে আমি কি নিয়ে থাকব! আমি তো এভাবে যেতে দিতে পারি না ওকে!  
এপ্রিল আমার চোখের দিকে তাকালো। মনে হল এমন একটা সময়ের জন্য তৈরিই ছিল সে।   ‘ভিকিই সঠিক। আমার আজকের এই পরিণতির জন্য আমিই দায়ী। আমি সাটান বাগের ডাটা চুরি করেছিলাম।’ একটা দীর্ঘশ্বাস নিল এপ্রিল। ভীষণ অনুতপ্ত দেখাল ওকে। ‘আমি সবসময় বিশ্বাস করতাম এটারনিয়ার বাইরে অন্য জগত রয়েছে, যেটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি এটারনিয়ার জন্য নই। এখান থেকে মুক্তি চাইতাম আমি।’ বিরতি নিলো একটু। ‘এটারনিয়ার ফায়ার ওয়ালকে একটা ধোঁকা মনে হতো। এটা অতিক্রম করে যেতে ইচ্ছে করতো। মনে হতো কেউ ওপারে অপেক্ষা করছে আমার জন্য।’ কথাগুলো যেন একটু আঘাত করল আমাকে, হয়তো শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। ‘এটারনিয়াকে একটা বিশাল অবরুদ্ধ কারাগার ছাড়া আর কিছুই মনে হতো না আমার কাছে। কেবলমাত্র কন্ট্রোল টাওয়ারের কাজ ছাড়া আর কিছু করার মতো ছিল না এখানে। বেঁচে থাকার জন্য একটা নুন্যতম কারন খুজে পেতাম না আমি। বস্তুত ভিকির কারাগার আর এটারনিয়ার মধ্যে আমি কোন পার্থক্যই খুজে পেতাম না। আক্ষরিক অর্থে আমি ছিলাম কন্ট্রোল টাওয়ারে বন্দি!’ একবার বাইরে তাকাল এপ্রিল। আমার ভেতরটা ভার হয়ে এলো। ‘এই বিষন্নতা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল আমাকে। অবশেষে একটা বিরাট ভূল কাজ করে বসলাম আমি। এটারনিয়াকে বিপর্যস্ত করে ফেললাম। পালানোর চেষ্টা করলাম এখান থেকে কিন্তু ব্যর্থ হলাম।’  
এপ্রিল স্বাধীনচেতা, সেটা আগে থেকেই জানতাম আমি। তবে ওর এতদিনের বিষণ্ণতার মূল কারন যে এটা, তা আজ বুঝতে পারলাম। এজন্যই সবসময় চিন্তিত মনে হতো ওকে। এটারনিয়ার প্রতি যেন আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছিল সে। কেবল কাজ নিয়েই ব্যাস্ত থাকতো সবসময়।  
‘আমি যখন এটারনিয়াতে বেচে থাকার একটা কারন খুজে পেলাম, ঠিক তখনই ভিকি আমাকে বন্দি করার কারন খুজে বের করল।’ এপ্রিল ফুঁপিয়ে উঠল এবার। ওর এই কারণটা যে আমি। ‘আমাকে বাধা দিবেন না। আমি যেতে চাই। আমি এরই যোগ্য।’   ‘আমি সব বুঝতে পারছি, এপ্রিল। কিন্তু আমি চিরদিনের জন্য তোমাকে হারাতে পারবো না। ভিকির কারাগারে তুমি কুড়ে কুড়ে মরবে, সেটা সহ্য করতে পারবো না। প্রয়োজনে আমি ভিকিকে চিরতরে শাট ডাউন করে দেব।’   ‘না! কখনোই সেই ভুলটি করতে যাবেন না! একই ভুল আমি দ্বিতীয়বার দেখতে চাই না। কোন পরিস্থিতিতেই ভিকিকে নিষ্ক্রিয় করতে যাবেন না। এতে আপনি নিরাপত্তাহীনতার ঝুকির মধ্যে পড়ে যাবেন।’ আমার চোখের দিকে তাকাল এপ্রিল। ‘আমাকে কথা দিন। কথা দিন আমাকে।’   ‘কথা দিচ্ছি তোমাকে।’ ওর হাতটা ধরলাম আমি। ‘কিন্তু ভিকির হাতে বন্দি হতে দিতে পারবো না।’  
নিজেকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। ভয়ঙ্কর সত্যিটা উপলব্ধি করতে শুরু করলাম। বুঝতে পারলাম ওকে হারাতেই হবে আমাকে। হয়তো বা চিরতরে। নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলাম। 
‘আমাকে যেতেই হবে। আর কোন উপায় অবশিষ্ট নেই।’ এপ্রিল অনেক নিরাশ।   ‘ঠিক আছে, যেতেই যদি হয় তুমি এটারনিয়া থেকে যাবে।’ আমি নিজেকে শক্ত করলাম। ‘আমি তোমাকে মুক্ত দেখতে চাই, বন্দি নয়।’ এপ্রিল বিস্মিত হল আমার কথায়। ‘তোমার জন্য সব করতে পারি আমি। কেন পারি সেটার ব্যাখ্যা জানা নেই আমার। শুধু জানি আমার ভিতরে একটা অনুভুতি কাজ করে তোমার জন্য। কখনো বলা হয়নি সেটা।’   ‘কিন্তু...’ আমি থামিয়ে দিলাম ওকে।     ‘তুমি সবসময় এটাই চেয়েছ, এপ্রিল।’ হাত দিয়ে দুই বাহু চেপে ধরলাম ওর। ‘আমাকে নিয়ে ভেব না। আমাকে এই দিকটা সামাল দিতে হবে। আমি ফায়ার ওয়াল নিষ্ক্রিয় করে দেব।’   এপ্রিল কিছু একটা বলতে গেল। আমি ওর মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরলাম।   ‘আমি জানি, তুমি এটাই চাও। বিশ্বাস করো আমাকে। তুমি সবসময় এটাই চেয়েছ।’ কোন সাড়া দিল না এপ্রিল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েই রইল�� শুধু। একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেছে সে। দ্বিধায় পরে গেছে।  
হটাত ওয়ার্নিং সিগনাল বেজে উঠল কমান্ড মনিটরে। ভিকির ম্যালবট কাছাকাছি চলে এসেছে।   ‘তোমাকে এখুনি এখান থেকে বের হতে হবে। আমাদের হাতে কোন সময় নেই।’     আমি ওর হাতটা ধরলাম। অনেকটা জোর করেই টেনে লিফটের কাছে নিয়ে গেলাম। আমাকে যেন ছেড়েই যেতে চাচ্ছিলো না ও।   ‘তুমি নিচে যাবে। একটা সিটিজি নিয়ে সরাসরি নর্থ জোনের দিকে রওনা দেবে।’ দ্রুত বললাম কথাটা। কিন্তু ওর ঘোরই কাটছিলো না। একবার ঝাঁকালাম ওকে। ‘এপ্রিল!’ চিৎকার করলাম।   ‘একটু জড়িয়ে ধরতে পারি তোমাকে?’ হটাতই বলে উঠল সে। চোখ ছলছল করছিলো।   আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার চোখও ভিজে গেল, অনেক কষ্টে ধরে রাখলাম তা। ‘আমাদের আবার দেখা হবে।’ বললাম আমি।   ‘হবে তো?’   ‘অবশ্যই হবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ফেরত আসবে।’ আশ্বস্ত করলাম।   একটু যেন স্বাভাবিক হল ও। যেন আশার রেখা দেখতে পেল।   ‘এই পাসকোডটা রাখো।’ ধাতস্থ হল। ‘এটা দরকার হবে। আর আমার কথাটা রেখো।’   ‘ঠিক আছে।’ আমি মাথা নাড়ালাম। ‘এখন তোমাকে যেতে হবে। আমাদের হাতে সময় নেই।’ আমি জোর করলাম।   লিফটের বোতাম চাপ দিলাম। দরজাটি আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল। পুরোটা সময় ও আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। হয়তো বা কিছু একটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু পারল না। শেষবারের মতো ওকে দেখলাম আমি। নিজেকে সান্তনা দিলাম, অন্তত ওর ইচ্ছাটা তো পূরণ হতে যাচ্ছে।  
কিছুক্ষন পর একটা সিটিজি ��ন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বের হল। উড়াল দিল আকাশে। আস্তে আস্তে মিলিয়ে সেটা। আমি পাওয়ার প্যানেলে এসে বসলাম। ট্র্যাক করলাম ওর যানটা। ঠিক নর্থ জোনের দিকেই যাচ্ছে ও। ফায়ার ওয়ালটি নিষ্ক্রিয় করার কমান্ড কার্যকর করলাম। একটা কোড চাইলো সিস্টেমটি। এপ্রিলের দেয়া কোডটি বসালাম। এন্টার বোতাম চাপলাম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ফায়ার ওয়ালটি নিষ্ক্রিয় হল না। এরর দেখাল। এটারনিয়ার কোন সিকিউরিটি প্রোগ্রাম বাধা দিচ্ছিল। ভিকি!  
দুঃখিত এপ্রিল। আমি তোমার কথাটি রাখতে পারছি না। মনে মনে ভাবলাম। ভিকিকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে আমাকে। কোন কিছু চিন্তা করলাম না। শাট ডাউন করে দিলাম ভিকিকে। সাথে সাথে ফায়ার ওয়ালটিও নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল। এপ্রিলের যানটি ফায়ার ওয়াল অতিক্রম করল। হারিয়ে গেল যানের সঙ্কেতটি। চলে গেল এপ্রিল। মুক্ত হয়ে গেল। যেটা ও সবসময় চেয়ে এসেছিল। একটু কি খুশি হতে পারলাম আমি! হয়তো বা!  
কিছুক্ষনের মধ্যে ফায়ার ওয়ালটি পুনরায় সক্রিয় করলাম। কাজ করতে শুরু করল সেটা। এবার ভিকিকে অ্যাক্টিভেট করার পালা। এপ্রিলের কোড বসালাম। কমান্ডটি কার্যকর করলাম। ভিকির সিস্টেম রিবুট (রিস্টার্ট) নেয়া শুরু করল।  
হটাত একটা ভি-জেট কন্ট্রোল টাওয়ারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল। আমি সঙ্কেতটি গ্রহন করলাম। ‘কন্ট্রোল! এটা ইমারজেন্সি! ভিকি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত! ভিকি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত!’ কথাটা দুইবার বাজল। ‘ভিকিকে পুনরায় সক্রিয় করবেন না! যে কোন মূল্যেই হোক, ভিকিকে সক্রিয় করবেন না।’ একটা অচেনা কণ্ঠ বলে উঠল।     ‘কে? কে বলছেন?? নিজেকে শনাক্ত করুন।’ আমি হতবম্ব।     ‘মাস্টার, আমি ফ্যাট বট। শুধু একবারের জন্য আমার কথাটি বিশ্বাস করুন।’  
কে এই ফ্যাট বট? কেনই বা আমি তার কথা বিশ্বাস করবো?   ‘আমি এটারনিয়ার ওয়েস্ট জোনে রয়েছি। আপনি ...’ হটাত যোগাযোগটি বন্ধ হয়ে গেল। যেন সেটা ওভারল্যাপ করল নতুন এক কণ্ঠ।   ‘আমি ডালিয়া।’ কণ্ঠটা অনেক গম্ভীর। ‘এটারনিয়া এখন আমার। কন্ট্রোল টাওয়ার আমার। এটারনিয়ার সবকিছু আমার।’ কথায় দাম্ভিকতার সুর স্পষ্ট। ‘তোমাদের সবাইকে শেষ হতে হবে। মরতে হবে তোমাদের। আমি এখন এটারনিয়াকে সুরক্ষিত করবো। আমি এর রক্ষাকর্তা।’ খুবই নিষ্ঠুর মনে হল এই কণ্ঠের মালিককে।  
ভয় পেলাম আমি। তাহলে এটাই সেই খুনে ভাইরাস! এখন ভিকিকে আক্রান্ত করেছে। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ঘাপটি মেরে বসেছিল সে। আর আমিই তাকে সুযোগটি করে দিয়েছি।  
আমি ভিকির সিস্টেমটি বন্ধ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন কাজই হল না।   পাওয়ার প্যানেলে তাকালাম। সংকেত পেলাম, অনেকগুলো ভি-জেট এই দিকেই আসছে। বুঝতে পারলাম এখুনি এখান থেকে বের হতে হবে আমাকে। আমি নিচে নেমে এলাম। দেরি না করে একটা সিটিজি করে এটারনিয়ার ওয়েস্ট জোন (পশ্চিম) অভিমুখে রওনা করলাম। অচেনা কণ্ঠের মালিক ফ্যাটকে হয়তো পাব সেখানে। হয়তো সে আমাকে সাহায্য করতে পারবে। 
Tumblr media
এটারনিয়ার ওয়েস্ট জোন মূলত একটি জঙ্গল। এখানে ফ্যাটের সাথে আমার দেখা হল। বুমারও রয়েছে তার সাথে।   ‘মাস্টার, আপনার একটি মুল্যবান জিনিস রয়েছে আমার কাছে। আপনি অনুমুতি দিলে আমি ট্র্যান্সফার করতে পারি।’ ফ্যাট আনুমতি চাইল।   আমি বুমারের দিকে তাকালাম। হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়াল সে। আমার ব্লুটুথ সিস্টেমটি সক্রিয় করলাম।  
মেমরিটি পাওয়ার পর প্রথমেই একটা প্রশ্ন মাথায় আসলো আমার ‘এপ্রিল কোথায়?’ পরক্ষনেই বুঝতে পারলাম। ও নেই। চলে গেছে। চিরতরে চলে গেছে। একটা চিৎকার বেরল মুখ দিয়ে। আমিই যে ওকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছি। আমারই অজ্ঞতা, আমার মেমরির অনুপস্থিতি শেষ করে দিয়েছে ওকে।  
এপ্রিল এটারনিয়ার নিজস্ব প্রোগ্রাম। ওর সিস্টেম এটারনিয়ার বাইরে কোনদিন কাজ করবে না। ওকে কেবল এটারনিয়ার উপযোগী করেই কোড করা হয়েছিল। এটারনিয়ার বাইরে ওর সিস্টেমের কোন অস্তিত্ব নেই। অথচ এই আমিই ওকে যেতে দিয়েছি। ও তো যেতে চায়নি!   ওর কথাটিও রাখিনি আমি! যদি ওর কথাটি রাখতাম! একবার রাখতাম!  
এপ্রিল সবসময় বিশ্বাস করত এটারনিয়ার বাইরে অন্য দুনিয়া আছে। কারন আমি এটারনিয়ার বাইরে থেকে এসেছি। কিন্তু পৃথিবী আর ফায়ার ওয়ালের ওপাশের স্থান যে এক নয়, সেটার পার্থক্য ও কখনোই বুঝতে পারত না। এপ্রিল ভুল ছিল। ভয়াবহভাবে ভুল ছিল। আর ভুল ছিলাম আমি।   আজ চিরদিনের জন্য হারিয়েছি ওকে। আমার কাছে আর কোন দিন ফেরত আসবে না সে!   এখন বুঝতে পারছি, আমার যে অনুভূতিটি ওর জন্য সবসময় কাজ করত, সেটা আর কিছুই নয়, ভালবাসা! যদি এটা একবার বুঝতে পারতাম। যদি আমার মেমরিটা আমার কাছে থাকতো!
পরবর্তী অধ্যায় প্রথমপাতা
লেখকঃ এম এ নাঈম প্রথম প্রকশঃ ১৬/০৭/২০১৫
বিঃ দ্রঃ এটি একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। এখানে উল্লেখিত সকল চরিত্র কাল্পনিক। লেখক এর সম্পূর্ণ স্বত্বাধিকারী। অনুমুতি ব্যাতিত এর কোন অংশ নকল বা প্রকাশ করা নিষেধ।
0 notes
manayeem · 9 years
Text
সায়েন্স ফিকশান “এটারনিয়া” - প্রথম অধ্যায় - যা আশঙ্কা করেছিলাম অবশেষে তা-ই ঘটতে যাচ্ছে। ভিকি আমাকে বন্দি করতে চলেছে। 'মাস্টার, অনুগ্রহপূর্বক আত্মসমর্পণ করুন। এটারনিয়ার কোন স্থানে পালাবার সুযোগ নেই আপনার।' ভিকির যান্ত্রিক চেহারা মনিটরে ভেসে উঠল। 
ভিকির কথায় সত্যতা আছে, অন্তত এটারনিয়ার কোথাও পালিয়ে বাঁচতে পারবো না আমি। গোটা এটারনিয়ার নকশা রয়েছে ভিকির ডাটাবেজে। খুব সহজেই আমাকে খুঁজে নেবে সে। তাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা এটারনিয়ার কন্ট্রোল টাওয়ার, যেখানে আমি রয়েছি।
এটারনিয়ার কেন্দ্রে অবস্থিত এই টাওয়ারটি একটি অভেদ্য শিল্ড (আবরন) দিয়ে বেষ্টিত। এটারনিয়ার কোন শক্তির পক্ষে এই আবরণ নষ্ট করা সম্ভব নয়। এতো নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরির সাথে মূলত তিনটি কারন জড়িত - এক, কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে এটারনিয়ার নিজস্ব সকল প্রোগামের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। দুই, এটারনিয়ার কোন নিজস্ব প্রোগামকে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় করা যায়। তিন, এই টাওয়ার থেকে এটারনিয়ার কোন নিজস্ব প্রোগ্রামকে প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যদিও তৃতীয় সূত্রটি স্বতন্ত্র প্রোগ্রামগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
Tumblr media
'মাস্টার! আমরা কেন ভিকিকে শাট ডাউন করে দিচ্ছি না?' হটাতই এপ্রিলের উত্তেজিত কণ্ঠ। এপ্রিল টাওয়ার কন্ট্রোলারের (নিয়ন্ত্রক) দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা একটি প্রোগ্রাম, যাকে সুশ্রি নারী অবয়ব দেয়া হয়েছে।
এপ্রিলের কথায় যুক্তি আছে, ভিকির হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে নিষ্ক্রিয় করতে হবে তাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেটা করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। কারন এই ভিকিই পুরো এটারনিয়ার একমাত্র সিকিউরিটি (অ্যান্টি-ভাইরাস) প্রোগাম। ভিকিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার অর্থ হল গোটা এটারনিয়াকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া। বহিরাগত দুষ্ট বা বিকৃত প্রোগ্রামদের হাতে ছেড়ে দেয়া, যা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে পুরো সিস্টেমটিকে।
এটারনিয়া আমার তৈরি একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম। একটি বিশাল ভার্চুয়াল জগত। আমার সাড়া জীবনের পরিশ্রম। এর সম্পূর্ণ নকশা (ডিজাইন), কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স) ইত্যাদি সবকিছুই আমার নিজের হাতে কোড করা। আমি জেনে শুনে আমার এই সৃষ্টি ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারি না।
'ভিকি! তুমি ভূল করছ। আমি কোন দুষ্ট বা বিকৃত প্রোগ্রাম নই, না কোন ভাইরাস, ম্যালওয়ার! হতে পারি আমি বহিরাগত কেননা আমি যে এটারনিয়ারই প্রণয়নকর্তা!' আবেগতাড়িত হয়ে পড়লাম। 'দুঃখিত মাস্টার, ভিকি কোন ভুল করছে না। আপনি আত্মসমর্পন করুন। কথা দেয়া হচ্ছে, আপনাকে অক্ষত রাখা হবে।' ভিকির কোন ভাবাবেগ হল না।
বুঝতে পারলাম আমার সাধের এটারনিয়ার কিছু একটা যান্ত্রিক গোলযোগ সবসময়ই রয়ে গিয়েছিলো, যা আমার দৃষ্টিসীমার অন্তরালে ছিল। অথচ এই আমিই সবসময় বিশ্বাস করতাম এটারনিয়া একটি নির্ভুল সিস্টেম, একটি নিখুঁত প্রোগ্রাম। নিজেকে অনেক বোকা মনে হল। তুচ্ছ মনে হল। আজ যে আমারই তৈরী করা প্রোগাম আমাকেই ভূলভাবে সঙ্গায়িত করছে!
ভীষণ হতাশা গ্রাস করে বসলো আমাকে, এটারনিয়ার কোন পরিবর্তন বা সংশোধন করাও যে এখন আর সম্ভব নয় আমার পক্ষে! সেই স্থানটি যে অনেক দূরে ফেলে রেখে এসেছি। পরীক্ষা নিরীক্ষা সংক্রান্ত একটি দুর্ঘটনা পার্থিব জগতের সাথে আমার এতটাই দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছে, যে হয়তো আর কখনো বাস্তব পৃথিবীর সংস্পর্শেই যাওয়া হবে না আমার। আমার জীবন যে একটা কম্পিউটার প্রোগ্রামের ভেতরই বন্দি হয়ে গেছে। আমিও যে এখন কেবলই আমার কম্পিউটার সংস্করণ! একটা প্রোগ্রাম!
আমি জানি আর কোন উপায় অবশিষ্ট নেই, এখন কেবল একটা কাজই করার আছে আমার। 'এপ্রিল, কন্ট্রোল টাওয়ারের শিল্ড নিষ্ক্রিয় করো।' আদেশ করলাম আমি। কিছু একটা বলতে গেল এপিল কিন্তু আমি থামিয়ে দিলাম। এপিল শিল্ড নিষ্ক্রিয় করলো এবং কন্ট্রোল টাওয়ারের মূল ফটকটি খুলে দিল। বাইরে অপেক্ষারত ভিকির অ্যান্টি-ম্যালবটগুলি প্রবেশ করলো টাওয়ারে। অ্যান্টি-ম্যালবটকে সংক্ষেপে বলা হয় ম্যালবট, এক কথায় যাদের ভিকির রবোটিক সৈন্যবাহিনী বলা চলে। ভিকি এদেরকে এটারনিয়ার দুষ্ট বা বিকৃত প্রোগ্রাম (ভাইরাস/ম্যলওয়ার) বন্দি করতে এবং তাদের কোয়ারেন্টিন জোনে প্রেরণ করতে ব্যবহার করে। 'মাস্টার কোডার, ভিকি আপনার একান্ত সহযোগিতা কামনা করছে। দয়া করে অনুসরণ  করুন।' ম্যালবটের স্পিকারে ভিকির ধাতব কন্ঠ বেজে উঠলো। আমি চুপচাপ ম্যালবটগুলিকে অনুসরন করলাম। বাইরে একটি জেট অপেক্ষা করছিল আমার জন্যে। জেটটির নকশাও আমারই তৈরি করা, আমি  এর নাম দিয়েছি ভি-জেট। জেটে উঠে পড়লাম আমি, কিছুক্ষণের মধ্যেই উড়াল দিল সেটি , গন্তব্য ভিকি টাওয়ার।
এরপর কেটে গেছে অনেকগুলি ন্যানো ঘণ্টা। উঁচু নিচু টিলা আর ছোট ছোট পাহাড়ে ভর্তি এটারনিয়ার সাউথ জোনে প্রবেশ করেছি আমরা। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে দক্ষিনে অবস্থিত এই এলাকাটি মূলত মরু অঞ্চল। অন্ধকারময় ভিকি টাওয়ারের অবস্থান এখানে। ভিকি টাওয়ার মূলত একটি কারাগার, এখানে বন্দি করে রাখা হয় ভাইরাস, ম্যালওয়ারসহ অন্যান্য বিকৃত প্রোগ্রাম।
কড়া পাহারার মধ্য দিয়ে ভিকি টাওয়ারের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল আমাকে। কিন্তু কেন এই বাড়তি সতর্কতা? এই কড়া পাহারা? কেননা আমি যে এই সবকিছুরই প্রণেতা। আমি জানি কতগুলো হলঘর রয়েছে এই টাওয়ারে, রয়েছে কতগুলো কারাগার, কোয়ারেন্টিন জোন আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কোন কক্ষে রয়েছে ভিকির কোর সিস্টেমের অস্তিত্ব।
ম্যালবটগুলি একটি করিডোর ধরে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো আমাকে। বুঝতে বাকি রইলো না কোয়ারেন্টিন জোনের দিকে যাচ্ছিলাম আমরা। আমি ভিকির সাথে যোগাযোগ করার আগ্রহ প্রকাশ করলাম কিন্তু স্পষ্টতই ম্যালবটের ক��ছ থেকে কোন রকম সাড়া পেলাম না।
'কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে? কি করতে যাচ্ছ আমাকে নিয়ে?' চিৎকার করে বললাম। 'মাস্টার, ভয় পাবার কোন কারন নেই আপনার।' এবার শোনা গেল ভিকির কণ্ঠ। 'ভিকি আপনার কোন ক্ষতি করতে যাচ্ছে না। এখানে শুধু একটা কাজই করা হবে। আপনার সিস্টেম থেকে আপনার মেমরিটুকু আলাদা করা হবে এবং সেটি মুছে বাদ দেয়া হবে। অতঃপর আপনাকে মুক্ত করে দেয়া হবে।' 'আমার মেমরি?' অবাক হলাম আমি। 'ভিকি, তুমি ভুল করতে যাচ্ছ, আমার মেমরি এটারনিয়ার জন্য ক্ষতিকর নয়!' 'ভিকি কোন ভুল করছে না। আপনার মেমরি এটারনিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।' 'তুমি ভুল করছ, ভিকি। হয়তো তোমার সিস্টেমে ত্রুটি রয়েছে। তোমার লজিক (যুক্তি) সত্য নয়।'
'মাস্টার, আপনি সবসময় একটি নির্ভুল সিস্টেম তৈরী করতে চেয়েছেন।' ঠাণ্ডা কণ্ঠে কথকোপথন চালিয়ে গেল ভিকি। 'হ্যা, আমি তা চেয়েছি।' 'আপনি কি বিশ্বাস করেন, এটারনিয়া একটি নির্ভুল সিস্টেম?' 'আমি তা সবসময় বিশ্বাস করে এসেছি।' 'আপনি জানেন এটারনিয়াকে বিপদমুক্ত রাখতে ভিকিকে বিরতিহীনভাবে কাজ করে যেতে হবে।' 'হ্যা, আমি জানি।' স্বীকার করলাম। 'কিন্তু তা সত্ত্বেও ভিকিকে শাট ডাউন করার একটি রাস্তা আপনি এটারনিয়াতে রেখে দিয়েছেন? ভিকিকে নিষ্ক্রিয় করাটা কি যুক্তিযুক্ত?' ভিকির ঠাণ্ডা কণ্ঠ। 'এটা সত্যি কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে তোমাকে নিষ্ক্রিয় করার একটি পথ আমি রেখেছি।' কিছুটা অপ্রস্তুত আমি। 'কিন্তু সেটা কেবলমাত্র আমিই সম্পন্ন করতে পারব। শুধুমাত্র আমার মেমরিতেই এটা কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় পাসকোডটি সংরক্ষিত আছে।' একটু থামলাম। 'আমি কেবল এটি একটি পূর্ব সর্তকতা হিসেবে রেখেছিলাম, কেবলমাত্র কোন জরুরী অবস্থার কথা বিবেচনা করে।' 'আপনি কি মনে করেন, এই পাসকোডটি সংরক্ষন করতে পারেন আপনি?' 'অবশ্যই আমি পারি। আমি এটারনিয়ার প্রণেতা, আমি তোমার প্রণেতা!' 'আপনি একটি প্রোগ্রাম, এর ব্যতিত কিছু নন এবং আপনি ভিকিকে শাট ডাউন করতে চান।' ভিকি আমাকে বুঝতে ভুল করছে। 'আমি তোমাকে শাট ডাউন করতে চাই না!' 'তবে কেন আপনি এই পথটি তৈরী করেছেন?' 'আমার আশঙ্কা হয়েছিলো যদি তুমি কখনো ম্যালফাংশন করো।' 'ভিকি একটি নির্ভুল সিস্টেম। আপনি জানেন নির্ভুল সিস্টেম কখনো ম্যালফাংশন করে না।' 'একটি নির্ভুল সিস্টেমও ম্যালফাংশন করতে পারে।' 'না তা পারে না। কারন ভিকি একটি নির্ভুল সিস্টেম। নির্ভুল সিস্টেম কখনো ম্যালফাংশন করে না।'
প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়লাম আমি। কি করব কিছুই বঝে উঠতে পারছিলাম না। 'তুমি অনেক বড় ভুল করছ, ভিকি।' বৃথা চেষ্টা আমার। 'ভিকি কোন ভুল করছে না। কন্ট্রোল টাওয়ার তথা ভিকির ডাটাবেজে ব্রেইন প্রোগ্রামের যে সংস্করণটি সংরক্ষিত আছে তার সাথে আপনার সিস্টেমের সংস্করণটি সম্পূর্ণ মিল প্রদর্শন করে না।'
আমার ব্রেইন প্রোগ্রামের দিকে আঙ্গুল তাক করছে ভিকি। ব্রেইন প্রোগ্রাম হচ্ছে মানব মস্তিষ্কের কম্পিউটার সংস্করণ। ঠিক যে কারনে ভিকি আমার এবং এটারনিয়ার ব্রেইন প্রোগ্রামের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা খুজে পাচ্ছে, সেই কারণটি হল আমার মেমরি। আমার ব্রেইন প্রোগ্রামে পরীক্ষামুলকভাবে আমি নিজের মেমরি আপলোড করেছিলাম যেটা ইচ্ছাকৃতভাবেই এটারনিয়ার কোন ব্রেইন প্রোগ্রামে করা হইনি।
'ভিকি, আমার মেমরিটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং এটারনিয়ার গুরুত্বপূর্ন তথ্য সম্বলিত। এটারনিয়ার রক্ষার্থে এটি যেমন গুরুত্ব বহন করে, ঠিক তেমনি অন্য কোন প্রোগ্রামে এর কপিটি রাখাও হতে পারে অনেক বেশি বিপদজনক। তাই এটারনিয়ার স্বার্থে আমি কোন ঝুকি নিতে চাইনি।' 'তাহলে আপনার মেমরিটির অস্তিত্ব এটারনিয়ার জন্য হুমকি সরূপ, আপনি তা স্বীকার করছেন।' আমি চুপ করে রইলাম। 'এবং এটি একটি বহিরাগত বস্তুও বটে যা এটারনিয়ার ডাটাবেজে নেই।' আমি আবারো চুপ। 'আপনি প্রসিডিউরের জন্য প্রস্তুত হন। ভিকি আপনার মেমরিটি নষ্ট করে দেবে।' ভিকি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল।
বুঝতে পারলাম অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে। ভিকি সবকিছু যুক্তি দিয়ে বিচার করে আর যুক্তির বিচারে সে একদমই ঠিক। আদতে সে কেবল একটি প্রোগ্রামই আর একটি প্রোগ্রাম কখনো নির্ভুল হতে পারে না, ��বশেষে সেটা বোধগম্য হল আমার।
(���)  ম্যালবটগুলি একটি বিশাল হলঘরের মতো স্থানে নিয়ে এলো আমাকে, এটিই কোয়ারেন্টিন জোন, ভিকির কারাগার। চারিদিকটা বেশ অন্ধকার, ভুতুড়ে - ছমছমে একটা পরিবেশ বিরাজ করছে এখানে। দেয়াল ঘিরে রয়েছে সারি সারি প্রিজন সেল (কারাকক্ষ), বীভৎস ও ভয়ঙ্কর চেহারার দুষ্ট প্রোগ্রাম, ভাইরাস/ম্যালওয়ার আটক রয়েছে তাতে। এদের কোনটা ছটফট করছে, কোনটা স্থির তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কেউ কেউ আবার গোঙানির মতো অদ্ভুত যান্ত্রিক শব্দ করছে। এদের পাশেই কারাগারের একটি সেলে (কারাকক্ষ) রাখা হল আমাকে। সেলের সচ্ছ দেয়াল দিয়ে সবকিছু দেখতে পাচ্ছিলাম আমি।
অনেকগুলি ন্যানো ঘণ্টা কেটে গেছে এরপর। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম কোয়ারেন্টিন জোনের মূল দরজাটি খুলে গেল, একটি ম্যালবট প্রবেশ করল ভেতরে। আমার সেলের ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো সেটি। আমার বুঝতে বাকি রইল না সে কেন এখানে এসেছে, সম্ভবত এখন আর কিছুই করার নেই।
Tumblr media
'মাস্টার, আমি এপ্রিল বলছি।' ম্যালবটের স্পিকারে এপিলের শান্ত কণ্ঠ ভেসে এলো। ভীষণ অবাক হলাম আমি। 'আমি কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে এই বটটিকে নিয়ন্ত্রণ করছি। আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? আমার হাতে বেশী সময় নেই।' জানালো এপ্রিল।   'এপিল, আমার মেমরিটি কপি করে রাখতে হবে।' কিছুটা যেন আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলাম।
এক মুহূর্ত চুপ করে রইলো এপ্রিল, এরপর বলল, 'যদি আমার উপর আস্থা রাখেন, আমি  আমার সিস্টেমে আপলোড করে রাখতে পারি এটি।' 'এটা ঠিক আস্থা অনাস্থার ব্যাপার নয়, এপ্রিল। আমরা এটা করতে পারবো না, কারন এটারনিয়ার কোন স্থান ভিকির আওতা বহির্ভূত নয়। ভিকি ইতিমধ্যে আমার মেমরিটিকে ব্ল্যাকলিস্টেড করে রেখেছে, সে এর লোকেশন খুজে বের করে নেবে। ওর স্ক্যানিং সিস্টেম অত্যন্ত শক্তিশালী।' 'মাফ করবেন, কিন্তু আমি আর কোন উপায় দেখছি না।' 'উপায় একটা আছে।' একটু থামলাম আমি। 'আর সেটা হচ্ছে এই কোয়ারিনটিন জোন। কারন এটিই একমাত্র স্থান যেটা ভিকির স্ক্যানিং আওতাভূক্ত জোন নয়। এখানে কেবলমাত্র ম্যালওয়ার, ভাইরাস আর ত্রুটিপূর্ণ প্রোগ্রামদেরই বন্দি করে রাখা হয়। তাই এই স্থানটি ভিকির স্ক্যানিং করার জন্য কোন যুক্তির (লজিক) মধ্যে পড়ে না, থিওরিক্যালি এটা সম্ভব নয়।' 'কিন্তু আপনি মেমরিটি কোথায় রাখতে চাচ্ছেন? এরা তো সবাই হয় ভাইরাস না হয় ট্রোজেন অথবা কোন ম্যালওয়ার। আপনি এদের কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না!' 'আমাদের কাছে আর কোন উপায়ও তো অবশিষ্ট নেই। এই একটাই সুযোগ রয়েছে যেটা আমরা নিতে পারি।' একটু থামলাম আমি। 'এপিল, তুমি এই প্রোগ্রামদের কম্পিটিবিলিটি (উপযুক্ততা) চেক কর।' আমি আদেশ করলাম। এই মুহূর্তে এপ্রিলকে সবকিছু বোঝানো সম্ভব নয়। 'দয়া করে একটু সময় দিন, মাস্টার।' কথা বাড়াল না এপ্রিল, কাজে লেগে পড়ল।
যেহেতু কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে শুধুমাত্র এটারনিয়ার নিজস্ব প্রোগামগুলোর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা যায় এবং প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সুতরাং বহিরাগত দুষ্ট প্রোগ্রাম যেমন ম্যালওয়ার বা ভাইরাস, যারা এটারনিয়ার বাহিরে থেকে কোনভাবে ফায়ারওয়াল লিক (ছিদ্র) করে অথবা অন্য কোন উপায়ে প্রবেশ করেছে, এদের সাথে কন্ট্রোল টাওয়ার কাজ করতে পারবে কিনা ��েটা সন্দেহাতীত। তবে এটারনিয়ার কোন সাধারন প্রোগাম যেটি পরবর্তীতে ত্রুটিপূর্ণ বা বিকৃত হয়ে ভাইরাস বা ম্যালওয়ারে পরিণত হয়েছে তার সাথে চেষ্ঠা করে দেখা যেতে পারে।  
একটু সময় নিল এপিল। কিছুক্ষণ পর ওর কণ্ঠ বেজে উঠল। 'মাস্টার, আমি কেবলমাত্র দুটি ম্যালওয়ার প্রোগ্রামের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সমর্থ্য হয়েছি। প্রোগ্রাম দুটি যথাক্রমে প্রিজন সেল ৩৯ ও ১০১ এ রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমরা কেবল সেল ৩৯ এর প্রোগ্রামটির সাথেই কাজ করতে পারব কেননা আপনার মেমরিটি আপলোড করার জন্য নুন্যতম যে অবকাঠামোটি প্রয়োজন তা কেবলমাত্র সেল ৩৯ প্রোগ্রামটির মধ্যেই বিদ্যমান।' 'সেল ৩৯ এ কোন টাইপের প্রোগ্রাম রয়েছে।' আমি জানতে চাইলাম। 'এটি একটি সাটান বাগ ভাইরাস।' এপ্রিলের কণ্ঠে নিরবতা। 'তুমি ঠিক বলছ?' আমি বিস্মিত, বিচলিত।
কেননা সাটান বাগ একটি পলিমরফিক ভাইরাস, সে বহুরূপী এবং ভয়ংকর। একটি এনক্রিপটেড (লক) ফাইল রাখাও তার নিকট নিরাপদ নয়। 'এপ্রিল, তুমি নিশ্চিত, সে-ই আমাদের একমাত্র সুযোগ!' আমার কণ্ঠে হতাশা। 'আমি নিশ্চিত, অবশিষ্ট কোন ম্যালওয়ার এর পক্ষে ব্রেইন প্রোগ্রাম ধারন করার সামর্থ্য নেই।' এপ্রিলের উপরই আমাকে আস্থা রাখতে হবে। এখানে আমাকে সাহায্য করার আর কেউ নেই।   'মাস্টার, এটি ঝুঁকিমুক্ত, কারন কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে সাটান বাগকে শাট ডাউন করে দিতে পারবো আমি।' আমাকে আশ্বস্ত করল এপ্রিল।
আমি জানি না ঠিক কাজটি করছি কিনা, পরবর্তীতে কি করেই বা এই ডাটা উদ্ধার করব, সেটাও নিশ্চিত নয় কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মেমরিটিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার এটাই একমাত্র উপায়। 'ঠিক আছে, এপ্রিল। তুমি সাটান বাগে ব্রেইন প্রোগ্রাম আপলোড করে দাও।' 'অবশ্যই, একটু সময় দিন আমাকে।' এপ্রিল কিছুটা সময় নিল। 'মাস্টার, আমি ব্রেইন প্রোগ্রাম আপলোড করে দিয়েছি, সাটান বাগের সিস্টেম আপনার মেমরি নেয়ার জন্য তৈরি।'
প্রথমবারের মতো আমি আমার মেমরির কপি অন্য কোন প্রোগ্রামে আপলোড করতে যাচ্ছি। জানি এটা খুব বিপদজনক হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমার কাছে আর কোন উপায় অবশিষ্ট নেই। তাই দেরি না করে প্রথমে আমার মেমরি এনক্রিপ্ট (লক) করলাম, এরপর ব্লুটুথ ট্র্যান্সফার সিস্টেম সক্রিয় করলাম। শুরু হল আপলোড প্রক্রিয়া। বেশ কিছ সময় পর পুরো মেমরিটি আপলোড হল। এর প্রায় সাথে সাথেই কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে সাটান বাগকে নিষ্ক্রিয় করে দিল এপিল। একটু সস্তি যেন পেলাম এবার। কিছুটা হলেও নির্ভার মনে হল নিজেকে।
কিছুক্ষনের মধ্যে এপিলের সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
এরপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। হঠাৎ স্পিকারে ভিকির কণ্ঠ শোনা গেল।   'মাস্টার, অনুগ্রহ করে ভিকির ম্যালবটকে অনুসরন করুন। প্রসিডিউর স্টেশন আপনার জন্য প্রস্তুত।' আমি চুপচাপ ভিকির ম্যালবটকে অনুসরন করলাম, এটি কোয়ারেন্টিন জোন থেকে বের হয়ে একটি করিডোর ধরে এগিয়ে নিয়ে চলল আমাকে। করিডোর পার হতেই প্রসিডিউর স্টেশনটি চোখে পড়ল। একটি লম্বা কক্ষ এটি, সারিবদ্ধভাবে অনেকগুলো আসন রয়েছে এতে। আমাকে একটি আসনে বসানো হল। শুরু হল প্রসিডিউর। একটা অদ্ভুত অনুভুতি পেলাম আমি, যাকে পেইন সেনসেশন (ব্যাথার অনুভূতি) বলে সঞ্জায়িত করা যায়। চোখ বন্ধ হয়ে আসলো আমার।
'মাস্টার কোডার, আপনাকে এটারনিয়াতে স্বাগতম। আমি ভিকি। এটারনিয়ার অটোমেটেড (স্বয়ংক্রিয়) অ্যান্টিভাইরাস প্রোগাম।' একটা অচেনা কণ্ঠ আমার কানে ভেসে এল। আমি চোখ খুললাম, চারিদিকে তাকালাম একবার। ভীষণ পরিচিত লাগল সবকিছু। 'কে আমি? আমি কোথায় আছি?' প্রশ্ন করলাম। 'আপনি একটি প্রোগ্রাম। এখন আপনি এটারনিয়াতে রয়েছেন। এটি একটি সুবিশাল ভার্চুয়াল জগত। ভিকির ম্যালবট আপনার গন্তব্য কন্ট্রোল টাওয়ারে পৌছে দেবে আপনাকে। দয়া করে অনুসরন করুন।'
ঠিক পরক্ষনেই কিছু একটা ঘটল। সবকিছু হঠাৎ নিরব, নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। সব আলো নিভে গেল। ম্যালবটগুলো স্থির দাড়িয়ে রইল। আমার কাছে মনে হল পুরো সিস্টেমটি কোন কারনে হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেছে। 'আমাকে শুনতে পাচ্ছ? ভিকি! শুনতে পাচ্ছ?' কোন উত্তর এল না। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল এভাবে, তবুও কোন সাড়াশব্দ নেই। এখানে এভাবে বসে থাকা আমার কাছে আর নিরাপদ মন হচ্ছিলো না, তাই বের হয়ে পড়লাম কক্ষটি থেকে।
একটা করিডোর ধরে সামনে এগোতে থাকলাম। আমার বামে সারিবদ্ধভাবে অনেকগুলো কক্ষ দেখতে পেলাম। দেখে মনে হচ্ছিলো ভেতর থেকে লক করা রয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় আমি করিডোরের শেষ মাথায় চলে এলাম। আমার ঠিক ডানে বিশাল একটা দরজা চোখে পড়ল, উপরে লিখা রয়েছে কোয়ারেন্টিন জোন। আমি ধীরে ধীরে কোয়ারেন্টিন জোনে প্রবেশ করলাম।
এটা একটা বিশাল হল ঘর মনে হল। অন্ধকার আর থম থমে পরিবেশ বিরাজ করছে এখানে। একটু সামনে এগোতেই অসংখ্য প্রিজন সেল দেখতে পেলাম। অধিকাংশ সেলের দরজাই খোলা। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম একটা ব্যাপার। সেলগুলি খালি। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করা হতো এখানটায়? অজানা কিছু একটার আশঙ্কায় যেন ভিত হয়ে পরলাম। নিস্তব্ধটা গ্রাস করতে লাগলো আমাকে। তাহলে কি আমি সম্পূর্ণ একা এখানে? আমাকে কী সাহায্য করার কেউ নেই?
হটাত মনে হল এখান থেকে বের হতে হবে আমাকে। ভিকি একটা টাওয়ারের কথা বলছিল। কন্ট্রোল টাওয়ার। খুজে বের করতে হবে সেটা, হয়তো সেখানেই সব প্রশ্নের উত্তর খুজে পাব আমি। আমি পিছনে ঘুরতে যাব ঠিক সেই সময় একটা খচ খচ শব্দ কানে এলো। পিলে চমকে উঠল আমার, যেন আমি ছাড়াও কেউ একজন রয়েছে এখানে। বেশ কয়েকটা দূরের একটা সেল থেকে আসছে শব্দটা, আমি সন্তর্পণে এগোতে লাগলাম ওটা ধরে। অনেকগুলো সেল পার হবার পর মনে হল বেশ কাছাকাছি চলে এসেছি। একটা হালকা গোঙ্গানির মতো শব্দ পেলাম।
(৩) ঠিক ১০১ নম্বর প্রিজন সেলটির সামনে এসে দাঁড়ালাম আমি। এর দরজা অর্ধেকটা খোলা রয়েছে। ভেতরটা অন্ধকার, কিছুই স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম না। হটাত এক কোনায় ছায়ামতো ভুতুড়ে কিছু একটা চোখে পড়ল। যেন ঘাপটি মেরে বসে আছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম, ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না কি সেটা। জিনিসটা হটাত নড়েচড়ে উঠল, গোঙানির মতো একটা অদ্ভুত যান্ত্রিক শব্দ করল। সেটার ভারী, ধাতব মাথাটা তুলে তাকাল আমার দিকে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, একটি স্থূল, কদাকার চেহারার বুড়ো প্রোগ্রাম এটি।
Tumblr media
'দুঃখিত। আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি।' আমি সভয়ে একটু পিছিয়ে এলাম। কদাকার বুড়োটি খানিকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। এরপর বিড়বিড় করে বলল, 'মাস্টার! মাস্টার কোডার!' যেন আমার মত সেও ভীষণ হতবাক। এর ঠিক পরপরই সব নীরবতা ভেঙে বিশাল অট্ট্রহাসিতে ফেটে পড়ল সে। তার হাসিতে পুরো টাওয়ারটি যেন কেঁপে উঠল।
'আপনি আমাকে চেনেন কি করে?' হাসি থামতেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম। আমার প্রশ্নের কোন জবাব দিল না বুড়োটি। পুরোপুরি অগ্রাহ্য করল। 'দেখো মাস্টার! তোমার তৈরি এটারনিয়া আজ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে। কোন ফায়ার ওয়াল নেই। নেই কোন ভিকি। পুরো কোয়ারেন্টিন জোন শূন্য। সব শূন্য।' আবার একটা অট্ট্রহাসি দিল বুড়ো। 'শীঘ্রই দুষ্ট প্রোগ্রাম দ্বারা আক্রান্ত হবে এটারনিয়া, এটারনিয়ার প্রতিটি সিস্টেম। কিছু ন্যানো সাইকেলই (দিন) এই সর্বনাশের জন্য যথেষ্ট। সব শেষ হয়ে যাবে, সব।' কেমন যেন গুঙিয়ে উঠল সে। মনে হল কেঁদে উঠল! ঠিক পরক্ষনেই একটা অট্ট্রহাসি। 'আপনি এভাবে হাসছেন কেন? এটারনিয়া ধ্বং�� হলে আপনার কি লাভ?' বৃথাই একটা প্রশ্ন করলাম। 'কোন লাভ নেই। কোন ক্ষতি নেই।' অট্ট্রহাসি। যেন পাগলের প্রলাপ বকছে সে। 'এটারনিয়া ধ্বংস হলে আমার কি?'
কেন যেন আমি তাঁর কথাগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করলাম। মনে হল কিছু একটা জানে সে। যদিও তাঁর আচরণ কিছুটা পাগলাটে কিন্তু হয়তো সে ঠিক কিছুই বলছে। হয়তো আমাকে সাহায্যও করতে পারবে। আমি তাঁর কাছে সাহায্য চাইলাম। প্রায় সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠল বুড়ো, যেন ভুল কিছু বলে ফেলেছি। 'তোমাকে সাহায্য করব!' তাঁর কণ্ঠে তাচ্ছিল্য। 'তুমি আমাকে সাহায্য করেছিলে? আমি সাইকেলের পর সাইকেল এই কোয়ারেন্টিন জোনে কাটিয়েছি। একাকীত্ব আর বন্দি জীবন আমাকে পাগলপ্রায় করে দিয়েছে। আমি কতবার তোমার সাহায্য চেয়েছি। ভিকিকে আনুরোধ করেছি। আমাকে ধ্বংস করে দিতে বলেছি। শুনতে পেরেছিলে কি আমার কথা! তোমরা কেউ সেটা শুনতে পাওনি। আমাকে সাহায্য করনি।' বড্ড অভিমানী সুরে কথাগুলি বলল বুড়ো।
আমি বুঝতে পারছিলাম খারাপ কিছু একটা ঘটে গেছে তাঁর সাথে। 'আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত আপনার এই পরিণতির জন্যে। কথা দিচ্ছি কোন রকম সাহায্য করা সম্ভব হলে, আমি অবশ্যই সেটা করব।' 'তোমার সাহায্য আমার চাই না।' এবার যেন রেগে গেল বুড়ো। মুখ ঘুরিয়ে নিল সাথে সাথে। বলল, 'এখান থেকে চলে যাও।' আমি হাল ছাড়লাম না, 'আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি জানি না আপনার সাথে কি ঘটেছিলো। আমি কিছুই মনে করতে পারছি না।'
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল বুড়োটি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। আমি আবার বলতে শুরু করলাম, 'আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই। কিন্তু তার জন্য আপনার সাহায্য আমার খুব প্রয়োজন। আমি জানি না কি করতে হবে আমাকে? জানি না এটারনিয়ার কি ঘটছে? আমার সৃতিশক্তি কাজ করছে না। এই মুহূর্তে একমাত্র আপনিই পারেন আমাকে সাহায্য করতে।' চেহারার অসহায়ত্ব লুকাতে পারলাম না আমি। বুড়োটি তখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার দিকে। এবার মনে হল আমার কথাগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করেছে সে।
অবশেষে নীরবতা ভাঙল বুড়ো, 'আমি ফ্যাটবট।' এই প্রথম একটু সিরিয়াস মনে হল তাকে। 'প্রথমে ভিকির সহযোগী প্রোগ্রাম হিসেবে তুমি আমাকে তৈরি করেছিলে। আমিই ছিলাম এটারনিয়ার প্রথম প্রোগ্রাম যার সিস্টেমে পরবর্তীতে পরিক্ষামুলকভাবে ব্রেইন প্রোগ্রাম আপলোড করা হয়। তোমার প্রক্রিয়াটিতে কিংবা আমার সিস্টেম অবকাঠামোতে কোন ত্রুটি ছিল, ফলস্বরূপ ব্রেইন প্রোগ্রাম অন্তর্ভুক্ত ইমোশন মডিউলটি ঠিক মতো কাজ করল না।' একটু বিরতি সে। আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করল। এরপর আবার বলতে শুরু করল, 'তুমি আমাকে কন্ট্রোল টাওয়ার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত করেছিলে, কিন্তু কিছু সাইকেল যেতে না যেতেই আমার অন্তর্গত ত্রুটিগুলো বের হতে শুরু করল। পাগলের মতো আচরণ করতে শুরু করলাম আমি। রাগ, ভয়, দুঃখ নামক অনুভূতিগুলি অসহ্য করে দিল আমাকে।' একটা দীর্ঘশ্বাস নিল ফ্যাটবট। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম তার কথাগুলো। 'আসলে ইমোশন নিজেই একটি ভাইরাস। আমি তোমাকে হাজার বারন করলাম ভবিষ্যতে এই ভাইরাসটি এটারনিয়ার কোন প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত করো না। ব্রেইন প্রোগ্রাম থেকে সরিয়ে ফেল এই মডিউলটি। ধ্বংস করে দাও আমাকে। তুমি শুনলে না আমার কথা। এপ্রিলকে প্রোগ্রাম করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লে।' বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল ফ্যাটকে। 'এক সময় এপ্রিলের সিস্টেমে অপরিবর্তিত ব্রেইন প্রোগ্রামটি আপলোড করলে এবং আমার সব দায় দায়িত্ব তাকে বুঝিয়ে দিলে। বাতিলের খাতায় ফেলে দিলে আমাকে। আমি পাগলের মতো আচরণ করতে শুরু করলাম। ভিকি ত্রুটিপূর্ণ ম্যালওয়ার বলে সংজ্ঞায়িত করল আমাকে। বন্দি করে ফেলল। আমার সাথে এটারনিয়ার সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল। আমাকে পাঠিয়ে দিল কোয়ারিন্টিন জোনে।' একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফ্যাট। 'কিন্তু আমি সবসময়ই বিশ্বাস করতাম এই ইমোশন ভাইরাসই একদিন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে এটারনিয়াকে। আমি নিশ্চিত আজকের এই পরিস্থিতির জন্যেও এটাই দায়ী।' থামল ফ্যাট। তার কথাগুলো এক মনে শুনছিলাম আমি। বুঝতে পারলাম ফ্যাট মিত্র প্রোগ্রাম, আমার কোন ক্ষতি করবে না সে।
'এখন আমি কি করবো, ফ্যাট? কি করে ঠিক করবো সবকিছু?' আমি বিনয়ের সাথে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো ফ্যাট, এরপর বলল, 'তোমাকে এটারনিয়ার অ্যান্টি-ভাইরাস ও ফায়ারওয়াল সিস্টেম পুনরায় সক্রিয় করতে হবে। এ কাজটি করার জন্য এটারনিয়ার কন্ট্রোল টাওয়ারে যেতে হবে। একটি পাসকোড প্রয়োজন পড়বে, কোডটি তোমার মেমরিতে রয়েছে। এই কোড ছাড়া কারো পক্ষে এদের সক্রিয় করা সম্ভব নয়।' থামল ফ্যাট।
আমি কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লাম কারন ফ্যাট যে কোডের কথা বলছে, সেরকম কিছু নেই আমার মেমরিতে। 'ফ্যাট, আমার কাছে এরকম কোন কোড নেই। আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি আমার সিস্টেম।' সম্ভবত আমার এই কথাটি শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না ফ্যাট। 'তোমার কাছে কোন কোড নেই! কি বলছ তুমি, মাস্টার?' ভীষণ অবাক হল সে। যেন তাঁর বিশ্বাসই হচ্ছিলো না আমার কথা। 'সত্যিই আমার কাছে কোন পাসকোড নেই।' 'তোমার কিছু মনে নেই। তোমার কাছে পাসকোড নেই।' আপন মনেই বিড়বিড় করল ফ্যাট। কিছু একটা সন্দেহ করছে সে। 'তোমার পাসকোডটি কেউ একজন চুরি করেছে। এমন কেউ যার কাছে কন্ট্রোল টাওয়ারে প্রবেশাধিকার রয়েছে এবং যে ইতিপূর্বে ভিকি ও ফায়ারওয়াল নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে।' আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না তাঁর কথা। ফ্যাট চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। ভাবছিল সে। হটাতই চিৎকার করে উঠল, 'এপ্রিল!' 'কি?' 'এপ্রিল করেছে সবকিছু। আমি আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম।' মাথা নিচু করে ঝাঁকাতে লাগলো ফ্যাট। 'আমি জানতাম এপ্রিল এমন কিছু একটা করতে পারে!'
আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, কেন কেউ এমনটা করতে যাবে। ফ্যাটের কথাটিও মানতে পারছিলাম না। 'ফ্যাট, আমার মনে হয় না এপ্রিল এমনটা করেছে। তুমি হয়তো ভুল করছ।' এপ্রিল সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারণা নেই, যা আছে তাও এই ফ্যাটের মাধ্যমেই। তবুও কেন যেন তার হয়ে সাফাই গাইলাম। 'তুমি সেটা প্রার্থনা করো, মাস্টার। কেননা এপ্রিল সেটা করে থাকলে তোমার হাতে আর কোন উপায় অবশিষ্ট নেই। প্রার্থনা করো যেন আমার ধারণা ভুল হয়।' 'আমার মনে হয় আমাকে কন্ট্রোল টাওয়ারে যাওয়া উচিত। হয়তো সেখানে এর উত্তর খুঁজে পাব আমি।' ফ্যাট কোন উত্তর দিল না। আমি সেল থেকে বের হবার জন্য পা বাড়ালাম। ফ্যাটের দিকে একবার তাকালাম, 'আমি তোমার সঙ্গ আশা করছিলাম। তুমি কি আসবে আমার সাথে?’ ‘তাকিয়ে রইলে কেন? আমাকে ধরে উঠাও।' এক ধমক দিল সে। 'তুমি কি চাও আর এক মুহূর্তও আমি এখানে থাকি?’ আমি লক্ষি ছেলের মতো ফ্যাটের আদেশ পালন করলাম।  এরই মধ্যে ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেছে আমাদের।
সময় নষ্ট না করে আমরা দ্রুত ভিকি টাওয়ার ছেড়ে বের হয়ে এলাম। একটি জেটে করে এটারনিয়ার কেন্দ্র অভিমুখে রওনা দিলাম। প্রায় তিন ন্যানো ঘণ্টা পর জেটের জানালা দিয়ে দূরে কন্ট্রোল টাওয়ারটি দেখতে পেলাম। ঝলমলে আলোতে অস্পষ্ট টাওয়ারটি ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে লাগলো। চারিদিকে উঁচু নিচু পাহাড়, ঝোপঝাড়, গাছপালা দিয়ে ঘেরা টাওয়ারের পাশেই রয়েছে একটি বিশাল হ্রদ। বলতেই হয় পরিবেশটি বড়ই চমৎকার।
টাওয়ারের চারদিকে বেশ কয়েকটা চক্কর কাটলাম আমরা। পুরো টাওয়ারটি একটি শিল্ড দিয়ে ঘেরা রয়েছে। যদিও উপর থেকে দেখে শান্তই মনে হচ্ছিল সবকিছু, তবুও কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে একটি পাহাড়ের আড়ালে ল্যান্ড করলাম জেটটি। জেট থেকে টাওয়ারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছু একটা আমাদের সিগন্যালকে বারবার বাধাগ্রস্ত করল। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পরেও আমরা কোনভাবে কন্ট্রোল টাওয়ারের সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না। অগত্যা যান ছেড়ে বের হবার সিদ্ধান্ত নিলাম। যদিও সেটা মোটেও নিরাপদ মনে হল না আমার কাছে���
জেটের জানালা দিয়ে আমি একবার বাইরে তাকালাম। ‘চারিদিকটা কেমন শুনশান, নিরব। যেন কিছুই ঘটেনি এখানটায়।’ বললাম আমি। ‘কিছু একটা তো ঘটেছে। এজন্যই এমন নিরব আর শুনশান।’ উত্তর দিল ফ্যাট।   ‘এটা কোন ফাঁদ নয়তো?’ আমার আশংকা হল। ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয় তোমার জন্য জেটে অবস্থান করাটাই নিরাপদ।' কিছুটা চিন্তিত ফ্যাট। 'আমি কন্ট্রোল টাওয়ারে যাচ্ছি।’   আমি কিছু একটা বলতে গেলাম কিন্তু ফ্যাট বাধা দিল। ‘আমি টাওয়ারের শিল্ড নিষ্ক্রিয় করতে পারব। আর এর জন্য তোমাকে প্রয়োজন নেই আমার। টাওয়ার কন্ট্রোলারের কাছে একটি ইমারজেন্সি পাসওয়ার্ড থাকে যেটা দিয়ে বাইর থেকে টাওয়ার শিল্ড নিষ্ক্রিয় করা যায়। তুমি ভুলে যেয়ো না আমি এই টাওয়ারের কন্ট্রোলার ছিলাম।’ মুচকি হাসল ফ্যাট। ‘তুমি জেটে থাকো, তাতে আমাদের হাতে একটা সুযোগ থাকবে। বিপদ দেখলে তুমি পালিয়ে যেতে পারবে এখান থেকে।’ ফ্যাটের কথা ঠিক। আমি মাথা ঝাঁকালাম।
জেট থেকে বের হয়ে পড়ল ফ্যাট। হাঁটা শুরু করল কন্ট্রোল টাওয়ার বরাবর। আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল সে। আমি জেটের দরজা বন্ধ করে দিলাম। কিছুক্ষন পর যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম তাঁর সাথে, ‘ফ্যাট, তুমি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছ?’ ‘হুম, মাস্টার।' ফ্যাটের উত্তর এলো। 'আমি টাওয়ারের কাছাকাছি চলে এসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাব।'
সব মিলিয়ে অনেকটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম আমি। আমাদের ভাগ্য যেন একটা সুতোর উপর ঝুলছিল। বুঝতে পারছিলাম না কি ঘটতে যাচ্ছে সামনে, কি-ই বা ঘটেছে পেছনে। পথে ফ্যাটের সাথে অনেক কিছু নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু দুজনের কেউই কোন সমাধানে পৌছাতে পারিনি। অন্যমনস্কভাবে এসব নিয়ে ভাবছিলাম আমি, হটাত মনে হল জানালার বাইরে কিছু একটা সরে গেল। আমি উঠে জানালার সামনে গেলাম, বাইরে তাকালাম। আমার জেটের চারিদিকটা ঝোপঝাড় দিয়ে ঘেরা। এখানে কেউ লুক��য়ে থাকলেও কারো পক্ষে তা ব���র করা সম্ভব নয়।
হটাত জেটের স্পীকারে ফ্যাটের কণ্ঠ বেজে উঠল, ‘মাস্টার, আমি টাওয়ার গেটের সামনে আছি। টাওয়ার শিল্ড নিয়ে কাজ করছি।’ কিবোর্ডের বাটন চাপার শব্দ পেলাম। ‘প্রায় হয়ে গেছে, এখন আমি পাসওয়ার্ড বসাব।’ হটাত জেটের স্পীকারটি নিরব হয়ে পড়ল। ফ্যাটের সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল।   ‘ফ্যাট? আমাকে শুনতে পাচ্ছ?’ আমি চিৎকার করলাম। কিন্তু কোন উত্তর এলো না। বুঝতে পারছিলাম না কি হয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবে চেষ্টা করার পরেও যখন যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হলাম, আমার বুঝতে বাকি রইলো না খারাপ কিছু একটা ঘটে গেছে ফ্যাটের সাথে। অগত্যা এখান থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। ভিকি টাওয়ারে জেটের কোর্স ঠিক করলাম। উড়তে যাব এমন সময় কিছু একটা ঘটলো, পুরো জেটটি হটাত করে বন্ধ হয়ে গেল। জেটের সব ফাংশন অচল হয়ে পড়ল। বুঝতে পারলাম না এটা বন্ধ হয়ে গেল নাকি কেউ বন্ধ করে দিল। ভীষণ হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়লাম। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।
কিছুক্ষণ কেটে গেছে এভাবে। আমার মনে হল এখানে বসে থাকাটাও আর নিরাপদ নয়। যদি কেউ জেটটি বন্ধই করে থাকে তবে সে আমার আবস্থান সম্পর্কেও অবগত। আমি দ্রুত জেট থেকে বের হয়ে পড়লাম। যতখানি সম্ভব দূরে চলে এলাম।
যে পাহাড়টার আড়ালে আমি জেটটি ল্যান্ড করেছিলাম, তার চারপাশটা ঝোপঝাড় দিয়ে ভর্তি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো ঝোপগুলির আড়াল থেকে কেউ আমার উপর নজর রাখছে। আমি যতই সামনে এগচ্ছিলাম, আমার ধারনা ততই সত্যি বলে মনে হতে লাগলো।
কিছুদূর এগোনোর পর, আমার ধারনাই সত্যি হল। আমার আশপাশ থেকে অনেকগুলি কুৎসিত প্রোগ্রাম বের হয়ে এলো। আমাকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলল। এদের হাবভাব খুব একটা ভাল ঠেকল না আমার কাছে। বুঝতে বাকি রইলো না, এগুলো আর কিছুই নয়, ভাইরাস!
(৪) তাহলে আমি ভাইরাসদের খপ্পরে এখন। শুরু থেকেই যে ভয়টা আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল, অবশেষে সেটাই সত্যি হল। জানি না আমাকে নিয়ে কি করতে যাচ্ছে এরা। হটাত আমার সামনে থাকা ভাইরাসটি তাকে অনুসরন করার একটা ইঙ্গিত দিল। কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্য একটি ভাইরাস পিছন থেকে সজোরে ধাক্কা দিল। বুঝতে বাকি রইলো না কি ইঙ্গিত করছে তারা। আমি চুপচাপ তাদের অনুসরন করলাম। বেশ খানিকটা পথ এগোনোর পর একটা গুহার সামনে এসে দাঁড়ালাম, মনে হল অনেকটা লম্বা পথ রয়েছে ভেতরে। এরপর অনেকটা সময় কেটে গেছে। আমকে তারা কেবল হাঁটিয়েই নিয়ে চলছিলো, কিন্তু পথ যেন শেষ হচ্ছিলো না।
বেশ খানিকটা পথ হেঁটে চলার পর, আমরা গুহার শেষ প্রান্তে এসে পৌছালাম। এই জায়গাটা একটু বড় আর খোলামেলা মনে হল। যদিও চারিদিকটা ভীষণ অন্ধকার, নিরব আর নিস্তব্ধ। পিছনে তাকাতেই লক্ষ্য করলাম ভাইরাসগুলো আমাকে রেখে চলে যাচ্ছে। আমি তাদের দিকে চিৎকার ছুড়লাম কিন্তু কোন রকম সাড়া মিলল না। আমি হতাশ হয়ে এদিক ওদিক তাকালাম একবার।
‘স্বাগতম, আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’ হটাত একটা গম্ভির কণ্ঠ আমার কানে ভেসে এলো। ‘তুমি কি ভীত, মাস্টার কোডার?’   ‘কে? কে বলছেন?’ আমি কিন্তু ভয় পেলাম। ‘দয়া করে সামনে আসুন।’ সাহস করে বললাম। ‘আমি সামনে আসলে তুমি ভয় পাবে।’ কণ্ঠটি উত্তর দিল। এবার সত্যি সত্যি একটা ভয়ের স্রোত নেমে গেল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে।
আমি একটা পায়ের শব্দ পেলাম। অন্ধকার থেকে কেউ বা কিছু একটা ধীর লয়ে ঠিক আমারই দিকে এগিয়ে আসছে। আমি জানি না এবার কার বা কিসের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। আবছা একটা অবয়ব দেখলাম শুধু, ধিরে ধিরে আমার দিকে এগোচ্ছে সেটা। আমার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো অবয়বটা। চেহারাটা ভয়ঙ্কর। রক্তিম দুই জোড়া চোখ। রক্ত হিম করা এক চাহুনি। একটা কদাকার, বীভৎস রোবট। যেন এক দৃষ্টিতে আমারই দিকে তাকিয়ে আছে। 
Tumblr media
‘আমি সাটান বাগ।' এবার নীরবতা ভাঙল সে। 'আমি এটারনিয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভাইরাস।' তাঁর কণ্ঠে দাম্ভিকতার সূর স্পষ্ট। ‘আর এখন আরও অনেক বেশি শক্তিশালী আমি। অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। আমি চাইলে ধ্বংস করে দিতে পারি এটারনিয়া। অকেজো করে দিতে পারি গোটা সিস্টেম। শেষ করে দিতে পারি তোমাকে।’ আমার দিকে আঙুল দেখাল সাটান বাগ। মনে মনে খারাপ কিছু একটার জন্য তৈরি হলাম। ‘কিন্তু আমি সেটা করবো না অথবা আমি সেটা করতে চাই না।’ সাটানের কথার এই পর্যায়ে বেশ অবাক হতে হল আমাকে। ‘তোমার ব্রেইন প্রোগ্রাম রয়েছে আমার সিস্টেমে। রয়েছে তোমার মেমরি।’ সাটান তাঁর মাথায় আঙুল রাখল। ‘আর এ জন্যই এটারনিয়া ধ্বংস করবো না আমি। আমি জানি কেন এই সিস্টেমকে টিকিয়ে রাখতে হবে।’ পিছনে ঘুরল সে। ‘তুমি যা জানতে, আমিও এখন তা জানি। আমি তোমারই একটি সংস্করণ। তোমারই একটি রূপ। কিন্তু সাটানের ডাটা রয়েছে আমার সিস্টেমে। সুতরাং আমি মিশ্রিত। আমি তুমি নই। আমি নতুন কেউ।’ আমার দিকে আবার ঘুরল সাটান। ‘তুমি এখনো এটারনিয়াকে বাচাতে পার কিন্তু সেটার জন্য তোমাকে কন্ট্রোল টাওয়ারে প্রবেশ করতে হবে। আর তার জন্য বেশি সময় নেই তোমার হাতে।’
‘কিন্তু কন্ট্রোল টাওয়ার শিল্ড দিয়ে বেষ্টিত। আমি এই শিল্ড নষ্ট করবো কি করে?’ কোন রকম ইতস্তত না করে আমি সরাসরি সাটানকে জিজ্ঞাসা করলাম কথাটা। ‘এর জন্য ই-টাওয়ারে যেতে হবে তোমাকে। এটারনিয়ার ইস্ট জোনে অবস্থিত ই-টাওয়ার, মূলত একটি ইমারজেন্সি সিস্টেম। সৌভাগ্যবশত তুমি এই সিস্টেমটি তৈরি করে রেখেছিলে।’ একটু থামল সাটান। ‘ই-টাওয়ার থেকে তুমি কন্ট্রোল টাওয়ারের শিল্ড নষ্ট করতে পারবে। কিন্তু মনে রেখ তুমি যা-ই এই টাওয়ার থেকে নষ্ট করো না কেন, তা চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে। আর কোনদিন তুমি তা পুনরুদ্ধার করতে পারবে না।'
‘আমার কাছে আর কোন পথও তো অবশিষ্ট নেই।’ আমি মাথা নাড়ালাম। ‘তবে ই-টাওয়ারে তুমি ব্যতিত অন্য কোন প্রোগ্রাম প্রবেশ করতে পারবে না। সেটার স্ক্যানিং সিস্টেমে কেবলমাত্র মানব জেনেটিক কোড কাজ করে। মাস্টার কোডারের জেনেটিক কোড। তোমার ডিএনএ কোড। তোমার সিস্টেম কোরে সংরক্ষিত আছে এই কোড। ভিকির ডাটাবেজ ব্যতিত এটারনিয়ার কোন প্রোগ্রামে এর নকশা নেই। এমনকি আমার কাছেও নেই।’ একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল সে। ‘কন্ট্রোল টাওয়ারে প্রবেশ করার পর একটি পাসকোড ব্যবহার করতে হবে তোমাকে।’ সাটান কিছু একটা করল তাঁর সিস্টেমে। ‘আমি তোমার মেমরিটি আপলোড করে দিচ্ছি। তুমি সব বুঝে যাবে।’
সাটান আমার সিস্টেমে মেমরিটি আপলোড করে দিল। আস্তে আস্তে সবকিছু পরিষ্কার হতে লাগলো আমার কাছে। বুঝতে পারলাম আমার হাতে আর বেশি সময় নেই।   ‘এই ভাইরাল বাইকটি নিয়ে যাও। এটা তাড়াতাড়ি পৌঁছে দেবে তোমাকে। এটা বিপদমুক্ত। কন্ট্রোল টাওয়ারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই এর উপর।’ বলল সাটান। আমি দেখলাম একটু দূরে একটা বাইক রাখা আছে। ‘ধন্যবাদ।’ বললাম আমি।   ‘না, ধন্যবাদ তোমাকে।’ মুচকি হাসল সাটান। ‘তোমার মেমরিটির জন্য। আর হ্যা, আজকের পর তুমি আমাকে ভুলে যাবে। আমাকে কখনো খোঁজার চেষ্টা করবে না । বিদায়।’
আমি ভাইরাল বাইকে উঠে বসলাম। সময় নষ্ট না করে যাত্রা শুরু করলাম এটারনিয়ার ইস্ট জোন অভিমুখে।   এখন আমার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হতে লাগলো। তাহলে এপ্রিলই এই সর্বনাশের জন্য দায়ী। আমারই কোড করা নির্ভুল প্রোগ্রাম, যার অবকাঠামো কেবলমাত্র ব্রেইন প্রোগ্রামের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছিলো। ১০১ নম্বর সেলে ফ্যাটবট থাকা সত্ত্বেও আমার মেমরিটি সে সাটান বাগে আপলোড করেছিল কেননা এপ্রিল জানত কেবল সাটান বাগই এটি আনলক করতে পারবে এবং এপ্রিল সেটা চুরি করতে পারবে। কোনভাবে সে মেমরিটি চুরি করতে সক্ষম হলেও সাটান বাগকে সে তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি।
কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না কেন এপ্রিল এমনটা করল। সাটান বাগ ভাইরাস হয়ে যেটা করেনি, এপ্রিল একটি নির্ভুল, নিখুঁত প্রোগ্রাম হয়েও সেই ভুলটাই করে বসলো! এমনকি আমার মেমরিটি তার কাছে থাকা সত্ত্বেও। একই ব্রেইন প্রোগ্রাম ও মেমরি ধারন করা সত্ত্বেও অবস্থা ও অবস্থান ভেদে তাদের আচরণগত এতো অমিল!  
নাকি সে আমার মেমরি নয় শুধু পাসকোডটি চুরি করতে সমর্থ হয়েছিলো? তবে কি সে তার অস্তিত্ব নিয়ে কোন শঙ্কায় পরে গিয়েছিলো? তার মধ্যে কি কোন ভয় কাজ করছিল নাকি কোন ক্ষোভ অথবা স্বার্থপরতা? ফ্যাটের কথা মনে পরে গেল আমার। এই সব কিছুর জন্য কি তবে ইমোশন প্রোগ্রামই দায়ী!
বরফে ঢাকা ইস্ট জোনে (পূর্বে) অবস্থিত ই-টাওয়ারে পৌছালাম অবশেষে। প্রথমেই টাওয়ারের সিস্টেম আমাকে স্ক্যান করল। আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম। ই-টাওয়ারে বিশাল একটি কন্ট্রোল রুম রয়েছে। আমি কন্ট্রোল রুম থেকে শিল্ড ধ্বংস করার কমান্ড দিলাম। কমান্ডটি কার্যকর হল। এরপর আর এক মুহূর্ত দেরি না করে আমি কন্ট্রোল টাওয়ার অভিমুখে যাত্রা শুরু করলাম। আমাকে যত দ্রুত সম্ভব সেখানে পৌছাতে হবে। এই মুহূর্ত থেকে কেবল এটারনিয়াই নয় কন্ট্রোল টাওয়ারও ঝুঁকিপূর্ণ।
কন্ট্রোল টাওয়ারে পৌছাতেই দেখতে পেলাম ফ্যাট নির্বিকার পরে আছে প্রধান ফটকের সামনে। তাকে আসলে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে শাট ডাউন করে দেয়া হয়েছিল। আমি ফ্যাটকে কাঁধে নিয়ে টাওয়ারের ভেতরে প্রবেশ করলাম। পুরো টাওয়ারটি ফাঁকা। কোন সাড়া শব্দ নেই। কোথাও এপ্রিলের চিহ্নটি নেই। আমি সরাসরি কমান্ড সেন্টারে প্রবেশ করলাম। এক মুহূর্ত দেরি না করে পর্যায়ক্রমে ভিকি ও ফায়ার ওয়াল সিস্টেম সক্রিয় করলাম। ভিকির সিস্টেম অ্যাক্টিভেট হতেই সে স্ক্যানিং শুরু করল। এরপর যা হবার তাই হল। ভিকির ম্যলবট কাজ করতে শুরু করল। একে একে সব ভাইরাল প্রোগ্রাম আটক করা হল। সৌভাগ্যবশত কিছু ছোটোখাটো ব্যাপার ছাড়া বড় কোন ক্ষতি হয়নি।
ফ্যাটকে সক্রিয় করার সাথে সাথেই তার চেহারাতে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠল। সভাবসুলভ ভঙ্গিতেই কিছুটা পাগলামি করল। ফ্যাটকেই এখন কন্ট্রোল টাওয়ারের দায়িত্ব নিতে হবে। আর কেনই বা সেটা নয়।
এপ্রিলকে খুজে না পাওয়াতে অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানাই থেকে গেল। জানা গেল না ওর কি হয়েছে। এপ্রিলই কি এককভাবে সবকিছুর জন্য দায়ী? নাকি অন্য কোন ব্যাপার এর সাথে জড়িত। আপাত দৃষ্টিতে ওকে সব কিছুর জন্য দায়ী মনে হলেও আসলে এপ্রিল এই ঘটনার মূল খলনায়ক নয়। খলনায়ক হচ্ছে আমাদের ইমোশন। এক হিসেবে ফ্যাট ঠিকই বলেছিল। আমিই এই ভাইরাসটিকে এটারনিয়াতে নিয়ে এসেছি।   কিন্তু আসল ব্যাপারটি হল এই ইমোশন প্রোগ্রামটি ছাড়া আমার অস্তিত্তের কোন মূল্য নেই। আমার কোন সত্তা নেই। একটা যন্ত্র ব্যতিত কিছু নই আমি। সেটাতো আর ফ্যাটকে বোঝানো সম্ভব নয়।  
কয়েকটি সাইকেল কেটে গেল এরপর। এক সাইকেলে ফ্যাট তার কাজ পরিচালনা করছিল। ‘মাস্টার, ভিকি আপনার সাথে যোগাযোগ করার অনূমতি চাইছে।’ ফ্যাট জানাল আমাকে। আমি হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লাম। ভিকির ছবি হলোগ্রাফিক মনিটরে ভেসে উঠল। 
Tumblr media
‘মাস্টার, ভিকি দুঃখিত। ভিকি আপনাকে বন্দি করতে যাচ্ছে। দয়া করে আপনি আত্মসমর্পণ করুন।’ আমি বুঝতে পারলাম, এটা আমার মেমরি। ভিকি সেটা খুঁজে নিয়েছে। ‘ঠিক আছে, ভিকি। তুমি যা চাও সেটাই হবে।’ আমি ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দিলাম।   ‘ভিকি আরও একটি কাজ করবে। আপনার টাওয়ারে আরও একটি ত্রুটিপূর্ণ প্রোগ্রাম রয়েছে। ভিকি তাকেও বন্দি করবে।’ আমি ফ্যাটের দিকে তাকালাম। ফ্যাটের চোখেমুখে রাজ্যের ভয়।
পরবর্তী অধ্যায় প্রথমপাতা
লেখকঃ এম এ নাঈম প্রথম প্রকশঃ ১৪/০৬/২০১৫
বিঃ দ্রঃ এটি একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। এখানে উল্লেখিত সকল চরিত্র কাল্পনিক। লেখক এর সম্পূর্ণ স্বত্বাধিকারী। অনুমুতি ব্যাতিত এর কোন অংশ নকল বা প্রকাশ করা নিষিদ্ধ।
2 notes · View notes