Tumgik
aminastik · 9 years
Text
ধর্ম - হুমায়ুন আজাদ
আদিম মানুষদের অন্ধ আদিম কল্পনা, আর পরবর্তী অনেকের সুপরিকল্পিত মিথ্যাচার, কখনো কখনো মত্ততা, নানাভাবে বিধিবদ্ধ হয়ে নিয়েছে যে-বিচিত্র রূপ, তাই পরিচিত ধর্ম নামে। বার্ট্যান্ড রাসেল, তার " আমি কেন খ্রিষ্টান নই" বইটিতে, বলেছেন, 'সব ধর্মই ক্ষতিকর ও অসত্য।’ কোনো অলৌকিক জগত থেকে কেউ ধর্ম পাঠায় নি, যদিও এটা বিশ্বাস করার নির্দেশ দিয়ে ভয় দেখানো হয়; কোনো অলৌকিক জগত নেই, মানুষ নিয়ে কোনো অলৌকিক সত্তার কোনো উদ্বেগ নেই। মহাবিশ্বে মানুষ খুবই ক্ষুদ্র । ধর্ম অলৌকিক নয়—বিধাতার বা দেবদেবীদের প্রণীত নয়; ধর্ম লৌকিক—মানুষের প্রণীত এবং বেশ সন্ত্রাসবাদী, ব্যাপার। মানুষ উদ্ভাবনশীল; মানুষের অজস্র উদ্ভাবনের একটি, ও সম্ভবত নিকৃষ্টটি, ধর্ম। ধর্মকে শাশ্বত সর্বজনীন মনে করার একটা চাপ রয়েছে; তবে ধর্ম শাশ্বত নয়, সর্বজনীন নয়। কোনো ধর্ম নেই, যা মানুষের শুরু থেকে চলে এসেছে, ও চিরকাল চলবে; কোনো ধর্ম নেই, যাতে বিশ্বাস করে সবাই। অনেক সত্য আছে, যা সবাই শুধু বিশ্বাস নয়, স্বীকার করে; কিন্তু বিশেষ একটি ধর্ম ও তার বিধাতার বিশ্বাস করে শুধু ওই ধর্মের মানুষ। অন্য ধর্মের মানুষের কাছে তা হাস্যকর ও অনেক সময়, ঘৃণার বিষয়। চারপাশে ধর্ম দেখে মনে হতে পারে যে মানুষ ধর্ম ছাড়া বাচতে পারে না; সত্য হচ্ছে ধর্মের মধ্যে মানুষ বেশিক্ষণ বাঁচতে পারে না। মানুষ মৰ্মমূলে ধর্মবিরোধী, মানুষের পক্ষে বেশি ধর্ম সহ্য করা অসম্ভব;–ধার্মিকেরাও যতোটা ধাৰ্মিক তার থেকে অনেক বেশি অধাৰ্মিক। মানুষের সৌভাগ্য মানুষ বেশি ধর্ম সহ্য করতে পারে না, তাই বিকাশ ঘটেছে মানুষের। বেশি ধর্মে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে, ধাৰ্মিক মানুষ অসুস্থ মানুষ। মানুষ যদি আপাদমস্তক-চব্বিশ ঘণ্টা, তিরিশ দিন, বারোমাস—ধাৰ্মিক প্রাণী হতো, আজো তাহলে থাকতো আদিম অবস্থায়। মানুষের মনের আদিম অংশটুকু ধর্ম। ধাৰ্মিক মানুষকে প্রশংসা করার একটা রীতি প্রচলিত রয়েছে; বলা হয় যে প্রকৃত ধাৰ্মিক মানুষ খুব ভালো মানুষ; কিন্তু সত্য তার উল্টো,—প্রকৃত ধাৰ্মিক মানুষ প্রকৃত খারাপ মানুষ। সে অবিকশিত, এবং মানুষের বিকাশের বিরোধী। হিন্দু, ইহুদি, খ্রিষ্টান, মুসলমান যদি সবাই হতো প্রকৃত হিন্দু, ইহুদি, খ্রিষ্টান, মুসলমান, তবে তারা আজো বাস করতো পাচ থেকে দেড় হাজার বছর আগের সমাজে। ধর্ম মানুষকে এগিয়ে দেয় নি, ধর্ম থাকা সত্ত্বেও মানুষ এগিয়েছে; কেননা মানুষ কখনোই পুরোপুরি ধাৰ্মিক নয়। মানুষ কখনো ধর্মের বিধান পুরোপুরি মানে নি। ধর্মের কোনো উপকারিতা দেখা যায় নি, কিন্তু অজস্র অপকারিতা সব সময়ই দেখা যায়। প্রত্যেক ধর্মের রয়েছে দুটি দিক;—ধর্মগুলো নিজেদের দায়িত্ব হিশেবে ব্যাখ্যা করে বিশ্বসৃষ্টির রীতি, এবং তৈরি করে সামাজিক বিধান। ধর্মের বইগুলো বিজ্ঞানের বই নয়, ওগুলো খুবই অবৈজ্ঞানিক। এগুলোতে বিশ্বসৃষ্টির যে-বর্ণনা পাওয়া যায়, তা পুরোপুরি ভুল; ওই বর্ণনা বইগুলো রচনাকালের মানুষের বিভ্রান্ত কল্পনামাত্র। বিশেষ এক ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠাই ধর্মপ্রবর্তকদের লক্ষ্য, তাই ধর্ম মূলত আদিম রাজনীতি। মৃত্যুর পর মানুষের পরিণতি বর্ণনা ধর্মের এক প্রিয় বিষয়; এ-এলাকায় ধর্মগুলো মানুষকে লোভের পর লোভ আর ভয়ের পর ভয় দেখায়। মৃত্যুর পর মানুষের পরিণতি সম্পর্কে ধর্মগুলো যা বলে, তা হাস্যকর, যাতে বিশ্বাস করতে পারে শুধু লোভী ও ভীত মানুষ। মানুষ সম্পর্কে খুবই নিম্ন ধারণা পোষণ করে ধর্মগুলো। ধর্মগুলো ধ’রে নিয়েছে যে মানুষ লোভী ও ভীত; তাই তাদের লোভ দেখাতে হবে, এবং রাখতে হবে সন্ত্রস্ত করে। ধর্মগ্রন্থ পড়ার সময় ধাৰ্মিক মানুষ বারবার লোভে পড়ে, আর ভয়ে কেঁপে ওঠে; তাই ধাৰ্মিক মানুষের পক্ষে সুস্থ থাকা সম্ভব নয়, লোভ ও ভয়ের মধ্যে বাস ক’রে তারা হয়ে পড়ে বিকলনগ্রস্ত। ধার্মিকেরা খুবই অমানবিক, তারা নিজেদের ধর্ম ও ধর্মের বই ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম ও ধর্মের বইকে মর্যাদা দেয় না। এক ধর্মের ধাৰ্মিক অন্য ধর্মের পবিত্রগ্রন্থ ও গৃহকে অবলীলায় অপমানিত করতে পারে, যা নাস্তিকেরা কখনো করে না। যে-কোনো নির্বোধের পক্ষে ধাৰ্মিক হওয়া সহজ, কিন্তু শুধু জ্ঞানী ও মানবিক ব্যক্তিই হতে পারে নাস্তিক। নাস্তিক হত্যা আর ধ্বংস করে না; কিন্তু ধাৰ্মিক সব সময় হত্যা ও ধ্বংসের জন্যে ব্যগ্র থাকে; তারা ইতিহাসের পাতাকে যুগে যুগে রক্তাক্ত করেছে। প্রত্যেক ধর্মে রয়েছে অসংখ্য সন্ত, যারা ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের হত্যাকারী। নাস্তিক চায় মানুষের চেতনাকে বদলে দিতে, মানুষকে বিকশিত করতে; আর ধাৰ্মিক চায় মানুষের চেতনাকে নষ্ট করতে, মানুষকে রুদ্ধ করতে। ধার্মিকদের নৈতিকতাবোধ খুবই শোচনীয়। বহু ধর্ম রয়েছে পৃথিবীতে। একটি সরল প্রশ্ন জাগতে পারে যে বিধাতা যদি থাকেন, তিনি যদি একলাই স্রষ্টা হন, তবে তিনি কেনো এতো ধর্ম পাঠালেন? তিনি একটি ধর্ম পাঠালেই পারতেন, এবং আমরা পরম বিশ্বাসে সেটি পালন করতে পারতাম। তিনি তা করে নি কেনো? তবে কি তিনি একলা নন? ওই অলৌকিক জগতেও কি রয়েছেন বহু প্রতিদ্বন্দ্বী, যারা মানুষের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে ব্যগ্র? তাদের কেউ হিন্দুর, কেউ ইহুদির, কেউ খ্রিস্টানের, কেই মুসলমানের, এবং কেউ ঙ-র, কেউ চ-র, কেউ ছ-জ-ঝর? যদি তিনি একলা, তাহলে এতো ধর্ম পাঠিয়ে কেনো তিনি বিভ্রান্ত করছেন মানুষকে? শুধু বিভ্রান্ত ক’রেই তিনি সুখ পাচ্ছেন না; তিনি মানুষের মধ্যে তৈরি করেছেন বিভাজন—কাউকে করেছেন ইহুদি, কাউকে খ্রিষ্টান, কাউকে মুসলমান, কাউকে হিন্দু। কেনো এদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন শক্���তা, এবং লিপ্ত করেছেন পারস্পরিক হত্যাকাণ্ডে? আরো নানা প্রশ্ন জাগতে পারে। তিনি কেনো শুধু এক ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করেন? তিনি কেনো একজনের কাছে বাণী পাঠান? তিনি কেনো শুধু প্রাচীন কালেই দেখা দিতেন? কেনো তিনি দেখা দিচ্ছেন না আধুনিক কালে? আধুনিক কাল নিয়ে তার বা তাদের কোনো উদ্বেগ নেই? কেনো তিনি একদলকে গরু খেতে নিষেধ করেন, আরেক দলকে খেতে বলেন; কেনো তিনি একদলের জন্যে নিষিদ্ধ করেন মদ্য, এবং সিদ্ধ করেন আরেক দলের জন্যে? কেনো তিনি সর্বশক্তিমান হয়েও শক্তির প্রকাশ ঘটান না? তার ক্রিয়াকলাপ কেনো এতো বিস্ময়কর, অস্বাভাবিক, এবং সম্পূর্ণরূপে অবিশ্বাস্য?
এসব সরল প্রশ্নের উত্তর ধর্মের বইগুলোতে পাওয়া যাবে না, কিন্তু পাওয়া যাবে যদি আমরা ধর্মের উদ্ভবের রীতি উদঘাটন করি। ধর্মগুলো কোনো অলৌকিক জগত থেকে কেউ পাঠায় নি, তেমন কেউ নেই; বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীই সৃষ্টি করেছে এগুলো। কোনো পরম সত্তা যদি থাকতেন, এবং তিনি যদি পৃথিবীতে ধর্মের প্রয়োজন বোধ করতেন (সম্ভবত বোধ করতেন না, তুচ্ছ মানুষের তুচ্ছতর স্তব তার ভালো লাগতো না), তাহলে একটি ধর্মই পাঠাতেন তিনি। ধর্মগুলো বাতিল ক’রে দেয় একটি অন্যটিকে; একই সময়ে সবগুলো ধর্ম সত্য হতে পারে না। কোনো সত্যের থাকতে পারে না একাধিক ব্যাখ্যা বা তত্ত্ব; কোনো প্রপঞ্চের একাধিক তত্ত্ব পেলে বুঝতে হবে এগুলোর একটি ঠিক হতে পারে, বা সবগুলোই ভুল। বিভিন্ন প্রতিযোগী তত্ত্বের মধ্যে মাত্র একটিই ঠিক হতে পারে, বা ভুল হতে পারে সবগুলোই। ধর্মগুলো বিশ্বসৃষ্টি, মানবসমাজ, মানুষের পরিণতি সম্পর্কে প্রস্তাবিত বিভিন্ন প্রতিযোগী তত্ত্ব;–পরস্পরবিরোধী, ও ভুল। এজন্যেই বহু সরল প্রশ্নের উত্তর এগুলো দিতে পারে না; সাধারণত নিষেধ করে প্রশ্ন করতে। এগুলো কথা বলে এমনভাবে, যা প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা যায় না। যা প্রমাণ ও অপ্রমাণ করা যায় না, তা অবৈজ্ঞানিক । ধর্মগুলো একদিনে দেখা দেয় নি; হঠাৎ কোনো ঈশ্বর কোনো ধর্ম পাঠান নি। মানুষ আদিম কাল থেকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে বিশ্বকে—বিশ্ব ও নিজের উদ্ভবকে, চারপাশের প্রপঞ্চরাশিকে; কিন্তু তখন তার সত্য উদঘাটনের শক্তির বিকাশ ঘটে নি; তাই সে সাহায্য নিয়েছে কল্পনার। সে অবিরাম ভুল কল্পনা করেছে, ভুল কল্পনার পর ভুল কল্পনাকে সত্য ব’লে বিশ্বাস করেছে, এবং বিকাশ ঘটিয়েছে বিচিত্র রকম ধর্মের। ধর্ম হচ্ছে আদিম ও ভুলবিজ্ঞান। আজ আমরা বজ্র আর বিদ্যুৎ ব্যাখ্যা করতে পারি; বিজ্ঞান বজ্রবিদ্যুতের সত্য বের করেছে; কিন্তু আদিম মানুষের পক্ষে এ-সত্য বের করা সম্ভব হয় নি। তারা কল্পনা করেছে দেবতা, আর দেবতাদের অস্ত্র। দেবতা, দেবতার অস্ত্র ইত্যাদি হচ্ছে আদিম মানুষের কল্পিত ব্যাখ্যা, যার মূলে কোনো সত্য নেই; কিন্তু এসব ভুলই গৃহীত হয়েছে ধর্মরূপে ।
আদিম মানুষ চারপাশের প্রপঞ্চ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বহু কাহিনী বা কিংবদন্তি তৈরি করেছিলো, বর্ণনা করেছিলো দেবতা বা অতিপ্রাকৃত সত্তার উপাখ্যান। আদিম মানুষের কল্পিত উপাখ্যানগুলোকে বলা হয় পুরাণ, এবং পুরাণ থেকেই হয়েছে ধর্মের উৎপত্তি। পুরাণ আদিম চিন্তাভাবনাকল্পনার ফল। বহু পৌরাণিক উপাখ্যান অত্যন্ত উপভোগ্য, এমনকি তাৎপর্যপূর্ণ; কিন্তু ওগুলো উপাখ্যান । পুরাণের এক উদ্দেশ্য ছিলো মানুষের সাথে মহাজগতের সম্পর্ক ব্যাখ্যা; পুরাণরচয়িতারা তা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে অনেকের কাছে এপুরাণই হয়ে ওঠে ধর্ম। আমাদের চারপাশের বড়ো ঘটনাগুলোকেও আমরা মহাজগতের সাথে জড়িত করি না; কিন্তু আদিম মানুষের স্বভাবই ছিলো জীবনে তুচ্ছতম ব্যাপারটিকেও মহাজগতের সাথে জড়িয়ে দেয়া। দাতের পোকা তাড়াতেও তারা এমন সব মন্ত্র আবৃত্তি শুরু করতো, যেনো ওই পোকার সাথে মহাজাগতিক বিশাল সব ব্যাপারের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পুরাণ ভরে পাওয়া যায় বিভিন্ন দেবতার জন্মের বিবরণ, তাদের শক্তি ও স্বভাবের কথা, বিশ্বসৃষ্টির উপাখ্যান। বিভিন্ন পুজো আর অর্চনার কারণও বর্ণনা করা হয় পুরাণে । পুরাণের গল্পগুলোতে পাওয়া যায় আদিম যুক্তি-অবিকশিত মানুষের মনের পরিচয় । পুরাণ যুক্তিপরায়ণ মনের সৃষ্টি নয়; সহজেই বোঝা যায় যে পুরাণগুলো এসেছে আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে থেকে। আমরা পৌরাণিক উপাখ্যানগুলোকে গল্প বলে মনে করি, সত্য মনে করি না; এবং জেসাসের, যদি সত্যিই জেসাস ব’লে কেউ জন্ম নিয়ে থাকেন, জন্মের বহু আগেই অনেকের কাছে এগুলো গ্রহণযোগ্য মনে হয় নি। তাই অনেক ধর্মপ্রণেতা, পুরোহিত, এবং কবি এগুলোকে গ্রহণযোগ্য রূপ দিতে চেয়েছেন। থিআগেনেস (৫২০ খ্রিপূ) অশোভন মনে করেছেন গ্রিক পুরাণের দেবতাদের যুদ্ধবিগ্রহ ও অন্যান্য কার্যকলাপ; তার মতে দেবতারা এমন অশোভন কাজ করতে পারেন না। ইন্দ্র আর জিউস যতো নারী ধর্ষণ করেছে, কোনো পুরুষ ততো করার স্বপ্নও দেখে নি। তিনি দেবতাদের যুদ্ধবিগ্রহকে ব্যাখ্যা করেছেন বিভিন্ন মৌল উপাদানের, আগুন-বাতাস-জলের, সংগ্রামের রূপকরূপে। বাইবেল বলেছে বিধাতা নিজের আদলে মানুষ সৃষ্টি করেছেন; আসলে মানুষ নিজের আদলে সৃষ্টি করেছে দেবতাদের। জেনোফানেস পছন্দ করেন নি মানুষ আকৃতির দেবতাদের। তার মতে: ঈশ্বর একজনই, যিনি শ্রেষ্ঠ দেবতা আর মানুষদের মধ্যে; অবয়ব আর চিন্তা কোনো কিছুতেই তিনি মানুষের মতো নন, তবু মানুষ কল্পনা করে যে দেবতারা মানুষের মতোই জন্মেছে, এবং তাদের অবয়ব আর কণ্ঠস্বর মানুষেরই মতো। যদি বৃষ, সিংহ, আর অশ্বরা মূর্তি বানাতে পারতো, তবে তারাও নিজেদের অবয়বের মতোই বানাতো দেবতাদের মূর্তি।
প্রাচীন মিশরিরাও বিস্মিত হতো যে তাদের অধিকাংশ দেবতাই পশু । তারা এটা মেনে নিতে পারতো না; এবং ব্যাখ্যা করতো যে দেবতারা পশু নয়, শুধু বিপদের সময়েই দেবতারা আশ্রয় নিতো নানা পশুর শরীরে ।
ম্যাক্স মুলার পুরাণরচয়িতাদের মনে করেছিলেন উন্মাদ । পুরাণে আদিম অযৌক্তিক উপাদানের প্রাচুর্য দেখে তিনি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, মানবজাতির জীবনে এসেছিলো এক অস্থায়ী পাগলামোর কাল; তারা ভুগেছিলো পাগলামো রোগে । একই পাগলামোতে কি ভুগেছিলো ভারত, গ্রিস, মিশর, ব্যাবিলন, প্যালেস্টাইন, আর আইসল্যান্ডের আদিম মানুষ? পুরাণকে কি মনে করবো পাগলামো? পুরাণের অযৌক্তিকতা পাগলামো নয়; তারা পাগল ছিলো না, ছিলো অবিকশিত। পুরাণ অবিকশিত মনের মানুষের সৃষ্টি। তাদের মনের বিকাশ ঘটে নি, যেমন আজো অধিকাংশের মন অবিকশিত রয়ে গেছে। তাদের অভিজ্ঞতা ছিলো কম, এবং ছিলো না বিজ্ঞানসম্মত, বস্তুনিষ্ঠ, ব্যাখ্যার মননশীলতা, যেমন আজো নেই অধিকাংশের। তারা বিভিন্ন প্রপঞ্চ যুক্তিসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করতে না পেরে ব্যাখ্যা করেছিলো আদিম কল্পনার সাহায্যে; সত্য আবিষ্কারের বদলে তারা বানিয়েছিলো কল্লোপাখ্যান। তারা ছিলো মানসিক শৈশবে, যেমন আজো আছে অধিকাংশ। তারা মনে করেছিলো প্রকৃতির শক্তিগুলো মানুষের মতোই; সেগুলো মানুষের মতোই কথা বলতে, কাজ ও চিন্তা করতে পারে। এরকম বিশ্বাসকে বলা হয় "অয়ানিমিজম বা সর্বাত্মাবাদ" যা বিশ্বাস করে প্রত্যেক বস্তুর আছে আত্মা । তারা মনে করেছিলো বাতাস, জল, আর গাছ কথা বলে; তারা বিশ্বাস করেছিলো যে আকাশ ভরে রয়েছে দেবতা। তারা যা দেখেছিলো, তা ব্যাখ্যার জন্যে যুক্তির সাহায্য নেয় নি, সাহায্য নিয়েছিলো কল্পনার। সব দেশের পুরাণের উপাখ্যানেই মেলে মানুষের বর্বরতার কালের পরিচয় । মানুষের প্রথম উদ্ভাবিত ধর্ম সর্বাত্মাবাদ। তারা বিশ্বাস করতো সব কিছুরই আত্মা আছে, যদিও আজ আত্মা ব’লে কিছু আমরা মানি না। সর্বাত্মাবাদী পুরাণে পাওয়া যায় আত্মা সম্পর্কে আদিম ভাবনার স্পষ্ট পরিচয়। পাওয়া যায় অনেক গল্প, যাতে কেউ ভূতপ্রেতের দেশে যায়, বা যায় এমন দেশে, যেখানে পশুপাখি কথা বলে, যেখানে মানুষকে রূপান্তরিত করা হয় পশু বা গাছে। সর্বাত্মাবাদী বিশ্বাসে আত্মা আর শরীরের মধ্যে রয়েছে পার্থক্য, যা টিকে আছে আজো সমস্ত ধর্মে। আজ বিজ্ঞান আত্মা মানে না, কিন্তু সাধারণ বিশ্বাসে আদিম বিশ্বাস এখনো টিকে আছে। বলা হয় ফেট’জম বা যদুবাদ বা ইন্দ্রজলবাদ। আদিম মানুষ বিশ্বাস করতো যে অনেক বস্তুর রয়েছে যাদুশক্তি। আফ্রিকা, এশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, অর্থাৎ সব করতো কোনো কোনো বস্তুতে বাস করে কোনো অতীন্দ্রিয় শক্তি। যাতে অতীন্দ্রিয় শক্তি বাস করে, সেটি যাদুবস্তু; যেমন কোনো অস্থি, বা পাথর, বা একগুচ্ছ পালক, বা ঝিনুকের মালা, বা অন্য কিছু। তারা বিশ্বাস করতো কোনো কোনো ব্যক্তি ওই বস্তুতে ডেকে আনতে পারে ওই বস্তুটির সাথে জড়িত অলৌকিক সত্তাটিকে, জিন বা দৈত্যকে, বা ওই সত্তাটি সব সময়ই থাকে ওই বস্তুটিতে। যাদুবাদ আজো টিকে আছে পৃথিবী জুড়ে। যাদুবাদের যাদুবস্তুতে যে-সত্তাটি বাস করে, সেটি হচ্ছে প্রেত। প্রেত দেবতা নয়, প্রেত আর দেবতার মধ্যে রয়েছে পার্থক্য; তবে প্রেত এক সময় হয়ে উঠতে পারে দেবতা। প্রেত আর দেবতার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে দেবতার থাকে ভক্ত, তার পুজো করা হয়; আর যাদুবাদের প্রেত থাকে কোনো ব্যক্তি বা গোত্রের অধীনে; যেমন আরব্যরজনীর প্রেত। সেটি দেবতা নয়, ভৃত্য; প্রদীপটি, অর্থাৎ যাদুবস্তুটি যার অধিকারে থাকে, সে হয় তার গোলাম। তবে অনেক সময় যাদুবাদের প্রেত হয়ে উঠতে পারে দেবতা। যাদুবাদের পর মানুষ পৌছে ধর্মের আরেক স্তরে, যার নাম টোটেমিজম বা উৎসবস্তুবাদ। টোটেম হচ্ছে কোনো পশু, বা উদ্ভিদ, বা বস্তু, যা কোনো সামাজিক শ্রেণীর সাথে সম্পর্কিত। টোটেমবাদে বিশেষ বিশেষ সামাজিক শ্রেণীর নাম হয়ে থাকে সম্পর্কিত টোটেমের নাম অনুসারে; তারা নিজগোত্রের প্রতীক হিশেবে ব্যবহার করে টোটেমটিকে। ওই গোত্রের লোকেরা মনে করে যে তারা ওই টোটেম প্রাণী বা উদ্ভিদ বা বস্তুটি থেকে জন্মেছে, এবং টোটেমটি তাদের জন্যে পবিত্র। পুরাণে পাওয়া যায় টোটেমের প্রচুর উদাহরণ। এর পর মানুষ সৃষ্টি করে দেবতা; দেবতা এবং দেবতা এবং দেবতা; এবং দেখা দেয় বহুদেবতাবাদ বা বহুঈশ্বরবাদ বা বহুভগবানবাদ । বহুদেবতাবাদে দেবতারা পরিপূর্ণ বিকশিত, ও তারা শক্তিমান। দেবতারা শক্তিমান হ’লেও স্তরক্রম অনুসারে। বহুদেবতাদের বিকাশ ঘটে নানা পথে। আদিম মানুষ দেবতার পর দেবতা তৈরি করে, দেবতাদের দেয় বিভিন্ন ভূমিকা বা দায়িত্ব, এবং তাদের পুজো করে; অনেক সময় একদল দেবতার কিছু কিছু শক্তি কমিয়ে ওই শক্তি অন্য দেবতার ওপর অর্পণ করে তৈরি করে নতুন দেবতা, বা পুরোনো দেবতাদের ঔরসে জন্ম দেয়া হয় নতুন দেবতাদের। কখনো কোনো দেবতা হয়ে ওঠে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কোনো দেবতা হারিয়ে ফেলে তার গৌরব; এতে ওই দেবতা কোনো ভূমিকা পালন করে না, ভূমিকা পালন করে মানুষ। মনে করা যাক কোনো নগরে বা ধর্মকেন্দ্রে পূজিত হতো কয়েকটি দেবতা; কিন্তু তাদের মধ্যে কে বড়ো কে ছোটো তা ছিলো অনিণীত। দেবতারা নিজেরা যুদ্ধ করে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারতো না; পুরোহিতেরাই দেবতাদের নানাভাবে বিন্যস্ত করে সৃষ্টি করতো দেবমণ্ডলী। দেবতাদের ভাগ্য পুরোপুরি নির্ভর করতো ভক্তদের ওপর। ভক্তরা তাদের দেবতাদের ভূষিত করতো নানা গুণে, অনেক সময় ভুল বুঝে বদল ঘটাতো দেবতাদের নামের। তারপর ছিলো ভক্ত রাজাদের উত্থানপতন, ভক্তদের দেশত্যাগ, জয় আর পরাজয়, এবং নতুন জাতির সংস্পর্শ। কোনো ভূভাগের রাজা পুজো করতো যে-দেবতাদের, তারা হতো প্রধান দেবতা; অন্য দেবতাদের ভক্ত যখন তাকে পর্যুদস্ত ক’রে রাজা হতো, তখন পর্যুদস্ত হতো আগের রাজকীয় দেবতারা, শক্তিমান আর প্রধান হয়ে দেখা দিতো নতুন রাজার দেবতারা। দেবতাদের ভাগ্য নির্ভর করতো ভক্তদের ভাগ্যের ওপর। দেবতারা ভক্তদের ভাগ্য কখনো নির্ধারণ করে নি, চিরকাল ভক্তরাই নির্ধারণ করেছে দেবতাদের ভাগ্য। বিধাতারা কখনো নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে নি, ভক্তরাই বিস্তার করেছে তাদের বিধাতাদের সাম্রাজ্য।
মানুষ উৎপাদন করেছিলো অজস্র দেবতা। এক সময় তারা আকাশমণ্ডল ভরে ফেলেছিলো দেবতায়; এবং তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলো নানা বিভাগের দায়িত্ব। কাউকে দেয়া হয়েছিলো অগ্নিবিভাগের দায়িত্ব, সে অগ্নিদেবতা; কাউকে জলবিভাগের দায়িত্ব, সে জলদেবতা; এভাবে দেখা দিয়েছিলো বায়ুদেবতা, বজ্রদেবতা, মাটির দেবতা, মদের দেবতা, শস্যের দেবতা, এবং শিল্পকলা, শিক্ষা, ধন ও আরো অসংখ্য বিভাগের দেবতা। ঋগ্বেদ এর ঋষিরা তৈরি করেছিলো ৩৩টি দেবতা;—১১টি পৃথিবীতে, ১১টি অন্তরীক্ষে, ১১টি স্বর্গে; তারপর বিভিন্ন বস্তুর অধিপতি হিশেবে কল্পনা করেছিলো ৩৩ কোটি দেবতা। তারা এসব দেবতা জন্যেই। তারা চারপাশের সব কিছুকে নিজেদের কল্যাণের জন্যে ব্যবহার করতো, এবং বিশ্বাস করতো ওই সব কিছুরই দেবতা রয়েছে, তাই দেবতাদের পুজো করলে দেবতারা তাদের জীবনকে সম্পদে ভ'রে দেবে। দেবতাদের সাথে তাদের থাকতো একটি চুক্তি, চুক্তিটি হচ্ছে দেবতারা তাদের অন্ন দেবে, বিনিময়ে তারা দেবে দেবতাদের অর্ঘ্য । তাদের কয়েকটি দেবতার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। আজ আমরা জানি সূর্যই পার্থিব সব কিছুর উৎস; আদিম মানুষেরাও সূর্যকেই মনে করতো জীবনের উৎস বলে। তবে তারা আজকের মতো জানতো না, তারা জানতো তাদের মতো করে। সব দেশে পুরাণেই দেবমণ্ডলীর মধ্যে সূর্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছে। সর্বাত্মাবাদীরা মনে করতো মানুষের মতোই সূর্যের আছে প্রাণ ও ইচ্ছাশক্তি, তাই সে চলতে পারে। বৈদিকরা সূর্যশ্রেণীতে সৃষ্টি করেছিলো বহু দেবতা : আদিত্য, মিত্র, বরুণ, পূষা, ভগ, অশ্বিনীকুমার, সবিতা প্রভৃতি। গ্রিকরা দুটি সূর্যদেবতা সৃষ্টি করেছিলো, একটি অ্যাপোলো, আরেকটি সূর্য নিজে, যার নাম হেলিওস। অ্যাপোলো তিমিরবিনাশী দেবতা, যে সোনালি তীরের আঘাতে হত্যা করে রাত্রির সাপ পাইথনকে, এবং তার এক কাজ হচ্ছে সভ্যতার বিকাশ ঘটানো। পৃথিবী জুড়েই পাওয়া যায় সূর্যদেবতা—ইন্দ্র, ক্যাডমাস, হোরাস প্রভৃতি, এবং তাদের উদ্ভবের উপাখ্যানের মধ্যেও মিল রয়েছে। সূর্যদেবতার মতো বজ্রদেবতাও পাওয়া যায় পৃথিবী ভরে।
আদিম মানুষ সৃষ্টি করে ছিল অজস্র দেবতা। যাদের এখন আর আমরা, হিন্দুরা ছাড়া, দেবতা মনে করি না; এবং বিশ্বাস করি না দেবতায় ।
দেবতাদের কাল শেষ হয়ে আসতে থাকে; বহুদেবতাবাদের পর, তিন-চার হাজার বছর আগে, মানুষ এগোয় একদেৱতাবাদ বা একেশ্বরবদের দিকে; তবে মানুষ কখনোই সম্পূর্ণরূপে একেশ্বরবাদী হয়ে ওঠে নি। একদেবতাবাদীদের ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে, প্রচ্ছন্ন ও স্পষ্টভাবে, বহুদেবতার মুখ দেখা যায়। ঈশ্বর বা বিধাতা বললে দেবতার থেকে মহান কিছু বোঝায় বলে অনেকের মনে হয়; কিন্তু ঈশ্বর বা বিধাতাও দেবতাই। এতে যা ঘটে তা হচ্ছে বহুদেবতাকে সরিয়ে একটি দেবতার প্রতিষ্ঠা। বহুদেবতাবাদ থেকে নানা প্রক্রিয়ায় দেখা দেয় একদেবতাবাদ। মানুষই সৃষ্টি করেছিলো বহুদেবতা, আবার মানুষই সৃষ্টি করে একদেবতা; এতে দেবতাদের কোনো ভূমিকা নেই। কখনো বহুদেবতার মধ্যে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে একটি বিশেষ দেবতা, কেননা, সেটি বিজয়ী জাতির দেবতা; সে নিজে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে নি, তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে বিজয়ী জাতি; কখনো পুরোহিতেরা বহুদেবতা পছন্দ করে নি, অন্য সব দেবতাকে বাদ দিয়ে প্রধান ক’রে তুলেছে একটিকে; কখনো ভক্তরা ছোটো দেবতাদের শক্তি কমিয়ে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় করে তুলেছে বিশেষ একটি দেবতাকে; কখনো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কেউ এসে একাধিক দেবতার মধ্য থেকে একটিকে ঈশ্বর বা বিধাতা ব’লে ঘোষণা ক’রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে তার প্রেরিতপুরুষরূপে; কখনো দেশের রাজবংশটি প্রধান করে তুলেছে একটি দেবতাকে। এতে দেবতাটির কোনো কৃতিত্ব নেই; সব কৃতিত্ব মানুষের। একদেবতাবাদ ও বহুদেবতাবাদের মধ্যে কোনোটি উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট নয়, যদ���ও এখন একদেবতাবাদকেই উৎকৃষ্ট বলে প্রচার করা হয়। ভাষার খেলাও কাজ করে এখানে। একদেবতাবাদকে বলা হয় একেশ্বরবাদ, তবে দেবতা ও ঈশ্বর মূলত একই জিনিশ । ইংরেজিতে শুরুতে বড়ো অক্ষর দিয়ে লেখা হয় God; দেবতাদের বেলা লেখা হয় ছোটো অক্ষরে god; এটা ভাষার খেলা। এমন কোনো মানদণ্ড নেই, যা দিয়ে একটিকে উৎকৃষ্ট ও অন্যটিকে নিকৃষ্ট প্রমাণ করা যায়। দুটিই সমান আদিম কল্পনা। তবে বহুদেবতাবাদ অনেকটা নিরীহ, ওই দেবতারা সারাক্ষণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার ও শাস্তি দেয়ার জন্যে উত্তেজিত থাকে না; কিন্তু একদেবতাবাদের দেবতা বা বিধাতা প্রচণ্ড নিয়ন্ত্রণবাদী, হিংস্র, ও বিদ্বেষপরায়ণ একদেবতাবাদের দেবতার থাকে স্বৈরাচারী প্রবণতা; সে নিজের বন্ধ্যা নিঃসঙ্গতায় বিরাজ করে মহাজাগতিক একনায়করূপে। নিঃসঙ্গ একদেবতা ভালোবাসা চায় না ভক্তদের, সে চায় তার ভয়ে ভক্তরা কাপবে থরথর করে, ভক্তরা হবে তার দাস । আদিম মানুষ সৃষ্টি করেছিলো অজস্র পুরাণ। তারা যে-প্রপঞ্চেরই মুখোমুখি হয়েছে, তার সম্পর্কেই উপাখ্যান তৈরি করেছে—সত্য বের করতে পারে নি; এবং এমন অনেক কিছু সম্পর্কে উপাখ্যান তৈরি করেছে, যার মুখোমুখি তারা কখনো হয় নি; তাই তার সত্য আবিষ্কারের কথাই ওঠে না। তারা তৈরি করেছে বিশ্ব ও মানুষ সৃষ্টির পুরাণ, বন্যার পুরাণ, স্বর্গের পুরাণ, নরকের পুরাণ, অগ্নির পুরাণ ও আরো অজস্র পুরাণ। সব পুরাণেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব; এবং এখনকার প্রচলিত ধর্মগুলো বিশ্বসৃষ্টির তত্ত্ব ধার করেছে বিভিন্ন পুরাণ থেকে। পুরাণের বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব যেহেতু ভুল বা অবৈজ্ঞানিক, তাই পৃথিবীর ধর্মগুলোর বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্বও ভুল এবং অবৈজ্ঞানিক। আদিম মানুষের কাছে জল ছিলো এক মহাব্যাপার; তাই সৃষ্টিপুরাণগুলোতে সাধারণত পাওয়া যায় জলের এক মহাজগত, যার ভেতরে উদ্ভূত হয় স্বয়ম্ভু স্ৰষ্টা, এবং কোনো শব্দ উচ্চারণ করে, বা ইচ্ছাশক্তিতে, বা শারীরিক শ্রমে সৃষ্টি করে জগত বা পৃথিবী। সাধারণত সে অতল জলের পাতাল থেকে উদ্ধার করে পৃথিবীকে। ব্যাবিলনিরা মনে করতো বেল বা মেরোডাক স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছে তিয়াওয়াথের শরীরের দু-টুকরো দিয়ে; পারসি জুরথুস্ত্রিরা বিশ্বাস করতো আহুর মাজদা বা ওরমুজদ হচ্ছে স্রষ্টা; গ্রিকরা বিশ্বাস করতো ইউরেনাস আর গ্যাআর মিলনে জন্মেছে সব কিছু হিন্দুরা মনে করে বরাহ অবতাররূপে ব্ৰহ্মা জলের অতল থেকে দাতে গেথে উদ্ধার করে পৃথিবীকে, এবং শুরু করে সৃষ্টির কাজ; জাপানিরা মনে করে ইজানাগি আর ইজানামির মিলনে সৃষ্টি হয়েছে জগত; পেরুর ইনকাসরা বিশ্বাস করতো আতাগুজু সৃষ্টি করেছে সব কিছু। মানুষ সৃষ্টির পুরাণে সাধারণত পাওয়া যায় যে এক অলৌকিক সত্তা মানুষ সৃষ্টি করেছে কাদা বা ধুলো থেকে। সে অনেক সময় মানুষকে ভিজিয়ে নেয় নিজের রক্তে বা ঘামে, এবং তার ভেতর সঞ্চার করে প্রাণ বা নিশ্বাস। গ্রিকরা বিশ্বাস করতো প্রমেথিউস সৃষ্টি করেছে নরনারী; হিন্দুরা মনে করে ব্ৰহ্মা বা প্রজাপতি সৃষ্টি করেছে মানুষ; ব্রাজিলের আদিবাসীরা মনে করে অধোলোক থেকে মানুষ এসেছে; মধ্য আমেরিকার কিচেরা মনে করে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে হলদে আর শাদা ভুট্টা থেকে। এর সবগুলোই সম্পূর্ণ ভুল।
প্রাচীন ভারতিরা বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে নিরবধি বুনেছে কল্পনার জাল। ঋগ্বেদ এর ঋষিরা কল্পনা করতে গিয়ে বিহ্ববল হয়েছেন, দেখেছেন মহাশূন্যটা। তারা বলেছেন, শুরুতে অসত্তাও ছিলো না, সত্তাও ছিলো না, ছিলো শুধু আঁধারে আবৃত জলরাশি। তারপর সেখানে জাগে কর্ম বা বাসনা। ঋগ্বেদ বলেছে : অস্তি ছিলো না, নাস্তিও ছিলো না, বায়ু ছিলো না, দূরে আকাশও ছিলো না; কে ছিলো সব কিছু আবৃত করে? কার ওপর নির্ভর করে ছিলো সব কিছু? অতল জলের ভেতরে? তখন মৃত্যু ছিলো না, অমৃত্যুও ছিলো না, ছিলো না রাত্রি ও দিনের বদল; শুধু একজনই নিশ্বাস নিচ্ছিলো ধীরে, তার বাইরে ছিলো না আর কিছু। কে জানে কখন উদ্ভূত হয়েছিলো এই মহাসৃষ্টি? তখন কোনো দেবতার জন্ম হয় নি, তাই কে প্রকাশ করতে পারে এ-সত্য? কখন জন্মেছে এ-জগত, আর তা স্বগীয় না অন্য কোনো হাতের রচিত, তা বলতে পারে শুধু স্বর্গে বিরাজমান এর প্রভু, যদি সম্ভব হয় তার পক্ষে ।
ঋগ্বেদ এর ঋষির অনিশ্চয়তাবোধে তৃপ্ত হয় নি যাযাবর আর্যরা, তারা আরো নিশ্চিত হতে চেয়েছে, এবং ঋগ্বেদ-এর পুরুষসক্ত-এ বলা হয়েছে: পুরুষের রয়েছে সহস্র মস্তক, সহস্ৰ চোখ, সহস্র পদ। পৃথিবীর সব দিক জুড়ে দশ আঙুলে সমান ভূমিতে তিনি বিরাজ করেন। পুরুষ নিজেই সমগ্র বিশ্ব, যা ছিলো, এবং যা হবে। - তারা আরো বলেছে যে দেবতারা খণ্ডিত করে পুরুষকে; তার মুখ থেকে জন্মে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে রাজন্য, উরু থেকে বৈশ্য, পা থেকে শূদ্র; তার মন থেকে জন্মে প্রভাত, চোখ থেকে সূর্য, মুখ থেকে ইন্দ্র আর অগ্নি ইত্যাদি, অর্থাৎ রাশিরাশি বাজে কথা। "সপ্তপথ ব্রাহ্মণ"এ পাওয়া যায় যে ভূ উচ্চারণ করে প্রজাপতি সৃষ্টি করে পৃথিবী, ভূবহু উচ্চারণ করে বায়ু, স্বহ উচ্চারণ করে আকাশ; ভূ বলে প্রজাপতি সৃষ্টি করে ব্রাহ্মণ, ভূবহ' বলে ক্ষত্র ইত্যাদি। তৈত্তিরিয় ব্রাহ্মণ "এ আছে ব্ৰহ্মা সৃষ্টি করেছে বিশ্ব, তারপর কী কী সৃষ্টি করেছে, তারও বর্ণনা আছে। হিন্দুদের পুরাণগুলোতে পাওয়া যায় সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার বিস্তৃত বিবরণ। যেমন, বিষ্ণুপুরাণ এর মতে ব্ৰহ্মা আদিতে ছিলো পুরুষ বা চৈতন্য এবং কালরূপে, তারপর তাতে যুক্ত হয় আরো দুটি রূপ; এবং ব্ৰহ্মার চারটি সত্তা—প্রধান উপাদান, পুরুষ, ব্যক্ত বা দৃশ্যমান বস্তু, ও কালই বিশ্বসৃষ্টি, রক্ষা ও ধ্বংসের কারণ। এর সবই হচ্ছে কল্পনার দীর্ঘ জালবিস্তার।
ব্যাবিলনের সৃষ্টিতত্ত্বে আদিম দেবতা দুটি—আপসু ও তিয়াওয়াথ। তাদের পর সৃষ্টি হয় কয়েকটি নতুন দেবতা—আনু, এন-লিল, ও ইআ । তাদের আচরণ পছন্দ হয় না আপলু এবং তিয়াওয়াথের, তারা শাস্তি দিতে চায় নতুন দেবতাদের; কিন্তু পরাভূত হয় নতুন দেবতাদের কাছে। তিয়াওয়াথ দানব সৃষ্টি করে নতুন দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায়; কিন্তু নিহত হয় মেরোডাকের সাথে যুদ্ধে। তাকে দু-ভাগে কাটা হয়; তার দেহের একভাগ দিয়ে মেরোডাক সৃষ্টি করে আকাশ। মেরোডাক ভাগ করে ওপর আর নিচের জল, বাসস্থান তৈরি করে দেবতাদের; সৃষ্টি করে চাদতারাসূর্য, নির্দেশ করে, কক্ষপথ। এক সময় তার শিরচ্ছেদ করা হয়, তার অস্থি আর রক্তে সৃষ্টি হয় মানুষ। এ হচ্ছে চমৎকার আদিম কল্পনা ।
পুরনো বাইবেল-এ আছে হিব্রুসৃষ্টিতত্ত্ব। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা পৃথিবীর তিনটি প্রধান ধর্ম বিশ্বাস করে এ-সৃষ্টিতত্ত্বে; অর্থাৎ পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ মানে এবং বিভ্রান্ত হয় এটি দিয়ে। বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব মৌলিক নয়, এর অনেকখানি ধার করা হয়েছে ব্যাবিলনি সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে; এবং এর নানা মিল রয়েছে হিন্দুসৃষ্টিতত্ত্বের সাথেও। জাদপুস্তক-এর জগত-সৃষ্টির বিবরণ-এ বলা হয়েছে: পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল, এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল, আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপরে অবস্থিতি করিতেছিলেন।... পরে ঈশ্বর কহিলেন, জলের মধ্যে বিতান হউক, ও জলকে দুই ভাগে পৃথক করুক। ঈশ্বর এইভাবে বিতান করিয়া বিতানের উধ্বস্থিত জল হইতে বিতানের অধঃস্থিত জল পৃথক করিলেন; তাহাতে সেইরূপ হইল। পরে ঈশ্বরের বিতানের নাম আকাশমণ্ডল রাখিলেন। বাইবেলের ঈশ্বর আদিম জলরাশিকে মঞ্চের সাহায্যে দু-ভাগ করে, যার ওপর স্থাপন করে গগনমণ্ডল। ব্যাবিলনি সৃষ্টিতত্ত্বের তিয়াওয়াথের লাশ দুভাগ করার সাথে মিল আছে এর । বাইবেলে আছে, ‘পরে ঈশ্বর কহিলেন, দীপ্তি হউক, তাহাতে দীপ্তি হইল। ব্যাবিলনি সৃষ্টিতত্ত্বে নেই এ-আলোবিকাশের কথা। তবে ব্যাবিলনি ঈশ্বর মেরোডাক নিজেই আলোর দেবতা ।
ইরানি বা জুরথুস্ত্রি সৃষ্টিতত্ত্বে আহুর মাজদা বা ওরমুজদ স্রষ্টা ও শুভশক্তি। সে সৃষ্টি করেছে সব কিছু। সে অবশ্য বিশ্বের জন্যে বেশি দিন আয়ুধার্য করে নি, করেছে বারো হাজার বছর। এটা আজকাল হাস্যকর মনে হয়, কেনোনা আজ আমরা অনন্ত মহাকালের ধারণা করতে পারি; আদিম মানুষের কোনো অসীম অনন্ততার বোধ ছিলো না; তখন বারো হাজার বছরই ছিলো মহাকাল, আর হয়তো পাঁচশো মাইলই ছিলো অনন্ত অসীম। ইরানি সৃষ্টিতত্ত্বে ছিলো একটি শয়তানও, যার নাম আহরিমান । আহরিমান আগে ওরমুজদের কথা জানতো না, একদিন ওরমুজদের শরীর থেকে বিছুরিত জ্যোতি দেখে সে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তিন হাজার বছরে ওরমুজদ সৃষ্টি করে বিশ্ব, সূর্যচন্দ্রনক্ষত্র, উদ্ভিদ, প্রাণী, ও মানুষ। তাবে আহরিমান ওরমুজুদের প্রতিটি শুভ সৃষ্টির বিরুদ্ধে অশুভ সৃষ্টির অভিযান চালিয়ে যেতে থাকে; সে হয় অশুভর ঈশ্বর। তিন হাজার বছর ধ’রে চলে শুভঅশুভর যুদ্ধ; তবে জুরথুস্ত্রের জন্মের সাথে জয়ী হয় শুভশক্তি। ইরানি সৃষ্টিতত্ত্বে শুভ-অশুভ বিরোধ খুব বড়ো ব্যাপার, যা নেই হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্বে; কিন্তু প্রবলভাবে রয়েছে হিব্রু আর আরব সৃষ্টিতত্ত্বে। তাদের গোপন চিন্তায় ঈশ্বর একটি নয়, দুটি; একটি শুভর, আরেকটি অশুভর।
পুরাণের একটি প্রধান কল্পনা হচ্ছে স্বর্গ ও নরক: মৃত্যুর পর পুণ্যবানদের জন্যে পুরস্কার ও পাপীদের জন্যে শাস্তির এলাকা। মৃত্যুর পর পুণ্যাত্মারা চিরসুখে বাস করবে, জীবনে পুজো করেছে যে-দেবতাদের পাবে তাদের সঙ্গ, এবং পাপীরা উৎপীড়িত হবে, এ-ধারণা কিছুটা অগ্রসর প্রায়-সব পুরাণেই পাওয়া যায়। মিশরি, ভারতি, ব্যাবিলনি, ও হিব্রু পুরাণে স্বৰ্গ আর নরক দখল ক’রে আছে বেশ বড়ো স্থান। কিন্তু গ্রিক, রোমীয়, স্কেন্ডিনেভীয় পুরাণে স্বৰ্গনরক নেই, আছে শুধু মৃতদের জন্যে এক বিশেষ স্থান, অন্যলোক—হেডিস । বৌদ্ধদেরও কোনো স্বৰ্গনরক নেই। কোনো একদল মানুষ স্বৰ্গনরক কল্পনা করেছে, আরেকদল করে নি? যারা স্বৰ্গনরক কল্পনা করেছে, তাদের নৈতিকতাবোধ কি উন্নত তাদের থেকে, যারা এমন কল্পনা করে নি? ধর্মীয় প্রচার আজকাল এতো ব্যাপক, এবং স্বৰ্গনরক এতো বেশি পরিচিত যে অধিকাংশ মানুষই মনে করবে স্বৰ্গনরক যারা কল্পনা করেছে, তারা উন্নত নৈতিকতাবোধসম্পন্ন; আর যারা স্বৰ্গনরক কল্পনা করে নি, তারা নৈতিকতাবোধহীন। গভীরভাবে বিবেচনা করলে বুঝতে পারি স্বৰ্গনরকের কল্পনাকারীরা স্থল, নিম্ন নৈতিকতাবোধসম্পন্ন, তারা উঠতে পারে নি পার্থিব মেনে নিতে; তাই তৈরি করেছে মিথ্যে স্বৰ্গনরক । যারা স্বৰ্গনরকের কথা ভাবে নি, ভেবেছে শুধু অনিবার্য পরিণাম মৃত্যুর কথা, মনকে মিথ্যেয় ভোলায় নি, মেনে নিয়েছে সত্যকে, তাদের নৈতিক মান অনেক উন্নত।
স্বৰ্গনরক সম্পূর্ণ বাজে কথা। রাসেল বলেছেন : "আমার মনে হয় ক্রাইস্টের নৈতিক চরিত্রে রয়েছে একটি বড়ো ত্রুটি; আর তা হচ্ছে যে তিনি বিশ্বাস করতেন নরকে । আমি মনে করি না যে গভীরভাবে মানবিক কোনো ব্যক্তি চিরশাস্তিতে বিশ্বাস করতে পারেন। সুসমাচারে ক্রাইস্টকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট যে তিনি চিরশাস্তিতে বিশ্বাস করতেন । তার কথায় যারা বিশ্বাস করে না তাদের বিরুদ্ধে একটা প্রতিহিংসামূলক ক্রোধ ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে সব সময়ই দেখা যায়।
"টিউটোনিক বা জার্মনরা মনে করতো মৃতরা যায় লোকির কন্যা হেল-এ (Hel, এখনকার Hell) জগতে। হেল শব্দটি এসেছে যে-ধাতু থেকে, তার অর্থ ‘গোপন করা"; তাই হেলেন অর্থ 'গোপন জগত, গোপনবাসের জগত’; অর্থাৎ মৃতদের জগত। পরে খ্রিষ্টানরা হেলকে, ক’রে তোলে শাস্তির জগতৎ—নরক। হেল মূলত শাস্তির জগত বা নরক ছিলো না, ছিলো বেশ সুখকর স্থান; পরে যখন ভলহল বীরদের স্বর্গ, ধারণা দেখা দেয়, হেল হয়ে ওঠে মৃত্যুর পর তাদের বাসস্থান, যারা তরবারির আঘাতে মরে নি। এভাবে টিউটােনিক মৃতরা দুভাগে, মত্যুর রীতি অনুসারে, ভাগ হয়ে যায়; যেমন ঘটে মেক্সিকোতো, যেখানে মৃত বীরেরা যায় সূর্যদেবতার প্রাসাদে, যারা মরে বজ্রপাতে বা প্লীহায়, তারা যায় জলদেবতার স্বর্গে, আর সাধারণেরা পচে মিকটলানের মৃত্যুগুহায়। টিউটোনিকদের ভালহাল্লা এক চমৎকার স্বর্গ; সেখানে মৃত বীরেরা দেবতাদের সাথে ভোজে আর দ্বন্দ্বে যাপন করে সময়। তবে এ-স্বর্গটি তৈরি একটি গাছের গুড়ির চারদিকে ঘিরে। ওই গাছের পাতায় চরে বেড়ায় ইকথিরমির নামে এক হরিণ, আর হিডব্ৰুন নামে এক ছাগল, যাদের বাট থেকে অনিঃশেষ ঝরে সুরার ধারা, যা পান ক’রে বীরেরা মেটায় তৃষ্ণা। তবে ওই স্বর্গে তোরণের সংখ্যা মাত্র পাঁচশো চল্লিশটি, যা দিয়ে একবারে ঢুকতে পারে মাত্র আটশো যোদ্ধা। বীরদের জন্যে একটি বিশেষ স্বর্গ কেনো? বোঝা যায় এটি সেনাগোত্রের কল্পিত স্বর্গ. তারা শুধু পৃথিবীতে ঐশ্বর্যে থেকে তৃপ্তি পায় নি, মৃত্যুর পরও নিজেদের জন্যে একটি স্বৰ্গ তৈরি করেছে। এসিরীয় বা ব্যাবিলনি পুরাণে মৃতরা থাকে শূন্যতা ও ঘোরে পরিপূর্ণ এক এলাকায়, যেখান থেকে কোনো প্রত্যাবর্তন নেই। কাদা আর ধুলো তার অধিবাসীদের খাদ্য, অন্ধকার উত্তরাধিকার। সেটি এমন গৃহ, যাতে নেই কোনো প্রস্থানপথ। ওই গৃহের প্রবেশপথে থাকে এক প্রহরী, যে প্রবেশকারীর থেকে গ্রহণ করে গৃহরানীর জন্যে অর্ঘ্য; এবং ভাগ্যহত প্রবেশকারীর ওপর ছড়িয়ে দেয় মন্ত্রজাল, একের পর এক সাতটি তোরণের ভেতর দিয়ে নিয়ে যায় তাকে, এবং হরণ করে তার পার্থিব সব অধিকার। এ-মৃত্যলোকের রানীর নাম আল্লাতু, যে বসে রত্নখচিত সিংহাসনে। আল্লাতু প্রবেশকারীকে শাস্তি দিতে পারে, এবং পারে ক্ষমা করতে। এ-পুরাণে মৃত্যুলোক ও জীবনলোকের ��ধ্যে প্রবাহিত হয় একটি নদী, মৃত্যুর নদী;—এর কোনো আকার নেই, এটি পূর্ণ অসহ্য শীত ও বিষাদাচ্ছন্ন অন্ধকারে। এখানে অশরীরী আত্মারা নিরন্তর খুঁজতে থাকে বেরোনোর পথ। এমৃত্যুলোকে আছে একটি বিচারবিভাগও। ওই বিচারালয়ের দিকে যাওয়ার পথ পূর্ণ সব ধরনের বিপদ ও বিভীষিকায়, তবে, মৃতদের অবশ্যই যেতে হয় ওই পথ দিয়ে। এ-মৃত্যুলোকে পুণ্যাত্মাদের জন্যেও আছে একটি এলাকা; বিচারের পর যারা পুণ্যাত্মা বলে বিবেচিত হয়, তারা বাস করে সেখানে। প্রশান্ত রুপোলি আকাশের নিচে, স্বচ্ছসলিলা নদীর তীরে, সেখানে বাস করে পুণ্যবান প্রাচীন প্রেরিতপুরুষেরা।
ইহুদিদের নরকের নাম জেহেন্না যার থেকে এসেছে মুসলমানদের জাহান্নাম। জেহেন্নায় পাপীদের দেয়া হয় শারীরিক ও আত্মিক দু-ধরনেরই শাস্তি। এখানে চিরশাস্তির মধ্যে থাকে অন্য জাতির মানুষেরা; ��বিশ্বাসী ইহুদিরাও থাকে, তবে এটা তাদের জন্যে পাপমোচনের এলাকা; পাপমুক্তির পর তারাও যায় স্বর্গে। শিওল নামেও আছে একটি ইহুদি মৃত্যুলোক, যেটি একান্তভাবেই হিব্রু বা ইহুদি। হিব্রুরা জেহেন্না ধারণাটি ধার করেছিলো আক্কাদীয় জি-উমুনা থেকে। শিওল মৃত্যুর পর পুণ্যবান ও পাপী উভয়েরই বাসস্থান; গ্রিক হেডিসের মতো জীবন যেখানে ছায়াচ্ছন্ন ও অশরীরী। যিশাইয়াতে (১৪,৯-১১) আছে :
“অধঃস্থ নরক তোমার জন্য বিচলিত হয়ে তোমার আগমনে উপস্থিত হয় তোমার সামনে; তোমার জন্যে সচেতন করে তোলে মৃতদের, এমনকি পৃথিবীর সব প্রধানদের; এ সিংহাসন থেকে তুলে এনেছে সব জাতির রাজাদের। তারা সবাই তোমাকে বলে, তুমিও কি দুর্বল হ’লে আমাদের মতো? তুমিও কি হ’লে আমাদের সমান? কবরে নামানো হলো তোমার আড়ম্বর, ও তোমার নেবলযন্ত্রের মধুর বাদ্য : তোমার নিচে পাতা রয়েছে কীট, এবং তোমাকে ঢেকেছে কৃমিরা।”
ব্যাবিলনের দাসত্বে থাকার পর ব্যাবিলন প্রভাবে ইহুদিরা শিওলকে সাধারণ শাস্তির, এবং জেহেন্নাকে দণ্ড ও পীড়নের বিশেষ এলাকায় পরিণত করে।
পুরাণ ও ধর্মের এ-সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে বোঝা যায়, কোনো ধর্মই কোনো ঈশ্বর পাঠান নি; মানুষই ভুল কল্পনার পর ভুল কল্পনা করে সৃষ্টি করেছে এগুলো। ধর্মের বইগুলো ঋণী মানুষের আদিম পুরাণগুলোর কাছে। মানুষ চিরকাল ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে নানা প্রপঞ্চ, কল��পনা করেছে বহু কিছু; মানুষ সত্য বলতে চেয়েছে, এবং মিথ্যা বলেছে প্রচুর, এবং মানুষ মিথ্যেয় যতো বিশ্বাস করেছে, সত্যে ততো বিশ্বাস করে নি; এখনো করে না। মিথ্যের বিহ্বলকর সুখকর শক্তি রয়েছে, যা নেই সত্যের। ধর্মের বইগুলো সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, যদিও বারবার নিজেদের সত্য ব’লে দাবি করে, এবং সত্যনিষ্ঠদের ভয় দেখায়। এগুলো প্রতিষ্ঠিত আদিম মানুষের কল্পনা ও পরবর্তীদের সুপরিকল্পিত মিথ্যার ওপর। মানুষ কতোটা মিথ্যা বলতে ও বিশ্বাস করতে পারে, তার অসামান্য উদাহরণ জেসাস বা খ্রিষ্ট । জেসাস মানুষের শ্রেষ্ঠ কল্পচরিত্র : গত দু-শো বছরের বাইবেলবিজ্ঞানীরা, যাদের অনেকেই ধাৰ্মিক ও পুরোহিত, প্রমাণ করেছেন যে জেসাস নামে কেউ ছিলো না। কিন্তু জেসাস সৃষ্টি হলো কীভাবে, এবং হয়ে উঠলো একটি প্রধান ধর্মের প্রবর্তক? জেসাসকে সৃষ্টি করা, তাকে ঘিরে পুরাণ, ও একটি নতুন ধর্ম বানানোর সমস্ত কৃতিত্ব খ্রিষ্টান সুসমাচারপ্রণেতাদের। ক্ৰাইষ্ট এক কিংবদন্তি বা পুরাণ। জেসাসসৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করার জন্যে ব্রুনো বাউআর, জে এম রবার্টসন, ভ্যান ডেন বার্গ ভ্যান এইসিংগা, আলবার্ট কালথোফ, গাই ফাউ, প্রোসপার আলফারিক, ডব্লিউ বি স্মিথ, জি এ ওয়েলস্ প্রমুখ তৈরি করেছেন একটি তত্ত্ব, যার নাম খ্রিস্টপুরান।
ডেভিড স্ট্রাউস লাইফ অফ জেসাস ক্রিটিকালি এক্সামিন্ড-এ (১৮৩৫) বলেছেন গসপেল বা সুসমাচারগুলো জেসাসের ঐতিহাসিক জীবনী নয়; জেসাসের বস্তুনিষ্ঠ জীবনী লেখা সুসমাচারলেখকদের উদ্দেশ্য ছিলো না; তারা চেয়েছিলেন ধর্মীয় পুরাণ লিখে তাদের প্রবর্তিত ধর্মে মানুষদের দীক্ষিত করতে। স্ট্রাউসের মূলকথা হচ্ছে নতুন টেষ্টমেন্ট-এর গল্পগুলো সত্য নয়; সিহঁত” বা ত্রাতার আগমন সম্পর্কে ইহুদিরা দীর্ঘকাল ধ’রে যে প্রত্যাশা ক’রে আসছিলো, গল্পগুলো তারই গল্পায়ন । ইহুদিরা বহুকাল ধ’রে প্রত্যাশা ক’রে আসছিলো একজন ত্রাতা আসবেন, কিন্তু তিনি আসছিলেন না। তার আগমন সম্পর্কে পুরেনে টেষ্টমেন্ট এ আছে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী; সুসমাচারলেখকেরা ওই ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে সাজিয়ে তৈরি ক’রে ফেলেছিলেন জেসাস ক্রাইস্টকে। সিহঁত” শব্দটি এসেছে হিব্রু ম/গত" থেকে, যার অর্থ "তৈলাক্ত ব্যক্তি'; এ-শব্দটি গ্রিকে হয় খ্রিষ্ট্ৰেস যার থেকে এসেছে ইংরেজি কেইষ্ট এবং বাঙলা খ্রিষ্ট। রাজা এবং পুরোহিতদের শরীরে, তাদের কর্ম শুরুর সময়, তেলমাখানো রীতি ছিলো ইহুদিদের; তাই তাদের বলা হতো মশিআহ; পরে এর অর্থ হয় ত্রাতা’ । ইহুদিরা অবশ্য প্রত্যাশা করছিলো রাজকীয় ত্রাতার; কিন্তু সুসমাচারলেখকরা রাজকীয় ত্রাতাকে বাদ দিয়ে সৃষ্টি করেন আধ্যাত্মিক রাজা, যে বলে, অনুতপ্ত হও, কেননা স্বর্গের রাজত্ব আসন্ন’, এবং সময় হয়ে গেছে, এবং ঈশ্বরের রাজত্ব আসন্ন; অনুতপ্ত হও, এবং সুসমাচারে বিশ্বাস করো। ঈশ্বর কোনো ত্ৰাতা পাঠান নি, কোনো ত্রাতা আসেন নি, ক্ৰাইষ্ট সুসমাচারলেখকদের সৃষ্টি। তারা পু্রোনো টেষ্টামেন্ট থেকে জানতেন ত্ৰাতা আসবেন; এ-বইতে বিশদভাবেই ব’লে দেয়া হয়েছে ত্রাতা কীভাবে আসবেন, কার গর্ভে জন্ম নেবেন, কী করবেন, কী বলবেন। এসব অবলম্বন ক’রে তারা জেসাসকে তৈরি করেন; ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে তাকে জন্ম দেন, তাকে দিয়ে কাজ করান, এবং তাকে দিয়ে কথা বলান। সুসমাচারগুলো উপন্যাসের থেকে সত্য নয়, জেসাসও সত্য নন উপন্যাসের নায়কের থেকে।
পুরোনো টেষ্টামেন্ট ভরেই রয়েছে নবিরা, এর পাতায় নবি পাওয়া যায়; যেমন ওই অঞ্চলের পথে পথে নবি পাওয়া যেতো। ওই নবিদের অনেকেই ছিলো শস্তা জ্যোতিষ। ইংরেজি প্রফেট শব্দটি এসেছে একটি গ্রিক শব্দ থেকে, যার অর্থ “যে অন্যের হয়ে কথা বলে” । শব্দটি হিব্রুতে হচ্ছে নবি বা নাভি। মোজেস বা মুসা তোতলা ছিলেন, ঠিক মতো কথা বলতে পারতেন না; জিহোভার ডাকে সাড়া দিয়ে নবি হওয়ার ইচ্ছেও তার ছিলো না, অনিচ্ছায়ই তিনি নবি হয়েছিলেন। জিহোভা আরোন (অর্থাৎ হারুন) হবে তোমার নবি । নবি শব্দটি এসেছে না থেকে, যার অর্থ ‘ডাকা, ঘোষণা করা’। তাই "নবি"র অর্থ হতে পারে ‘ঘোষণাকারী, আহবানকারী', বা হতে পারে যাকে আহবান করা হয়েছে। বাইবেলে দু-অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বাইবেলে জিহোভা বলেছে, ‘আমি তোমার পিতার ঈশ্বর, আব্রাহামের ঈশ্বর, আইজাকের ঈশ্বর, এবং জ্যাকবের ঈশ্বর... এসো, আমি তোমাকে ফারাওদের কাছে পাঠাবো যাতে তুমি আমার মানব, ইসরাইলের পুত্রদের, মিশর থেকে উদ্ধার করে আনতে পারো।’ শব্দটির আরেক অর্থ পাঠানো তাই নবি হচ্ছে প্রেরিতপুরুষ। সুসমাচার লেখকেরা পুরোনো বাইবেলের নবিদের উপাখ্যান ভালো ক’রেই জানতেন। বাউআর বলেছেন, তারা পুরোনো বাইবেলের নবিদের আদলে তৈরি করেছিলেন জেসাসকে, যিনি কখনো ছিলেন না। প্রথম শতকে ইহুদি আর গ্রিক-রোমীয় চিন্তাভাবনা থেকে উদ্ভব ঘটেছিলো খ্রিষ্টধর্মের। সে-সময়ের অনেকে দাবি করেছেন যে জেসাসকে তৈরি করা হয়েছে তাইআনার অ্যাপোলোনিয়াসের আদলে । অ্যাপোলোনিয়াস ছিলেন একজন ভ্ৰাম্যমাণ কৃচ্ছতাপূর্ণ জীবন যাপন করতেন, নিজেকে দাবি করতেন অলৌকিক শক্তির অধিকারী ব’লে এবং নিরো ও ডোমিতিয়ানের রাজত্বকালে বাস করতেন নিয়ত মৃত্যুভীতির মধ্যে। তার অনুসারীরা তাকে বলতো ঈশ্বরের পুত্র। আদিখ্রিষ্টানরা জেসাসের মুখে অনেক কথা বসিয়েছে, ওসব কথা জেসাস কখনো বলেন নি; কেননা তিনি কখনো ছিলেন না। ওই কথাগুলো জেসাসের কথা নয়, ওগুলো খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস, এবং আশার প্রকাশ। তারা যা দেখছিলো, যা বিশ্বাস করেছিলো, যে-প্রত্যাশা পোষণ করছিলো, তাই তারা ব্যক্ত করেছে জেসাসের কাজে ও উক্তিতে। ইহুদিরা বহুকাল আশায় আশায় ছিলো যে সময়েই আসবেন মুক্তিদাতা, পালিত হবে প্রাচীন প্রতিশ্রুতি। প্রথম দিকের খ্রিষ্টানরা পুরোনো বাইবেল থেকে জানতো যে ত্রাতার আগমনে আগে পৃথিবীতে ফিরে আসবে এলিজা। যখন তারা মনে করে যে ব্যাপটিষ্ট জনই হচ্ছে পৃথিবীতেফিরে-আসা এলিজা, তখন তারা বিশ্বাস করে যে ত্রাতার আগমনের আর দেরি নাই; এবং তৈরি করে ফেলে জেসাসকে, যে জনকে ডাকে এলিজা নামে। জেসাসের জন্মের ব্যাপারটিকে তারা পরিণত করে এক অলৌকিক ঘটনায়। পুরুষ সংসৰ্গহীন কুমারী মাতার গর্ভে সন্তান জন্ম অসম্ভব হ’লেও তা কল্পনা করা অসম্ভব নয়; ওই সময়ে গ্রিক আর রোমসাম্রাজ্য ভরেই প্রচলিত ছিলো কুমারী মাতার গর্ভে সন্তান জন্মের কিংবদন্তি। গ্রিক পুরাণে কুমারী ডানার গর্ভে জন্ম নেয় পারসেউস, তার মা ডানা গর্ভবতী হয় স্বর্ণবর্ষণের ফলে; আবার কুমারী নানা গর্ভবতী হয় ডালিম খেয়ে, এবং জন্ম দেয় আত্তিসকে। তখন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও—পিথাগোরাস, প্লাতো, আলেকজান্ডার, অগাস্টাস—কুমারী মাতার গর্ভে বা দেবতাদের হস্তক্ষেপে জন্ম নিয়েছেন ব’লে বিশ্বাস করা হতো। আদিখ্রিষ্টানরাও যখন জেসাসকে সৃষ্টি করে, তার ঐশ্বরিকতা প্রমাণ করার জন্যে তাকে জন্ম দেয় কুমারী মায়ের গর্ভে। অনেকে মনে করেন কুমারী মাতার কিংবদন্তিটি জন্মেছে পুরোনো বাইবেলের ত্রাতার জন্মসংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীর একটি শব্দ ভুল বোঝার ফলে।
পুরোনো বাইবেলে (যিশায়িয় ৭:১৪) একটি ভবিষ্যদ্বাণী আছে: তাই প্ৰভু তোমাদের এক চিহ্ন দেবেন। দেখো এক কন্যা গর্ভবতী হয়ে পুত্র জন্ম দেবে, ও তার নাম ইম্মানুয়েল রাখবে। খ্রিস্টানরা এখানে দেখতে পায় ত্রাতার আবির্ভাবের ভবিষ্যদ্বাণী । তারা ঐশ্বরিক উন্মাদনায় ভুল অনুবাদ করে কন্যা’ শব্দটির । পুরোনো বাইবেলে আছে হলমন্ত্র যার অর্থ তরুণী’, বাঙলায় বাইবেল অনুবাদকেরা যার অর্থ করেন কন্যা’। হিব্রুতে বেঙুল হচ্ছে ‘কুমারী’ । খ্রিষ্টান ধর্মপ্রবর্তকেরা গ্রিকে হালমাহর অনুবাদ করেন পর্থেনেসে অর্থাৎ কুমারী। তাই ত্রাতার যেখানে জন্ম নেয়ার কথা ছিলো তরুণী মায়ের গর্ভে, সেখানে খ্রিস্টানরা তাকে জন্ম দেয় কুমারী মায়ের গর্ভে। জ��সাস এক কিংবদন্তি; সত্য নন, কিন্তু সত্য বলে পূজিত। ধর্ম এমনই সব সত্যের সমষ্টি । জেসাসের গল্প বলেছেন শুধু সুসমাচারলেখকরা, সে-সময়ের আর কেউ বলেন নি। প্রথম শতকে রোমসাম্রাজ্যে অন্তত ষাটজন ঐতিহাসিক লিখছিলেন ইতিহাস, তারা কেউ জেসাসের কথা লেখেন নি। জেসাস ঐতিহাসিক ব্যক্তি হ’লে তাদের কেউ না কেউ জেসাসের উল্লেখ করতেন; কিন্তু উল্লেখ করেন নি, কেননা তারা ইতিহাস লিখছিলেন, কিংবদন্তি তৈরি করছিলেন না। এখন এটা স্বীকৃত যে সুসমাচারগুলো, মথি, মার্ক্স লুক, যেহেন—যেগুলো ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে খ্রিষ্টধর্ম—জেসাসের শিষ্যদের লেখা নয়; সুসমাচারপ্রণেতারা জেসাসকে দেখেন নি। সুসমাচারগুলো লেখা হয়েছিলো জেসাসের কথিত ক্রুশকাঠে প্রাণ দেয়ার চল্লিশ থেকে আশি বছর পরে, লিখেছিলেন নামপরিচয়হীন লেখকেরা। এগুলোর মধ্যে মথি, মার্ক, লুকের, বিষয় একই; ভাষাও অনেকটা এক। সম্ভবত মার্কই সবচেয়ে পুরোনো, আর অন্যগুলো এটির নকল। তাই এগুলোতে যে-কাহিনী ও কথা আছে, তা কোনো বাস্তব মানুষের নয়। ঐতিহাসিক বই নয় এগুলো; এগুলো সুসমাচারপ্রণেতাদের বিশ্বাস অনুসারে লেখা জেসাসপুরাণ। খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তকেরা পুরোনো বাইবেলের শূন্য ভবিষ্যদ্বাণী ও নিজেদের ভুল বিশ্বাস অনুসারে সৃষ্টি করেছিলেন এক ত্রাতাকে; কিন্তু মিথ্যায় তাদের আত্মা সম্ভবত শান্তি পায় নি, তাই নতুন বাইবেল ভরেই পাওয়া যায় জেসাসের দ্বিতীয় আগমনের প্রত্যাশা। ইয়েটস্ খ্রিস্টানদের এ-প্রত্যাশার বেদনা মর্মে মর্মে বোধ করে, বিশশতকে, একটি কবিতা লিখেছেন দ্বিতীয় আগমন’ নামে, যাতে জেসাস নয়, একটি নরমুণ্ডধারী বিকট পশু বেথলেহেমের দিকে এগোয় জন্ম নেয়ার জন্যে। নতুন অর্থাৎ খ্রিষ্টানদের বাইবেল ভ'রেই ছড়ানো জেসাস শিগগিরই আসবেন’, ‘জেসাসের আগমন আসন্ন ধরনের প্রত্যাশা; কিন্তু জেসাস প্রথমবার আসেন নি, দ্বিতীয়বারও আসেন নি, কখনো আসবেন না। মথির মতে জেসাস বলেছেন, ‘সত্যি, আমি তোমাদের বলছি, এই প্রজন্মের কাল কেটে যাওয়ার আগেই ঘটবে এসব ঘটনা। আশার পর আশা আর বহু ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ হয়ে গেছে, জেসাস আসেন নি। তাহলে কি জেসাসের কথা সত্য নয়? সুসমাচারলেখকেরা অদম্য, তারা ঈশ্বরের বাণীকে মিথ্যে হ’তে দিতে পারেন না; তাই তারা ব্যাখ্যা করেন যে ঈশ্বরের সময় মানুষের সময়ের মতো নয়। তারা বলেন, ঈশ্বরের একদিন সহস্র বছরের সমান, এবং সহস্র বছর একদিনের সমান।’ বলা যে হয়েছে শিগগির; প্রশ্ন হচ্ছে কতোটা শিগগির’ হচ্ছে ‘শিগগির’? কেনো বিলম্ব হচ্ছে? ঈশ্বরের একদিন সহস্ৰ বছর আর সহস্র বছর একদিন, এ-হিশেব খুব উৎসাহব্যঞ্জক নয় মানুষের জন্যে; মানুষ আশাবাদী, কিন্তু তারা আশায় আশায় অসুস্থ হয়ে পড়ে, এবং সহস্র বছর বাঁচে না। ধার্মিকরা মত বদলাতে খুবই অভ্যস্ত, তারা নতুন ব্যাখ্যা দিতে লজ্জা পান না; এবং ঈশ্বরের বাণী থেকে সব সময়েই সুবিধামত তাৎপর্য বের করতে পারেন। তাই পরে জেসাস শিগগিরই আসবেন’ থেকে শিগগির বাদ দেয়া হয়; বলা হয় জেসাস আসবেন। দ্বিতীয় আর তৃতীয় শতকের খ্রিষ্টান পুরোহিতেরা মনে করতেন জেসাস শিগগিরই এসে হাজার বছরের জন্যে স্থাপন করবেন তার সাম্রাজ্য। কিন্তু তার দেখা নেই। কনস্ট্যান্টিন (২৮৮-৩৩৭) যখন খ্রিষ্টধর্মকে স্বীকৃতি দেয়, তখন এক পাদ্রি জেসাসের সহস্র বছরের শাসনের এক রূপক ব্যাখ্যা দেন। তার মতে এ-স্বীকৃতিই জেসাসের রাজত্বের শুরু; এর সমাপ্তি ঘটবে জেসাসের পুনরাগমনে। খ্রিষ্টানরা জেসাসের ফিরে আসার আশা যখন হাজার বছরের জন্যে স্থগিত ক’রে দেয়, কিন্তু ১০০০ অব্দের কাছাকাছি এসে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ক্রাইস্ট ফেরেন নি; তাই ব্যর্থ প্রত্যাশার বেদনা থেকে জন্ম নেয় আরেক নতুন আশা। কনস্ট্যান্টিন ৩১২ অব্দে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলো, তারা ওই বছরটিকে সহস্রকের সূচনা ধ’রে ১৩১২-র দিকে ক্রাইষ্টের পুনরাগমনের প্রত্যাশায় থাকে। তারপরও ক্ৰাইষ্ট আসেন না; সময় আসে, আর চলে যায়; তখন আবার দিতে হয় জোড়াতালি। ষোলশতকের খ্রিস্টান সংস্কারকেরা পোপতন্ত্রকে, রোমীয় ক্যাথলিক গির্জার স্তরক্রমকে, শনাক্ত করে শয়তান ব'লে। তারা বলে যে তারা বাস করছে পবিত্র সহস্রকের পরে, যখন পোপতন্ত্ররূপী শয়তান ছাড়া পেয়ে ক’রে চলছে অবাধ শয়তানি । আরেকদল শালেমেনের রাজত্বের সূচনাকে (৮০০ অব্দ) ধরে পবিত্র সহস্রকের শুরু হিশেবে, এবং অপেক্ষায় থাকে ক্রাইস্টের। তারা চিরকাল আশা করতে থাকবে, কিন্তু ক্ৰাইষ্ট ফিরবেন না; কেননা তিনি কখনো ছিলেন না, আসেন নি। আধুনিক পৃথিবীতে আদিম ব্যাপার হচ্ছে ধর্ম। পৃথিবী অনেক এগিয়েছে, বিকাশ ঘটেছে জ্ঞানবিজ্ঞানের, তবে অধিকাংশ মানুষের মনের আদিমতা কাটে নি; তারা লোভ-ভয়-অপবিশ্বাসের মধ্যে বাস ক’রেই স্বস্তি পাচ্ছে। ধর্ম রাজনীতিও; পৃথিবী জুড়ে ক্ষমতাগৃধু দুষ্ট রাজনীতিকদের বড়ো অস্ত্র হয়ে উঠেছে ধর্ম। তারা নিজেরা ধর্মে বিশেষ বিশ্বাস করে না, তাদের জীবন যদিও অধাৰ্মিক, তবু তারা ক্ষমতার জন্যে উত্তেজিত করে তোলে সাধারণ মানুষের লোভ-ভয়অপবিশ্বাসকে। মানুষ ধাৰ্মিক হয়ে জন্ম নেয় না যদিও অনেক সময় রটানো হয় যে কেউ কেউ মায়ের গর্ভ থেকেই ধর্মগ্রন্থ মুখস্থ ক’রে এসেছে; অধিকাংশ মানুষ সাধারণত ধর্মকে পাত্তা দেয় না। ধর্ম এতো দিনে লোপ পেয়ে যেতো যদি না চারপাশে সারাক্ষণ সক্রিয় থাকতো ধর্মের রক্ষীবাহিনী। প্রতিটি ধর্ম সৃষ্টি করে তার সুবিধাভোগী রক্ষীবাহিনী; কখনো এবং কোথাও ওই বাহিনী অত্যন্ত হিংস্র, কখনো কোথাও মৃদু। পরিবার, পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, মসজিদ-মন্দিরগির্জা-সিনেগগ, উৎসব, পুরোহিত-মোল্লা-রাবাই, বিদ্যালয়-পাঠ্যপুস্তক, সমাজ-রাষ্ট্র সবই কাজ করে ধর্মের রক্ষীবাহিনীরূপে । এরা সব সময় চোখ রাখে যাতে কেউ ধর্মের বাইরে যেতে না পারে, অর্থাৎ তাদের ক্ষমতাকে অস্বীকার করতে না পারে। আমাদের দেশে এদের আচরণ মৃদু, কিন্তু ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠছে; এবং ইরানে, সৌদি আরবে, পাকিস্থানে হিংস্র । আমাদের দেশেও ধর্মের বাইরে যাওয়া কঠিন। বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে, চাকুরির জন্যে আবেদন করতে, এবং তুচ্ছ নানা কাজ করতে গেলে ধর্মের ঘর পূরণ করতে হয়; যারা ধর্মে বিশ্বাস করে না, তারাও রক্ষীবাহিনীর গোপন ফাদের বাইরে যেতে পারে না। ধর্ম টিকে আছে এরক্ষীবাহিনীর সক্রিয়তায় । রক্ষীবাহিনীটি ধর্মের সুবিধাভোগী বাহিনী; ধর্ম থেকে যতোটা সুবিধা তোলা যায়, তারা তোলে, এবং ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের আগ্নেয়াস্ত্র হিশেবে, যা গর্জে উঠতে পারে যখন তখন। আমাদের দেশে কেউ চুপচাপ ধর্মের বাইরে থাকতে পারে, পালন নাও করতে পারে ধর্মের বিধিবিধান, কিন্তু সে প্রকাশ্যে ধর্মের সমালোচনা করতে পারে না, লিখতে পারে না। ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার ধর্ম, অর্থাৎ ধর্মের রক্ষীবাহিনী দেয় না, যেমন স্বৈরাচারীরা দেয় না তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার। ধর্মগুলো যুক্তি ও সততা সহ্য করে না; ধর্মের পক্ষে কোটি কোটি মিথ্যে মানুষ কয়েক হাজার বছরে বলেছে, এখনো বলছে; ধর্মের আপত্তি নেই ওই সব মিথ্যে সম্বন্ধে, বরং ওই মিথ্যেগুলোকেই মনে করা হয় ধর্ম; কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধে একটি সত্যও বলা যায় না। ধর্মের প্রতিপালকেরা যতো মিথ্যে কথা বলে প্রতিদিন, শুক্রবার, রোববার, ধর্মীয় জলসায়, সাধারণ মানুষ ততো কখনো বলে না।
ধর্ম এবং ধর্মের বইগুলো অলৌকিক নয়, ধর্মের বইগুলো জ্ঞানের বইও নয়; পঞ্চম শ্রেণীর বই পড়লেও যতোটা জ্ঞান হয়, ধর্মের বইগুলো পড়লে ততোটা জ্ঞানও হয় না, বরং অনেক অজ্ঞানতা জন্মে। বিশ্বাস ও অজ্ঞানতা পরস্পরের জননী; জ্ঞান জন্মে অবিশ্বাস থেকে। বিশ্বাসমাত্রই অপবিশ্বাস; জ্ঞান বিশ্বাসের বিষয় নয়, জানার বিষয়। কোনো ধর্মপণ্ডিত যদি সারাজীবন ধর্মেরই বই ও তার ভাষ্য পড়ে, আর কিছু না পড়ে, সে থেকে যায় পঞ্চম শ্রেণীর শিশুটির ��েকেও মূখ। ওই শিশুটি জানে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে পৃথিবী ও বিভিন্ন গ্রহ, কিন্তু ধর্মপণ্ডিত জানে পৃথিবীই কেন্দ্র; শিশু জানে সাত আসমান বলে কিছুই নেই,—ওটা টলেমির ধারণা ছিলো এবং ঢুকে গিয়েছিলো ধর্মের বইয়ে, ধর্মপণ্ডিত তা জানে না; শিশু জানে চাদ পৃথিবীর উপগ্রহ, তার কোনো পবিত্রতা নেই, ধর্মপণ্ডিত জানে চাদ পবিত্র, মাস আর বছর হিশেব করার জন্যে বিধাতা এটি সৃষ্টি করেছে। এগুলোতে সত্য নেই, রয়েছে প্রচুর মিথ্যে, ও আদিম মানুষদের ব্যাপক অপবিশ্বাস। ধর্মের বইগুলোতে রয়েছে প্রচুর ভুল, আর স্ববিরোধিতা; এবং এগুলো পরস্পরবিরোধী। বলা হয় যে ধর্মের বইগুলো বিধাতার বই, তাই সহজাতভাবেই শ্ৰেষ্ঠ; এ-বই মানুষের পক্ষে লেখা অসম্ভব। তবে এগুলোর থেকে বহু উৎকৃষ্ট বই মানুষ লিখেছে, এবং আরো লিখবে। এগুলোতে পুনরাবৃত্তি ও বাজে কথার শেষ নেই; এবং এমন কিছু নেই, যাকে আমরা অনুভব বা বোধ করতে পারি ঐশী ব'লে। এ-বইগুলো কিছু প্রমাণ করে না; এগুলো বিধাতার উক্তি দিয়েই প্রমাণ করে বিধাতাকে, আর তার কথিত সৃষ্টিকে। ধর্মের অন্ধ ভাষ্যকারেরা এগুলোর সব শ্লোকেই বিধাতার অপার মহিমা দেখে; কিন্তু একটু যুক্তি খাটালেই ধ'সে পড়ে শ্লোকের পর শ্লোকের মাহিমা ।
ধর্ম কী? অলৌকিক সত্তায় বিশ্বাসই, অনেকে মনে করেন, ধর্ম। এটা ধর্মের বড়ো উপাদান, তবে এই ধর্মের সব নয়; ধর্মে প্রধান নানা আনুষ্ঠানিকতা। ধর্মে আবশ্যিকভাবে প্রহরে, প্রহরে পুজোআরাধনা করতে হয়; যেতে হয় তীর্থে; বানাতে হয় মসজিদ, মন্দির, সিনাগগ, গির্জা, প্যাগোডা ও নানা দেবালয়; পালন করতে হয় বহু আদিম আচারানুষ্ঠান। এগুলোর উদ্দেশ্য ধর্মীদের সংঘবদ্ধ করে উন্মাদনা জাগিয়ে রাখা; উগ্র রাখা তাদের সম্প্রদায়বোধ। মানুষ যদি একান্ত ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করতো অলৌকিক সত্তায়, ধর্ম হতো ব্যক্তিগত; কিন্তু ধর্মগুলো ব্যক্তিগত ধর্ম চায় না, চায় সংঘবদ্ধ ধর্ম; এগুলোর কাজ অলৌকিক আধ্যাত্মিক অনুভূতি দেয়া নয়, এগুলোর কাজ বিশেষ ধরনের সমাজ গঠন করা। আধ্যাত্মিক অনুভূতি সম্পূর্ণ বাজে কথা; যারা এ-ধরনের অনুভূতি চায়, এবং পেয়েছে ব’লে দাবি করে, তারা মনোব্যাধিগ্রস্ত মানুষ । সমস্ত আধ্যাত্মিক কবিতা ও গান মনোবিকারের ফল। ধর্মগুলো মানুষকে নিজের জীবন ধারণ করতে দেয় না, বাধ্য করে বিশেষ ব্যক্তি বা গোত্রের পরিকল্পিত জীবন যাপন করতে। প্রতিটি ধর্মের পুজোআরাধনার রীতিগুলো হাস্যকর; ইহুদিরা একভাবে, খ্রিস্টানরা আরেকভাবে, মুসলমানরা আরেকভাবে, হিন্দুরা আরেকভাবে, এবং আরো যে অজস্র ধর্ম ��য়েছে, সেগুলোতে শৃঙ্খলিতরা বিচিত্ররূপে পুজোআর্চনা করে। প্রতিটি কাছে হিন্দুর পূজো আর ঘন্টাধ্বনি হাস্যকর, হিন্দুর কাছে মুলমানের দিনে পাঁচবার উঠে-ব’সে প্রার্থনা হাস্যকর। এসবে এমন কিছু নেই, যা বহন করে কোনো পরম সত্তার ছোয়া। এগুলোতে বারবার আবৃত্তি করা হয় এমন সব শ্লোক, যেগুলো স্থূল, যেগুলোর নেই কোনো অসাধারণত্ব । কোনো কোনো ধর্মের আরাধনার অনেক শ্লোক কালাতিক্রমণতাগ্রস্তও; উপাসনার সময় প্রতিদিন এমন সব ব্যক্তিকে ধ্বংস হওয়ার অভিশাপ দেয়া হয় যারা বহু আগেই লোকান্তরিত ।
প্রচলিত ধর্মগুলো সম্পূর্ণ পৃথক ধর্ম নয়; এগুলোর একটির সাথে আরেকটির নানা মিল রয়েছে। অনেক সময় এক বা একাধিক ধর্ম থেকে জন্মেছে আরো এক বা একাধিক ধর্ম। তবে প্রতিটি ধর্মই নিজেকে সম্পূর্ণ নতুন বলে দাবি করে, যেনো এইমাত্র বিধাতা সেটি তৈরি ক’রে পাঠিয়েছেন। ভারতীয় ধর্মগুলোর মধ্যে মিল অত্যন্ত স্পষ্ট; একটি মূল ধর্ম থেকেই ভারতে দেখা দিয়েছে পরবর্তী ধর্মগুলো । মধ্যপ্রাচ্যেও তাই রয়েছে; কানান বা প্যালেস্টাইন হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মগুলোর মতৃভূমি। প্যালেস্টাইনের মানুষ নানা কিংবদন্তি থেকে সৃষ্টি করেছিলো ইহুদিধর্ম, তার থেকে উদ্ভূত হয় খ্রিষ্টধর্ম; এবং ইহুদি-খ্রিষ্ট ও মক্কায় প্রচলিত পৌত্তলিক আরবদের ধর্ম থেকে বিকশিত হয় ইসলাম। ইসলামের ধর্মগ্রন্থে বিধাতার প্রেরিত ধর্মরূপে ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্ম স্বীকৃত; এবং এ-গ্রন্থে রয়েছে বহু উপাখ্যান, যেগুলোর উৎস পুরোনো ও নতুন বাইবেল। আদম-হাওয়ার উপাখ্যানটি স্বীকার করে তিনটি ধর্মই। এ-উপাখ্যানটি প্রথম তৈরি করেছিলো হিব্রুরা, ও অন্তর্ভুক্ত করেছিলো পুরোনো বাইবেলে। এটা প্যালেস্টাইনের লোককাহিনী বা পুরাণে প্রচলিত ছিলো; এমনকি তারা কল্পনা করেছিলো তিনটি হাওয়ার, যাদের শেষটি তিনটি ধর্মগ্রন্থে স্থান পেয়ে নিন্দিত ও বিখ্যাত। ইসলাম ধর্মে শুধু আদম-হাওয়াই নয়, পাওয়া যায় পুরোনো বাইবেলের আরো বহু চরিত্র; যেমন, হারুন (অ্যারোন), ইব্রাহিম, (আব্রাহীম) হাবিল (আবেল), কাবিল (কেইন), দাউদ (ডেভিড), ইলিয়াস (এলিয়াস), জিব্রিল (গ্যাব্রিয়েল), ইয়াজুজ (গগ), ইসহাক (আইজ্যাক), ইসমাইল (ইসমায়েল), ইউনুস (জোনাহ), ইউসুফ (জোসেফ), মাজুজ (ম্যাগোগ), নুহ (নোআহ), ফিরাউন (ফারাও); এবং পাওয়া যায় বাইবেলের বহু গল্প : বিশ্বসৃষ্টি, আদমের স্বৰ্গচ্যুতি, কেইন ও আবেল, আব্রাহামের নিজের পুত্রকে উৎসর্গ করার উদ্যোগ, নুহের নৌকো, ইউসুফের মিশরগমন, ইউনুস ও মাছ, ফেরাউন, সলোমনের বিচার, শেবার রানী ও আরো নানা কাহিনী। ইসলামের বিধাতার নামটিও নতুন নয়, নামটি আরবে আগে থেকেই প্রচলিত ছিলো; মুসলমানরা অবশ্যই দাবি করে নামটি সৃষ্টির শুরু থেকেই আছে। এ-দাবির ওপর কোনো কথা নেই। নামটির বহু উদাহরণ পাওয়া যায় ওই সময়ের আরবদের ব্যক্তিনামে; যেমন, আবদুল্লা—আল্লার দাস। ইসলামপূর্ব মক্কায় পূজিত হতো তিনটি দেবী—দেবতা নয়,—আল-লাত, মানত, ও আল-উজ্জা। আল-উজ্জা ছিলো চান্দ্রদেবী, মক্কার মহাদেবী; তার ভক্তদের নাম হতো আবদুল উজ্জা (আবু লাহাবের আসল নাম)—উজ্জার দাস। তার আরেকটি নামও ছিলো। ইসলামপূর্ব আরব ছিলো মাতৃপ্রধান, ইসলামে ঘটে পিতৃতন্ত্রের উত্থান : ধর্মে যেমন ইসলামে হেলাল বা বাকা চাদকে পবিত্র মনে করার বিশেষ কারণ রয়েছে। ইসলাম আগের আরবকে অন্ধকারের কাল ব’লে নিন্দিত করলেও ওই আরব অতোটা অন্ধকারে ছিলো না; চিরকালই বিজয়ীরা পরাজিতদের নামে কুৎসা রটায়। ইসলামপূর্ব আরব থেকে ইসলাম নিয়েছে বহু কিছু : পুরুষের বহুবিবাহ (আরবে নারীদের বহুবিবাহও প্রচলিত ছিলো), দাসপ্রথা, সহজ বিবাহবিচ্ছেদ (আরবে নারীরা সহজে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারতো, ইসলামে বিবাহবিচ্ছেদ সহজ হয়ে ওঠে পুরুষের জন্য), সামাজিক নানা বিধি, খৎনা ইত্যাদি। ইসলাম অপৌত্তলিক; কিন্তু এর তলদেশে আরব পৌত্তলিকতার ফয়ুস্রোত সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায় নি। তীর্থযাত্রা, পশুবলি, উপবাস প্রায় সব ধর্মেই রয়েছে; ইসলামেও আছে। হজ ও কোরবানির মূল ব্যাপার নিয়ে আলোচনা থেকে বিরত থাকছি। আরব কবি আলমারি (৯৭৩-১০৫৭) লিখেছেন, দশ দিক থেকে মানুষ আসে পাথর ছুড়তে আর চুমো খেতে। কী অদ্ভুত কথা তারা বলে! মানুষ কি অন্ধ হয়ে যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছে না সত্য? জালালউদ্দিন রুমি লিখেছেন, ‘আমি পথ খুঁজি, তবে কাবা বা উপাসনালয়ের পথ নয়, প্রথমটিতে আমি দেখি একদল পৌত্তলিককে আর দ্বিতীয়টিতে একদল আত্মপূজারীকে। খলিফা উমর কাবার কালোপাথরকে উদ্দেশ ক'রে বলেছিলেন, যদি না আমি দেখতাম মহানবি তোমাকে চুমো খাচ্ছেন, আমি নিজে তোমাকে চুমো খেতাম না।’
ইসলামে পশু উৎসর্গকে জড়িত করা হয় হিব্রু নবি আব্রাহামের নিজের পুত্র ইসমায়েলকে উৎসর্গ করার উপাখ্যানের সাথে। পশু উৎসর্গ অত্যন্ত পুরোনো পৌত্তলিক যজ্ঞ। মানুষ যাযাবর ছিলো, শিকারই যখন ছিলো জীবিকা, তখন তারা দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য পশু বলি দিতে শুরু করে। বাইবেলের আবেল ও কেইনের উপাখ্যানে এটা দেখতে পাওয়া যায়। আদিপুস্তক-এ আছে: হাওয়ার গর্ভে প্রথম জন্মে কেইন, পরে আবেল। আবেল ছিলো মেষপালক, এবং কেইন চাষী। চাষী কেইন ঈশ্বরের উদ্দেশে উৎসর্গ করে তার জমির শস্য, আবেল উৎসর্গ করে পশু । ঈশ্বর আবেলের উৎসর্গ, পশু, গ্র��ণ করেন; কিন্তু কেইনের উৎসর্গ, শস্য, গ্রহণ করেন না। এর ফলেই ঘটে প্রথম নর ও ভ্রাতৃহত্যা;—কেইন হত্যা করে ভাই আবেলকে। প্যালেস্টাইনের ঈশ্বর চাষী পছন্দ করেন না, তার পছন্দ শিকারী, কেননা তিনি মূলত যাযাবরের বিধাতা। আরবসমাজ ছিলো গোত্রবদ্ধ, প্রত্যেক গোত্রের ছিলো নিজস্ব দেবদেবী; বেদুইনরাও বিশেষ বিশেষ স্থানে দেবদেবীদের পুজো করতো। ওই দেবদেবীদের প্রতীক ছিলো বিভিন্ন পাথর। ওই পাথরগুলো কখনো হতো মূর্তি, কখনো বিশাল পাথরখণ্ড। আস সাফা ও আলমারওয়া পাহাড় দুটির নাম বোঝায় পাথর। আরবরা সৌভাগ্যলাভের জন্যে এ-দুপাহাড়ে ছোটাছুটি করে ছুতো ও চুমো খেতো দুই পাহাড়ে স্থাপিত ইসাফ ও নাইলার দুটি মূর্তি। দ্বিতীয় শতকের শেষ দিকে আলেকজান্দ্রিয়ার ক্লেমেন্ট লিখেছেন, আরবরা পাথর পুজো করে; ওই শতকেই ম্যাক্সিমাস টাইরিউস রূপায়িত করে একটি চতুর্ভুজ পাথররূপে। মুসলমানরা তীর্থে গিয়ে চুমো খায় একটি কালোপাথরকে। এটি এক সময় নির্দেশ করতো উর্বরতা। মুসলমানরা বিশ্বাস করে এটি পড়েছে স্বর্গ থেকে। বিশ্বাসটি একেবারে ভুল নয়; যদিও ব্যাখ্যাটি ভুল; স্বর্গ থেকে না পড়লেও এটি পড়েছে আকাশ থেকেই; এটি একটি উল্কাপিণ্ড। আকাশে কি পাথর আছে? আছে। মঙ্গল ও বৃহস্পতির কক্ষপথের মাঝখানে ঘুরছে কিছু গ্রহাণু; এগুলোকে ভুলবশত অ্যাষ্টিরয়িড বলা হ’লেও এগুলো তারা নয়, এগুলো অতিশয় ছোটো ছোটো গ্রহ। ১৮০১ অব্দের জানুয়ারি মাসের এক তারিখে প্রথম গ্রহাণুটি আবিষ্কার করেন ইতালীয় সন্ন্যাসী পিয়াসৃসি । গ্রহাণুটির নাম সিরিস। তারপর দু-হাজারেরও বেশি গ্রহাণু আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর কক্ষপথ বেশ গোলমেলে, এবং কখনো কখনো কোনোটির সাথে অন্য কোনোটির সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের ফলে যে-টুকরোগুলো পৃথিবীর জলবায়ুতে প্রবেশ করে, সেগুলোকে বলা হয় উল্কা । তবে শুধু উল্কা নয়, পুরো কোনো গ্রাহাণুও এসে আঘাত করতে পারে পৃথিবীকে, এবং সেটা সৃষ্টি করতে পারে একটা বড়ো বিপর্যয়। বিজ্ঞানীরা এখন গ্রহাণুর সম্ভাব্য আঘাত নিয়ে নানা গবেষণা করছেন। ওই কালোপাথরটি একটি উল্কাপিণ্ড; তবে এখন যেটিকে চুমো খাওয়া হয়, সেটি হয়তো আসল পাথরটি নয়। চতুর্থ হিজরি শতকে কারম্যাশিয়ানরা (Qarmatian) আসলটি নিয়ে গিয়েছিলো, ফেরত দিয়েছিলো অনেক বছর পরে। অনেকের ধারণা তারা আসলটি ফেরত দেয় নি।
কালোপাথরটির পাশেই আছে আরেকটি লালবর্ণের পাথর, যার নাম হুবাল। ধর্মগুলো দাবি করে ঈশ্বর নিজে, বা কোনো দেবদূতের মাধ্যমে প্রেরিতপুরুষের কাছে পৌছে দিয়েছেন তার বাণী বা প্রত্যাদেশ। এটা বিশ্বাস করা ধর্মগুলোর অনুসারীদের জন্যে বাধ্যতামূলক। টমাস পেইন এইজ অফ রিজন বা যুক্তির ব্লগ গ্রন্থে বলেছেন: প্রত্যেক জাতীয় গির্জা বা ধর্ম এটার ভান করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে সেটি পেয়েছে ঈশ্বরের বিশেষ বাণী, যা জ্ঞাপন করা হয়েছে বিশেষ ব্যক্তির কাছে। ইহুদির আছে মোজেস; খ্রিষ্টানদের আছে জেসাস ক্রাইস্ট, তার শিষ্য ও সন্তরা, এবং তুর্কিদের আছে তাদের মাহোমেট, যেনো ঈশ্বরের পথ সব মানুষের জন্যে সমভাবে খোলা নয়। প্রত্যেকটি গির্জা দেখিয়ে থাকে বিশেষ বিশেষ গ্রন্থ, যেগুলোকে তারা বলে প্রত্যাদেশ, বা ঈশ্বরের বাণী। ইহুদিরা বলে ঈশ্বর মুসার কাছে, মুখোমুখি দাড়িয়ে, দিয়েছেন তাদের ঈশ্বরের বাণী; খ্রিষ্টানরা বলে তাদের ঈশ্বরের বাণী এসেছে ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণার মধ্য দিয়ে; এবং তুর্কিরা বলে তাদের ঈশ্বরের বাণী স্বর্গ থেকে নিয়ে এসেছে একজন দেবদূত। ওই গির্জাগুলো একটি অন্যটিকে অবিশ্বাসী ব’লে অভিযুক্ত করে; এবং আমি নিজে এগুলোর প্রত্যেকটিকে অবিশ্বাস করি।
প্রত্যাদেশ অসম্ভব ও কল্পিত ব্যাপার। কিন্তু যদি ধ’রেও নেই যে প্রত্যাদেশ সত্যি ঘটনা, বিধাতা সত্যিই দেখা দিয়েছেন কারো কাছে (অবশ্যই প্রাচীন কালে, আজ যদি কেউ দাবি করে সে প্রত্যাদেশ পেয়েছে, তাকে মানসিক রোগী মনে করা হবে, বা ধার্মিকরা তাকে খুন করবে), বা দেবদূতরা বিধাতার বাণী পৌছে দিয়েছে কারো কাছে, তাহলে ওই প্রত্যাদেশ শুধু তারই জন্যে প্রত্যাদেশ, অন্যদের জন্যে নয়। সে যখন তা অন্য কাউকে বলে, অন্যজন যখন তা বলে আরেকজনকে, এবং সে যখন তা বলে আরেকজনকে, তখন তা তাদের জন্যে প্রত্যাদেশ থাকে না, তা হয় শোনাকথা। প্রত্যাদেশগুলোতে আন্তর কোনো প্রমাণ থাকে না, যা পড়েই বোঝা যায় এগুলো বিধাতার বাণী। এগুলোতে থাকে বহু ভুল ও স্ববিরোধিতা; এগুলোতে থাকে কিছু সরল নীতিকথা, আর নির্দেশ, যার জন্যে বিধাতার দরকার পড়ে না। সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষেরা অনেক উৎকৃষ্ট নীতিকথা আর বিধান সৃষ্টি করেছে। বিধাতার আচরণ অদ্ভুত, তিনি একজনের কাছেই দেখা দেন, বাণী পাঠান; আর সমগ্র মানবজাতি তার কাছে থেকে বিধাতার সত্য শেখে, এবং শিখতে গিয়ে তারা একজন মানুষের অনুগত হ’তে বাধ্য হয়। এক সময় তার স্থান দখল করে নানা প্রতিষ্ঠান; অর্থাৎ বিধাতা থেকে যান বিশেষ একদল মানুষের নিয়ন্ত্রণে ।
বহু ধর্মে রয়েছে শেষবিচার নামে এক ভয়ঙ্কর ব্যবস্থা, যার ভয়ে অনুসারীরা থাকে দুঃস্বপ্নে। নরক বিধাতার বন্দীশিবির। বলা হয় ওই দিন শিঙ্গা বেজে উঠবে, টুকরো টুকরো হয়ে যাবে স্বর্গমর্ত্য, পাহাড়পর্বত ধুলোতে পরিণত হবে, আকাশ জন্যে বেরিয়ে আসবে সমস্ত মানুষ। দাড়িপাল্লা দিয়ে মাপা হবে তাদের পাপপুণ্য, এবং বিচার করবেন বিধাতা। কারো জন্যে নির্ধারিত হবে চিরস্বর্গ, কারো জন্যে তাদের পার্থিব শরীর। প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে পুনরুজ্জীবিত হবে মৃতরা? যারা পচে গেছে, বিনষ্ট হয়ে গেছে যাদের অস্থিমাংস আর অন্ত্রতন্ত্র, যারা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তারা কীভাবে ফিরে পাবে শরীর? যারা হারিয়ে গেছে সমুদ্রে, যারা গেছে বাঘভাল্লুকের পেটে, কীভাবে পাওয়া যাবে তাদের? বলা হয় শেষবিচারের দিনে সবাইকে জাগানো হবে পার্থিব শরীরে। বলা হয় কিছুই অসম্ভব নয় বিধাতার পক্ষে, তিনি সব পারেন। তিনি সব পারেন, কিন্তু একটি ছোট সমস্যা রয়েছে; কেউ ম’রে যাওয়ার, মাটিতে মিশে যাওয়ার কোটি কোটি বছর পর, মনে করা যাক, অবিকল তাকে সৃষ্টি করা হলো; কিন্তু তখন তো সে আগের মানুষটি নয়, সে অন্য এক মানুষ, বা আগের মানুষটির অবিকল নকল। একজনের পাপপুণ্যের জন্যে তার অবিকল নকলকে স্বর্গে বা নরকে পাঠানো হচ্ছে অবিকল যমজ ভাইদের একজনের পাপপুণ্যের জন্যে আরেকজনকে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়ার মতো অন্যায়। আজকাল একজনের প্রত্যঙ্গ আরেকজনের শরীরে সংযোজন করা হয়। মনে মরা যাক এক পাপী এক পুণ্যবানের হৃৎপিণ্ড ধারণ ক'রে বেঁচে রইলো, এবং মারা গেলো পুণ্যবানের হৃৎপিণ্ড নিয়েই। শেষ বিচারের দিনে এক পাপীর পাপের জন্যে কি শাস্তি পাবে পুণ্যবানের হৎপিণ্ড? তাকে পুনরুজ্জীবিত করার সময় সম্পন্ন করা হবে আরেকটি শল্য চিকিৎসা, পাপীর আগের হৎপিণ্ড এনে লাগানো হবে? কী হবে পুণ্যবান ব্যক্তিটির, যাকে কবর দেয়া হয়েছে হৎপিণ্ড ছাড়াই? পরলোক হাস্যকর কল্পনা। মানুষ মরতে ভয় পায় বলে উদ্ভাবন করেছে পরলোকস্বৰ্গনরক। পরলোক হচ্ছে জীবনের বিরুদ্ধে এক অশ্লীল কুৎসা; পরলোকের কথা বলা হচ্ছে জীবনকে অপমান করা। পরলোকে বিশ্বাস জীবনকে ক’রে তোলে নিরর্থক ।
ধর্মের ভিত্তি, শুনতে সুখকর না লাগলেও, লালসা ও ভীতি। রাসেল বলেছেন :
ধর্ম, আমার মনে হয়, প্রথমত ও প্রধানত দাড়িয়ে আছে ভয়ের ওপর ভিত্তি করে। এর অংশবিশেষ হচ্ছে এমন বোধ যে আমার রয়েছে এক জ্যেষ্ঠভ্রাতা, যে বিপদাপদে আমার পাশে এসে দাড়াবে। সম্পূর্ণ ব্যাপারটির ভিত্তি হচ্ছে ভয়—অলৌকিকের ভয়, পরাজয়ের ভয়, মৃত্যুর ভয়। ভয় নিষ্ঠুরতার জনক, এবং এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে নিষ্ঠুরতা ও ধর্ম এগিয়েছে হাতে-হাত ধ’রে।
সব ধর্মের নৈতিকতার ভিত্তি ভয় । বহু ধর্মে বিধাতা চরম ক্রুদ্ধ ও হিংস্র; ক্রুদ্ধ ও হিংস্র হয়ে থাকা ছাড়া তার আর কোনো কা��� নেই; অবিশ্বাসীকে শাস্তি দেয়ার জন্যে তিনি ব্যগ্র, এবং বিশ্বাসীকেও সব সময় রাখেন ভীতির মধ্যে। বিশ্বাসী কোনো উন্নত নৈতিকতাবোধ দিয়ে চালিত হয় না; সে ভয়েই করে পুণ্যকাজ, এবং থাকে সম্পূর্ণ অনুগত। ভয় আর লালসা দূষিত করে সব ধরনের নৈতিকতাকে। ধর্মীয় নৈতিকতা থেকে মানবিক নৈতিকতা অনেক উন্নত। অনেকে বলে ধর্ম আছে ব’লেই সমাজ চলছে; এটা বাজে কথা; ধর্ম না থাকলে সমাজ আরো ভালোভাবে চলতো। অনেকে বলে ধর্ম মিথ্যা হতে পারে, কিন্তু এর উপকারিতা আছে; কেননা ধর্ম ভালোমন্দ শেখায়, মানুষকে সৎপথে চালায়। এ-যুক্তি খুবই আপত্তিকর, কেননা এটা মানুষকে যুক্তিহীন করে, আর উৎসাহিত কবে ভণ্ডামোকে; বর্জন করে সত্যকে । ধর্ম যে মানুষকে ভালোমন্দ শেখায় না, সৎপথে চালায় না; তার প্রমাণ চিরকালই দেখা গেছে, এবং আজকাল খুবই বেদনাদায়কভাবে দেখা যাচ্ছে। ধর্মের নৈতিকতার সাথে মানবিক নৈতিকতার তুলনা করলে ধরা পড়ে যে ধর্মীয় নৈতিকতার ভিত্তি হচ্ছে কল্যাণ। মুসলমানদের শুয়োর খাওয়া আর হিন্দুর গরু খাওয়া পাপ; এর মূলে কোনো নীতিবোধ নেই, এটা স্বেচ্ছাচারী নির্দেশ। ইসলামে কবি ও চিত্রকর নিষিদ্ধ; তাই আধুনিক বিশ্বের প্রায় সব কিছুই নিষিদ্ধ ইসলামে; এ-নিষিদ্ধকরণের পেছনে কোনো নীতিবোধ কাজ করে নি, কাজ করেছে কবিতা ও চিত্র সম্পর্কে ভুল ধারণা। চুরির অপরাধে হাত কেটে ফেলা বা অবিবাহিত সঙ্গমের জন্যে পাথর ছুড়ে হত্যা নীতির দিক থেকে অত্যন্ত শোচনীয়, কিন্তু ধর্মে একেই মনে করা হয় নৈতিকতা। ধর্ম গভীর মানবিক নৈতিকতা বোঝে না, বোঝে কতকগুলো মোটা দাগের আদেশ পালনের নৈতিকতা । দস্তয়ভস্কির এক নায়ক বলেছে তাকে যদি বলা হয় একটি শিশুকে হত্যা করা হলে দেশের সবাই চিরসুখে থাকবে, তাহলেও সে ওই শিশুকে হত্যা করবে না, কেননা তা তার কাছে অনৈতিক কাজ। ধর্ম এ-ধরনের নৈতিকতা বোঝে না; মনে করে যে কুলুপ লাগায় সে নৈতিক, যে লাগায় না সে অনৈতিক। ধর্মীয় নৈতিকতা কখনো কখনো খুবই হাস্যকর। ইসলামে পবিত্র পরিচ্ছন্ন থাকাকে নৈতিক কাজ ব’লে মনে করা হয় (কিন্তু প্রকাশ্যে কুলুপ ধ’রে হাটাহাটি ক’রে পা ঝাকানো পেরিয়ে যায় শ্লীলতার সীমা), আর খ্রিষ্টধর্মে নোংরা থাকাই নৈতিকতা। খ্রিষ্টীয় গির্জা স্নানের ব্যাপারটিকে আক্রমণ করেছে এজন্যে যে যা-কিছু দেহকে আকর্ষণীয় করে, তাই মানুষকে ঠেলে দেয় পাপের পথে। সৌন্দর্য, সন্তদের বিশ্বাস, পাপের উৎস; সৌন্দর্য থেকেই জন্মে কাম, কাম থেকে জন্মে মানুষের আদি ও অন্তিম পাপ । খ্রিষ্টীয় চার্চ প্রশংসা করে অপরিচ্ছন্নতার, কেননা নোংরা মানুষ কাম জাগায় না, কাউকে পাপিষ্ঠ করে না। সন্ত পলা বলেছেন, "দেহ ও বস্ত্রের পবিত্রতা বোঝায় আত্মার অপবিত্রতা। সন্তরা উকুনকে বলতো বিধাতার মুক্তো; উকুনখচিত থাকা ছিলো সন্ততার শংসাপত্র। কোনো কোনো ধর্মে উপাসনার আগে বিশেষ পদ্ধতিতে দেহ পরিচ্ছন্ন করার রীতি রয়েছে; তবে ওটা দেহকে পরিচ্ছন্ন করার জন্য নয়, শয়তান তাড়ানোর জন্যে, যে-শয়তান কোথাও নেই।
ধর্মের ইতিহাস পাচ হাজার বছরের, এর মধ্যে অজস্র ধর্ম প্রচারিত হয়েছে ও বাতিল হয়ে গেছে; কিন্তু মানুষ আছে কোটি বছর আগে থেকে, টিকে থাকবে বহু কোটি বছর। পৃথিবী ধ্বংসের আগে মানুষ হয়তো অন্য কোথাও পাড়ি জমাবে; —মানুষের সম্ভাবনা অনন্ত, দেবতাদের থেকে মানুষ অনেক বেশি প্রতিভাবান। পাচ হাজার বছর, তিন হাজার, দেড় হাজার বছরকে চিরকাল মনে করার কারণ নেই। মানুষ দেবতার পর দেবতা তৈরি করেছে, এবং ছেড়েছে; তাতে দেবতাদের কিছু যায় আসে নি, তারা জানেই না তারা উৎপন্ন হয়েছে, কিন্তু অনেক এসে গেছে মানুষের। ভবিষ্যৎমুখী মানুষকে বিপুল লড়াই করতে হয়েছে ধর্মের সাথে; ধর্ম না থাকলে মানুষ আরো অনেক এগোতো। দেবতারা কখনো দেখা দেয় নি, কখনো পীড়ন করে নি মানুষকে; কিন্তু ধর্মকে চিরকালই একগোত্র মানুষ ব্যবহার করেছে অস্ত্ররূপে। ধর্মের পক্ষে যারা, তারা বিশেষ স্বার্থেই ধর্মের পক্ষে; যারা বিপক্ষে, তাদের কোনো স্বার্থ নেই; তাদের স্বার্থ মানুষের বিকাশ। আগামী দু-এক শতকের মধ্যেই মানুষ মুক্ত হবে ধর্মের কবল থেকে। কোনো ধর্মই মানুষের শুরু থেকে ছিলো না ও শেষ পর্যন্ত থাকবে না। ধর্মের প্রধান ক্ষতিকর দিক হচ্ছে ধর্ম বিভেদ সৃষ্টি করে; মানুষকে বিভিন্ন গোত্রে ভাগ করে দেয়, সৃষ্টি করে পারস্পরিক ঘৃণা, বিদ্বেষ, শক্রতা। কোনো সুষম ধর্মও নেই, প্রতিটি ধর্ম বিভক্ত নানা শাখা ও উপশাখায়; ওই শাখা-উপশাখাগুলো ঘৃণা করে পরস্পরকে। মানুষ ধর্ম দ্বারা আক্রান্ত; এবং বিশেষ ধর্মের মানুষ আক্রান্ত ওই ধর্মের মানুষদের দ্বারা; মুসলমান আক্রান্ত মুসলমান দ্বারা, হিন্দু হিন্দু দ্বারা; তাই মুসলমানের হাত থেকে মুসলমানকে, হিন্দুর হাত থেকে হিন্দুকে বাচানো দরকার। ধর্মের অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে মানুষকে হয়ে উঠতে হবে মানুষ ।
2 notes · View notes
aminastik · 9 years
Text
ক'জন হিন্দু নারী রাম-এর মত স্বামী চান ?
জন্মসূত্রে আপনি হয়তো এক হিন্দু নারী, ছোটবেলা থেকে রামায়ণ মহাভারতের গল্প শুনে এসেছেন। রাম-লক্ষ্মণ সীতা থেকে যুধিষ্ঠির-দুযোধন দুঃশলাদের কথা জানেন। আপনি হয়তো এক গরীব পরিবারের মেয়ে, স্কুলে এইট-নাইন অব্দি পড়ার পর আর পড়া হয়নি , তারপর কোনরকমে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। কিংবা মোটামুটি স্বচ্ছল এক পরিবারে আপনার জন্ম গ্রাজুয়েট হয়েছেন ; একটি ছোট স্কুলে চাকরিও করছিলেন, এমন সময় বিয়ের সম্বন্ধ আসায় বা নিজে দেখেশুনেই, একজনকে বিয়ে করলেন - চাকরিটা হয়তো ছাড়তে হ’ল – বা কোনরকমে চাকরিটা করেও গেলেন। অথবা আপনি একজন উচ্চশিক্ষিতা - হয়তো বা ডাক্তার, কিংবা ইঞ্জিনিয়ার, কিংবা অধ্যাপিকা ; নিজে ভালবেসে বা বাড়ীর যোগাযোগে একজনকে বিয়ে করেছেন। কিংবা হয়তো অন্যধরনের কিছু, কিন্তু সদ্য বিবাহিতা ।
বিয়ের কিছুদিন পরে দূরে কোথাও বেড়াতে গেছেন - হয়তো বা শৈলশহর, কিংবা সমুদ্রতট অথবা জঙ্গলে ঘেরা মনোরম জায়গা। দু’জন মিলে বেড়াচ্ছেন - এমন সময় কেউ একজন আপনার স্বামীকে বোকা বানিয়ে বা কপোকাৎ করে, আপনাকে ধরে নিয়ে পালিয়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আপনার স্বামী জানতে পারলেন, কোন এক অভিজাত ব্যক্তিই আপনাকে অপহরণ করেছেন। এবং সমানে আপনাকে বিয়ে করার চাপ দিয়ে যাচ্ছে। আর তার পরিচিত মেয়েদের বসিয়েছে আপনার পাহারায় যাতে আপনি পালাতে না পারেন।
কিন্ত�� একদিন পুলিশ আর বন্ধুবান্ধদের সাহায্য নিয়ে অনেক পরিশ্রম করে আপনার স্বামী আপনাকে ঐ বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করলেন। দীর্ঘদিন পরেস্বামীর সঙ্গে সাক্ষাতের পুলকে আপনি তখন তীব্র আনন্দ আর বেদনায় ভাসছেন। কিন্তু ঐ সময় ঐখানেই আপনার ঐ প্রিয়তম স্বামী আপনাকে বলেন ঐ বন্দিদশায় আপনি যে সতী ছিলেন অর্থাৎ যৌনমিলন করেন নি, তার প্রমাণ দিতে হবে, ডাক্তারি পরীক্ষা দিতে হবে - তাঁরা আপনার যোনি পরীক্ষা করবেন, প্রয়োজনে প্রস্রাব পরীক্ষা করে গর্ভবতী কিনা জানবেন ইত্যাদি। তখন আপনার কেমন লাগবে?
আপনি নিশ্চিত যে বন্দিদশায় আপনার সঙ্গে কারোর যৌনমিলন হয় নি। তবু আপনি রাজি হলেন এবং ডাক্তারেরা রায় দিলেন - না, আপনি ধর্ষিতা নন। একমাত্র তখনই আপনার স্বামী আপনাকে গ্রহণ করলেন।
এরপর সবাই মিলে বারি এলেন। বেশ সুখে ঘরসংসার করছেন। এর পর আপনার গর্ভে এলো আপনাদের সন্তান। কিন্তু ঐ সময় একদিন আপনার স্বামীর কানে এল - পাড়ার লোকেরা, আত্মীয়স্বজন আপনাকে সন্দেহ করছে। দীর্ঘদিন বন্দি অবস্থায় আপনার যৌনজীবন সম্পর্কে তারা সন্দিহান। কারন আগের ডাক্তারি পরীক্ষার কথা তারা জানেন না, বা জানলেও তাদের সামনে করা হয়নি বলে তারা সন্দিহান। মনে করা যাক আপনার স্বামী একজন জনপ্রতিনিধি, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন জনসমক্ষে তার ইমেজ ঠিক রাখতে হবে। কিংবা একজন সাধারন মানুষ তাই চাই চারপাশের মানুষদের সন্তুষ্ট রাখতে চান। আপনার দেবরকে ডেকে বল্লেন, “যাও, বৌদিকে এ ঘর থেকে দূর করে অন্য কোথাও রেখে এস।” কিংবা বাপের বাড়ীতেই পাঠিয়ে দিতে বল্লেন। আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে দুঃখ পেলেন, তা-ও আপনি জানেন। তবু এভাবে বিতাড়িত হবার পর আপনার কেমন লাগবে ? তা সত্ত্বেও, স্বামীর সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে আপনি দিন কাটাতে থাকলেন। সন্তান হল। ঘটনাচক্রে একদিন শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ হল । ছেলের খবর শুনে স্বামী আর থাকতে পারলেন না। সসম্মানে, ভালবাসায় আপনাদের ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু এতদিন তো আপনি ঘরছাড়া। তাই আপনার স্বামী (এবং হয়তো বা পাড়ার লোকজন বা বন্ধুবান্ধবদের চাপে) আবার চাইলেন আপনার চরিত্রের শুদ্ধতা যাচাই তথা ডাক্তারি পরীক্ষা ইত্যাদি। না, আপনার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আপনি ক্ষোভে দুঃখে আত্মহত্যা করলেন।
আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো এমন স্বামী কি আপনি চান ? দরিদ্র, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত যে পরিবার থেকেই আপনি আসুন না কেন – ঠিক এমন, যেমন ব্যবহার তখনকার দিনে শ্রীরামচন্দ্র নিজের স্ত্রী সীতা-র প্রতি করেছিলেন, তেমন ব্যবহার কি আপনার কাম্য ? আপনি রামায়ণ পড়েছেন। তাই রামের এমন ব্যবহার আপনার জানা, আপনি যদি জানেন যে আপনার ভাবী স্বামী ঐ রামেরই মত ব্যবহার আপনার সঙ্গে করবেন, তবে কি আপনি ঐ ব্যক্তিকে বিয়ে করবেন ? সত্যি কথা বলুন।
লেখাটি ভবানী প্রসাদ সাহু’র রচনাবলী থেকে সংগ্রহিত সংক্ষিপ্ত রূপ।
0 notes
aminastik · 9 years
Text
শয়তানের জবানবন্দি - আরজ আলী মাতুব্বর
বোশেখ মাস, আকাশ পরিষ্কার, বায়ু স্তর। রাতটি ছিল অতি গরমের। বৈঠকঘরের বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি ; ঘুম আসে না গরমে। মনে হয় যেনো জাহাজে বয়লারের কাছে শুয়েছি অন্যত্র জায়গা না পেয়ে। মনটা ছোটাছুটি করছে তাপের লেজ ধরে কল্পনাজগতের নানা পথে। ভাবছি তাপ দুপ্রকার – কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক। কৃত্রিম তাপ কমানো যায়, বাড়ানো যায়, নতুবা তাপের উৎস থেকে দূরে সরে যাওয়া যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক তাপের বেলায় সবসময় তা পারা যায় না। আজকের এ তাপের উৎস হচ্ছে সূর্য। যার স্থানীয় তাপমাত্র ৬০০০ হাজার ডিগ্রী (সে) এবং দূরত্ব ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল। শোনা যায় যে, দোজখের আগুনের তাপ নাকি সে আগুনের চেয়ে ৭০ গুণ বেশী। অর্থাৎ ৪,২০,০০০ ডিগ্রী (সে) এবং তা হবে মানুষের কাছে দূরত্বহীন। কেননা সে আগুনের ভিতরেই নাকি থাকতে হবে তাবৎ বিধমী বা অধাৰ্মিক মানুষকে। তা-ও আবার দশ-বিশ বছর নয়, অনন্তকাল। মানুষের এহেন কষ্টভোগের কারণ নাকি একমাত্র শয়তান। তাই বিশ্বাসী মানুষ মাত্রেই শয়তানের উপর অত্যন্ত ক্ষ্যাপা।
শয়তান নাকি পূর্বে ছিলো ‘মকরম’ নামে একজন প্রথম শ্রেণীর ফেরেস্তা এবং অত্যন্ত মুছল্লি। সে নাকি এতই খোদাভক্ত ছিলো যে, জগতে এতটুকু স্থান বাকি নেই, যেখানে তার সেজদা পড়েনি। কিন্তু আল্লাহতালার হুকুম মোতাবেক নাকি বাবা আদমকে সেজদা না করায় তার ফেরেস্তার পদ ও মর্যাদা নষ্ট হয়। তাই সে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে বাবা আদম ও তার বংশাবলীকে দাগা অর্থাৎ অসৎকাজে প্ররোচনা দিয়ে নাকি দোজখী বানাচ্ছে। সামান্য পদমর্যাদা হানির বিনিময়ে গোটা আদম জাতির অগণিত মানুষের দোজখবাসের কারণ হয়ে থাকলে শয়তান তো মানুষের সাধারণ শক্র নয় – মহাশক্র, পরমশক্র, মহাপরমশক্রই বটে। শয়তানের স্বভাব-চরিত্র, কার্যকলাপ ও বাসস্থান সম্বন্ধে ভাবতে ভাবতে শেষরাত্রে গরমটা কিছু কমে যাওয়ায় আরাম বোধ করতে লাগলাম এবং মনের ভাবনাগুলোও স্তিমিত হলো। এ সময় শুনতে পেলাম, কে যেন কোমল কণ্ঠে মৃদুস্বরে আমাকে দরজা থেকে ডাকছে।
আমি দূর থেকে দেখতে পেলাম আগন্তুক আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সে এক সৌম্য মূর্তি। পরনে সাদা পাজামা, গায়ে সাদা জুব্বা, মাথায় (লেজওয়ালা) সাদা পাগড়ী এবং বুক ভরা সাদা দাড়ি, সুঠাম সুডৌল তেজোদীপ্ত চেহারা। তাঁর চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছে আনন্দ ও বুদ্ধির জ্যোতি। জীবনে এমন মানুষ কখনো দেখিনি, কোনরূপ আবেগ উৎকণ্ঠ নেই, নতুন স্থান বলে নেই কোন কিছু নিরীক্ষণের প্রয়াস। এখানের পথঘাট, গাছপালা ও ঘরবাড়ি যেনো তার সবই চেনা। ভাবলাম, লোকটা আলেম তো হবেনই, মুছল্লিও বটেন। কিছু দূরে থাকতে তিনি আমাকে শ্রদ্ধাভরে সালাম জানালেন, কাছে গেলে করমর্দন করলেন। আমি আমার বৈঠকঘরে প্রবেশ করে একখানা চেয়ার দেখিয়ে সসম্প্রমে তাঁকে বললাম – বসুন জনাব।
আগন্তুকটির পরিচয় জানার আগ্রহ নিয়ে আমি তার দিকে দৃষ্টিপাত করতে তিনি তা যেনো বুঝে ফেললেন এবং আমাকে বললেন, “আমার পরিচয় জানতে চান? আমার পরিচয় আপনি ভালো করেই জানেন। আর আপনি একাই নন, আমার পরিচয় সকল মানুষই জানে এবং ভালোভাবেই জানে। কিন্তু কেউ আজ পর্যন্ত আমাকে দেখেনি, দেখেননি আপনিও। পৃথিবীর জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সবখানে আমার অবাধ গতি। আমি সকল মানুষের সাথেই মেলামেশা করতে চাই, চাই ভালোবাসা করতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার সাথে কেউ মেলামেশা করতে চায় না। আমার মাতাপিতা নেই ; ছিলোও না কোনোদিন। আমি আল্লাহতালার নূরে তৈরী, কুদরতে সৃষ্টি, জন্মসূত্রে আমার নাম ‘মকরম ফেরেস্তা, পরে ইবলিশ এবং হাল নাম শয়তান।"
আগন্তুকের নামটি শুনে আমি ভড়কে গেলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম যে, তার সাথে আমি কি কথা বলবো এবং কিভাবে বলবো। কোনো বিষয় কিছু ভাবতে সাহস হচ্ছে না। কেননা তিনি যেনো আমার মনের ভাবনাগুলোও দেখতে পাচ্ছেন। স্থির করলাম – কিছু ভাববো না, বলবো না কিছু নীরব-নিশ্চিন্তে শুনে যাব শুধু, যা বলবার তিনিই বলুন। এখন সমস্যা হলো যে আগন্তুককে সম্মান প্রদর্শন করবো কি করবো না। তবে বেশ-ভূষায় তো সম্মানের পাত্রই বটেন।
আমার মৌনভাব দেখে আগন্তুক যেনো আমার মনের কথা সমস্তই বুঝতে পারলেন এবং অনর্গল বলে যেতে লাগলেন, “যে কোন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে মুরব্বি বলা হয় এবং সভাসভ্য তাবৎ মানুষ জাতির মধ্যেই মুরব্বি ব্যক্তি সম্মানের পাত্র। মানুষের মধ্যে কারো কোনো মুরব্বি ব্যক্তির বয়সের জ্যেষ্ঠতা সচরাচর দশ-বিশ কিংবা পঞ্চাশ-ষাট বছর, কদাচিৎ একশ'। কিন্তু আপনাদের আদি পিতা আদম যখন সৃষ্ট হন, আমি তখন বেশ সেয়ানা এবং আজো বেঁচে আছি। সুতরাং বয়সের হিসাবে শুধু আপনারই নয়, আমি সমস্ত মানুষ জাতির মুরবিব।
"আল্লাহ সর্বাগ্রে ফেরেস্তা বানিয়েছেন, পরে জীন বানিয়েছেন এবং সর্বশেষে বানিয়েছেন আদমকে। ইসায়ীরা সৃষ্টিকর্তাকে ‘পিতা বলেই সম্বোধন করে থাকে। কাজেই একই ঈশ্বরের সৃষ্টি বলে আদমকে আমার ভাইও বলতে পারি, তবে বয়সে কনিষ্ঠ। আপনাদের সমাজে বা মানব সমাজে কারো কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে প্রণাম (সেজদা) করবার রীতি আছে কি? হয়তো নেই। তা হলে আদমকে সেজদা না করে আমি নীতিবহির্ভূত কাজ করিনি, করেছি আল্লাহতালার আদেশ লঙ্ঘন। কিন্তু আদেশ যিনি করেছেন, তা লঙ্ঘন করার শক্তিও তিনিই দান করেছেন। জগতে কারো এমন কোনো শক্তি নেই, যার সে শক্তি দ্বারা আল্লাহর ইচ্ছাশক্তিকে পরাস্ত করে নিজের ইচ্ছাশক্তিকে কার্যকরী করতে পারে। আল্লাহ জানতেন যে, আমি তাঁর হুকুমে আদমকে সেজদা করবো না, আদম তাঁর নিষেধ মেনে গন্ধম খাওয়া ত্যাগ করবে না এবং আদমের আওলাদরা তাঁর আদেশ-নিষেধ কেউ মানবে, কেউ মানবে না। তা না জানলে তিনি আদমকে সৃষ্টি করার পূর্বে, বিশেষত আমাকে শয়তান বানাবার পূর্বে বেহেস্ত-দোজখ নির্মাণ করলেন কি করে, কি জন্য ?
“আমি লাখো লাখো বছর আল্লাহকে সেজদা করে এসেছি, এখনো করি। আমি বেঁচে থাকতে আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা করবো না, এ কথা তিনি জানেন এবং তিনি নিজেও বলেছেন, "আমাকে ভিন্ন অন্য কাউকে সেজদা করো না। আল্লাহর আসনে অন্য কাউকে বসালে তাতে তার গৌরব বাড়ে কি-না, তা তিনিই বোঝেন। তথাপি তিনি আদমকে সেজদা করার জন্য ফেরেস্তাদের হুকুম করার কারণ — এটা তার লীলা অর্থাৎ অন্তরের বাণী নয়।
“আল্লাহ সাতটি দোজখ বানিয়েছেন, সবগুলোতে মানুষ থাকার জন্য। তিনি কি চান যে, আমি আমার দাগাকাজ বন্ধ করি, আর তার দোজখগুলো খালি থাক? তা তিনি চান না, চাইতে পারেন না। চাইলে তাঁর দোজখ বানাবার সার্থকতা ক্ষুন্ন হয়। আল্লাহর ইচ্ছা যে, কিছুসংখ্যক মানুষ দোজখবাসী হোক। আর আমাকে বলেছেন তার সেই ইচ্ছা পূরণে সহায়তা করতে। এ কাজ আমার পক্ষে করা ফরজ, না করা হারাম।
“আমি আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারি না, কেউই পারে না। বহু চেষ্টা করেও কোনো নবী-আম্বিয়া, দরবেশকে আমি দোজখবাসী করতে পারিনি। কেননা তাঁরা দোজখবাসী হোন, তা আল্লাহর ইচ্ছা নয়। পক্ষান্তরে হজরত ইব্রাহিম নমরুদকে, হযরত মুসা ফেরাউনকে এবং শেষ নবী (দ:) আবু জেহেলকে হেদায়েত করে বেহেস্তের তালিকায় নাম লেখাতে পারেননি আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও। কেননা তা আল্লাহর ইচ্ছা নয়।
“আপনারা মনে করেন যে, আল্লাহর যতো সব রহমত মানুষের উপরই বর্ষিত হয়। বস্তুত তা নয়। আল্লাহর রহমত আমার উপর অনেক বেশী মানুষের তুলনায়। আদমকে সৃষ্টি করার কতো লাখ বছর পূর্বে আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তা তিনিই জানেন। অথচ আল্লাহর রহমতে আমি আজও বেঁচে আছি। কিন্তু মানুষ বেঁচে থাকে মাত্র ৬০, ৭০ কিংবা ১০০ বছর। তদুপরি শিশুমৃত্যু-অপমৃত্যু যথেষ্ট। আমার সুদীর্ঘ জীবনে আজ পর্যন্ত আমি কোনোরূপ রোগ, শোক বা অভাব ভোগ করিনি, আল্লাহর রহমতে। কিন্তু মানুষ অসংখ্য রোগ, শোক ও অভাবে জর্জরিত। ফেরেস্তারা আমাকে লক্ষ্য করে তীর ছেড়েন আবহমান কাল থেকে। অথচ আল্লাহর রহমতে আমি নিরাপদেই থাকি। কিন্তু তাতে (বজ্রপাতে) ধ্বংস হয় সবকিছু মরে মানুষ। পবিত্র মক্কায় গিয়ে হাজী সাহেবরা আবহমানকাল আমায় লক্ষ্য করে পাথর ছোড়েন। কিন্তু আল্লাহর রহমতে তা আজ পর্যন্ত আমার গায়ে পড়েনি একটিও। অথচ সমুদ্রে জাহাজ ডুবে অসংখ্য হজযাত্রী মারা যান, আল্লাহর রহমতে।
"আল্লাহর রহমতে আমি নিমেষে বিশ্বভ্রমণ করতে পারি, অদৃশ্যকে দেখতে, শ্ৰবণাতীতকে শুনতে, নিজে অদৃশ্য থেকে অন্যের মনের খবর জানতে। দুদিন অনিদ্রা-অনাহারে থাকলে মানুষ ঝিমিয়ে-নেতিয়ে পড়ে। আর আমি লাখ লাখ বছর ধরে অনিদ্রা-অনাহারেও সুস্থসবল আছি, সে তো আল্লাহর রহমতেই। বলা যাবে যে, মানুষ তো ওর অনেক কিছুই আয়ত্ত করে ফেলেছে। অণুবীক্ষণ, দূরবীক্ষণ, রেডিও, টেলিভিশন, রকেট ইত্যাদি যন্ত্র দিয়ে মানুষ এখন অদৃশ্যকে দেখছে, শ্রবণাতীতকে শুনছে, আকাশে-পাতালে ভ্রমণ করছে, অনাহারে বেঁচে থাকার গবেষণা চালানো হচ্ছে এবং কেউ তো অন্যের মনের ভাবও জেনে নিচ্ছে টেলিপ্যাথির সাহায্যে। এসব মানুষ আয়ত্ত করছে সত্য, হয়তো আরো অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করবে। কিন্তু সে সমস্ত যারা করেছেন ও করবেন, তাঁরা তো আমারই শিষ্য।"
“কোনো মানুষের অকল্যাণ আমার কাম্য নয় এবং তা করিও না। পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোতে এমন কতোগুলো বিধি-নিষেধ রয়েছে, যা মানুষের অকল্যাণই করে এসেছে আবহমান কাল থেকে। তাই মানুষের কল্যাণ কামনায় সে সব বিধি-নিষেধ অমান্য করার জন্য আমি মানুষকে প্রেরণা ছি। কেননা সেসব বিধি-নিষেধ লঙ্ঘন করার জন্য মানুষকে প্রেরণা দেওয়াই আমার কাজ। আর তারই ফল আধুনিক জগতে মানব জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার ক্রমোন্নতি। তথাকথিত ধর্মগ্রন্থগুলোতে আকাশতত্ত্ব, রসায়নতত্ত্ব, ভূ-তত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, প্রাণতত্ত্ব ইত্যাদি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য যাবতীয় তত্ত্বালোচনাই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, ঘোষিত হয়েছে স্বর্গ ও নরক-তত্ত্ব, বিশেষভাবে।
“মানুষ আজ সমুদ্রতলে বিচরণ করে, আকাশে পাড়ি জমায়, পরমাণুগর্ভে প্রবেশ করে এবং কতো অসাধ্য সাধন করে, কিন্তু এর কোনোটাই ধর্ম বা ধমীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে শিক্ষা দেয়নি, বরং নিষেধ করেছে বারে বারে। আমার কর্তব্য বিধায় ওসব আমিই শিক্ষার প্রেরণা দিয়েছি ও দিচ্ছি মানুষকে, আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু তাতে শুধু অধাৰ্মিকরাই লাভবান হয়নি, ধার্ষিকরাও ভোগ করছেন তার সুযোগ-সুবিধাগুলো পুণ্যার্জনের জন্য। জল, স্থল ও হাওয়াই যানের সাহায্য ছাড়া শুধু পদব্রজে পবিত্র হজ্জব্রত পালনে হাজীদের সংখ্যা কতোজন হত��, তা হিসেব করে দেখেছেন কি? বর্তমানে ওয়াজে, আজানে, পবিত্র কোরান তেলাওয়াতে, জানাজার নামাজেও মাইক, রেডিও, টেলিভিশন ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে পুণ্যের মাত্রা নিশ্চয়ই বাড়ছে। সুতরাং শুধু পাপকর্মের দ্বারা দোজখে যাবার জন্যই নয়, পুণ্যকর্মের দ্বারা বেহেস্তে যাবার জন্যও আমি মানুষকে সহায়তা করছি না কি? এছাড়া আমি হামেশা আল্লাহকে স্মরণ করি, তার হুকুম পালন করি, তাঁর এবাদত করি, কিন্তু দোজখ থেকে পরিত্রাণ বা বেহেস্ত লাভের প্রত্যাশায় তা করি না। কেননা দোজখের শাস্তি ও বেহেস্তের সুখ আমার কাছে অকে���ো। যেহেতু নূরের তৈয়ারী দেহ আমার আগুনে জুলবে না এবং আহার-বিহার নিদ্রা ইত্যাদি না থাকায় (বেহেস্তের) সুখাদ্য ফল, সুপেয় পানীয়, স্বর্ণপুরী, সুদরী ললনা (হুর-গেলমান) ইত্যাদি আমার কোনো কাজেই আসবে না। পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি জীবমাত্রেই আল্লাহর এবাদত করে থাকে। কিন্তু তারাও দোজখের ভয়ে বা বেহেস্তের লোভে তা করে না। অথচ মানুষ তা-ই করে থাকে। ধর্মের নিশানধারীদের মধ্যে হাজারে বা লাখে এমন একজন মানুষ মিলবে কি-না সন্দেহ, যিনি নিছক আল্লাহর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই পুণ্যকাজ করেন, যার সাথে বেহেস্তদোজখের সম্পর্ক নেই। যারা দোজখের ভয়ে বা বেহেস্তের লোভে পুণ্যকাজ করে, তারা আমার চেয়ে অধম, পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট।
"এ যুগের মানুষ আপনি, হয়তো কম্পাস দেখেছেন। ওর কাটার একটা প্রান্ত সর্বদা পৃথিবীর উত্তরে সুমেরুর দিকে এবং অপর প্রান্ত দক্ষিণে কুমেরুর দিকে স্থির হয়ে থাকে। কেউ ওর ব্যত্যয় ঘটাতে পারে না। নাড়াচাড়া বা জোরজুলুম করে সাময়িকভাবে ওর কিছু ব্যত্যয় ঘটালেও, ছাড়া পেলে কাঁটা স্থির হয় গিয়ে সাবেক বিন্দুতে। কোনো কম্পাসের কাঁটাদ্ধয়ের কোন প্রান্ত সুমেরু ও কোন প্রান্ত 'কুমেরু মুখী থাকবে, তা নির্ধারিত হয় তার সৃষ্টিকর্তার (নির্মাতার) দ্বারা তখনই যখনই তিনি কাঁটটিকে সৃষ্টি করেন অর্থাৎ যখন কাঁটাটিকে ধন (পজিটিভ) ও ঋণ (নেগেটিভ) ধর্মী দুটি আলাদা জাতের বিদ্যুতের দ্বারা চুম্বকায়িত করেন। কোনো সাধারণ মানুষের সাধ্য নেই কম্পাসের কাঁটার দিকপাতনে ব্যত্যয় ঘটাবার, একমাত্র তার সৃষ্টিকর্তা (নির্মাতা) ছাড়া। অনুরূপভাবেই মানুষের মানসরাজ্যেরও ‘সু’ ও ‘কু দুটি মেরু আছে। তবে তাকে মেরু বলা হয় না, বলা হয় প্রবৃত্তি। অর্থাৎ সুপ্রবৃত্তি এবং কুপ্রবৃত্তি। সুপ্রবৃত্তি থাকে বেহেস্তমুখী এবং কুপ্রবৃত্তি থাকে দোজখমুখী হয়ে। মানবমনের এরূপ বৃত্তিবিভাগ করেছেন আল্লাহতা'লা মানবসৃষ্টির বহু পূর্বে। যে সময়টিতে আল্লাহ এ বিভাগ দুটি নির্ধারণ করেছেন, সে সময়টিকে বলা হয় ‘রোজে আজল বা ‘নিয়তি |
“রোজে আজল-এ নির্ধারিত ফলাফলের বিরুদ্ধে দাগ দিয়ে কোনো মানুষকে আমি দোজখী বানাতে পারি না এবং কোনো ধর্মপ্রচারকও হেদায়েত করে কোনো মানুষকে বেহেস্তবাসী করতে পারেন না। তবে সাময়িক মনের পরিবর্তন ঘটানো যায় মাত্র। কোনো কম্পাসের কাঁটাকে নেড়েচেড়ে বা জোর করে মেরুভ্রষ্ট করা হলে, ছুট পেলে পুনঃ যেমন সাবেক মেরুতে চলে যায়, মানুষের মানসকাঁটাও তদুপই সুমেরুমুখী কোনো মানুষকে দাগ দিয়ে তার দ্বারা আমি অসৎকাজ করাতে পারি, এমন কি তাকে ‘কাফের নামে আখ্যায়িত করাতেও পারি। কিন্তু পারি না তার জীবনসন্ধ্যায় তওবা পড়ে মোমেন হয়ে বেহেস্তে যাওয়া রোধ করতে। অনুরূপভাবেই কুমেরুমুখী কোনো মানুষকে হেদায়েত-নছিহত করে তার দ্বারা কোনো ধর্মপ্রচারক সৎকাজ করাতে পারেন এবং তাকে আখ্যায়িত করতে পারে মোমেন নামে। কিন্তু তিনি পারেন না তার অন্তিম মুহুর্তে ‘বেঈমান হয়ে দোজখে যাওয়া রোধ করতে। এভাবে অনেক সমাজী কাফের বেহেস্তে যাবে। যাবে ‘সমাজী মোমেন দোজখে।
“আল্লাহ র্যাকে দোজখবাসী করতে চান না, আমি শত চেষ্টা করেও তাঁকে দোজখী বানাতে পারি না। লক্ষাধিক নবী-আম্বিয়াদের প্রত্যেককেই আমি দাগ দিতে চেষ্টা করেছি এবং কিছু কিছু সফলও হয়েছি। কিন্তু আমি কাউকে দোজখী বানাতে পরিনি।
“আমার দাগায় পড়ে তারা সামান্য গুনাহ যা করেছেন, আল্লাহ তার শাস্তি প্রদান করেছেন এ দুনিয়াতেই, পরকালে তাঁরা সবাই থেকেছেন নিষ্পাপ। যেমন – হযরত আদমের বেহেস্ত থেকে দুনিয়ায় নির্বাসন, হযরত ইউনুসের মৎস্যগর্ভে বাস, হযরত আইউবের বিমার, শেষ নবী (দ) এর খাদান শহিদ ইত্যাদি উক্তরূপ পাপেরই শাস্তি।
“আজ পর্যন্ত আমি আল্লাহতালার মাত্র একটি হুকুমই অমান্য করেছি। তাঁর হুকুমে আদমকে সেজদা না করে। আর অন্য কজনও তো তাঁর হুকুম অমান্য করেছে প্রায় একই সময়, একই জায়গায় থেকে। কিন্তু সেজন্য তিনি রাগ করেননি বা কাউকে কোনোরূপ শাস্তি দেননি। জেবরাইল, মেকাইল ও এস্রাফিল ফেরেস্তাত্রয়কে আল্লাহ হুকুম করেছিলেন পৃথিবী থেকে মাটি নেবার জন্য, আদমকে বানাবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু একে একে তিন ফেরেস্তাই আল্লাহর হুকুম খেলাপ করে ফিরে গেলেন তাঁর কাছে খালি হাতে, মাটির অসম্মতির জন্য। অবশেষে আজরাইল ফেরেস্তা আল্লাহর আদেশ মোতাবেক জোরপূর্বক কিছু মাটি নেওয়ায় তদ্বারা আদমকে বানানো হলো। কিন্তু চারবার আদেশ অমান্য সত্ত্বেও আল্লাহ মাটিকে (দোজখের) আগুনে পোড়ালেন না, বরং পানি দিয়ে কাদা বানিয়ে মহানন্দে আদমের মূর্তি বানালেন ও তাতে প্রাণদান করলেন। আর তিন ফেরেস্তা যে তাঁর হুকুম অমান্য করলেন তুচ্ছ মাটির কথা মেনে, তা যেনো তাঁর খেয়ালই হলো না। পক্ষান্তরে তাঁর হুকুম অমন্যের দায়ে আমাকে নাকি দিলেন অভিশাপ, আমার গলায় দিলেন লানতের তাওক এবং নির্বাসিত করলেন বেহেস্ত থেকে দুনিয়ায় চিরকালের জন্য। এসব কি তাঁর পক্ষপাতিত্ব বা ন্যায়বিরোধী কাজ নয়? না, এতে তিনি এতটুকু পক্ষপাতিত্ব বা অন্যায় করেননি। বরং অন্যায় করেছে মানুষ, তার ইচ্ছে ও উদ্দেশ্যকে উপলব্ধি করতে না পেরে।
“বলা হয় যে, আমি অভিশপ্ত, তিরস্কৃত ও নির্বাসিত হয়েছি। বাস্তবে তার একটিও না। এ বিষয়ে একটু খোলাসা করেই বলি।
“প্রথমত আমি আল্লাহর বিরাগভাজন ও অভিশপ্ত হয়ে থাকলে তিনি আমাকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান করতে পারতেন, পারতেন রোগ, শোক, দুঃখ-কষ্ট ও অভাব ভোগ করাতে, যেমন করেছেন হারুৎ-মারুৎ ফেরেস্তাদ্বয়কে। সর্বোপরি পারতেন মৃত্যু ঘটিয়ে জগত থেকে আমাকে নিশ্চিহ্ন করতে। কিন্তু তিনি তার একটিও করেননি। বরং উল্টোই করেছেন। যদি কেউ কাউকে বলে, ‘তুমি রোগ, শোক, দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত হয়ে দীর্ঘজীবন লাভ করে – তাহলে সেটা কি তার পক্ষে আশীৰ্বাদ না অভিশাপ? আল্লাহ আমাকে কোনো রোগ দেননি, শোক দেননি, অপমৃত্যু দেননি, কোনো অভাব দেননি, বরং দীর্ঘায়ু দান করেছেন। এসবের মধ্যে অভিশাপ কোনটি?
“দ্বিতীয়ত বলা হয়ে থাকে যে, আমি তিরস্কৃত হয়েছি। অর্থাৎ আল্লাহ আমার কণ্ঠে লানতের তাওক দান করেছেন। এ কথাটিও পুরো ঠিক নয়। আমি "তাওক একটি পেয়েছি ঠিকই। তবে সেটা কাঠের না লোহার না স্বর্ণের তৈরী, কেউ তা দেখেননি বা শোনেননি কারো কাছে আজ পর্যন্ত। ওটা কারাবাসীর কণ্ঠে যেমন তিরস্কার (তাওক), তেমন বিজয়ীর কণ্ঠে পুরস্কার (মেডেল) সূচিত করে। তারতম্য শুধু গঠন ও উপকরণে। এ বিষয় পরে বলবো।
“তৃতীয়ত বলা হয় যে, আমি বেহেস্ত থেকে বিতাড়িত হয়েছি, নির্বাসিত হয়েছি পৃথিবীতে। আল্লাহর আদেশে পৃথিবীতে আসা-যাওয়া অথবা স্থায়ীভাবে বসবাস করে তাঁর নির্দেশিত কর্তব্য তো অন্যান্য ফেরেস্তাগণও পালন করে থাকে। তারাও কি নির্বাসিত ? জেবরাইল ফেরেস্তা সংবাদ বহন ও আজরাইল ফেরেস্তা মানুষের জান কবজ করার উদ্দেশ্যে না হয় পৃথিবীতে আসে ও চলে যায়। কিন্তু মিকাইল ফেরেস্তা পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারে না আবহাওয়া বিভাগের কাজ বন্ধ করে। কেরামান ও কাতেবীন ফেরেস্তাদ্বয় রোজনামচা (ডাইরী) লেখা ছেড়ে দিয়ে মানুষের কাঁধ থেকে এক পা বাইরেই দিতে পারে না এবং মনকির ও নকিরকে তো জীবন কাটাতে হচ্ছে মানুষের কবরে কবরেই পৃথিবীতে। এরা যদি নির্বাসিত বলে সাব্যস্ত না হন, তবে আমি নির্বাসিত হই কোন বিচারে? আমিও তো আল্লাহর আদেশে আমার কর্তব্য পালন করে যাচ্ছি পৃথিবীতে বসে। বরঞ্চ আমি ওদের প্রত্যেকের চেয়ে মুক্ত ও স্বাধীন।
“জেবরাইল ফেরেস্তা সংবাদবাহক। সে আল্লাহর সকালের আদেশ কারো কাছে বিকেলে পৌছাতে পারে না। মেকাইল ফেরেস্তা আবহাওয়া পরিচালক ও খাদ্য পরিবেশক। সে আল্লাহর সকালের আদেশের বৃষ্টি বিকেলে এবং বাংলাদেশের বৃষ্টি আরবদেশে বর্ষাতে পারে না, পারে না ধনীর খাদ্য গরীবকে দান করতে। এভাবে প্রত্যেক ফেরেস্তাই আছে তাদের নিজ নিজ কর্তব্যের নিয়মশৃঙ্খলে আবদ্ধ। কিন্তু আমার কর্তব্য (পরীক্ষা) কাজ সম্পাদনে আল্লাহ আমাকে এরূপ কোনো নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেননি। আমার পরীক্ষাকাজের সকাল-বিকাল নেই বা শীত-বসন্ত নেই, এশিয়া-ইউরোপ নেই ; নেই যুব-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব পার্থক্যের নির্দেশ। বস্তুত আমি বিতাড়িত বা নির্বাসিত নই, অন্যান্য ফেরেস্তাদের মতোই আমি কর্তব্যের খাতিরে প্রেরিত হয়েছি পৃথিবীতে। আমি আল্লাহর মনোনীত ফেরেস্তা — বিশ্ববাসীর বিশ্বাসের পরীক্ষক (একজামিনার) ।
“বলা হয় যে, আদমকে সেজদা না করায় আমি ঘৃণিত ও অধঃপতিত হয়েছি এবং আদমকে গন্ধম ভোজন করিয়ে মানুষের শক্র হয়েছি। বাস্তবে তা নয়। বরং পুরস্কৃত হয়েছি ও পদোন্নতি লাভ করেছি এবং মানবকুলের বন্ধুর কাজই করেছি। আমার কথা শুনে আপনি একটু তাজ্জব হলেন বুঝি। এ বিষয়ে একটু বুঝিয়ে বলি।
“ফেরেস্তারা নূরের তৈরী। তাই পাক-সাফ বটে, তবে ওদের বুদ্ধি নেহাত কম। নিজেরা কোনো কাজই করতে পারে না আল্লাহর হুকুম তামিল করা ছাড়া। হা হুজুর’ ছাড়া না হুজুর বলার ওদের অভ্যাস নেই। তবে একদিন না হুজুর’ বলেছিলো, কিন্তু তা খাটনি। আল্লাহ পৃথিবীতে মানবজাতি সৃষ্টির পরিকল্পনা ঠিক করে আদমকে বানাবার পূর্বে ফেরেস্তাগণের আক্কেল পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। তাতে তারা আল্লাহকে বলেছিলেন, "আদমীরা আপনার হুকুম-আহকাম মানবে না বা এবাদত করবে না। সুতরাং আদম সৃষ্টি না করাই উত্তম। মানবজাতির পরম সৌভাগ্য যে, আল্লাহ ফেরেস্তাদের সে উপদেশ অগ্রাহ্য করে আদমকে বানালেন। কিন্তু আল্লাহ যদি ফেরেস্তাদের প্রস্তাব মেনে আদমকে না বানাতেন, তাহলে মানবজাতির এ দুনিয়াস্ত্রীতির কি দশা হতো?
“আদমকে বানিয়ে আল্লাহ ফেরেস্তাদের ডেকে বললেন – তোমরা আদমকে সেজদা করো। আল্লাহর হুকুম পেয়ে সব ফেরেস্তা একযোগে অর্থাৎ জামাতের সহিত এক রাকাত নামাজ আদায় করলেন আদমকে কেবলা করে। কিন্তু আমি সে নামাজ পড়লাম না। আল্লাহর আসনে আদমকে বসিয়ে তাকে সেজদা করতে আমার বিবেক বাধা দিলো। আমার বিবেক বললো যে, আল্লাহ পরিস্কার ভাষায় বলেছেন, “আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা কোরো না। তবে আজ কেন আদমকে সেজদা করতে বললেন? হয়তো এর কারণ ফেরেস্তাদের আক্কেল পরীক্ষা করা। আল্লাহ দেখতে চান যে, ওদের তুচ্ছ করা আদমকে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ফেরেস্তারা সেজদা করতে আপত্তি করে কি-না।
“মনে করুন – কোনো এক ব্যক্তি তার পাচটি ছেলেকে ডেকে জনৈক পথিককে দেখিয়ে বললো, “তোমরা সবাই ওকে বাবা বলে ডাকো। পিতার আদেশ পালন করা কর্তব্য, এ নীতিবাক্যটি পালন করে চারটি ছেলেই সেই পথিককে ‘বাবা বলে ডাকলো। কিন্তু একটি ছেলে ডাকলো না। সে ভাবলো, ‘পিতা কখনো দুজন হতে পারে না। পথিককে বাবা বললে তা হবে মিথ্যে কথা বলা। আর পিতা তো আগেই বলেছেন, কখনো মিথ্যে কথা বলবে না। আমার মুখে পথিককে বাবা ডাকার মধুর শব্দটি শুনে পিতা খুশী হবার জন্য নিশ্চয়ই এ কথাটি বলেননি, বলেছেন আমাদের আকেল পরীক্ষার জন্য। সুতরাং পিতার এ আদেশটি না মানাই শ্রেয়। এ ভেবে সে ছেলেটি তার জীবনের মহাকর্তব্য (সত্যকথন) পালন করলো, কপট পিতাকে মিথ্যা ‘বাবা ডাকলো না। ছেলেদের পিতা তার চার ছেলের অজ্ঞতা দেখে মনোক্ষ্ম হলেন এবং এক ছেলেকে বিজ্ঞতার পুরস্কার বাবদ তার গলায় দিলেন মেডেল।
"আল্লাহ হলেন অন্তর্যামী। মানুষ বা ফেরেস্তা কারো বাহ্যিক আচার-আচরণ দেখে তিনি তুষ্ট হন না, বিচার করেন মনের। আদমকে সেজদা করার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ ফেরেস্তাগণের আক্কেলের পরীক্ষা নিয়েছিলেন। আমি তাতে উত্তীর্ণ হওয়ায় তিনি আমাকে দান করেছেন বিজয়ের একটি নিশানা। কেউ কেউ তাকে বলে আমার পরাজয়ের নিশানা বা লানতের তাওক । বস্তুত আল্লাহ আমাকে দান করেছেন বিজয়ের নিদর্শনস্বরূপ ‘মেডেল ।
“বলা হয় যে, আমি আদমের শক্র, আদম জাতির শক্র ; কেন না গন্ধম ভক্ষণ করিয়ে আমি আদমকে বেহেস্তছাড়া করেছি। আসলে তা নয়। যৌনক্রিয়ায় নাকি মানুষ নাপাক হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে বেহেস্ত হলো চিরপবিত্র স্থান। সেখানে ওসব নাপাকীর কোনো স্থান নেই। কাজেই আদম-হাওয়া বেহেস্তে থাকলে তাদের যৌনক্রিয়া আজীবন বন্ধ রাখতে হতো। ফলে আদম থাকতেন নিঃসন্তান ও নির্বংশ। আদমের প্রেমাসক্তি সম্পূরণ ও বংশবৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ আদম-হাওয়াকে স্থান দিয়েছেন পৃথিবীতে তাদের বংশবৃদ্ধির গরজে।
“বেহেস্তের মধ্যে তখন তিন জাতীয় ফলের গাছ ছিলো। প্রথমত সুখাদ্যদায়ক বৃক্ষ, এর ফলগুলো ছিলো সাধারণ খাদ্য। অর্থাৎ জীবনধারণের উপযোগী খাদ্য। দ্বিতীয়ত জীবন বৃক্ষ। এর ফলগুলো ছিলো অমরত্বের প্রতীক। অর্থাৎ পরমায়ুবর্ধক। তৃতীয়ত জ্ঞানদায়ক বৃক্ষ। অর্থাৎ জ্ঞানবৃদ্ধির সহায়ক। এই জ্ঞানদায়ক ফলটিরই নামান্তর গন্ধম।
“আদমকে যখন বানানো হলো, তখন তিনি ছিলেন নিজীব মাটির পুতুল এবং আল্লাহ যখন প্রাণদান করলেন, তখন হলেন তিনি সজীব পুতুল। কিন্তু তখনও জ্ঞান বস্তুটি তার মধ্যে ছিলো না মোটেই। এমন কি লজ্জা-জ্ঞানও না। আদম-হাওয়া ছিলেন উলঙ্গ। ইতর প্রাণী ও মানুষের প্রধান পার্থক্য হলো লজ্জাজ্ঞান | আদম-হাওয়ার সেই লজ্জাজ্ঞান জন্মালো গন্ধম ভক্ষণের পর। ক্রমে জন্মালো ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বিবিধ জ্ঞান গন্ধম ভক্ষণের ফলে। পক্ষান্তরে বিবি হাওয়া হলেন রজস্বলা গন্ধম ছেড়ার ফলে। কাজেই গন্ধম না খেলে হযরত আদম থাকতেন জ্ঞানশূন্য আর বিবি হাওয়া থাকতেন বন্ধ্যা। আদমের জ্ঞান ও বিবি হাওয়ার সন্তানোৎপাদিক শক্তি জমালো গন্ধম খাওয়ার ফলে। সুতরাং গন্ধম খাইয়ে আমি শুধু আদম-হাওয়ারই নয়, তাবৎ মানবজাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বংশবিস্তারের সহায়তাই করেছি, যা অন্য কোনো ফেরেস্তা করেননি। কার্যত আমি মানুষের পিতার চেয়ে ভক্তির পাত্র এবং গুরুর চেয়ে মান্যবর। দুঃখের বিষয় এই যে, কতক মানুষ তা বাহ্যত মানতে চান না, তবে কার্যত মেনে চলেন। আর তাতেই আমি সন্তুষ্ট কেননা একজন বিশ্বাসী মানুষ দিনেরাতে নানা কারণে যতবার আমার নামটি মুখে উচ্চারণ করেন, মনে হয় যে, ততোবার তার বাবার নামও উচ্চারণ করেন না। বিশেষত আমার নামটি তাদের প্রাতঃস্মরণীয় ও অগ্রপাঠ্য।
"আপনি ভাবছেন, এ বিরাট পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে দাগ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় কিরূপে। আপনার এ ভাবনাটা অমূলক নয়। আসলে ও কাজটা ততো কঠিন নয় আমার পক্ষে। কেননা আমি দুনিয়ার সকল অঞ্চলের সকল মানুষকে দাগ দেই না, দাগ দেই ঈমানদাদিগকে। অর্থাৎ যারা আমাকে বিশ্বাস করে তাদেরকে। আমার উপর যাদের ঈমান নেই, অর্থাৎ আমি আছি বা আমার অস্তিত্বকে যারা অস্বীকার করেন, তারা তো কাফের। কেননা পবিত্র কোরানে আল্লাহ বলেছেন, "শয়তান আছে এবং পবিত্র হাদিছে নবী বলেছেন, "শয়তান আছে। এতদসত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি যদি বলে, "শয়তান নেই, তবে পবিত্র কোরান-হাদিছের বাণী অমান্যকারী সে ব্যক্তি কি কাফের নয়?
“আবার যে ব্যক্তি কাফেরের ঔরসে জন্মলাভ করে, সে তো জন্মসূত্রেই কাফের এবং সে নানাবিধ বেসরা কাজ (মূর্তিপূজা) ইত্যাদি করে থাকে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে আমার দাগ দেওয়া ছাড়াই। তাকে তার কৃতকর্মে বাধা দানের অর্থ হয় অসৎকাজে অর্থাৎ পাপকাজে বাধাদান করা। আল্লাহ তো কারো অসৎকাজে আমাকে বাধা দিতে বলেন নি। তাই আল্লাহর আদেশ মেনেই আমি কোনো বিধমীকে দাগা দেই না। অর্থাৎ আমার অস্তিত্বের উপর যাদের ঈমান নেই, তাদের আমি দাগ দেই না, এমনকি তাদের কোনো সৎকাজেও না। তাইতো বর্তমান দুনিয়ায় ঈমানদারদের চেয়ে বেঈমানদারগণই সৎকাজ করেন বেশী।
“আমা���ে যেমন সকল মানুষকে দাগ দিতে হয় না, তেমন সকল জায়গায় আমি সমভাবে অবস্থানও করি না। বিশ্বাসীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উপাসনা মন্দির ও ধর্মধামেই আমাকে সময় কাটাতে হয় বেশী। কেননা ওগুলোই হচ্ছে আমার প্রধান কর্মকেন্দ্র। তবে মফস্বলেও কিছু কিছু কাজ না করলে চলে না |
“আপনার জানতে ইচ্ছা হচ্ছে যে, অহরহ মানুষের সহবাসে থাকা সত্ত্বেও তারা আমাকে দেখতে বা আমার অস্তিত্বই অনুভব করতে পারে না, এর কারণ কি এবং কোথায় বসে আমি মানুষকে দাগ দিয়ে থাকি? তা বলি শুনুন। "আল্লাহ আমাকে ক্ষমতা দান করেছেন মানুষের দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করতে এবং শিরায় । শিরায় চলতে। যখন আমি কোনো ব্যক্তিকে দাগ দিতে চাই, তখন তাকে বাইরে থেকে ডেকে বলি না যে, তুমি এ কাজটি করো না এবং ও কাজটি করো। আমি তখন প্রবেশ করি তার দেহের কেন্দ্রস্থল মস্তিকে এবং মস্তিষ্কের কেন্দ্রবিন্দু ত্রিতলা মনের একেবারে নীচের তলায়, যে জায়গাটির নাম অচেতন মন বা 'নিজ্ঞান মন। সেখানে বসে আমি তার অচেতন মনকে প্রলুব্ধ করি কোনো কাজ করতে বা না করতে। আমার কর্মকেন্দ্র মানুষের মস্তিকের অভ্যন্তরে অবস্থিত। তাই দুষ্ট লোকেরা বলে টুপির নীচে শয়তান থাকে। তাদের সে কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। কেননা আমার অধিষ্ঠানটি টুপির নীচেই উপরে নয়।
"আমি পূর্বেই বলেছি যে, আমি আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারি না, কেউ পারে না। আমি যা কিছু করি তদ্বারা আল্লাহর ইচ্ছাকেই পূরণ করি এবং অন্যেরাও তা-ই করে থাকে। দুঃখের বিষয় এই যে, বিশ্বাসীরা তা পুরাপুরি মানেন না। তাঁরা আল্লাহকে বলেন সর্বশক্তিমান, আবার কোনো কাজে আমার উপর দোষ চাপান। শুধু তাই নয়, তাঁরা আরও বলেন, ‘শুভ কাজের কর্তা আল্লাহতা'লা এবং অশুভ কাজের কর্তা শয়তান।’ যদি তা-ই হয়, তবে "আল্লাহ অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও সর্বশক্তিমান -- এ কথাটির সার্থকতা কি? এতে কি আমাকে ‘আল্লাহর প্রতিদ্বন্দ্বী ও দ্বিতীয় শক্তিধর বলে প্রমাণিত হয় না? বস্তুত তা নয়। আমার সমস্ত কাজেই আছে আল্লাহতালার সমর্থন। এখন তাই একটু বলছি।
“বলা হয়, আল্লাহ দুনিয়ার সব কাজ করবার ক্ষমতাই মানুষকে দান করেছেন। কিন্তু হায়াত,মউত, রেজেক ও দৌলত, এ চারটি কাজ রেখেছেন নিজের হাতে। আবার এ কথাও বলা হয় যে, খুন-খারাবী, চুরি-ডাকাতি ও ব্যভিচারের উদ্যোক্ত শয়তান। তাই যদি হয় অর্থাৎ আমার দাগায় পড়েই যদি কোনো এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে হত্যা করে, তাহলে আহত ব্যক্তির জান কবজ করতে আজরাইল ফেরেস্তা সেখানে আসেন কার হুকুমে? সেই দিনটি মৃতব্যক্তির হায়াতের শেষ দিন নয় কি? কলেরা-বসন্তাদি রোগে অসংখ্য মানুষ মরে জীবাণুদের আক্রমনে। সেই জীবাণুদের দাগ দেয় কে?
“সমস্ত জীবের রেজেক (খাদ্য) দান করেন স্বয়ং আল্লাহতালা। চোর-ডাকাতের রেজেক দান করেন কে? মানুষ জানে না যে, আল্লাহ কার রেজেক কার ভাণ্ডারে রেখেছেন। আল্লাহ যার রেজেক ও দৌলত যেখানে রেখেছেন, যে কোনও উপায়েই হোক সেখান থেকে এনে সে তা ভোগ করবেই। চোর চুরি করে বটে, কিন্তু আসলে সে তার আল্লাহর বরাদ্দকৃত খাদ্যই খায়। আমি যদি দাগ দিয়ে চুরি-ডাকাতির মাধ্যমে একের রেজেক অন্যকে খাওয়াতে পারি, তাতে আল্লাহর গৌরব বাড়ে কি? অন্যান্য জীবের রেজেকও আল্লাহতালাই জোগান। গেরস্ত বাড়ির হাঁস-মোরগ ও খাদ্যাদি চুরি করে শেয়াল-কুকুরে খায়। তাদের দাগ দেয় কে?
“বলা হয় যে, শয়তানের খপ্পরে পড়ে মানুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তাতে আল্লাহর কোনো সমর্থন নেই। যদি তাই হয়, তবে জারজ সন্তানের প্রাণদান করে কে ? মানব সৃষ্টোত্তর কালে আল্লাহ যখন মানুষের প্রাণ সৃষ্টি করেছেন, তখন থেকেই তিনি জানেন যে, কোন প্রাণ কখন কোথায় জমাবে, কে কি কাজ করবে এবং অস্তিমে কে কোথায় যাবে, অর্থাৎ বেহেস্ত না দোজখে। তিনি এ-ও জানতেন যে, কে কার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হবে। তিনি ইচ্ছা করলে ব্যভিচারীদ্বয়কে দাম্পত্যবন্ধন দান করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে জারজ সন্তানদের জন্য প্রাণ সৃষ্টি করে রেখেছেন। জারজ সন্তানদের প্রাণদান করেন আল্লাহ ইচ্ছা করেই। ব্যভিচার ঘটিয়ে আমি আল্লাহর সেই ইচ্ছাকেই পূরণ করি মাত্র।
“বিশ্বাসীরা মনে করেন যে, শয়তান না থাকলে মানবজাতির মঙ্গল হতো। তাঁরা ভেবে দেখেননি যে, আমার নির্দেশিত পথে চলেই বর্তমান জগতের মানুষের যতো সব আয়-উন্নতি এবং তারই সাহায্যে চলছে ভালো ধর্মের বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য। আজ যদি আমি দুনিয়া ছেড়ে চলে যাই বা আমার দাগাকাজ বন্ধ করি, তাহলে মানবসমাজে যে বিপর্যয় দেখা দেবে তা থেকে রক্ষা পাবে না বিশ্বাসীরাও।
“প্রথমত কতিপয় রাষ্ট্ৰীয় দপ্তর থাকবে না। ফলে মন্ত্রিত্ব হারাবে অনেকে এবং রাজ্যশাসনে বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ হবে কর্মহীন। সুরশিল্পী, চিত্রশিল্পী থাকবে না, থাকবে না মাদকদ্রব্যের ব্যবসা। এছাড়া থাকবে না সুদ, ঘুষ, কালোবাজারী ইত্যাদির পেশা। আর এতে মানবসমাজে যে ভয়াবহ বেকারত্ব ও আর্থিক সংকট দেখা দেবে, তার প্রতিক্রিয়া হবে ধর্মরাজ্যেও। কেননা ঐসব অসৎবৃত্তির আয় দ্বারাই তো হচ্ছে যতো মসজিদ-মাদ্রাসার ছড়াছড়ি ও হজ্জ্বযাত্রীদের সংখ্যাবৃদ্ধি।
“কোনো কিছুর অভাব আমার নেই বা অন্য কোনো দুঃখ আমার নেই। একটিমাত্র দুঃখ এই যে, মানুষ আল্লাহকে না জানার ফলে এবং তাঁর কুদরৎ অনুধাবন করতে না পেরে অযথা আমার উপর দোষারোপ করে। আল্লাহ ইচ্ছাময় ও সুমহান। "এখন আর বেশী কথা বলার সময় নেই। নামাজের সময় হচ্ছে, মসজিদে যাই। আসসালামু আলাইকুম।"
আগন্তুক চলে গেলেন মসজিদের দিকে। কিন্তু নামাজ পড়তে না দাগ দিতে তা বুঝা গেলো না। মাইকের আজানে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো, চেয়ে দেখি পূর্ব আকাশ পরিষ্কার।
বিস্ময়বিষ্ট হয়ে আমি ভাবতে লাগলাম – এতদিন আমার মনে হচ্ছিলো যে, হিন্দু পুরাণশাস্ত্রে লিখিত 'নারদ মুনি' পরবর্তিকালে শয়তান রূপ লাভ করেছেন। উভয়ের পরিচয়পত্র মিলালে তা বেশ বুঝা যায়। হিন্দুশাস্ত্ৰমতে – ‘নারদ-এর মাতাপিতা নেই। সে ভগবান ব্রহ্মার মানসসৃষ্টি। তার বাসস্থান ছিলো স্বর্গে এবং সে ছিলো ধাৰ্মিক চূড়ামণি। সে সৃষ্টিকর্তার একটি আদেশ অমান্য করায় অভিশপ্ত হয়ে (মানবরূপে) পতিত হয় মর্ত্যে (পৃথিবীতে)। সে ছিলো সর্ববিদ্যাবিশারদ এবং স্বৰ্গ-মর্ত্য-অন্তরীক্ষে ছিলো তার অবাধ গতি।”
সৃষ্টি, বাসস্থান, স্বৰ্গচ্যুতি ও গুণাবলীর বর্ণনায় নারদ এবং শয়তান দুজনের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। শয়তান যেনো নারদের একটি অভিনব সংস্করণ। তবে দ্বিতীয় বা তৃতীয় নয়, চতুর্থ সংস্করণ। নারদ-নাটকের দ্বিতীয় সংস্করণের নায়ক পার্সি ধর্মের ‘আহরিমান, তৃতীয় সংস্করণে ইহুদী ধর্মের সেদিম বা ‘দেয়াবল এবং চতুর্থ সংস্করণের নায়ক হচ্ছে শেষ জামানার শয়তান।
পূর্বেকার ঐসব অনুমান আমার হঠাৎ যেনো নস্যাৎ হয়ে গেলো। কেননা মূর্তিমান শয়তান যে আজ আমার চোখের সামনেই বসা ছিলো এতক্ষণ।
0 notes
aminastik · 9 years
Quote
ভয়ের সুযোগে আতংক সৃষ্টি করে মানুষকে বিশ্বাসী করে তোলাটাই ধর্মের মূল কাজ। তাই ধর্ম মানেই আতঙ্কবাদ।
1 note · View note
aminastik · 9 years
Link
One of the “most hated” groups in America, atheists face discrimination in everything from employment to child custody. A growing movement is fighting back—in the name of civil rights.
0 notes
aminastik · 9 years
Text
The Age of Disbelief
I found his article fascinating on The National Geographic tittle as "The Age of Disbelief”. Please read it if you are interested to know from the safety of fluoride and vaccines to the reality of climate change, faces organized and often furious opposition. Empowered by their own sources of information and their own interpretations of research, doubters have declared war on the consensus of experts.
Tumblr media
Read it Here http://goo.gl/R5Lxw4
0 notes
aminastik · 9 years
Text
আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র
Tumblr media
আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র ০৩
আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র ০২
আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র ০১
0 notes
aminastik · 9 years
Text
যার যা ধর্ম: বাংলা ভাষায় প্রথম ধর্ম অভিধান - মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
Tumblr media
বিশ্বের অন্যান্য ভাষায় নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক অভিধানের ছড়াছড়ি। সেদিক থেকে বাংলা ভাষা বলতে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। অবশ্য, ক্রমেই তাঁর এসব খামতি পূরণ হওয়ার পথে। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রণীত যার যা ধর্ম: বাংলা ভাষায় প্রথম ধর্ম অভিধান। এই অভিধানের পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণের কাজ যখন শুরু হয়, তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ততার সুযোগ পেয়ে আমাদের যথেষ্ট খুশি হওয়ার কারণ ঘটেছিল। প্রথমত, হাবিবুর রহমানের উদ্যমশীলতা, এই অভিধানে কোনো প্রয়োজনীয় ভুক্তি বাদ পড়ল কি না, সে বিষয়ে তাঁর উৎকণ্ঠা এবং তা নির্ভুলভাবে সংযোজন করার ব্যাপারে তাঁর আন্তরিক প্রয়াস আমাদের মুগ্ধ করেছে প্রতিনিয়ত। 
প্রগাঢ় করেছে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধকে। এ কথা সুবিদিত যে ভাষা-সংক্রান্ত সাধারণ অভিধান যেমন, তেমনি নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক অভিধানও একবারে সম্পূর্ণ হয় না। হওয়াটা অসম্ভব। পাশ্চাত্য থেকে প্রকাশিত ধর্মবিষয়ক একাধিক প্রকাশনীর একাধিক অভিধান দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। সেসব অভিধানের একজন প্রণেতা-প্রধান আছেন এবং তাঁকে সহায়তা করার জন্য একটা সম্পাদকীয় প্যানেল বা বোর্ড আছে। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে যার যা ধর্ম নামের এই অভিধানে প্রায় দুই হাজার ছোট-বড় যেসব ভুক্তি আছে, সেসবের লেখক, অনুবাদক ও সম্পাদক একজনই—মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। কী পাহাড়সমান প্রয়াস তাঁর! বর্ণানুক্রমিকভাবে বিন্যস্ত এই অভিধানের ভুক্তিসূচির দিকে একবার আদ্যোপান্ত চোখ বোলালেই পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে, এই অভিধানের তাৎপর্য কোথায়? বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্ম তো বটেই, অভিধানে গৌণ থেকে গৌণতর ধর্মেরও প্রায় কোনো বিষয়ই বাদ যায়নি। পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রত্যেক নবী ও খলিফাদের পরিচয় যেমন যথাসাধ্য দেওয়া আছে, তেমনি এই ধর্মের ক্রমবিকাশের ইতিহাস, তার গুরুত্ব, ইহ ও পরলোকের বিবরণ, নামাজ, রোজা এবং পালনীয় কৃত্যাদি, দোয়াদরুদ, পবিত্র ধর্মীয় স্থানগুলোর পরিচয়ও পৃথক পৃথক ভুক্তির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ইসলামধর্মের অনুসারী সংস্কারক, সমাজসেবী ও সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচয়ও তুলে ধরা হয়েছে একইভাবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিষ্টান, শিখ ও নানা লোকধর্মের পরিচয়, তাদের বিবর্তনের ইতিহাস, ধর্মীয় লোকাচার, তাদের কৃত্যাদি এবং মূর্তিপূজক ধর্মগুলোর দেবদেবীদের পরিচয়ও তুলে ধরা হয়েছে যথাসম্ভব বিশ্বস্ততার সঙ্গে। আছে গ্রিক ও রোমক পুরাণের দেব-দেবীদের কথা, বিশ্বের নানা ধর্মের স্মরণীয় ঘটনাসম্পৃক্ত দিবসগুলোর বিবরণ। আছে বিশ্বের সব ধর্মের উল্লেখযোগ্য প্রচারক ও সংস্কারকদের জীবনী। বাদ যায়নি বিশ্বের সব ধর্মের তীর্থস্থানগুলোর বিবরণসংবলিত পরিচিতিও। নানা ধর্মে প্রচলিত সংস্কার বা কুসংস্কারের বিবরণও মিলবে এই গ্রন্থের সুবাদে, ভুক্তির পর ভুক্তি থেকে। বস্তুত, বিশ্বের প্রতিটি ধর্ম সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধি যতই বাড়বে, আমরা দেখব, আমাদের মন ও মননের দিগন্ত তত বেশি প্রসারিত হচ্ছে, আলোকিত হচ্ছে। মন থেকে উপড়ে ফেলছি ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা। এবং দেখছি, বিশ্বের সব ধর্মেরই এক সুর—মানবজাতির কল্যাণ, মানবজাতির মঙ্গলসাধন। এই বিচারে, যার যা ধর্ম অভিধানের আদ্যন্তপাঠ খুবই জরুরি এবং এর সংগ্রহ শিথানসঙ্গ করা আরও বেশি আবশ্যকীয়। বইটি পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন। 
0 notes
aminastik · 9 years
Video
youtube
Atheism: A Rough History of Disbelief, with Jonathan Miller
If we go back to the beginning we shall find that ignorance and fear created the gods; that fancy, enthusiasm, or deceit adorned or disfigured them; that weakness worships them; that credulity preserves them; and that custom, respect and tyranny support them in order to make the blindness of men serve its own interests.
Episode 02
Episode 03
0 notes
aminastik · 9 years
Video
youtube
নিচের ভিডিওটি দেখুন। কেন দেখবেন তার জন্য একটি কথাই শুধু বলবো। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পাশা পাশি এই আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও নাস্তিকদের ঘৃণার চোখে দেখা হয়। অনেক ধার্মিক মনে করেন নাস্তিকরা হলো শয়তানের পূজারী। এই প্রথমবারের মতো আমেরিকার জাতীয় গনমাধ্যম CNN এর মতো চ্যানেলে নাস্তিকতার স্বপক্ষে ডকুমেটারি প্রচার করা হলো।
1 note · View note