সামতাবেড়, শরৎকুঠি ও আমরা
29.11.2022
গতকাল দুপুর ১ টায় ট্রেন চেপে দেউলটি গিয়েছিলাম আমরা, কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের সৃজনশীল বাসভিটা পরিদর্শনে। গ্রামটির নাম সামতাবেড়, রূপনারায়ণ নদীর তীরে গড়ে ওঠা গ্রামটি বেশ একটু গাছগাছালিতে ঘেরা আর খোলামেলা প্রকৃতির। আর যেজন্য এই বাক্যবহুল একটা গদ্য লেখা সেটা সংক্ষেপে বলতে গেলে; এখনো একমুহূর্তে মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় বাধ্যতামূলক পড়াশোনার টানাপোড়ন আর বিল্ডিংএর বন্ধুদের সাথে অল্প বিস্তর খেলাধুলোর খুনসুটির পাশাপাশি নিজের খুব পছন্দের প্রিয় ঠাকুরমা ঝুলি, গোপাল ভাঁড়, টুনটুনির গল্প, উপেন্দ্রকশোর সমগ্র, সুকুমার রায়ের মজাদার গল্প ছড়া,আরব্য রজনী, গোয়েন্দা গল্প আর যতরকম ভূতের গল্প হাতের কাছে পাওয়া যায় সেসব পড়তে পড়তে একটু একটু করে বেড়ে উঠতে থাকা আমি অল্প বড় হওয়ার প্রারম্ভেই প্রথম যে মানুষটির সৃষ্টি শুধুমাত্র তাঁর নামের সাথে পরিচিত হওয়ার সুবাদে কিনে ফেলি সেটা ছিলেন ইনি - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তারপর একে একে ওনার প্রায় সবকটি লেখা পড়ে ফেলি আমি। ওনার লেখার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য যা সকলেই স্বীকার করেন তা হলো ওনার নারী চরিত্রের বৈচিত্রময় রূপ ফুটিয়ে তোলার শৈল্পিক দক্ষতা। ওনার লেখা নিয়ে বলতে গেলে শুধু এটুকুই বলার আছে আমার যে খুবঅল্প বয়সে ওনার লেখাগুলি পড়ে আমি বড়দের জীবনযাপন আর তৎসংলগ্ন জটিলতা বোঝার চেষ্টা করতাম, যা আমার কাছে নতুন ছিল, আমি সেই নতুনত্ব ভালোবাসলাম রোজ। আর ওনার সৃষ্টি বহু নারিচরিত্রের মাধুরী, সম্ভ্রম , সহনশীলতা , সাহস, সরলতা, সৃজনশীলতা আমি উপলব্ধি করতাম, সেগুলির সজীবতায় নিজেকে অসংকোচে অনুপ্রাণিত হতে দিতাম। তারপর পাশাপাশি একে একে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঠাকুর, আরো বেশ কিছু পরিচিত লেখকদের লেখা পড়তে থাকলাম, সবাই বেশ নিজস্বতা নিয়ে লেখেন, আমি আপনাদের প্রণাম জানাই। এর পরেপরেই ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে গ্রযুয়েশন করা শুরু, স্বাভাবিকভাবেই বেশ কয়েক জন লেখকদের এবং তাদের সৃষ্টির সাথে পরিচিতি হওয়া গেলো, জানার পরিধি বাড়লো, শেখার পরিধি বাড়লো, নব পরিচিত ইংরেজি লেখকদের লেখা নিজে থেকে পড়তে লাগলাম, ভালোবাসলাম শিখতে এটাও। সেই নতুন নতুন প্রথম প্রথম পড়তে শেখার প্রথম রোমাঞ্চ আজ না থাকেলও , কিছু ক্ষেত্রে কিছু মাত্রায় পছন্দ বদলে গেলেও সেই পছন্দসই বই পড়ার জন্য উৎসাহ আজও অমলিন। না, 'bibliophile' আমি নই, কখনো ছিলাম না, তবে বই পড়তে আমি ভালোবাসি। বাড়ির বাইরে বন্ধুবান্ধব কোনোকালেই ছিসামতাবেড়, শরৎকুঠি ও আমরা তাই বোধকরি বইএর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাকা হয়ে গিয়েছিল। তাই নিজেকে বইপ্রেমী না বলে "বইপরী" বলতে নির্ভেজাল আমোদ বোধ হয়। আর এতসব সৃষ্টিশীল মানুষদের মাঝে এই মানুষটার অবদান বুঝি শুধু এটুকু বললেও সবটা প্রকাশ পায় না যে আপনার সৃষ্টি অনুপ্রেরণা, আপনি দীপ জ্বেলে গেছেন, আপনি আমাদের হৃদয়ে সবসময় বিশেষ প্রনম্য হয়ে রয়েছেন।
এবার আসি আমাদের কথায়, তিনটা নাগাদ আমরা পৌঁছেছিলাম শরৎকুঠিতে। কুঠি খুলতে তখনও আধা ঘণ্টা দেরি, তাই আমরা কাছাকাছি রূপনারায়ণ নদী ঘুরে এলাম। খুব কম পরিদর্শক ছিলেন জায়গাটির আশপাশে, অনেকে ছবি তুলছেন তো আবার কেউ কেউ ঘুরে দেখছেন জায়গাটি। খাবারের দোকান বলতে গেলে শুধু ফুচকা আর আইসক্রিম এর দোকান আর একটি চা, চিপসের দোকান রয়েছে। নদীর তীরে একধারে গাছগুলোয় বেশকিছু ছোট বড় হনুমান দেখতে পেলাম, জিজ্ঞেস করে জানলাম ওরা নিরীহ গোছের, বিরক্ত না করলে ওরা কাউকেই কিছু বলে না। মাঝিদের ছোট ছোট চালা দেখতে পেলাম সার বেঁধে দাড়িয়ে রয়েছে, মাছ ধরার জাল শুকোতে দেওয়া রয়েছে। স্থানীয় ছেলেপুলেদের আনাগোনা, খেলাধুলা, হইচই আর মাঝেমধ্যে নৌকোর চলাচল দেখতে দেখতে আমরা পুনরায় কুঠি যাওয়ার রাস্তা ধরলাম। চলতি পথে রাস্তার পাশে স্থানীয় একজন কাকিমার কাছ থেকে জিনিয়া ফুলের চারা কিনলাম দুজন। যখন কুঠি পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে পৌনে ৪। অতঃপর, দুজনে দেরি না করে উঠে পড়লাম দালানে। উঠোনের মুখে দুজন ভিন্য বয়স্ক গাইড এর সাথে দেখা হলো, যারা খুব সংক্ষেপে এবং খুব দ্রুত কুঠির সব ঘরদোরের বর্ণনা দিচ্ছিলেন আমাদের এবং আমাদের মতই কৌতূহলী নবাগত পরিদর্শকদের, যদিও আমরা সংখ্যায় খুবই অল্প ছিলাম।
লেখকের লেখার ঘর থেকে শুরু করে ওনার বৈঠক যেখানে সাধারণ থেকে শুরু করে মহৎপ্রাণ অনেক ব্যাক্তির আগমন ঘটতো, এবং সেই একই ঘরটিতে উনি বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন মানুষজনের, আলমারি ভর্তি করে সাজিয়ে রাখা ওষুধপত্রের কৌটো এখনও গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে। এরপরের ঘরটিতে খুবই ঘরোয়া ভাবে সাজা নোফুল-চন্দন ঢাকা একটি বেদীর ওপর রাখা আছে রাধা কৃষ্ণের যুগলমূর্তী, আর ঠিক তার ডান পাশেই দেখতে পাওয়া যাবে ওনাদের গৃহলক্ষীর মাটির হাঁড়িটি, যেটি এখনও পুজো পায়। লেখক ময়ূর পুষতেন, আর ওনার সেই সখের সাক্ষীস্বরূপ খাঁচাটি এখনও উঠোনের একধারে অক্ষত আছে। উঠোনের শেষপ্রান্ত ��েঁসে একটি সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলা যাওয়ার। সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়ে আরো দুটো ঘর দেখতে পেলাম, যেগুলো লেখকের শোবার ঘর হিসেবে ব্যাবহার হতো বলে জানিয়েছিলেন গাইড দুজন। ওপর নিচ সব ঘরগুলেতেই সাদা বেডশিট দিয়ে ঢেকে রাখা বালিশ বিছানা সুপরিপাটি করে পাতা রয়ছে। ঘুরতে ঘুরতে লক্ষ্য করলাম ঘরময় রঙিন পাথরে মোজাইক করা মেঝের কয়েকজায়গা জুড়ে এঁকেবেঁকে হালকা চিড় নেমেছে। ঘর দালানের দেওয়াল জুড়ে প্লাস্টিক ফুলেরতোড়া টাঙানো হয়েছে জায়গাটিকে মনোরম করে তোলার দৃষ্টান্তে। দোতলার বারান্দার একপ্রান্তে দেখতেপেলাম একটি পাখির খাঁচা রাখা আছে। খাঁচাটি ডবল লেয়ার, যার ফলে অসুবিধা হয়েছে এটাই যে বাইরে থেকে রঙিন পাখুগুলির অস্তিত্ব বোঝার উপায় নেই, যদি না ওরা কোনরকম সাড়া করে কিংবা খুব কাছ থেকে যদি খাঁচার ভেতর উঁকি দেওয়া হয়। সূর্যের আলো খুব একটা ঢোকে না খাঁচার ভেতর সেটা স্পষ্ট। পাখিদের নিয়ে আলোচনা করতে করতে আমরা দুজন দোতলার চারিদিক ঘুরে দেখতে থাকলাম। বিশাল জমি সমেত সবুজ ঘেরা তৈরি বাস বাড়িটি দোতলা, বাড়ির সামনে একটি সুন্দর বাগান, যেখানে ওনার মূর্তি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, এখন শীতকাল, নতুন চারাগাছ রোপণ করা হয়েছে দেখলাম। কুঠি ঘুরে দেখা আর ছবি তোলা মোটামুটি শেষ করে আমরা দুজন ওই স্বল্প মানুষের ভিড় ছেড়ে দোতলার ঘরগুলোর একটার পেছন দিকের কোন খুঁজে কিঞ্চিৎ একটু নিরালায় বসলাম। এখান ওখান থেকে ভেসে আসা চাপা কোলাহলের মাঝে দুজনে চুপ, শুধু মাঝে মাঝে আমার ভালো বন্ধুটির হাসি মাখা মুখের ক্ষীণ জিজ্ঞাসা ছাড়া, " মনু, কেমন লাগছে?"
কিছু পরেই ওকে বললাম চলো গান করি দুজনে। ও খুব রাজি। দুজনে মিলে গাইতে শুরু করলাম " তোমার হলো শুরু" আর " চোখের আলোয় দেখেছিলেম"…তারপর গান শেষ হতেই বন্ধুটি বলল চলো ওনার লেখা একটা গল্প পড়া যাক, অতঃপর,গুগল করতেই যেটা হাতের সামনে পেলাম সেটা ছিল " লালু", লালুকে তো অনেকেই চিনি আমরা তাই না, আমি পড়তে শুরু করলাম, প্রথম গল্পটি , শেষ করার সুযোগ হলো না তার আগেই দুজন স্টেশনের জন্য রওনা দেওয়ার তাগাদা অনুভব করলাম। কারণ ততক্ষনে কুঠি বন্ধ হওয়ার সময় হতে চলছিল। কিন্তু গল্প পড়তে গিয়ে দুজন খুব মজা পেলাম, বন্ধুটির ভালো লাগলো, ও খুব হেসেছিল গল্প শুনে, ও এই প্রথম লালুকে চিনেছিল, একটা সুন্দর মুহূর্ত সৃষ্টি করে এসেছিলাম শরৎকুঠির শান্তিপুরে।
দোতলা থেকে নিচে নেমে পাখিদের বিষয়টা নিয়ে গাইডদের সাথে কথা বলে পাখিদের জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো বন্দোবস্ত নেওয়া যায় কিনা জানতে চাইলে একজন অল্পবয়স্ক গাইড জানান যে পাখিদের উড়তে দিলে ওরা তো আর ফিরবে না, আর তাছাড়া এখানে কেউ বাস করে না যে ওদের পোষ মনিয়ে ছেড়ে রাখলে ওরা আবার ঘরে ফিরে আসবে, আর ডবল লেয়ার দিতে হয়ছে সাপের মুখ থেকে ওদের বাঁচাতে। আগে বহুবার সাপ উঠে ওদের খেয়ে নিত, এখন সেটা আর হয় না।
পরে স্টেশন হাঁটা পথে বন্ধুটিকে ধন্যবাদ জানালে ও বলেছিল
"ওনার লেখা ওনার বাড়িতে পড়ে আমরা ওনাকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করলাম, আমরা এই মুহূর্ত ওনাকে দিয়ে গেলাম।"
বলাবাহুল্য, জায়গাটির আবিষ্কারের কৃতিত্ব বন্ধুটির, ও আমায় নিয়ে গিয়ে খুশি আর আমি ওর সহৃদতায় গর্বিত আর কৃতজ্ঞ।
লেখাটি পড়ার জন্য
তোমাদের ধন্যবাদ। - মনি 🥰
শরৎকুঠি ও আমরা🎻
শরৎকুঠী যাওয়ার পথে💙
শরৎকুঠীরগেটে🏡
লেখকের লেখার ঘরে। ✍️
লেখকের বৈঠকখানা যেখানে আলাপচারিতার পাশাপাশি উনি বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন।👏🌹
লেখকের বৈঠকখানায় রাখা তৎকালীন চরকা।🕊️
লেখকের ঠাকুরঘর ।💛
দোতলা থেকে লেখকের বাগানের দৃশ্য।💚
লেখকের শোবার ঘর।🛌
এই বাঁশের তৈরি খাঁচাতেই ময়ূর পুষতেন লেখক। 🦚
রূপনারায়ণ নদী যাওয়ার রাস্তায়।💚
রূপনারায়ণ নদী 🌅।
আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাই। আমার প্রথম ব্লগ পোস্টে আপনাদের স্বাগত।উপরোক্ত লেখাটি আর সংলগ্ন ছবিগুলি আপনাদের কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন। 😊🙏
7 notes
·
View notes
Chankharpul Press is a Bangla typeface font inspired by the old Bangla printing press. It's a WIP project by Helikon. Only a very limited number of glyphs are available in this beta version. Bangla quotes ideas - Bangla Typography, Bengali Articles, Chankharpul Press, Bangla aesthetic, calligraphy Bangla, fine art, Bangla design, typography quotes, positive quotes, #gopals_diary #kolkata #quotesaboutlife #quotesaesthetic #astheticbangla #dhaka #kolkatablogger- love quotes Bangla. Sad quotes Bangla, ভালোবাসার স্ট্যাটাস, রোমান্টিক স্ট্যাটাস, কষ্টের স্ট্যাটাস, funny message, best love lyrics, relationship poems, Girl poses, film poster, romantic couple photography, saree style, fashion photography
2 notes
·
View notes
আমরা পিছিয়ে পড়ব জীবনে, হয়তো জীবনের গতি টা স্লো হয়ে যাবে, হয়তো যা চাইবো তা পাওয়া হবে না।আপাত দৃষ্টিতে মবে হবে আমরা হেরে গেছি।কিন্তু তার মানে থেমে থাকা যাবে না।
হয়তো একটু বিরতি নিতে পারি তবে তাও খুব অল্প সময়ের জন্য, একদম বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না।
তারপর আবার সেই লড়াই শুরু করতে হবে। মাঝে মাঝে অন্যকে টোপকে যেতে হবে, রিস্ক নিতে হবে, সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে যেতে হবে। থামা যাবে না। হেঁটে বা দৌড়ে পথটা পারি দিতেই হবে।
জন্ম-মৃত্যুর আবর্তন হবে না, পূনর্জন্ম হবে না। জীবন একটাই, একবারই সুযোগ। যা পাওয়ার নয় তা পাওয়া হবে না, যা পাওয়ার তা কেউ আটকাতে পারবে না।
0 notes
Chankharpul Press is a Bangla typeface font inspired by the old Bangla printing press. It's a WIP project by Helikon. Only a very limited number of glyphs are available in this beta version. Bangla quotes ideas - Bangla Typography, Bengali Articles, Chankharpul Press, Bangla aesthetic, calligraphy Bangla, fine art, Bangla design, typography quotes, positive quotes, #gopals_diary #kolkata #quotesaboutlife #quotesaesthetic #astheticbangla #dhaka #kolkatablogger- love quotes Bangla. Sad quotes Bangla, ভালোবাসার স্ট্যাটাস, রোমান্টিক স্ট্যাটাস, কষ্টের স্ট্যাটাস, funny message, best love lyrics, relationship poems, Girl poses, film poster
1 note
·
View note